যতনে রাখিবো পর্ব-১৯+২০

0
179

#যতনে_রাখিবো

১৯
মুভির শুটিং কয়েকদিনের জন্য অফ রাখা হয়েছে। অভয়ের হাতের হাড়ে সত্যিই ফ্যাকচার এসেছে। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত শুটিং সেটে ফিরতে পারবে না। এই নিউজ পুরো মিডিয়া পাড়া জুড়ে ঘুরছে। অভয়ের মেয়ে ভক্তরা অনেকেই তাথৈকে দোষ দিচ্ছে। তাথৈ বুঝতে পারছে না এই পুরো ঘটনায় তার দোষ কোথায়? সে কি ধাক্কা দিয়ে ট্রাক থেকে ফেলে দিয়েছে? তাদের বিয়ের পর এটা ঘটেছে বলে সে অপয়া হয়ে গেল! দুর্ঘটনা তো যেকোনো সময় ঘটতে পারে। ফ্যান গার্লদের এসব হেট কমেন্ট দেখতে দেখতে তাথৈ নিজেই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। তাথৈয়ের আচরণে এই চিড়চিড়ে ভাবটা অভয়ও লক্ষ্য করেছে। তাথৈ জীবনে কোনদিনও রান্নাঘরে ঢোকেনি। কিন্তু এখন সে অভয়ের জন্য রান্না করছে। তার সব স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তবুও লোকটার দেখভাল করছে। এর থেকে বেশি আর কী করবে সে? এদিকে অভয় ভাবছে তাথৈ সেদিন যেতে পারেনি বলেই হয়তো তার উপর রেগে আছে। কিন্তু সে তো পরের দিনও চলে যেতে পারত। এখন আপুরা নিয়মিত আসা যাওয়া করছে। তাই কি তাথৈ থেকে গেছে? ফ্রি সময়ে অভয় বই পড়ে। যদিও এই সুযোগ খুব কমই হয়। নিজেকে দেওয়ার জন্য তার সময়টাই তো নেই।

বড় আপুর থেকে জেনেছে পায়েসের পরে বিরিয়ানি অভয়ের সবথেকে বেশি পছন্দ। তাথৈ কোনদিন ডিমটা তো ভাজেনি৷ সে বিরিয়ানি কীভাবে রাঁধবে? তারপরও আপুদের থেকে হেল্প নিয়ে, ইউটিউব ঘেঁটে বিরিয়ানি বসিয়ে দিয়েছিল। রান্না প্রায় শেষের দিকে। জীবনের প্রথম রান্না করছে। খাওয়ার উপযুক্ত না-ও হতে পারে। এটা বলার জন্যই তাথৈ ঘরে এসেছিল।
তাথৈ ঘরে এলে অভয় বই থেকে মুখ তুলে ডাকল,

-তাথৈ।

-জি বলুন।

-তুমি চাইলে এখন আপুর বাসায় যেতে পারো।

লোকটার কথা শুনে তাথৈ হতবাক হয়ে তাকাল। তাকে বিদায় করার এত তাড়া! সে-ই কি গাধা যে এই কথাটা বুঝতে দেরি করে ফেলেছে।

-আপনার আপুরা এসে যখন প্রশ্ন তুলবে আপনার এই অবস্থায় আমি কেন চলে গেলাম তখন কী বলবেন?

তাথৈ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আপুদের কথা ভেবে থেকে যাক এটা অভয় চায় না।

-আপুদের আমি বুঝিয়ে নেবো। তুমি যেতে চাইলে আমি নোমানকে বলে দিচ্ছি।

সে কেন যেতে চাইবে না? এই লোকের জন্য থেকে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। সেদিন নোমানের মুখে অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা শুনে তাথৈ বাড়ির সামনে থেকে ফিরে এসেছে। কার জন্য? এই স্বার্থপর লোকের জন্য? তাথৈ ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও মুখে বলল,

