মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-১৩

0
882

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩

“এতরাতে ছাত্রীর সাথে দেখা করতে আসাটা কি শোভা পায়, স্যার? আপনার মত বিচক্ষণ মানুষের দ্বারা এতবড় ভুল?”

ধ্রুব স্যার নিশ্চল। প্রতুক্তি দেওয়ার ন্যায় ভাবাবেগ নেই। অনুদ্ধত দৃষ্টি নিবদ্ধ দূর মেঘহীন অমাবস্যা অন্তরিক্ষে। তার নিশ্চলতায় অসন্তোষ প্রকাশ করলাম। অগ্ৰসর হওয়ার প্রয়াস করলাম পেরিয়ে আসা পথে। ব্যর্থ হলাম অকস্মাৎ স্পর্শে। জমে গেল দেহ। হিম স্তুপে রুপান্তরিত হল। বা’হাত বলিষ্ঠ সুপুরুষের আয়ত্তে। আমি দ্রুত দৃষ্টি মেলালাম। হাত ছাড়লেন, সরলেন না। বরং এগিয়ে এলেন। অগোছালো চুলগুলোকে খোঁপায় পরিনত করল। চুলের মাঝে গুঁজে দিল কালচে গাঁদা ফুলের গুচ্ছ। লহমায় অমাবস্যা তিথি রুপ নিল পূর্ণিমার। ঈষৎ গলায় বলেন, “চলো।”
পুনরায় আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে পা বাড়ালেন। স্পর্শের মাঝেও ঘোরতর দূরত্ব। সূচালো বাঁধল হাতে। অবিলম্বে বোধগম্য হল। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,

“কী হয়েছে আপনার? ব্যান্ডেজ করা কেন? কথা বলছেন না কেন?”

“নজরে পড়ল বুঝি। আমি তো ভেবেছিলাম, দেখলেও এড়িয়ে যাবে।”

“ফাজলামো বন্ধ করুন তো! কী হয়েছে বলুন।”

“তা পরে বলছি, এখন এসো।”
বলে এগোলেন। তোয়াক্কা করলেন না। কিছুটা পথ পেরিয়ে আসতেই‌ তার গাড়ি নজরে এল। আলো বন্ধ ফলস্বরুপ গাড়িটা দৃষ্টিনন্দনে আসতে বেশ বেগ পেতে হল। আমি ভনিতা না করতেই সামনের সিটে বসলাম। সিটব্যাল্ট বাঁধতে গেলেই বারণ করলেন। ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা ভিড়িয়ে বললেন,

“যতদিন বাঁচব, প্রাণ খুলে বাঁচব। অহেতুক কোনো বন্ধনে বন্দিত থেকে নয়।
আর চিন্তা নেই, তুমি পাশে থাকলে এতটা জোরে ড্রাইভ করব না। লাগুক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।”

বলেই শুরু করলেন। অন্তরিক্ষের দিকে ধ্যান রাখলাম।

‘আলো নেই, আঁধার নেই, নেই চাঁদ কিংবা বাঁকা চাঁদের ফালি। তবুও আমার আকাশে পূর্ণিমা। মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা। যার কারণ, আমারই অজানা। এইমাত্র এই মানুষটির সান্নিধ্যের জন্যই তীব্রতর অপেক্ষায় রইতে পারি।’
_______
বেসরকারি হসপিটালে করিডোরে বসে আছি। শুভ্র রঙের বাতির আলো হ্রাস পেয়েছে। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। নার্স, স্টার্ফ কিংবা ওয়ার্ড বয় যাচ্ছে। আমি নিভু নিভু দৃষ্টি মস্তিষ্কে গেঁথে নিচ্ছি। নিদ্রায় চোখজোড়া আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে আসছে। এদিকে পেটের ক্ষুধায় অস্তির। ধ্রুব স্যার আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে সন্দিহান গলায় বলেন,

“ঘুম পেয়েছে?”

“না, নাচ পেয়েছ। নাচব এখানে? আশ্চর্য!”

