যদি তুমি চাও পর্ব-১২+১৩

0
359

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

১২.
অন্তি পার্সেলটা খুলে দেখে সেখানে ওর বইগুলো আছে একেবারে ঝকঝকে চকচকে নতুন সব বই। বইগুলো মধ্যে থেকে এক হাতে দু’টো আর অন্যহাতে একটা বই নিয়ে এদিক সেদিক উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে তারপর আবিরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। আবির ওর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলে,
-অবাক হওয়ার কিছু নেই এতে, তুমি আজ থেকে আবারও নিয়মিত সকল ক্লাস এটেন্ড করবে। এগুলো তোমার বই আগের গুলোর প্রয়োজন নেই আমি চাই না আমার বউয়ের কাছে এখন আর তার মায়ের দেওয়া কিছু থাকুক। এরপরেও যেগুলো ভীষণ প্রয়োজনীয় যেমন তোমার সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড আর এমন কিছু ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসপত্র সেগুলো আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
-আপনি কী আমার লাইফ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন আবির?
অন্তির প্রশ্ন তবে আবিরের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই আবারও বললো,
-করবেন না। আর করলেও আমায় কন্ট্রোল করতে পারবেন না। আমি আমার মায়ের কন্ট্রোলে ছিলাম কারণ এই নয় যে আমি তাকে ভয় পেতাম কারণটা ছিল তার প্রতি আমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান। যার কোনোটাই আমার আপনার প্রতি নেই। ভয়, সেটাও নেই।
-তবে কি ঘৃণা?
-উহু, ঘৃণা করতে হলেও মানুষকে মনে জায়গা দিতে হয়। মনে যে তিক্ততার জায়গা থাকে আপনি সেই জায়গাতেও জায়গা পাবেন না। কথাটা মাথায় রাখবেন এবং আমার লাইফে ইন্টেফেয়ার করার চেষ্টা করবেন না।
-আমি তোমার হাজব্যান্ড অন্তরা।
অন্তরা তাকায় আবিরের দিকে তখন আবির বলে,
-সহজ বাংলায় বলি, আমি তোমার স্বামী।
অন্তরা সেই কথাটা শুনে বাঁকা হেসে বলে,
-জানি তবে আমাকে আমার স্বামী বিয়ের রাতে যে বলেছিল তাকে বাধ্য করা হয়েছে বিয়ে করতে সেই কথাটাও মনে করি আর হাসি। আপনি খুব ভালো ড্রামা জানেন। এখন বলুন স্বামী বলে কী অধিকার খাটাবেন?
-স্বাভাবিক নয় কী!
অন্তরা আবারও হাসে তারপর বলে,
-উমম, হুম স্বাভাবিকই তো। আসলে প্রথমদিনের কথাগুলোই অস্বাভাবিক ছিল।
-যা ভাবার ভাবো আমার অফিসে যেতে হবে তুমিও তৈরি হয়ে নাও আমার সাথেই যেতে হবে তোমাকে।
-আমি যাবো না।
-আমার বউ অশিক্ষিত থেকে যাবে সেটা আমি মেনে নিতে পারবো না।
-আপনিই বা শিক্ষিত হয়ে শিক্ষার পরিচয় দিতে পারলেন কোই! আর শুনুন আমি যথেষ্ট শিক্ষিত। আমি না আপনার বউ?
-হ্যা, তো?
-তাহলে আমার তো বাড়িতে থেকে সংসার সামলাতে হবে এখন পড়াশোনা করাটা মানায় না।