-আমার তো এখানে থেকে যাওয়ার কোন কারণ নেই। প্রতিবার নোমান সাহেবকে কষ্ট দিতে হবে না। আমি একাই চলে যেতে পারবো।

এর পরে অভয়কে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাথৈ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। অভয় ভাবছে সে তাথৈকে এই জোরজবরদস্তির সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাথৈ ডিভোর্স চাইলে ওটাও দিয়ে দিবে। তাথৈ চলে যাওয়ার পর অভয় আর বই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। আগেও এই বাড়িতে সে একাই থাকতো। কিন্তু এখন তাথৈ চলে যাওয়ার পর বাড়িটা খুব বেশি ফাঁকা লাগছে।

-আপুদের বোঝানো সহজ হবে না। কিন্তু তোমাকে আমি সমাজ, পরিবারের কথা ভেবে মিথ্যা একটা সম্পর্কে আটকে রাখতে পারি না। আজ থেকে তুমি স্বাধীন।

—–
রাস্তায় বেরিয়ে তাথৈ নিজের উপরই প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে। লোকটা তোকে বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আর তুই ওই লোকের জন্যই বিরিয়ানি রাঁধতে চেয়েছিস। এত দরদী কবে থেকে হয়েছিস?

-এই বেটাকে নিয়ে শুরু থেকেই আমার ভাবনা ঠিক ছিল। চরিত্রহীন পুরুষ মানুষ। উনার তো নায়িকার অভাব ছিল না। তারপরও আমার মতো সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করতে গেল কেন? বিয়ে করেছে বলেই না বুঝতে পারলো উনাকে দিয়ে কতবড় ভুল হয়েছে। এখন ডিভোর্স দিয়ে দিবে। দিক। আমিও উনার মতো চরিত্রহীন নায়কের সাথে থাকতে চাই না।

তাথৈ ফোন পার্স কিছুই আনেনি। বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে ভেবেই পা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। এত সুখের জীবন ছিল তার। কেন যে এই মাথামোটা মেন্টাল নায়কের পাল্লায় পড়তে গেল?

অভয়ের নিজের ফোন বাজছে না। কিন্তু কারো ফোন তো বাজছে। তাথৈ কি ওর ফোন ফেলে গেছে? রিংটোনের শব্দ শুনে অভয় ড্রয়িংরুমে চলে এলো। শব্দ মনে হয় কিচেন থেকে আসছে। কিচেনে এসে তাথৈয়ের ফোন হাতে নিয়ে দেখল আয়েশা আপু কল করেছে। অভয় ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কল রিসিভ করল। অভয় কথা বলার আগেই আয়েশা বলে উঠল,

-রান্না শেষ? ঠিকঠাক মতো হয়েছে?

অভয় কপাল কুঁচকে ভাবল কিসের রান্না? আপু কী বলছে? সে কিছু বলবে তার আগে আয়েশাই আবার বলে উঠল,

-বাঁদরটা খেয়ে কী বলে আমাকে জানাবে। রান্না ভালো হয়নি বললে কান টেনে লম্বা করে ফেলব। সকাল থেকে এত খাটাখাটুনি করছো। একটু তো প্রশংসা পেতেই পারো।

অভয় ফোন ধরা অবস্থায়ই কিচেনটা ভালো করে দেখল। চুলায় কিছু বসানো। অভয় এগিয়ে গিয়ে দেখল তাথৈ বিরিয়ানি রান্না করছিল। আপুর থেকে হেল্প নিয়েই কি রাঁধছিল? তাথৈ কিছু বলছে না দেখে আয়েশা জিজ্ঞেস করল,

-কী হলো কিছু বলছো না কেন?

-আপু আমি।

-তুই! তাথৈয়ের ফোন তোর কাছে কেন?
আর এতক্ষণ ধরে আমি তোর সাথে কথা বলছিলাম?