আমার কথার ফোড়ন দিয়ে বলেন, ” সত্যি নাচবে, গান বাজাব? কিন্তু তোমার নাচ দেখলে পেসেন্টরা হসপিটাল ছেড়ে পালাবে। কী ঝামেলা।”

প্রখর চাইনি নিক্ষেপ করে বললাম, “দেখছেন যে, হাই তুলছি তবুও বোকার মত জিজ্ঞেস করছেন।”

অতিবাহিত হল কিছু মুহুর্ত। একজন স্টার্ফের আগমন হল। ধ্রুব স্যারকে ভেতরে যাওয়ার জন্য বলেই তার গন্তব্যে ছুটলেন। ধ্রুব স্যার উঠে এগোলেন। পিছু না ফিরে অবিচল হয়ে বললেন, “ভেতরে এসো।”

“ভেতরে গিয়ে আমি কি করব?” একরোখা জবাব।

“তুমি না গেলে চিকিৎসা করবে কার?”

“মানে?”
“গেলেই দেখতে পারবে।”

ভেতরে প্রবেশ করতেই তাজ্জব বনে গেলাম। ধ্রুব স্যার একটা লিস্ট দেখিয়ে বললেন টেস্ট করিয়ে আনতে আমায়। বোধগম্য হলনা, কী এমন হয়েছে আমার। শতবার বারণ করার সত্বেও অনিবার্য করেন টেস্ট করতে। স্টার্ফরা জোরপূর্বক তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরে রেহাই মিলেছে। বাড়ির মূল দরজার থেকে কিছুটা দূরত্বে গাড়ি থামালেন। এমন অবধি বেশ কয়েকবার কথা বলার প্রয়াস করেছেন। আমি নিশ্চুপ, বুলিহীন। কিয়ৎক্ষণ আমার মুখপানে চেয়ে থেকে বললেন, “তোমার বাড়িতে পৌঁছে গেছি। যাবে না?”

“না!” মুখ ফুলিয়ে বলি।

ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। অগোচরে হাসলেন মৃদু। বিদ্রুপ করে বলেন, “তারমানে তুমি যাবে না, গাড়ি ঘুরাব?”

“না!”

“বেশি লেখেছে?”

“আপনাকে কেন বলব?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সরে গেলেন তিনি। ফট করে নেমে দাঁড়ালাম। ঝংকার তুলে দ্বার গ্ৰথণ করে দিলাম। প্রবল বেগে ধাবিত হলাম। তিনি পথ আঁটকে দাঁড়ালেন। হাইট মাপলেন আমার। ধ্বনিশূন্য ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে কিছু উচ্চারণ করলেন। অতঃপর কিঞ্চিত শব্দে বলেন, “সামনে পরীক্ষা। তোমাকে পড়ানোর কথা ছিল। কালকে লাইব্রেরীতে দেখা হচ্ছে। গুড নাইট।”

“যাবো না।”

“বাড়িতে চলে আসব।”
বলেই চঞ্চল হল পাজোড়া। গাড়ির ভেতরে ঝুকে একটা প্যাকেট বের করলেন। অনুমতি ব্যতীত হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, “জানি, ধ্রুবের চিন্তায় খাওয়া হয়নি। খেয়ে নিও।
চিন্তা করো না। যাতে রাহাতের সাথে তোমার বিয়েটা না-হয়, তাই এই টেস্ট গুলো করা জরুরি ছিল।”

তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করল ললাট। আমি বিস্মিত হলাম। চোখ জোড়া চড়কগাছে উঠল। আমার বিস্ময় ভঙ্গ হওয়ার পূর্বেই তিনি মিলিয়ে গেলেন রাতের আঁধারে।‌ তার স্থান দখল করে নিল দমকা হওয়া। কম্পিত করল ভিশন। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অমাবস্যা রাত তারকাময় রাত। চাঁদের চেয়েও ঢেরগুন বেশি রঙিন।

