রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-২+৩

0
4

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

খটখট শব্দ তুলে মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে৷ জানালার উপর ঝুলে থাকা পর্দাগুলো উড়ছে৷ রোদের আলো ঘরে প্রবেশ করতে না পারলেও বারান্দায় কিছুটা লুটোপুটি খাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দ্বারা চুল ঠিক করছে প্রলয়৷ গায়ে তার সাদা শার্ট জড়ানো৷ মেদহীন আঁটসাঁট দীর্ঘ দেহ৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পারফিউম নিয়ে নিজের গায়ে স্প্রে করল৷ এরপর আলমারির ভেতরে চাবি ঝুলিয়ে রাখা ছোটো ড্রয়ার খুলে রিভলবার বের করল প্রলয়। এটার লাইসেন্স আছে। শত্রুপক্ষের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে— এটা সবসময় পাশেই থাকে৷ জুতোর ফিতা ঠিক করে লাগিয়ে শয়নকক্ষ থেকে বের হয়ে গেল সে৷ যাবার আগে নিজের ঘরে তালা আটকে নিল৷ গত একবছর যাবৎ এমনটাই করে আসছে সে৷ এই ঘরে অর্পণ‚ পূর্ণতা আর পুষ্পিতা ছাড়া আর কারো আসার অনুমতি নেই৷ এমনকি— মাধুরীরও না।

বৈঠকখানায় তখন সবাই বসে ছিলেন। রান্নার ঘর থেকে মাধুরী পানের বাটা নিয়ে এসে বসলেন। উনার স্বামী মোর্শেদ শিকদার‚ দেবর মেহরাব শিকদার আর তার স্ত্রী ফিরোজাও এখানে বসে আছে। উনাদের চারজনের জন্য বেশ ভালো করে পান বানালেন মাধুরী। কথায় কথায় মনে পড়ল কতদিন ছেলের সঙ্গে শান্তিতে দুদণ্ড কথা হয় না। ছেলের বিস্তর পরিবর্তন অবাক করল উনাকে৷ এই এক বছরে একটু একটু করে মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। মাধুরী হাহুতাশ করতে লাগলেন।

এরই মাঝে প্রলয় আর অর্পণ একেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়েছে। ওদের দুজনের পেছন পেছন পূর্ণর আর পুষ্পিতাও এসেছে। মাধুরী উঠে গেলেন ছেলের কাছে৷ কালকের সেই কথাটা তিনি আবারও পুনরাবৃত্তি করলেন। বিতৃষ্ণা আর ক্রোধে শরীর কাঁপছে প্রলয়ের৷ অর্পণ খেয়াল করছে সবটা। না জানি এখন কোন প্রলয় আসে। পুরুষালি উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর বৈঠকখানার চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনি তুলছে।

“বিয়ে নিয়ে জোর করলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব৷ এণ্ড আই মিন ইট!”

প্রলয়ের শান্ত স্বরের হু’মকি শুনে মাধুরীর মুখ থমথমে হয়ে গেল। ছেলের কাছ থেকে এমন কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও আশা করেননি তিনি। যেখানে তিনি সবার উপর ছুরি ঘুরান। পূর্ণতা পুষ্পিতা ঠোঁট টিপে হাসছে৷ মায়ের থমথমে মুখখানা দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে তাদের৷ অর্পণ ইশারায় দুটোকে হাসি থামাতে বলল। মাধুরী কথা কা’টাতেই জিজ্ঞেস করলেন‚

“কোথাও কী যাবি তোরা?”

উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না প্রলয়। মুঠোফোন হাতে কিছু একটা দেখতে লাগল। কিছুই বুঝলেন না মাধুরী। অর্পণ এগিয়ে এসে বলল‚

“বড়ো মা— আমি আর ভাই একটু বের হব।”

“কোথায়?”

“ওই একটু…”

পুরো কথাটা বলতে পারল না অর্পণ। তার আগেই প্রলয় ফোড়ন কে’টে বলল‚

“এখানে দাঁড়িয়ে এত কথা বলার কোনো মানেই হয় না৷ দেরি হচ্ছে— অর্পণ আয়।”

“এই সমস্ত রাজনীতির পেছনে না ছুটে তোর চাচা আর অর্পণের মতো ডাক্তার তো হতে পারতি।”

“এসব আমার কাছে ঝামেলা মনে হয়। আর ডাক্তারি আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। আমার স্বপ্ন রাজনীতি।”

শেষোক্ত হতেই প্রলয় উপস্থিত সকলের দিকে তাকাল। ছেলের এহেন কথায় বোকা বনে গেলেন মাধুরী। উনার কত ইচ্ছে ছিল— ছেলে মস্ত বড়ো ডাক্তার হবে৷ এই ছেলে তো উনার সকল আশা জল ঢেলে দেয়৷

“এই ছেলেকে বুঝিয়ে কাজ নেই৷”

প্রলয় একবার মেহরাব শিকদারের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন মেহরাব শিকদার। প্রলয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল‚

“তোমাদের কথা আমি বুঝতেও চাইছি না চাচ্চু।”

এদিকে ছেলের এমন খামখেয়ালিপনায় বেজায় বিরক্ত মোর্শেদ শিকদার। ছেলের ব্যবহারে দিনকে দিন আরো ক্রূরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিরোজা বললেন‚

“দেখলেন ভাইজান— প্রলয় কীভাবে কথা বলছে!”

মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “চাচার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা ভুলে গেছ তাইনা?”

“ফর ইয়্যর কাইন্ড ইনফরমেশন— আমি এমনই।”

বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে এলো প্রলয়৷ তার পেছন পেছন ছুটে এলো অর্পণ। ডাক্তারি ছাড়াও তার আরেকটা কাজ হলো প্রলয়ের প্রত্যেকটা কাজে সঙ্গ দেওয়া। যাকে এক কথায় পারসোনাল সেক্রেটারি বলা যায়।

মালঞ্চ নীড় পেছনে ফেলে গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ড্রাইভ করছে প্রলয়। পাশের সিটে বসেছে অর্পণ। খুব দ্রুত এবং বাজে ভাবে ড্রাইভ করছে প্রলয়৷ নিয়ন্ত্রণে না এলে খারাপ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। প্রলয়কে থামাতে অর্পণ বলল‚

“ভাই সমস্ত রাগ কী গাড়ির উপর ঢালবে?”

“তুই তো জানিস রাজনীতি আমার স্বপ্ন। দীর্ঘ বছরের তপস্যা।”

অন্যদিকে…

রিকশা হসপিটালের সামনে থামল। ভাড়া মিটাল মৃত্তিকা৷ গুটিয়ে রাখা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে— হাত বাড়িয়ে দিল তনুজার দিকে৷ মেয়ের হাত ধরে রিকশা থেকে নামলেন তিনি৷ সকাল থেকে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল৷ এ কথাটা বলতেই মৃত্তিকা উনাকে জোড় করে হসপিটালে ধরে এনেছে৷ এর আগে ডক্টরের সঙ্গে কনসাল্ট করে এসেছে৷ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দ্বিতীয় ফ্লোরে এসেই হাঁপিয়ে উঠলেন তনুজা। কিছু একটা সমস্যার জন্য আজ লিফট চলছে না। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে উনাকে। ইদানীং শরীরটা খারাপ যাচ্ছে৷ লাগাতার নিশ্বাস নিলেন তিনি। করিডরে বিছিয়ে রাখা সিটে তনুজাকে বসাল মৃত্তিকা। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“মামনি তোমার কী খারাপ লাগছে?”

দূর্বল স্বরে তনুজা বললেন‚ “আমি ঠিক আছি রে মা।”

ব্যাগ থেকে বোতল বের করে— পানি পান করতে দিল। কয়েক ঢোক পানি পান করলেন তনুজা। কিছুটা ভালো লাগছে৷

“মামনি তুমি একটু বোস। আমি রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলে আসছি।”

তনুজা চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে বললেন‚ “হুম!”

এবড়োখেবড়ো ভাঙা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে উদ্যম গতিতে। সাঁই বেগে বাতাস বইছে। দৈবাৎ এ বাতাসে সূক্ষ্ম ও মসৃণ চুল উড়ে যাচ্ছে৷ প্রলয় এক হাতে ড্রাইভ করছে তো অন্য হাত দ্বারা মসৃণ চুল ঠিক করছে। অর্পণ ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে৷ প্রলয়ের মনে পড়ল‚ ‘কাল ওভাবে একটা অচেনা মেয়েকে জড়িয়ে ধরা তার মোটেই উচিত হয়নি। শুধু শুধু একটা মেয়ের কাছে ফেইস লস হলো। পরক্ষণেই ভাবল‚ যা ইচ্ছে ভাবুক। মেয়েটার ভাবনা মাথা ঝেড়ে ফেলে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল। এদিকে অর্পণ ফোনটাকে হাতে নিয়ে প্রলয়কে জিজ্ঞেস করল‚

“ভাই এখন কী পার্টি অফিসে যাবে?”

“আমার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।”

এ মুহূর্তে তামাশা একদম পছন্দ হলো না অর্পণের৷ ‘আল্লাহ ভাইকে এবার একটু গাম্ভীর্য অর্পণ করো।’ অর্পণকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রলয় ভুরু যুগল উঁচিয়ে ইশারা জিজ্ঞেস করল ‘কী হয়েছে?’ অর্পণ ডানে বামে মাথা ঝাকাল অর্থাৎ ‘কিছু না!’ গাড়ি এখনো ছুটছে৷ আজ নির্ঘাত কোনো অঘটন ঘটেই যেত। ভাগ্যিস তখন প্রলয়ের রাগ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গতিবেগ কমিয়েছিল। নীরবতা ভেঙে অর্পণ বলল‚

“ভাই একটা খবর দেওয়ার আছে।”

সামনের দিকে তাকিয়েই প্রলয় বলল‚ “বল আমি শুনছি।”

“জাতীয় পার্টি একটা সমাবেশ আয়োজন করেছে।”

অর্পণের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚ “কবে?”

