মেঘবৃত্ত পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
1103

#মেঘবৃত্ত
#অন্তিম_পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

পথটা বেশ দীর্ঘ ছিলো। কাঁটাময়, বন্ধুর পথটা পাড়ি দেওয়া ততটা সহজ ছিলো না। দিনে দিনে মেঘার শরীরের অবনতি যেনো বৃত্তের চোখে আঙুল উঁচিয়ে বলছে, ‘ তোর মেঘ হারিয়ে যাচ্ছে বৃত্ত। চোখের সামনে তোর সাজানো গোছানো জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তুই কিছুই করতে পারলি না। ছিঃ, ধিক্কার তোকে বৃত্ত! ‘
মেঘার কদিন ধরেই রক্তবমি হচ্ছে, মাথাটাও ফুলে গেছে কালশিটে হয়ে গেছে। মেঘার ঘন চুল পড়ে একদম পাতলা হয়ে গেছে। মেঘা নিজের রোগ সম্পর্কে না জানায় এসব লক্ষণ তার খুব অদ্ভুত লাগছে। তবুও নিজের বাচ্চার জন্যে বিনা অভিযোগে সব সহ্য করছে ও।
ছ মাস কেটে গেছে। মেঘার শরীরের অবস্থা দিনদিন আরো শোচনীয় হচ্ছে। একসময় বৃত্ত সিদ্ধান্ত নিলো, না, অনেক হয়েছে। মেঘার অপারেশনটা এবার করাটা জরুরি। বাচ্চাটার ক্ষতি হলে হোক। মেঘা সুস্থ থাকলে বাচ্চা আরো নেওয়া যাবে। এই বাচ্চার জন্যে মেঘার এত কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না। বৃত্তের মাঝেমধ্যে মন চায়, চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু দিনশেষে ও একজন পুরুষ। পুরুষ মানুষের কাঁদা পাপ। ঘোর পাপ। তাই, বৃত্ত কাঁদতে পারে না। বরং ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে সে। এ যেনো এক মরন কষ্ট!
_________________________
— মাত্র সাতমাস! বেবি এখনো প্রিপায়ার্ড না, মিস্টার বৃত্ত। আপনি কি সিউর সিজার করতে চান?

ডাক্তারের কথা শুনে মেঘা স্থব্ধ হয়ে গেলো। ডাক্তারের কথা না ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারলো না। সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত তখন নির্বিকার। মেঘা কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— বৃত্ত, ডাক্তার এসব কি বলছে? এখন সিজার করবে মানে? এখনো তো সময় হয়নি। কিসের সিজার এখন?

বৃত্ত মেঘার কথার উত্তর দিলো না। বরং শান্ত চোখে ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললো,
— আমি সিউর। আপনি অপারেশন থিয়েটার রেডি করুন, ডক্টর!

ডাক্তার লোকটা মেঘার দিকে একপল তাকালেন। মেঘার চোখে জল এসে গেছে। সে পাগলের মত বৃত্তের সাথে বারবার কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, বৃত্ত একবারও মেঘার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। ডাক্তার এবার গম্ভীর সুরে বললেন,
— ঠিক আছে। আমি সব রেডি করছি। আপনি আপাতত আপনার স্ত্রীকে সামলান, মিস্টার বৃত্ত।

ডাক্তার চলে গেলেন কেবিন ছেড়ে। মেঘা এবার বৃত্তের কলার আঙ্গুলের ডগায় মুচড়ে ধরলো। বৃত্ত মেঘার দিকে তাকাচ্ছে না অব্দি। সে অন্যদিকে চেয়ে মেঘার হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
— কলার ছাড়, মেঘ।
মেঘা কেঁদে উঠলো। চোখের জলে মাখামাখি হলো তার শ্যামা মুখশ্রী। মেঘা বৃত্তের মুখ দুহাতে ধরে বৃত্তের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করলো। বললো,
— এই বৃত্ত, এই? কি হয়েছে তোর, হ্যাঁ? এমন করছিস কেনো তুই? বাচ্চাটা মাত্র সাত মাসের। এখন একে পৃথিবীতে আনলে ও মরে যাবো তো। আমার বৃত্ত এতটা পাষাণ হতে পারে না। এই বৃত্ত? তাকা না আমার দিকে। বল আমাকে। কি সমস্যা তোর? এই বৃত্ত? তাকা না একবার।