-হুম।

-আচ্ছা ভালো হয়েছে তোর সাথে কথা হয়ে গেল। শোন বাঁদর, মেয়েটা তোর পছন্দ জেনে নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করছে। তাথৈ রান্নাবান্না জানে বলে মনে হয় না। তবুও চেষ্টা তো করছে৷ সকাল থেকে কম করে হলেও আমাকে একশোটা কল দিয়েছে। আমি নিজে এসেই ওকে হেল্প করতাম। কিন্তু নূরের স্কুলে প্যারেন্টস মিটিংয়ে এসেছি। তাথৈ কোথায়? ওর কি রান্না শেষ? যা-ই রেঁধেছে খেতে ভালো না হলেও কিন্তু বলবি ভীষণ ভালো হয়েছে।

-হুম।

আপু কল কেটে দিলে অভয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তখনই কলিংবেল বেজে উঠেছে। তাথৈ কি ফিরে এসেছে? অভয় দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলে দিলে সামনে নোমানকে দেখল পেলো। নোমানের এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট। আরেক হাতে গিফটের বক্স। অভয় ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নোমান বলল,

-প্রথম বার আপনার বাসায় দাওয়াত খেতে আসছি। খালি হাতে তো আসতে পারবো না। তাই ভাবীর জন্য সামান্য উপহার।

তাথৈ কি তাহলে নোমানকেও আসতে বলেছে। অভয় দরজার সামনে থেকে সরছে না দেখে নোমান ভেতরের দিকে উঁকি দিয়ে বলল,

-ভাবী কি আমাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য কোন প্ল্যান করেছে?

অভয় সরে দাঁড়িয়ে বলল,

-ভেতরে এসো।

নোমান ভেতরে গিয়ে তাথৈকে ডাকতে লাগল। অভয় জানাল,

-তাথৈ বাসায় নেই।

অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই নোমান বুঝে গেছে কোন গণ্ডগোল তো হয়েছে। সে সন্দিহান গলায় বলল,

-ভাবী কি রাগ করে বোনের বাসায় চলে গেছে?

অভয় গিয়ে সোফায় বসে মাথা নিচের দিকে ঝুকিয়ে বলল,

-রাগ করে যায়নি।

-তাহলে? রাগ করে না গেলে অন্য কোথাও গেছে? কোথায় গেছে বলুন। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।

-তোমার ভাবী আসবে না নোমান।

-কেন আসবে না স্যার? জানি এটা জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা হয়ে যাবে। কিন্তু, আপনাদের কি ঝগড়া হয়েছে?

-উঁহু।

অভয়ের কথা নোমান কিছুই বুঝতে পারছে না। ঝগড়া হয়নি। রাগ করেও যায়নি। তাহলে ফিরে আসবে না কেন?
অভয় বুঝতে পারছে সে কত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। তাথৈ যেতে চায়নি। সে নিজেই তাথৈকে যাওয়ার কথা বলেছে। তাথৈ এমন একজন মেয়ে যার আত্মসম্মানে সামান্যতম ছোঁয়া লাগলেও সে বরদাস্ত করবে না। অভয় অজান্তেই তাথৈয়ের আত্মসম্মানে আঘাত করেছে।
অভয় চুপ করে বসে থাকলেও নোমান জানার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে।

-স্যার কী হয়েছে কিছু তো বলবেন। ভাবী কেন গেছে? ভাবী যদি চলেই যাবেন তাহলে আমাকে আজ আসতে বলতেন কেন? কিছু তো হয়েছে স্যার।

অভয় হাঁটুতে কনুই ভর দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ বসে রইল। তারপর সোজা হয়ে বলে বলল,