“পহেলা জুন।”

“এই নিয়ে একটা জবরদস্ত হ্যাপি নিউ ইয়ার পার্টি তো হতেই হবে।”

অর্পণ বোকা বনে জিজ্ঞেস করল‚ “আমরা কেন পার্টি করব ভাই?”

“ভবিষ্যৎ মন্ত্রী আমি— দেশের নাগরিকদের আনন্দে যদি পাশেই না থাকি তাহলে কী হয়?”

কিছুই বুঝল না অর্পণ। তবুও মেকি হাসল। প্রলয়ের কথায় সায় জানাল। এর সঙ্গে থাকতে থাকতে সেও একদিন পাগল হয়ে যাবে। কোন কুক্ষণে যে সে প্রলয়ের সঙ্গ দিয়েছিল৷ রাজনীতি তার কোনো কালেই পছন্দ ছিল না৷ সে তো সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল৷ শুধুমাত্র কাউকে দেওয়া কথা রাখতে— আজ সে রাজনীতির পথে।

“আমাকে একবার হসপিটালে যেতে হবে৷”

“হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিই?”

“না ভাই। একবার পার্টি অফসে যাব তারপর হসপিটাল।”

প্রলয় কিছু বলল না। নেমে এলো অবাক নীরবতা। কালো রঙা গাড়িটা ছুটে চলছে হসপিটালের দিকে৷ সেই দিকে খেয়াল নেই অর্পণের। সে তো গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রয়েছে৷ মিনিট দশেকের মাঝেই হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা। অর্পণ অবাক হয়ে বলল‚

“আগে পার্টি অফিসে যাবার কথা ছিল ভাই।”

“আগে মানুষের জীবন তারপর অন্যকিছু।”

অর্পণে অধর কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল। তার ভাই যে এমনই। সে জানে তার ভাই মানুষ হিসেবে কতটা বেস্ট! তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকেই যায়! দায়িত্ববান এই মানুষটাকে ঘৃণা করে কেউ একজন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে৷ ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছুটা ঝুঁকে প্রলয়কে বলল‚

“ভাই সাবধানে গাড়ি চালাবে।”

চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল‚ “চিন্তা করিস না৷”

অর্পণ ভেতরে চলে গেল৷ প্রলয় একটিবার দেখে নিল পুরো হসপিটাল চত্বর। দৃষ্টিতে ছেয়ে গেল গাম্ভীর্যতা। গভীর কিছু একটা ভাবাচ্ছে তাকে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সে। তার যে আরেকটা কাজ পেন্ডিং এ রয়েছে। সেই কাজটা খুব প্রয়োজন। গাড়ি নিয়ে চলে গেল তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে। বেঁটেখাটো ধরনের দেখতে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রলয়ের গাড়িটা দেখা মাত্রই ছেলেটা এগিয়ে এলো। গাড়ি থেকে নামল না প্রলয়। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল‚

“যা বলেছিলাম— কাজ হয়েছে?”

“হ্যাঁ ভাই।”

“আপডেট কী?”

“উনি এডভোকেট মাহেদ্র রায়চৌধুরী মেয়ে৷”

জাহিদের কথা বিশ্বাস হলো না প্রলয়ের৷ মন আর মস্তিষ্ক যে আলাদা আলাদা কথা বলে। এতটা মিল সত্যিই সম্ভব? পরক্ষণেই মনে হলো‚ শুধু একই চেহারা হলেই হবে না। ভূমির সঙ্গে এই মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আকাশ পাতাল তফাত।

পকেট থেকে হাজার দুয়েক টাকা ছেলেটার হাতে তুলে দিয়ে গাড়ির জানালা তুলে বসল। মনে মনে দু তিনটে কথা আওড়াল‚

“আমার পাওয়ার সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা জন্মায়নি মিস মৃত্তিকা৷ ভবিষ্যৎ মন্ত্রী আমি৷ ভালো বুদ্ধির সঙ্গে কুটিল বুদ্ধি আমারও আছে৷ কিছু প্রমাণ আমার হাতে হাতে প্রয়োজন।”

প্রলয় বাঁকা হাসল। গাড়ি নিয়ে চলল পার্টি অফিসের দিকে৷ এবার বাকি কাজগুলো করা যাক। আধ ঘণ্টার মাঝেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে গেল প্রলয়৷ চশমাটা ঠিক করে গাড়ি থেকে নামল। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন গার্ড সালাম জানাল। প্রলয় সোজা চলে গেল ভেতরে৷ তিনজন লোক সেখানে বসে রয়েছে৷ দুজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো তাদেরই অনুচর হবে। একজন এগিয়ে এসে প্রলয়কে বসলে দিল। প্রলয় পায়ের ওপর পা তুলে বসল। চোখমুখে গম্ভীর ভাব। এখানে আসার আগে রবিন আর শিহাবকে কল করে আসতে বলেছে। ওরা এলো বলে৷ প্রলয় কাউন্সিলরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“পরপর তিনবার বৃদ্ধ ভাতা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায়নি কেন?”