আবিরের কাছে এবার বিরক্ত লাগছে সবটা, এই মেয়েটা এমন কেনো? ও তো আর জানে না ও ভার্সিটি না গেলে আবিরের উপরই সব শাস্তি এসে পড়বে। আবির নিজেকে শান্ত করে বলে,
-অন্তরা তুমি যাবে নাকি আমি তোমায় নিয়ে গিয়ে পোশাক পাল্টে দেবো?
অন্তি এবার কিছুটা দমে যায় সে আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে আসে। আবির ওকে সাথে করে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে। আজ আবিরের কাছে গাড়িটা নেই, অন্তি এ কদিনে বাড়ি থেকে বেরোয়নি বলেই দেখতে পায়নি নয়তো বিয়ের পরের দিন সকালে আবির গাড়িটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। হয়তো অন্তির কথাগুলো তার ইগোতে লেগেছিল অথবা অন্য কোনো কারণে সে যাই হোক আজ অন্তি খেয়াল করলো আবির একটা পুরোনো মডেলের বাইক নিয়ে এসে তার সামনে থামলো তারপর বললো,
-এতে বসতে নিশ্চয়ই তোমার কোনো সমস্যা হবে না, এটা কারো দয়ার নয় বরং আমার বাবার রক্ত জল করা আয়ের অংশ একটু একটু করে জমিয়ে কেনা। বাবা কিনেছিলেন, তার স্মৃতি বলতে পারো।
অন্তি অবাক হলো তার নিজের অনুভূতি বুঝতে পেরে। ওর আজকের এই এখনকার আবিরকে ভালোই লাগছে। মানুষটাকে এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে। সে আবিরের পেছনে উঠে বসে তারপর আবির বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে,
-কাঁধে হাত রাখো সেফটির জন্য বলছি এমনিতেও সমস্যা হওয়ার কথা নয় আমি তোমার স্বামী বলে কথা।
অন্তি আলগা করেই হাতটা আবিরের কাঁধে রাখলো তারপর বাইকটা ছুঁটলো নিজের গন্তব্যে। অন্তির হঠাৎ খেয়াল হয় আবির একবার ওর অফিসের নামটা বলেছিল সেইটা। সে কিছু একটা ভেবে বলে,
-আপনি কী আমায় মাঝপথে নামিয়ে দেবেন?
-কেনো?
-আপনার অফিস তো লেফট সাইডের রোড ধরে আর আমার যেতে হতে সোজা পথে।
-চিল অন্তরা, তুমি আমার দ্বায়িত্ব আমি তোমায় আগে পৌঁছে দিয়ে তারপর যাবো। হাতে এখনো অনেক সময় আছে বুঝলে।
অন্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় যা দেখার চান্স আবিরের ছিল না তবে তার চোখ সামনের মিররে থাকায় দেখতে পেয়ে বলে,
-তুমি আমার পেছনে বসে থেকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছ! আমি যদি মিরর না দেখতাম তবে তো বুঝতেই পারতাম না একটুখানি তো মুখ ফুটে হু,হা,নু,না কিছু বলতে পারো।
অন্তি আবারও মাথা নাড়িয়ে নিজেই নিজের মাথায় টোকা মারে। এতে আবিরের কাঁধ থেকে হাতটা সরাতে হয় তাকে। এখানেই দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো সময় থাকতেই আবারও কাঁধে হাত না রাখলে পড়ে মাথাটা ফাটতো ওর। আবির শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করলো,
-সাবধান।
এরপর আর কোনো কথা হলো না দু’জনের মাঝে। পথটা নিরবতার মাঝেই পেরিয়ে গেল ওরা।