______
পূর্বের দিনগুলোর ন্যায় আজকের দিনটাও সূর্যের আলোয় পরিপূর্ণ। প্রকৃতি তার স্ব স্ব রীতিতে চলবে। তাকে বাঁধা দেওয়ায় সাধ্য নেই। তবে আমার রীতি একটু বদলে গেছে। তন্দ্রা থেকে মুক্তি মিলেছে একটু বিলম্বে। যার ফলশ্রুতিতে ভার্সিটিতে আসতে বিলম্ব ঘটেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলাম। ততক্ষণে ক্লাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। একটু সময়ের জন্য থমকে ‘স্যরি’ বলে পুনরায় হাঁটা ধরলাম। কিন্তু তরুণী আমার পিছু ছাড়ল না। পেছন থেকে ডেকে উঠল জোর গলায়। তরুণী আর কেউ নয়, মাহি! বই চাইল। গতকাল ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যারের সাথে দেখার করার জন্য অনুপস্থিত ছিলাম ক্লাসে। পড়াও জানা ছিল না। তিনি বেশি পড়া দিয়েছেন। আমি সন্তর্পণ হাসি দিয়ে বই দিলাম। অতঃপর ছুটলাম লাইব্রেরীর দিকে। দূর থেকে অস্ফুট বেল বাজার শব্দ শ্রবণ হল। আমি দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত না করে পৌঁছে গেলাম সেখানে। ধ্রুব স্যার বই নাড়াচাড়া করছিলেন। আমাকে দেখে এক পলক চাইলেন। সেকেন্ডের মাথায় দৃষ্টি সরালেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ক্লাসের সময় হয়ে এসেছে। এখন এসেছ পড়তে। তোমার সময় শেষ। ছুটির পর সোজা এখানে আসবে।”

অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কাল রাতে দেরিতে ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই..

“ক্লাসে চলো।”
তার পৌঁছে যাওয়ার পূর্বেই আমি হাজির হলাম ক্লাসে। দ্রুত বন্ধুমহলের পাশে বসলাম। আঁখির ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এক ঢোক পান করলাম। অবিলম্বে স্যার উপস্থিত হলেন। আমি সৌজন্য হাসি দিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার বসতে বলে লেকচার দেওয়া শুরু করলেন। বই চাইলেন। ফট করে মাহি আমার বইটা এগিয়ে দিল। পড়ায় মনোযোগ দিলাম। একসময় স্যার থেমে গেলেন। বইয়ের ভেতর থেকে ভাঁজ করা পৃষ্ঠা বের করলেন। খুলে পড়লেন। বইয়ের পাতা বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বললেন,

“এই বইটা কার?”

মাহি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, “চড়ুইয়ের!”

তিনি এগিয়ে এসে পৃষ্ঠা সামনে ধরে বললেন, “এটা কী চড়ুই?”

“পৃষ্ঠা।”

“আমিও দেখতে পাচ্ছি পৃষ্ঠা। কী লিখেছ, সেটা জিজ্ঞেস করছি।”

আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। আমি লিখেছি? কী লিখেছি? কখন লিখেছি। আড়চোখে মাহির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে হাসছে? বোধগম্য হলনা।
স্যার হাতে ধরিয়ে দিলেন। পিছিয়ে গেলেন। পড়ে শোনাতে বললেন।
আমি সাহস সঞ্চয় করে পড়তে লাগলাম। কী বিশ্রী হাতের লেখা।‌ দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। কার হাতের লেখা? তাকে জাদুঘরে বড় করে টানিয়ে রাখা উচিত।

“প্রিয় ধুব,
আপনি আমার..

“ওটা ‌ধুব না ধ্রুব।” মাহি উঠে বলে।

আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার পড়তে লাগলাম,

“আপনি সম্পর্কে আমার স্যার হলেও, স্যারের নজরে দেখি না। প্রেম প্রেম নজরে দেখি। আপনি ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই আপনাকে ভালো লাগে।”

মাত্র এই কয়টা শব্দ উচ্চারণ করতে কম করে হলেও ৫ মিনিটের বেশি নষ্ট হলো। তুতলে যায়। ধ্রুব স্যার আমার করুন অবস্থা দেখে পৃষ্ঠা নিয়ে মাহির হাতে ধরিয়ে দিল। তাকে পরার নির্দেশ দিলেন। মাহি দিব্যি পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা ওর লেখা।
ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলাম। এই মেয়েটারই কাজ। নাহলে এমন কাজ কেউ করতে পারে না।

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল ধ্রুব স্যারের হুংকারে। তিনি মাহির ব্যাগ সার্চ করে খাতা বের করলেন। পরখ করলেন হাতের লেখা। সন্দিহান গলায় বললেন,

“তাজ্জব ব্যাপার তো, মিস মাহি! চড়ুইয়ের হাতের লেখা তোমার সাথে কীভাবে মিলে গেল। আবার তুমি গড়গড় পড়ছ, মনে হচ্ছে কবিতা মুখস্থ বলছ?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]