কাউন্সিলর শামসুদ্দিন শুকনো ঢোক গিললেন৷ ভাতা পৌছাবে কী করে— সব তো তার পকেটে ঢুকেছে৷ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি৷ এমন নীরবতায় গম্ভীরতার মাত্রা তড়তড় করে বাড়তে শুরু করল প্রলয়ের৷ দাঁত চিবিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল‚

“কেন পৌছায়নি?”

এবার মুখ খুলল শামসুদ্দিন‚ “ইয়ে মানে আসলে স্যার…”

“স্টপ! আপনার ইয়ে মানে আসলে শুনতে আসিনি আমি। আগামীকালের মধ্যেই তিনগুণ করে দেবেন নয়তো বাকিটা আমি দেখছি।”

নিজের পকেট থেকে টাকা খোয়াতে হবে ভাবতে বুকটা ভারী হতে শুরু করল৷ শামসুদ্দিন মুখটাকে আঁধার করে রাখলেন। উনার অবস্থা বুঝতে পেরে প্রলয়ের হাসি পেল তবুও নিজেকে গাম্ভীর্যের আবরণে ঢেকে রাখল৷ এরই মাঝে রবিন আর শিহাব এসে পৌঁছেছে৷ একজনের হাতে ব্যান্ডেজ করা তো আরেকজনের কপালে৷ প্রলয় দেখল দুজনকে৷

“একা মা’র খেয়ে কুপোকাত হয়েছিস নাকি দু চার ঘা ওদেরও দিয়েছিস?”

মাথা নিচু করে শিহাব বলল‚ “সমান সমান ভাই।”

শামসুদ্দিন সহ বাকিরাও প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখানে যে আরও তিনজন মান্যগণ্য লোক বসে রয়েছে তাদেরকে পাত্তাই দিচ্ছে না প্রলয়। মনে হচ্ছে যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই এখানে। রবিন আর শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলল‚

“এই না হলে আমার অনুচর।”

কথাটা বলে প্রলয় থামল। বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল‚

“এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকার কিছু হয়নি। আমি জানি— আমি যথেষ্ট সুন্দর। অযথা নজর লাগাবেন না।”

উপস্থিত সকলে বোকা বনে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল৷ প্রলয় উঠে দাঁড়িয়ে আবারও বলল‚

“শামসুদ্দিন সাহেব— যা বলেছি মনে থাকে যেন।”

“জি স্যার মনে থাকবে।”

প্রলয় হনহন করে বেরিয়ে গেল। তার পেছন পেছন রবিন আর শিহাবও বেরিয়ে গেল৷ টেবিলের উপির রাখা পানি ঢকঢক করে পান করলেন শামসুদ্দিন। গলা শুকিয়ে কাট হয়ে ছিল। সাহস হয়ে উঠছিল না পানি খাওয়ার৷

ব্যস্ত শহর। এ শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানান ধর্মের মানুষ। জীবিকা নির্বাহের জন্য না চাইতেও তাদেরকে কাজের পিছু ছুটতে হচ্ছে। বাস স্টপেজে বসে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে মৃত্তিকা। সবার মতো ব্যস্ততায় ঘেরা জীবন তো তারও। আজ একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল৷ ইন্টারভিউ বেশ ভালোই হয়েছে তবে তিনদিন পর কলে জানিয়ে দেবেন কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে৷ হুট করে কোত্থেকে এক গাড়ি এসে শব্দ করে থামল বাস স্টপেজে। এতক্ষণ মাথাটা নিচু করে বসেছিল মৃত্তিকা। এবার মুখ তুলে তাকাতেই কালকের সেই বেহায়া লোকটাকে দেখতে পেল। গাড়ির কাচ নামানো বিধায় প্রলয়ের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল মৃত্তিকা। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে। কিছুটা অপমানিত বোধ করল প্রলয়। সূক্ষ্ম রাগ উঁকি দিল মস্তিষ্কে। গাড়ি থেকে নেমে চাবিটা পকেটে ঢুকাল৷ মৃত্তিকার সামনে এসে দাঁড়ালেও কোনো গুরুত্ব পেল না৷ রাগে শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। মৃত্তিকার ডান হাতের কনুই বেশ জোরে ধরল। মুখ থেকে আহ্! শব্দ বেরিয়ে এলো। রণমুর্তি ধারন করল রমণী। কর্কশ গলায় বলল‚

“এ কী ধরনের অসভ্যতা?”

একটা নির্জন জায়গায় এনে হাত ছাড়ল প্রলয়। মৃত্তিকার হাতটা কিছুটা রুক্ষ ভাবে ধরেছিল সে৷ চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে কনুইয়ের অংশে। মৃত্তিকার সত্যি জানার জন্য প্রলয় অধৈর্য হয়ে উঠল। প্যান্টের পকেট থেকে রিভলবার বের করে মৃত্তিকার মাথায় ঠেকাল।

“হু দ্যা হেল আর ইউ? আপনার সাহস কী করে হয় আমার উপর রিভলবার তাক করার।”

প্রলয় বাঁকা হেসে বলল‚ “এমপি সেহরিশ আরশান প্রলয়কে সাহসের কথা জিজ্ঞেস করছ! আমার সাহসের দেখেছ কী? একটা ট্রিগার চাপলেই তোমার খেল খতম৷ সত্যি করে বল— তোমার নাম কী?”