অন্তি কে নামিয়ে দিয়ে আবির বললো,
-অন্তরা।
অন্তি ভেতরে চলে যেতেই নিচ্ছিলো আবিরের ডাক শুনে ফিরে তাকাতেই সে বললো,
-ফোন সাথে এনেছো?
অন্তি মাথা নেড়ে উত্তর দেয় যার মানে দাঁড়ায় ও ফোন নিয়ে এসেছে। আবির উত্তর পেয়ে বলে,
-দেখবে আমার নম্বর সেইভ আছে ফেরার সময় হলে আমায় একটা টেক্সট করবে আমি এসে নিয়ে যাবো।
অন্তি কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আবির ওকে কিছু বলার সুযোগটা দিলোই না উল্টো নিজেও আর কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো। অন্তিও আর মাথা ঘামালো না এ নিয়ে। সে ভেতরে প্রবেশ করে। গিয়েই ছায়ার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। ছায়ার চেহারা দেখেই বুঝতে পারে ও রেগে আগুন হয়ে আছে তারপরেও সে কিছু বললো না দেখে অবাক হলো অন্তি। ছায়া আগেই এগিয়ে এসে অন্তিকে জড়িয়ে ধরে তারপর বলে,
-তোর ফোন বন্ধ কেনো? জানিস কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আমি!
অন্তি মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে যার মানে ও জানে না। ছায়া রেগে যায় অনেক। একে তো ওর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না তার উপর এইসব মজা হিসেবে নিচ্ছে ও। এটা মেনে নেওয়া যায় না। একেবারেই না। ছায়া দুই হাত একত্রিত করে অন্তির গলা টিপে ধরতে আসে, অন্তি পিছিয়ে গিয়ে বলে,
-পাগল হয়ে গেছিস, আমি মরে যাবো মা।
-আমি তোর কোন জন্মের মা?
অন্তির কথা শুনে ছায়া নিজের হাতদুটো কোমরে রেখে প্রশ্ন করলো। এটাই তো চাইছিল অন্তি, ও জানতো এমন কিছু বললে ছায়া ঠিকই হাত কোমরে নিয়ে রাখবে। ওর এটা অভ্যাস।
-ওসব ছাড় না, চল ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।
-ক্যান্টিন এরিয়ায় যাবো না ভাই। তোর কিছু খাওয়ার হলে গিয়ে প্যাক করে নিয়ে আয় আমরা ক্যাম্পাসের এক কোণাতে বসি তারপর তুই খাস।
অন্তি কিছু বলার আগেই ছায়া আবারও অন্তিকে বলে,
-এই অন্তি তোর ভাইকে কী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে?
-কি সব আবল তাবল বকছিস?
-আরে শোন না, গত পরশু আমি রাফিদকে কল দিলাম তোর খোঁজ নিতে বলে না ‘অন্তি ওর বাড়িতে আছে সেখানে গিয়ে খোঁজ নাও আমায় জ্বালিও না।’ লেহ!
অন্তি ছায়ার কথা বলার ভঙ্গি অন্য কোনো সময় দেখলে হয়তো হেসে কুটিকুটি হয়ে যেতো কিন্তু এখন মুখটা মলিন হয়ে গেল।