-খুব বড় একটা ভুল হয়ে গেছে নোমান।

-কী ভুল স্যার।

অভয় নোমানকে সবটা বললে নোমান মাথায় হাত দিয়ে বলল,

-আপনার এত জীবনের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান বুদ্ধি সব ভাবীর বেলায় হাওয়া হয়ে যায় কেন স্যার? ভাবীর মন বুঝতে আপনার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? যে মেয়ে সেদিন চলে গিয়েও শুধুমাত্র আপনার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে ফিরে এসেছে আপনি তাকে কোন আক্কেলে চলে যাওয়ার কথা বলেন? ভাবীর যদি চলে যাওয়ারই ইচ্ছে থাকতো, তাহলে কেন ফিরে আসতো? আপনি দেখতে পান না ভাবী আপনার কতটা কেয়ার করে। মুভিতে আপনি পারফেক্ট হাসবেন্ড, বয়ফ্রেন্ড হতে পারলেও বাস্তব জীবনে এক্ষেত্রে ফ্লপ খেয়ে গেছেন। ভাবীকে যেতে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।

চলবে

#যতনে_রাখিবো

২০
দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে তাথৈ একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কেনই যেন আপু ওখানে যেতে ইচ্ছে করল না। তাই হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছে। অভয়ের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তো এসেছে। কিন্তু পার্স টাকাপয়সা আনতে ভুলে গেছে। রিকশা ভাড়ার টাকাটাও নেই। পায়ে হেঁটে যেতে হবে কিন্তু খিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে। সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। জীবনের প্রথম বিরিয়ানি রান্না করার খুশিতে খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল। পেটের ভেতর ইঁদুর গুলো ছুটাছুটি করা শুরু করে দিয়েছে। তাথৈ দু’হাতে পেট চেপে ধরে সান্ত্বনা দেওয়া স্বরে বলল,

-খিদে পেয়েছে তোদের? আমারও ভীষণ খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে এক কেজি চালের ভাত একাই খেয়ে ফেলতে পারব। সাথে ডিম ভাজা আর শুকনো মরিচ ভাজা। আহ! জিভে জল এসে গেল রে।”

-আম্মাজি, মুচকা খাইবেন?”

তাথৈ নিজের দুঃখে এতটা ডুবে ছিল আশেপাশে খেয়াল করার সময় হয়নি। পাশেই একটা ফুচকার ভ্যান ছিল চোখে পড়েনি তার। ফুচকা ওয়ালা লোকটার ডাকে ফিরে তাকাল। ফুচকা দেখলেই তো খেতে ইচ্ছে করে। আজ আরও পেট পুরোপুরি ফাঁকা। তাথৈ ফুচকার দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল। বুড়ো লোকটা আবার বলল,

-দেইখা মনে হইতাছে ভুখা আছেন। ফুচকা খাইবেন?

তাথৈ মুখ ভার করে সত্যি কথাটাই বলে ফেলল,

-কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই চাচা।

টাকা নেই বলে তাকে মন খারাপ করতে দেখে লোকটা খিকখিক করে হাসল। বলল,

-টেকা লাগব না। একদিন নাহয় এই চাচার থেইকা ফিরিতে খাইলেন।

-আপনার লস হয়ে যাবে চাচা।

-একদিন নাহয় লোকসান হইলো।

-এক প্লেট, দু’প্লেট দিয়ে আমার পেট ভরবে না। ফুচকা খাওয়াতে আমার রেকর্ড আছে। উনসত্তরটা একসাথে খেয়েছিলাম।

লোকটা মাথা দোলাতে দোলাতে হাসতে হাসতে ফুচকা বানাতে লাগল। তাথৈ ভাবল, দুনিয়ায় এখনও ভালো মানুষ আছে। কিন্তু লোকটার লস করাতে চায় না সে। তাই রাজি হচ্ছিল না। পরে ভাবল পরে কখনো এসে টাকা দিয়ে যাবে।

-আপনি কি রোজ এখানে বসেন?

-জি আম্মাজি।

-চাচা আপনার দেশের বাড়ি কোন জেলায়?