অকপটেই পাল্টা জবাব এলো‚ “মৃত্তিকা রায়চৌধুরী।”

একটু থেমে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “ডটার অফ এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী এণ্ড তনুজা রায়চৌধুরী।”

প্রলয়ের বিশ্বাস হলো না। একই ভঙ্গিতে মৃত্তিকার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ অন্যকেউ হলে ভয়েই জ্ঞান হারাত। অথচ এই মেয়ে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ এত সাহস পাচ্ছে কোথায়? প্রলয়ের মনে পড়ল— ‘একজন তো রিভলবার দেখলে ভীষণ ভয় পেত। একবার তো এমনও হয়েছে ড্রেসিং টেবিলের উপর রিভলবার দেখে ভূমি খুব ভয় পেয়েছিল আর সারাদিনে একবারও প্রলয়ের মুখদর্শন পর্যন্ত করেনি। পাছেই না প্রলয় রাগে রিভলবারের নল গুলো তার মাথাতেই ঠুকে দেয়।’

কথাগুলো মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠল প্রলয়। কত ভীতুই না ছিল তার ভূমি। তবে এই মেয়ে পরিপূর্ণ আলাদা। দুজনের চেহারায় এত মিল কী করে হতে পারে? তবে স্বভাব? স্বভাব তো মিলছে না? ভূমি যদি পানি হয় এই মেয়ে তো আগুন। অনেক কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলা হয়ে উঠল না প্রলয়ের। রিভলবার নামিয়ে নিল। মৃত্তিকার মুখভঙ্গি রুক্ষমূর্তি ধারণ করল। সে বিদ্রুপের স্বরে বলল‚

“কী ভেবেছেন— সামান্য এই রিভলবার দেখে আমি মৃত্তিকা ভয় পাব?”

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

পতনোন্মুখ আরক্তিম গোধূলিলগ্ন। নীলচে আকাশ ধূসর হচ্ছে৷ অলিগলির ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ বাতিগুলো একে একে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ জুড়ে পাখিরা খেয়ালখুশি উড়ে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে৷ ঘরে ফেরার তাড়া তো সবারই আছে— ওদেরও রয়েছে। বারান্দায় রেলিঙের উপর দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণ। পশ্চিমাকাশে তাকিয়ে দেখছে দিবসপতির পতন। হসপিটাল থেকে সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছে৷ আসার পর থেকেই নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে অবরুদ্ধ রেখেছে। বাবার প্রতি চড়াও হয়েছে বিস্তর অভিমান। এই একটা মানুষের জন্য দুটো জীবন নষ্ট হয়ে গেল৷

“তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করব না বাবা৷ তুমি বাবা হয়ে কী করে নিজের সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলে? আই হেইট ইউ।”

অদ্ভুত বিষণ্ণতায় সন্ধ্যা গড়াল। যামিনী তমসাবৃত হলো। অলিগলির ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ রশ্মি একে একে দৃশ্যমান হতে শুরু করল। অর্পণ সেদিকপানেই চেয়ে রইল। গভীর আঁখিপল্লব অশ্রুপ্লুত। নিজের অপারগতায় ক্রোধাগ্নি জ্বলে উঠল। অন্তঃকরণ হতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ বিছানার উপর অযত্নে পড়ে থাকা মুঠোফোন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে। এই সময় কে-ইবা তাকে স্মরণ করবে। ডান হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা সিক্ত নেত্র যুগল মুছে ফেলল৷ এরপর বড়ো বড়ো পা ফেলে শয়নকক্ষে প্রবেশ করল অর্পণ। ফোনে হাতে নিলে স্ক্রিনে “ইরাবতী” নামটা দৃষ্টিগোচর হলো৷ অন্যসময় হলে অধর কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মিলত অথচ আজ তার কোনো অনুভূতি কাজ করছে না৷ নিজেকে নিস্পৃহ গোছের মনে হচ্ছে৷ ফোনটা এখনো বেজে যাচ্ছে৷ কথা বলার উৎসাহ পাচ্ছে না সে৷ অবহেলায় কল কে’টে গেল। সেকেন্ড তিন চারেকের মাঝে আবারও বেজে উঠল। রিসিভ করল অর্পণ। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

“আপনি কী ভুলে গেছেন আজ আমাদের দেখা করার কথা ছিল?”

একটু থেমে ইরা আবারও বলল‚ “ওহ্হো আমি তো ভুলেই গেছি— দ্য গ্রেট তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ তো খুবই ব্যস্ত মানুষ। গার্লফ্রেন্ডকে সময় দেওয়ার মতো সময় কী উনার আছে নাকি!”