অন্তি ছায়ার মুখোমুখি বসে আছে, এতক্ষণ সে তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্তটা তাকে খুলে বলেছে আর এটাও বলেছে যে তার ফোন লুকিয়ে রেখে তাকে নতুন একটা ফোন দেওয়া হয়েছে যেখানে শুধু আবিরের নম্বর আর ভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষকের নম্বর ছাড়া আর কারো নম্বর রাখা হয়নি এমনকি তার মায়েরও নয়। ছায়া কথাগুলো শুনে অবাকই হলো আবার অন্তির জন্য তার খারাপ লাগলো কিন্তু কিছু করার নেই যে।

দুজনেই কিছু সময় নিরবতা পালন করার পরে ছায়ার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠলো সে বললো……

চলবে…..

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

১৩.
ছায়া যে কথাটি বললো সেটি শোনার পরে অন্তির চোখ কপালে, কোন গাঞ্জিকা সেবন করে এসেছে এই মেয়ে কে জানে। পুরো একটা মুভি স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে সাবাসী দিচ্ছিলো নিজেকে। অন্তি সাথে সাথে ছায়ার মাথায় চাটি মেরে বলে,
-কোন মুভি দেখে এসব আইডিয়া বের করেছিস বলতো। এসব সিনেমাতেই মানায় বাস্তবে করলে তোকে গাড়ির নিচে পিষে দিয়ে চলে যাবে।
-ওসব আমি দেখে নেবো তুই শুধু বল ওই লোক সিঙ্গেল কি-না।
-জানি না।
-তুই তো মেয়ে মানুষ, সিঙ্গেল না হলে একমাত্র ক্যারেক্টারলেস পার্সনই মেয়েদের পেছনে ছুটবে। এখন খুঁজে বের করতে হবে এ সত্যিই সিঙ্গেল নাকি ক্যারেক্টারে ভেজাল আছে।
-এ মা খ্যামা দে আমায়, তোর কিছু করতে হবে না।
ছায়া অন্তির কথা কানে নিলো না সে গভীর চিন্তায় মত্ত। গালে হাত দিয়ে বললো,
-একটা কথা বুঝতে পারছি না এখনও।
-কী?
-তোর পেছন পেছন নিজে ঘুরলো এরপর না পেরে তোর বয়ফ্রেন্ডকে উঠিয়ে নিলো তারপর তোর বিয়ে করালো কিন্তু কথা হলো অন্য ছেলের সাথে কেনো?
-এতো কিছু না ভেবে একটা পথ বের কর না।
-কীসের?
-নিহালকে খুঁজে বের করতে হবেরে। ওর অবস্থা ভালো নেই, বুঝতেও পারছি না ওর সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কি-না।
-তার খবর কোথায় পাওয়া যাবে?
-ওই ব্যক্তির কাছেই।
-তাহলে আমি আমার প্ল্যান এক্সিকিউট করি?
-কাজ হবে?
-তোর সুন্দরী বান্ধবীর সৌন্দর্যের উপর ভরসা নেই বুঝি? একসাথে হাজার ছেলেকে ঘায়েল করতে পারবো বুঝলি।
-ওহ।
-কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
-কী সমস্যা?
-এটাই আমার প্রথমবার।
ছায়া মুখটা বাংলার পাঁচ করে বললো কথাটা। অন্তি মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে আর ভাবে, এ কাকে দ্বায়িত্ব দিয়ে বসলো সে। একে তো পুরোনো মুভি ট্রিক তার উপর এই হাল। আল্লাহ্ জানেন এই মেয়ে কী ঘটনা ঘটাবে।

ফেরার সময় অন্তির মনে পড়ে আবির বলে যাওয়া কথাটা সে সাথে সাথে মোবাইল বের করে আবিরের নম্বরে টেক্সট করে তারপর ছায়াকে বলে,
-তুই যা আমাকে অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়।
-কার?
অন্তি শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ছায়ার দিকে আর সেও বুঝে যায় বিষয়টা।
-আচ্ছা বুঝেছি আর বলতে হবে না।
অপেক্ষারত অবস্থায় কিছু সময় পর ছায়া বলে,
-আচ্ছা লোকটার বয়স কতো?
-হবে সাতাশ বা আটাশ।
-ওহ, আর কিছু জানিস? মানে কোন রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে তাহলে ফাঁসাতে সুবিধা হবে।
অন্তি ভ্র-কুঁচকে তাকায় তারপর বলে,
-তুই কার কথা বলছিস বল তো!
-তুই কার কথা ভাবছিস?
-ওই যে তোর পেছনে লেগে থাকা সেই সিসি ক্যাম এর কথা।
-ওহ, তাই বল। তার বয়স থার্টি প্লাস হবে।
-মানে আমার থেকে ১, ২, ৩…… নয় বছর! এখন আমার কী হবে রে!
অন্তি ছায়ার পিঠে মেরে বলে,
-তুই কী সত্যিই প্রেম করবি নাকি!
-না না, আমি আর প্রেম নো ওয়ে।
-তবে সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা! কোথায় সমস্যা? নেই তো কোনো সমস্যা।
ছায়া অন্তির কাছে থেকে নিজের অবস্থা লুকিয়ে স্বাভাবিক প্রকাশ করার চেষ্টা করে তারপর বলে,
-তুই কর, অপেক্ষা। আমি যাই বুঝলি। বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।
অন্তি রেগে গিয়ে বলে,
-আমি তোকে অপেক্ষা করতে বলেছি?
ছায়া আর দাঁড়ায় না সেখানে। সে স্থান ত্যাগ করে। হাঁটতে থাকে।