-দেশের বাড়ি? আমার জন্মস্থান এইডা না আম্মাজি। যুদ্ধের সময় আমার আব্বা এইখানে আসেন। তার পর থেইকা এটাই আমার দেশ।

-ওহ। সেজন্যই আপনার বাংলাটা এত পরিষ্কার না। কথায় কেমন একটা টান আছে।

-অনেকদিন এই দেশে আছি। তারপরেও মানুষ ভাবে আমি ভিনদেশী।

-আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন চাচা? আমি ওভাবে বলিনি।

লোকটা সামান্য হেসে বলল,

-কষ্ট পাই নাই।

-আচ্ছা বাদ দিন। আপনার বাড়িতে কে কে আছে?

-বউ ছেলেমেয়ে সবাই আছে।

-কয়জন ছেলেমেয়ে আপনার?

-আল্লাহর মাল ছয় জন।

-মা-শা-আল্লাহ।

কথা বলতে বলতে লোকটা ফুচকা বানিয়ে দিচ্ছে তাথৈ টপাটপ করে মুখে চালান করে দিচ্ছে। এত খিদে পেয়েছিল। ফুচকা দেখে লোভ সামলাতে পারছে না।

-আরেকটু বেশি করে ঝাল দেন চাচা। আমি প্রচুর ঝাল খাই।

-আম্মাজির বাড়িতে কে কে আছে?

-একটা বড় বোন। দুলাভাই। আর একমাত্র ভাগ্নে।

-আম্মাজির বিবাহ হয় নাই?

তাথৈ একটা ফুচকা মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-হয়েছিল কপাল করে! তবে না হওয়ার মতোই।

তাথৈয়ের কথাতেই কেমন ব্যাঙ্গ ফুটে উঠল। তাই লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল,

-জামাই বাবাজি মানুষ ভালো না বুঝি?

মুখের ভেতর ফুচকা থাকায় সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। চিবোতে চিবোতে বলল,

-মানুষ হিসেবে মনে হয় ভালোই হবে। শিওর না। নায়ক হিসেবে নাম্বার ওয়ান। কিন্তু বর হিসেবে জিরো।

-কেন আম্মাজি?

-বেটা হলো অভিনেতা বুঝলেন চাচা। অভিনয়ে কাঁচা হলে নিশ্চয় দেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারত না। আমার সমস্যা এখানেই। লোকটা কখন অভিনয় করে, কখন নিজের আসল রূপ দেখায় এটাই ধরতে পারি না।

-জামাই বাবাজি অনেক বড় নায়ক বুঝি?

-অনেক বড়। অনেক বেশিই বড়। আপনি টিভি দেখেন না? উনার নাম শুনলেই চিনবেন।

-আমি টিভি দেখি না আম্মাজি।

-তাহলে চিনবেন না। আপনার ছেলেমেয়েরা হয়তো চিনবে। কত মানুষ উনার জন্য পাগল! বিশেষ করে মেয়েরা।

-আপনাগো বিয়া কীভাবে হইছে?

-সে অনেক কাহিনী চাচা। বলতে গেলে দিন ফুরিয়ে যাবে। তবে এটুকু জেনে নিন আমাদের বিয়েটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। উনিও রাজি ছিল না। আমিও না।

-আপনি জামাই বাবাজিরে ভালোবাসেন না?

তাথৈ থামল। এতক্ষণ সব প্রশ্নের চটপট উত্তর দিয়ে ফেললেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিল।

-ভালোবাসা! নাহ।

-ভালোবাসা না থাকলে বিবাহে রাজি হইলেন কেন? বাড়ি থেকে ঠিক হইছিল মনে হয়।

-তা-ও না।

-তাহলে?

-পরিস্থিতিই এমন হয়ে গিয়েছিল যে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না।

-তার মানে আপনি মানুষটারে পছন্দ করেন না।

তাথৈ কতক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-এক সময় আমি উনার অনেক বড় ফ্যান ছিলাম। এখন অবশ্য নই। উনি আমার কলেজ জীবনের ক্রাশ ছিলেন।

-এই যুগের ছেলেমেয়েরা ক্রাশ বলতে তো পছন্দ করাই বোঝায়। তাইলে তো আপনার বিবাহ পছন্দের মানুষের সাথেই হইছে।

-উঁহু চাচা। ওসব তো অনেক বছর আগের কথা।

-কত বছর আগের?