অর্পণ কিছু বলল না। কিছুটা একা থাকার অভিলাষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল৷ প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষারত রমণী উত্তর না পেয়ে ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“কী হলো— কথা বলছ না কেন? আদৌ তুমি কলে আছ তো?”

“ইরাবতী আই নিড সাম স্পেস।”

“হঠাৎ কী হলো তোমার? সকালেও তো বেশ হাসিখুশি ছিলে। কিছু নিয়ে কী মন খারাপ?”

“আ’ল কল ইউ ব্যাক।”

অর্পণকে বেশি ঘাটল না ইরা। প্রত্যুত্তরে শুধু বলল‚ “ইয়াহ শিওর!”

পড়তে বসেছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। বিকেলে টিউটর এসে দুজনকে পড়িয়ে দিয়ে যান৷ কলেজ ছাড়া বাহিরে যাওয়ার অনুমতি নেই ওদের৷ প্রলয় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। খাতাটা বন্ধ করে পুষ্পিতা একপলক পূর্ণতার দিকে তাকাল। পূর্ণতা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। মেয়েটা বেশ গম্ভীর ধাঁচের— একদম বড়ো ভাইয়ার মতো। তার থেকে কয়েক মিনিটের বড়ো। পুষ্পিতা ডাকল‚ “পূর্ণ?”

বইয়ে মুখ গুজে রাখা পূর্ণতা এবার বোনের দিকে তাকাল। চশমাটা ঠিক করে ইশারায় জিজ্ঞেস করল‚ “কী হয়েছে?”

“ক্ষিধে পেয়েছে আমার। চল না হালকা কিছু খেয়ে‚ পড়তে বসি?”

“পড়তে বসলেই তোর ক্ষিধে পায়?”

মেকি হাসল পুষ্পিতা। তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেল। পূর্ণতা তবুও উঠল না৷ আবারও আগের ন্যায় পড়তে শুরু করল৷ পুষ্পিতা এবার বোনের বাহু ঝাকিয়ে বলল‚

“প্লিজ বোনু— চল কিছু একটা খেয়ে তারপর পড়তে বসি!”

পুষ্পিতার জ্বালায় আর বসে থাকতে পারল না পূর্ণতা৷ দুজনে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। বৈঠকখানা পেরিয়ে রান্নাঘর। এই মুহূর্তে কেউই এখানে নেই৷ পূর্ণতা ঝটপট দুটো ম্যাগি নুডলস রান্না করে ফেলল। সেই সঙ্গে দুজনের জন্য দুটো অমলেট। এরপর খাওয়া শেষ হতেই আবারও স্টাডি রুমে চলে এলো তারা৷ বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই পুষ্পিতা আবারও ডাকল পূর্ণতাকে।

“পূর্ণ!”

“আবার কী দরকার তোর?”

“মায়ের কাছ থেকে তুঁতে শাড়িটা নিয়ে দিবি— প্লিজ।”

“মায়ের শাড়ি দিয়ে কী কাজ তোর? আমি চাইব আর মা আমাকে শাড়ি দিয়ে দেবে?”

“আমার না শাড়িটা খুব পড়তে ইচ্ছে করছে। তোকে তো মা বেশি আদর করে৷ প্লিজ জোগাড় করে দে।”

“আমি পারব না৷ তুই গিয়ে চাচি মাকে পটা। তিনি তোকে সাহায্য করতে পারবে।”

আবারও বইয়ে মুখ গুজল৷ না এই মেয়েকে বই আর পড়া থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। পড়াশোনার উপর চরম বিরক্ত পুষ্পিতা৷ তার ভালো লাগে আঁকিবুঁকি করতে‚ ঘুড়ি উড়াতে আর আড্ডা দিতে৷ আর পূর্ণতা? সে তো তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে গাছ লাগাতে‚ রান্না করতে আর পড়াশোনা ভালোবাসে। পুষ্পিতা এবার একটু মজা করার উদ্দেশ্য ডাকল‚

“অ্যাই পূর্ণ?”

“এবার কিন্তু মা’রব। চুপচাপ পড়।”

সশব্দে খিলখিল করে হেসে উঠল পুষ্পিতা। মুখ তুলে চাইল পূর্ণতা৷ এই মেয়ের কার্যকলাপে মাঝে মাঝে বোকা বনে যায় সে। কতটা চঞ্চল এই মেয়ে। আর সে? সে তো বিপরীতমুখি।