বৃত্তের এবার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। তার চোখও অশ্রুতে টলটল করছে। সে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা ফ্যালফ্যাল চোখে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছে। বৃত্ত এক ঢোক গিললো। অতঃপর খুব কষ্ট নিয়ে বললো,
— তুই বাঁচলে বাচ্চা আরো নেওয়া যাবে, মেঘ। কিন্তু তোর কিছু গিয়ে গেলে, আমি শেষ হয়ে যাবো রে। প্লিজ পাগলামি করিস না, মেঘ। বুঝার চেষ্টা কর।

বৃত্তের এত কঠিন কথা মেঘার বোধগম্য হলো না। সে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
— ক-কি হয়েছে আমার?

বৃত্ত চুপ হয়ে যায়। কথা বলতে পারছে না সে। গলায় যেনো কেউ আস্ত এক পাথর বসিয়ে দিয়েছে। মেঘা এবার চিৎকার করে বললো,
— বল? কি হয়েছে আমার?
বৃত্ত নিজেকে সামলালো। এক ঢোক গিলে টলমলে চোখ নিয়ে বললো,
— ব্র-ব্রেইন ট-টিউমার।
বৃত্তের মুখে এত কঠিন বাস্তব শুনে মেঘা মুহূর্তেই নিথর হয়ে গেলো। বৃত্তের গালে থাকা দুহাত আপনা আপনি নিচে পড়ে গেলো তার। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মেঘা দুমিনিট চেয়ে রইলো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত নিজেও কাঁদছে আজ। সে পারেনি তার কান্না আর আটকাতে। হুট করে মেঘার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মেঘা নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যায় বৃত্তের বুকের উপর। বৃত্ত মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায়। মেঘার মুখখানা নিজের দিকে উঁচু করে ওর গালে আস্তে করে থাপ্পর মেরে ডাকে,
— মেঘ, এই মেঘ? মেঘ? কি হলো তোর? মেঘ?

মেঘার জ্ঞান আসে না। বৃত্ত পাগলের মত হয়ে যায়। একবার ডাক্তারকে ডাকে আরেকবার নার্সকে ডাকে। নিজেকে এই মুহূর্ত বড্ড উন্মাদ মনে হচ্ছে তার। এই বৃত্তকে দেখে কেউ চিনতেই পারবে না, এই সেই বৃত্ত। যার সুন্দর চেহারা সম্পূর্ণ ভার্সিটিতে আলোচিত ছিলো। এই বৃত্ত সেই বৃত্ত না, যে সারাক্ষন নিজের ত্বকের যত্ন নিত। এই বৃত্ত তো কোনো অন্য! যে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ে উন্মাদ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। বৃত্তের এহেন দশা দেখে আজ সবার চোখে পানি চলে এসেছে। মেঘার বাবা মায়ের গর্বে বুক ফুলে, তাদের মেয়ে জীবনে একজন সুন্দর মনের স্বামী পেয়েছে।

মেঘাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। বৃত্ত একপাশে বসে আছে। চোখ বেয়ে শুধু জল গড়াচ্ছে তার। বৃত্তের মা এসে বৃত্তের পাশে বসলেন। তিনি বৃত্তের কাঁধে হাত রাখতেই বৃত্ত মাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মায়ের কাঁধে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো ও।
— মা, আমার মেঘ? আমার মেঘ ফিরে আসবে তো? আল্লাহ কি কোনো মিরাকেল করতে পারেন না? আল্লাহ চাইলে ত সব করতে পারেন। মা, আমি মরে যাবো মা। আমার কোনো বাচ্চা চাইনা, মা! বাচ্চাটার যা কিছু হয়ে যাক, মেঘ যেনো ফিরে আসে মা। মেঘ ছাড়া আমি কি করে থাকবো মা। কি করে?