-চার বছর তো হবেই।

-আম্মাজি আমি কিন্তু আপনার কথা বুঝতে পারতাছি না। একবার কন পছন্দ। আবার কন পছন্দ না।

-আচ্ছা আপনাকে শুরু থেকে বুঝিয়ে বলছি। উনাকে নিয়ে পাগলামি কলেজ জীবনে করেছি। যেখানেই উনার ছবি পেতাম নিজের কাছে রেখে দিতাম। কলেজ চুরি করে হলে গিয়ে উনার মুভি দেখেছি কতবার হিসেব নেই। অন্য কোন মেয়েও উনাকে পছন্দ করে এটা শুনলেই ঝগড়া লেগে যেতাম। মানে দেশের সব মেয়েদের নিজের সতীন মনে করে হিংসে করতাম। উনাকে বিয়ে করার স্বপ্নও দেখতাম একসময়।

তাথৈয়ের কথা শুনতে শুনতে লোকটা ফুচকা বানানো বন্ধ করে দিলে তাথৈ বলল,

-আমার এখনও পেট ভরেনি চাচা। আপনি দিতে থাকুন। পরে এসে আপনার টাকা দিয়ে যাব। আমার বরের অনেক টাকা। কে খাবে এত টাকাপয়সা? তাই ভাবছি এখন থেকে উনাকে ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দু’হাতে যেভাবে পারি উনার টাকা উঠিয়ে শেষ করব। হিরো বর পেয়েছি একটু সুযোগ সুবিধা তো নেওয়াই যায়।

তাথৈ মূল কথা থেকে সরে গেছে। লোকটা আবার তাকে মনে করিয়ে দিল। কোথায় ছিল ও।

-ওহ তারপর বলি। কলেজ জীবনের ক্রাশ। বলতে পারেন জীবনের প্রথম ভালো লাগা। ভালোবাসা বা প্রেম কি-না বলতে পারব না। তবে উনাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম এটা সত্য। আমার বান্ধবীরা সবাই জানতো। ওরা বলত, পাগলামি করিস না তাথৈ। তোর বিয়ের বয়স হতে হতে উনি তিন বাচ্চার বাপ হয়ে যাবে। তখন আমি কী বলতাম জানেন চাচা? মনে পড়লে এখন হাসি পায়। আবার নিজের বোকামিতে লজ্জাও লাগে। বলতাম, আমি ওই তিন বাচ্চার বাপকেই বিয়ে করব। সতীন নিয়ে ঘর করতেও আমার সমস্যা নেই। উনার সাথে আমার বয়সের পার্থক্যটা তখন চোখে পড়ত না। চোখে পড়ার মতোও না। এখনও উনাকে ২৩/২৪ বছর বয়সী যুবকই মনে হয়। নিজেকে মেইনটেইন করে রেখেছে কিনা। সময়ের সাথে সাথে আমার পাগলামিও বাড়ছিল।

-দেখছেন তো আম্মাজি, আপনি উনারে মন থেকে চাইছিলেন বইলাই আল্লাহ আপনার ডাক শুনছেন।

তাথৈয়ের মুখটা ধপ করে নিভে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে বলল,

-না চাচা। আমার ছেলেমানুষি পাগলামি অনেক আগেই কেটে গিয়েছিল। বাস্তবতা খুব ভালো ভাবেই চোখের সামনে উঠে এসেছিল।

তাথৈ অন্যমনস্ক হয়ে কথা বললেও লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখছে। কপালে সামান্য ভাজও পড়েছে।

-কেন আম্মাজি?