ব্লেন্ডারে শুকনো মরিচ পিষছে মৃত্তিকা৷ লোকটার সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। সাহস আছে বলতে হবে। তা নাহলে দিনদুপুরে মাথায় রিভলবার ঠেকাতে পারে? ইচ্ছে করছে লোকটাকে ক্রোধানলে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে৷ সাহস কী করে হয়— এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ের মাথায় রিভলবার তাক করার৷ ভেবেছে সে ভয় পাবে! অথচ লোকটা জানেই না তার কাছেও রিভলবার ছিল। বাঁকা হাসল মৃত্তিকা৷ একটা স্প্রের বোতল ভালো করে ধুয়ে নিল। এরপর সেটাতে শুকনো মরিচের গুড়ো সেই সঙ্গে পরিমাণ মতো পানি নিয়ে নিল। এরপরের বার যা হবে সমানে সমানে। সে-ও কারো থেকে কম যায় না৷ কোথাকার কোন এমপি এলো রে। তাকে নাকি ভয় পেতে হবে। এক একটাকে দেখে নেবে সে। হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে উঠতেই ভাবনাচ্যুত হলো। হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাতখানা ভালো করে ধুয়ে নিল। এরপর দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সদর দরজা খুলেই পরিচিত কাউকে দেখে খুশি হয়ে গেল মৃত্তিকা।

“হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কেমন আছ দিদিভাই?”

“আগে তো ভেতরে আসতে দিবি।”

মেকি হেসে জিভে কামড় দিল মৃত্তিকা৷ সশব্দে হেসে উঠল সুদর্শিনী৷ মৃত্তিকা দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। চেয়ারে বসে ছিলেন তনুজা৷ সুদর্শিনী ভেতরে প্রবেশ করেই তনুজাকে প্রণাম করল৷ সুদর্শিনী হচ্ছে তনুজার বোনের মেয়ে। ভালোমন্দ অনেক কথাই জিজ্ঞেস করলেন তনুজা। মৃত্তিকা দরজা আটকে দিয়ে ওদের কাছে এসে সুদর্শিনীর পাশে বসল।

“আমি তো ভালোই আছি। তারপর বল— তোর কী খবর?”

“আ’ম অলওয়েজ ফিট এন্ড ফাইন। জামাইবাবুকে তো নিয়ে আসতে পারতে দিদিভাই।”

“তোর জামাইবাবুর সময় হচ্ছে না। ব্যবসার কাজে সিলেট গিয়েছে।”

এরপর তিনজনে খোশগল্পে মেতে উঠল তিনজন। সুদর্শিনীকে পেয়ে মৃত্তিকা যেন সবকিছু বেমালুম ভুলে গেল৷

বিছানার উপর বসে আছেন মাধুরী আর ফিরোজা। দু জায়ের মাঝে গল্পগুজব চলছে। এরই মাঝে মাধুরীর ফোনে কল এলো৷ উনার মা কল করেছেন। তিনি কল রিসিভ করেই সালাম জানালেন৷ ওপ্রান্ত থেকে কিছু শুনতে পেলেন না ফিরোজা৷ তিনি চুপ করে মাধুরীর কথা বলার ভঙ্গি দেখছেন। মাধুরী উনার মাকে বললেন‚

“আর বোলো না মা। অলক্ষ্মী মেয়েমানুষ। মরেও শান্তি দিচ্ছে না৷ কোথায় ভাবলাম ছেলের বিয়ে দেব— তা আর হলো কই?”

মাধুরীর কথা বলার ধরনে খানিকটা খারাপ লাগল ফিরোজার৷ শত হোক ভূমি উনার খুব আদরের ছিল। ওপর পাশ থেকে কী কথা বলছে কিছুই শোনা গেল না‚ “………”

মাধুরী বললেন‚ “তাহলে কালই তৃপ্তিকে পাঠিয়ে দাও।”

“………”

কল কে’টে গেল। ফিরোজা জিজ্ঞেস করলেন‚

“মাওই মা কী বললেন গো ভাবি?”

“আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে তৃপ্তি— ওকে মা আমাদের এখানে বেড়াতে পাঠাবেন। মেয়ে নাকি দেখতে শুনতে বেশ ভালো। ছোটো থাকতে মেয়েটাকে একবার দেখেছিলাম।”

রাত তখন আটটা…

ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রলয়। ঘর্মাক্ত শরীরের সাদা শার্টটা লেপ্টে রয়েছে। মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো। কালো গোল ফ্রেমের চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আঁখিদ্বয় র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছাদিত কামরায় প্রবেশ করেই গা থেকে শার্ট খানা খুলে ফেলল সে। শনশন শব্দ তুলে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়৷ সারাদিন নিজেকে কাজের মাঝে ডুবিয়ে রাখলেও দিন শেষে সে ভালো নেই। ভূমির শূন্যতা তাকে ভস্ম করে দিচ্ছে। একটা ভুল তার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অবিশ্বাস করার ফল সে পাচ্ছে এবং পেয়ে যাচ্ছে। আদতে কী মেনে নিতে হবে তার ভূমি আর নেই। মেয়েটা নিজের কথা রেখেছে। পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। ভূমির অস্তিত্ব কোথাও নেই— কোত্থাও না! বুক ভারী হয়ে এলো প্রলয়ের। সারাক্ষণ নিজেকে কাটখোট্টা প্রমাণ করা লোকটার নেত্র কোণে অশ্রুকণা উঁকি দিল৷ কম্পিত কণ্ঠে গুনগুনিয়ে উঠল প্রলয়‚

❝আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন‚
তোমাতে করিব বাস;
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনি দীর্ঘ বরষ মাস!❞