ছায়া তখন রাস্তা ক্রস করছিল। এই রাস্তা পার করলেই একটা কাঁচা সড়ক পড়ে সেই পথ ধরে গেলে আর দশ মিনিট লাগে তার বাড়ি পৌঁছুতে। রাস্তা পার করার সময় ছায়ার মনে হয় সেই ব্যক্তির কথা। সে ভাবে যাকে ট্র‍্যাপে ফেলতে যাচ্ছে তার চেহারাটাই তো দেখা হয়নি এখনো। মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বের করে ইন্টারনেট অন করে সামনের দিকে এগোতে এগোতে গুগলে সার্চ করার জন্য সার্চ অপশনে যায় সে। এখান থেকে কিছু না কিছু তো পেয়েই যাবে সে। কী যেনো নামটা? ও হ্যা মনে পড়েছে। ছায়া টাইপ করতে শুরু করে, ‘B A K H….’ এইটুকু টাইপ করার সাথে সাথে একটা আওয়াজ কানে আসে তার। কেউ গাড়ির হর্ন দিয়েছে, ছায়া তাকাতেই ঘাবড়ে যায়। থমকে দাঁড়ায় রাস্তার মাঝে। হঠাৎ গাড়ি তার কাছাকাছি এসে ব্রেক করায় সে এতোটাই ঘাবড়ে যায় যে হাত থেকে মোবাইল টা পড়ে গিয়ে তিনটে টুকরোতে পরিণত হয়। ছায়া নিজের প্রাণ বাঁচার জন্য খুশি হয়ে যাওয়ার পরের মুহুর্তেই যখন খেয়াল করে তার মোবাইলটা আর চলার অবস্থায় নেই তখন সেখানেই বসে পড়ে সে। মোবাইলের টুকরো গুলো হাতে নিয়ে লাগানোর চেষ্টা করে। নাহ, এরা আর জোড়া লাগবে না। কখনোই না। তার খুব কান্না পাচ্ছে।

ছায়া খেয়াল করলো গাড়ির ড্রাইভিং সীটের গেটটা খুলে কেউ বেরিয়ে এলো। ছায়া উঠে দাঁড়ালো তখনই সেই মানুষটি এসে তাকে বললো,
-আই এম সরি মিস। আমি খেয়াল করিনি আপনি কী ব্যথা পেয়েছেন কোথাও?
ছায়া কিছু বলে না তখনই মানুষটির চোখ যায় ছায়ার হাতে থাকা ভাঙা ফোনের দিকে। সে বলে,
-আপনার তো অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললাম আমি। আবারো সরি।
ছায়া মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ভুল আমার ছিল, আমি নিজেই না দেখে হাঁটছিলাম আর যার কারণে না দেখে হাঁটছিলাম তার তো ক্ষতি হওয়ারই ছিল।
-কী বলতে চাইছেন?
ছায়া ফোনের টুকরো গুলো সামনে ধরে বললো,
-এই যে একে দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম তাই… আমি খুব দুঃখিত এইভাবে সামনে না দেখে চলছিলাম। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনার অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো।
-উহু, ক্ষতি তো আপনার হয়েছে তাও আমার কারণে। আমি এর ক্ষতিপূরণ দিতে চাইবো যদি কিছু মনে না করেন তবে।
-প্রয়োজন নেই, ভুল তো আমার ছিল তবে খামখা খরচ আপনি কেনো করবেন?
-আমি কিন্তু মিথ্যে বলছি না, ভুল আমারও ছিল। আমি এই আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত না থাকলে আপনাকে আগেই দেখতে পেতাম আর হর্নও আগেই শুনতে পেতেন আপনি। তাহলে এর মানে দাঁড়ায় দুজনেই সমান দোষী। এখন আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি তাই না, তবে আপনার হয়েছে। আজকের মতো দিনে এই মোবাইল ফোন কাছে থাকা খুবই প্রয়োজন আর আপনার….
ছায়া তাকে আর বলতে দিলো না।
-শুনুন আমার কোনো সমস্যা হবে না। কয়েক মাস পরে এমনিতেও নতুন একটা নিতাম। টাকাও জমিয়েছি আরও কিছু হলে নতুন কিনে নেবো চিন্তা করবেন না। আর এটার মূল্য আমার প্রাণের থেকে তো বেশী নয় বলুন, আপনি সঠিক সময়ে ব্রেক করে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এই অনেক আর কিছু চাই না আমি। আপনি যে দিতে চেয়েছেন এই অনেক। ভালো থাকবেন আসি।
ছায়া ধীর পায়ে মোবাইলটার দিকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কমদামী হলেও এটা কিনতে ওর অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। অনেকের কাছেই হয়তো বিশ, পঁচিশ, ত্রিশ হাজার এমনকি লাখ টাকা দামেরও মোবাইল থাকে তাদের কাছে ওরটা তুচ্ছই বটে কিন্তু দু বছর আগে যখন এটা কিনেছিল তখন দাম ছিল সাত হাজার। মাত্র নয় এটা ওর কাছে অনেক বেশি। আবারও এই দু’বছরে কিছু টাকা জমিয়েছে আর কিছু জমিয়ে এটা বেচে নতুন নেবে ঠিক করেছিল কিন্তু এখন দেখছে অপেক্ষা একটু বেশিই করতে হবে।