-সে অনেক কথা চাচা। আরেকদিন বলব।

-মনের কথা চাইপা রাখতে নাই আম্মাজি। মনের কথা বইলা দিতে হয়।

-নিজের বরের কথা আর কী বলব? যেভাবেই হোক এখন উনি আমার স্বামী। আর এই সত্যটা চাইলেও আমি অস্বীকার করতে পারব না।

মুখে এই কথা বললেও মনে মনে ভাবল,
যদিও আমাদের কাছে বিয়েটা মিথ্যা। কিন্তু মানুষের চোখে তো আমরা সত্যিকারেরই স্বামী স্ত্রী।

-সে সময়ে একটা নায়িকা ছিল। তানিয়া নাম। ওই নায়িকা আর উনার জুটি সবাই পছন্দ করেছিল। একসাথে অনেকগুলো ছবি করেছিল ওরা। ওদের সম্পর্কে গুঞ্জনও কম ছিল না। প্রথম দিকে এসব আমি পাত্তাই দিতাম না। অবুঝ ছিলাম ভীষণ। আমার কলেজের শেষের দিকের একটা ঘটনা। টিভিতে, পেপারে ওদের দু’জনকে নিয়ে অনেক লেখালেখি নিউজ হয়েছে। উনারা লুকিয়ে বিয়ে করেছেন। তানিয়া প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর উনি তানিয়াকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন। এই খবরটা দেশবাসী বিশ্বাস করে নিয়েছিল। আমি কীভাবে অবিশ্বাস করে থাকতাম। ওই খবর শোনার পর থেকেই আমার অবুঝ মন বুঝে নিয়েছিল। আমার স্বপ্ন শুধুই একটা রঙিন স্বপ্ন। উনার সাথে আমার কোন মিল নেই। আর না কোনদিন হবে। উনি কোনোদিন জানতেই পারবেন না তাথৈ নামের একটা মেয়ে উনাকে নিয়ে কত ছেলেমানুষী স্বপ্ন বুনেছে। কতটা গাধা হলে কাউকে এমন নিঃস্বার্থ ভাবে চাওয়া যায়! আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে কি উনি জানেন? তাহলে কেন উনি অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না? কেন অন্য কাউকে ভালোবাসবেন না? কী পাগল ছিলাম আমি, না?

তাথৈয়ের ফুচকা খাওয়া শেষ। সে প্লেট রেখে দিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছে নিল।

-আমি কালই এসে আপনার টাকা দিয়ে যাব চাচা।

-আম্মাজি একটা কথা বলি। কিছু মনে করবেন না। আপনি আমারে আপন ভাইবা এত কথা কইলেন। আমি একটা উপদেশ দেই?

-বলেন চাচা। আপনার কোন কথাতেই আমি রাগ করব না।

-নায়ক নায়িকাগো জীবনে এমন অনেক কথাই উঠে। কিছু সত্য হয়। কিছু মিথ্যা বায়োনাট হয়। এখন তো উনি আপনার স্বামী। আপনার সাথেই সারা জীবন থাকতে হইব।

-আমাদের বিয়ে হয়েছে বলেই যে উনাকে সারাজীবন আমার সাথে থাকতে হবে এমন না চাচা। উনি যদি আমার সাথে থাকতে না চান তাহলে আমি উনাকে ছেড়ে দিব। বা আমিও যে উনার সাথে থাকতে চাই এমন না। আমার মনও যখন তখন ঘুরে যেতে পারে। অন্তত আজকের আচরণের পরে ডিভোর্স দিব এটাই ফাইনাল।

-একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দুইজনরেই শ্রম দিতে হয়। আপনার দিক থেকে আপনি একটু চেষ্টা করলেন। উনার দিক থেকে…

-চেষ্টা করেও আমাদের মাঝে কিছু ঠিক হওয়ার নেই। আমরা কেউ কারো জন্য সঠিক নই।

চলবে
Jerin Akter Nipa