বৃত্তের মা আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। নিজেও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মেঘার বাবা মা একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলছেন। এত এত মানুষের কান্না দেখে আল্লাহর কি সত্যিই দয়া হবে না? হয়তো!
_________________________
— আব্বু, জানো আজ আমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এসেছে। টিচার ওকে আমার পাশে বসিয়েছে। তুমি জানো আব্বু, ছেলেটা না খুব পাজি। সারাক্ষণ আমার চুলের বেনুনি ধরে টান দেয়। আবার আমাকে বলে, আমি নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হবো। আমি তো একদম মানা করে দিয়েছি। বলেছি, আমি কাউকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বানাবো না। আমি সারাজীবন একা একা থাকবো। কাউকে আমি বন্ধু বানাবো না। একা একা থাকতে অনেক মজা, তাইনা আব্বু?

বৃত্ত আর বৃষ্টি নৌকায় বসে মাছ ধরছিল। হঠাৎ নিজের মেয়ের মুখে এ কথা শুনে বৃত্ত একপ্রকার অবাকই হয়েছিল। মেঘবৃত্তের মেয়ে, বৃষ্টি একদম নিজের বাবার মত হয়েছে। যাকে এককথায় অগোছালো, বেপরোয়া বলা যায়। মেয়ের এমন আচরণে বৃত্ত বেজায় খুশিও বটে। বৃত্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলালো। আদর করে বললো,
— একটা কথা জানো আম্মু, আমাদের লাইফে একজন বেস্টফ্রেন্ডের খুব দরকার। যে মানুষটাকে আমরা চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। তার কাছে আমাদের সুখ দুঃখের ঝুলি উপড়ে দিতে পারি। আর তাকে অনেক অনেক ভালোবাসতে পারি। সারাটা জীবন একা একা থাকা যায়না আম্মু। আমাদের জীবনে একটা পর্যায়ে এসে একজন কাছের মানুষের খুব প্রয়োজন হয়। সে কাছের মানুষটা যদি হয় আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড, তখন আমাদের জীবনটা স্বপ্নের মত সুন্দর মনে হয়।

বাবার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো বৃষ্টি। কিন্তু, পরক্ষনেই অবুঝ মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে বললো,
— না, না। আমি একাই থাকবো। একদম অ্যালোন অ্যালোন। কাউকে আমি বন্ধু বানাবো না। কাউকে না।

বৃত্ত মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললো। মেয়ের নরম গালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বললো,
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন চলো, মাছগুলো মায়ের কাছে নিয়ে যাই। মা মজা করে রান্না করবে। ঠিক আছে?

বৃষ্টি লাফিয়ে উঠলো যেনো। দুহাত এক করে ক্রমাগত তালি দিয়ে মাথা নাড়লো মেয়েটা। বৃত্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। একহাতে মাছের ঝুড়িটা নিয়ে নৌকায় থাকা উনুনের কাছে এলো।

উনুনের সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। শরীরে জড়ানো লাল টকটকে এক শাড়ি। শাড়ীর আঁচল মাটিতে অবহেলায় লেপ্টে আছে। তার ঘন রেশমি চুলগুলো দখিনা হাওয়ায় উড়ছে। দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলছে। সে এক দারুণ রূপবতী মেয়ে! বৃত্ত মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে।

— মেঘ?
রূপবতী মেয়েটা তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত মাছের ঝুড়ি এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে। বললো,
— মাছগুলো ঝটপট ভেজে ফেল তো। বাপ বেটি মিলে আজ কব্জি ডুবিয়ে খাবো।
মেঘা হেসে ফেললো। কিন্তু, পরক্ষণেই মুখ ফুলিয়ে বললো,
— এখন? বৃষ্টি আসবে যে?

বৃত্ত মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমেছে। আর একটু পরেই মেঘ নিংড়ে বৃত্তাকার বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি, বৃষ্টি নামবে শুনে খুশি হয়ে হাতে তালি দিতে লাগলো। বললো,
— ইয়াহু, বৃষ্টি আসবে। আব্বু, আমি বৃষ্টিতে ভিজবো?
বৃত্ত হেসে বৃষ্টির গাল টিপে দিলো। অতঃপর, মেঘার দিকে চেয়ে মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
— আজ নাহয় একটুখানি বৃষ্টি হোক। আজ মেঘবৃত্ত আর বৃষ্টি নিয়ে আমাদের এক গল্প হোক। রচিত হোক একটা সুন্দর প্রেমের গল্প!

#সমাপ্ত।