ছায়া যখন নিজ ভাবনার মাঝে ডুবে আছে তখন পাশে থেকে কেউ বলে,
-শুনুন।
ছায়া পাশে দেখে সেই ব্যক্তি যার সাথে একটু আগে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
-আপনি?
-আপনাকে দেখে খুব আপসেট মনে হলো তাই আর যেতে পারিনি।
-আপসেট কোথায়?
-একটা কথা বলি?
-বলুন।
-আমরা তো সমান দোষী তবে আমার কাছে থেকে এটলিস্ট ৫০% ক্ষতিপূরণ আপনার প্রাপ্য তাই নয় কি?
ছায়া হাসে তারপর বলে,
-আপনি মানবেন না তাই না!
বিনিময়ে সেই ব্যক্তিও হাসে। ছায়া বলে,
-আমি সত্যিই আমার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
-আমি জানতে চাইনি আপনার প্রয়োজন আছে নাকি নেই। এবার চট করে দাম টা বলুন দেখি।
-এখন এর মূল্য শূন্য।
-না বললে কিন্তু আমি আপনার সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকবো।
-আমি এক ছায়াই ঠিক আছি আর কোনো ছায়ার প্রয়োজন নেই।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ছায়া। সেই ব্যক্তি অবাক চাহনি নিয়ে বলে,
-বুঝিনি।
-আমার নাম ছায়া তাই বললাম।
-ওহ।
-আচ্ছা শুনুন আপনি ক্ষতিপূরণ দিতে চান তাই তো?
সেই ব্যক্তি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। ছায়া বলে,
-আমার এই ফোনটার দাম সাত হাজার ছিল যখন কিনেছিলাম এখন এর বর্তমান প্রাইস তিন হাজার হবে বলেও মনে হয় না। চলুন ৫০% দিতে চেয়েছেন একটা হাজার টাকার নোট দিয়ে চলে যান। আপনিও শান্তি পাবেন আর আমিও বাঁচবো।
-বেশ হিসেবি আপনি। ইম্প্রেসিভ।
-তা বলতেই পারেন। এখন দিন দিয়ে তারপর আমায় উদ্ধার করুন। আমাকে বাড়ি পৌঁছুতে হবে।
আর কথা বাড়ালো না সে, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে হাজার টাকার একটা নোট বের করে ধরিয়ে দিলো ছায়ার হাতে। তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো।
-শুনুন।
ছায়া ডাকলো, সে পেছন ফিরে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো কী হয়েছে।
-আপনার নামটা?
-ওহ, মেঘ। আমার নাম মেঘ।
-ভালো থাকবেন মেঘ, আপনার মনটা খুব ভালো এই রকমই থাকুন দোয়া করি।
-থ্যাংকস।
দু’জনেই হেসে যে যার পথে এগোলো।

সন্ধ্যে সাতটা ত্রিশ মিনিট। রাফিদ এসেছে মায়ের অফিসে, মায়ের সাথে দেখা করতে হবে তাকে। খুব আর্জেন্ট। সে কাউকে কিছু না বলে সোজা মায়ের কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু কথা শুনতে পায় সে। তার কেমন একটা সন্দেহজনক বল্র মনে হয় কথাগুলো।

চলবে…..