[রবীন্দ্র সঙ্গীত]

কৃষ্ণবর্ণীয় বিশাল অন্তরিক্ষ। বাতাবরণে দাবদাহ মেশানো৷ শাড়ির আঁচলে মুখশ্রী আর গ্রীবায় জমে ওঠা বিন্দু ঘাম মুছে নিল মৃত্তিকা৷ রান্নাঘরের তপ্ত দহনে ঘাড়ের কাছে ছোটো চুলগুলো এলোমেলো লেপ্টে রয়েছে৷ মাত্রই রান্না করেছে সে। দুজনের জন্য রান্না করা ছিল কিন্তু এতে করে সবার হবে না। তাই আবারও রান্না করতে হয়েছে তাকে। যখন ইচ্ছে তখনই মাসিমণিকে চাইলে দেখতে আসতে পারে না সুদর্শিনী। ব্যস্ততার কারণে আসা হয় না। মাস ছয়েক আগে এসেছিল। রান্নার কাজ শেষ হতেই ঘরে এলো মৃত্তিকা৷ শয়নকক্ষে ঘুমচ্ছে সুদর্শিনী। আনন্দের খবর এই যে‚ সে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। খবরটা শোনা মাত্রই খুশিতে আত্মহারা মৃত্তিকা। সেই সঙ্গে তনুজাও খুব খুশি হলেন। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন বোনঝিকে। ছোট্টো একটা প্রাণ একটু একটু করে মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠবে। আধ আধ বুলিতে তাকে ‘মিম্মি’ বলে ডাকবে। ভাবতেই চিত্তচঞ্চল হয়ে উঠল। পাশাপাশি বিষাদের নীল বি’ষে জর্জরিত হৃদয়— আঁধারিয়া আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। নারী হিসেবে সে যে অপরিপূর্ণ।

হাত খোপা করে রাখা চুলগুলো খুলে দিল মৃত্তিকা। লতাপাতা ন্যায় পেচিয়ে থাকা ঘন দিঘল কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ সমগ্র কোমড় জুড়ে বিছিয়ে গেল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তাচ্ছিল্য করে হাসল মৃত্তিকা৷ এ হাসি অস্বাভাবিক আর জটিল। ছোটো ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা কাঁকই তুলে নিল। চুলে বিনুনি গাঁথতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে৷ এলোমেলো জড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো কাঁকইয়ে মিশে রইল অনেকখানি। বিনুনি গাঁথা হয়ে গিয়েছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবারও পর্যবেক্ষণ করল মৃত্তিকা৷ এরপর বিছানার কাছে এগিয়ে গেল৷ হাঁটার সঙ্গে লম্বা বিনুনি দোল খাচ্ছে৷

“অ্যাই দিদিভাই ওঠ!”

ঘুম ভাঙল না সুদর্শিনীর৷ মৃত্তিকা আস্তে করে আবারও ডাক দিল। কাজে দিয়েছে হয়তো। নড়েচড়ে উঠল সুদর্শিনী। আধবোজা চোখে পিটপিট করে তাকাল৷ মৃত্তিকাকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। শোয়া থেকেই আড়মোড়া ভাঙল। উঠে বসতেই সুদর্শিনীর পাশে গিয়ে বসল মৃত্তিকা।

“রাত হচ্ছে৷ খাবারে অনিয়ম করা যাবে না দিদিভাই।”

চোখ বন্ধ করে গাল এলিয়ে আবারও হাসল সুদর্শিনী। মেয়েটা যে কতটা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সেটা সে ভালো করে জানে। মেয়েটার প্রতি তার একটা আলাদা টান অনুভূত হয়। ইচ্ছে করে বুকের ভেতরটায় লুকিয়ে রাখতে। মেয়েটাকে দেখতেই ভীষণ আদর আদর পায়। হাই তুলে সুদর্শিনী জিজ্ঞেস করল‚

“খালামণি বলল‚ আজ নাকি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলি? নাচের ক্লাসের ইন্টারভিউ কেমন ছিল?”

“ভালোই হয়েছে। তিনদিন পর জানাবে।”

“তুই ভালো নাচিস৷ দেখবি তুই-ই সিলেক্ট হবি।”

“তাই-ই যেন হয়! চল দিদিভাই খেয়ে নিবি।”

“আজকের খাবার কে রান্না করেছে— তুই নাকি মাসিমণি?”

“মামনির কাজ করা বারন। আমিই রেঁধেছি।”

“তুই বোস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

মৃত্তিকা চোখের পলক ঝাপ্টে সায় জানাল। সুদর্শিনী চলে গেল ওয়াশরুমে। এলোমেলো বিছানা চট করে গুছিয়ে নিল মৃত্তিকা। বসার ঘরে টিভি দেখছেন তনুজা৷ উনার প্রিয় সিরিয়াল হচ্ছে। সেটা কী মিস করা যায় নাকি?

নিশীথে ঘুম হলো না প্রলয়ের৷ রাত তিনটে অবধি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। শত চেষ্টা করেও আঁখিপল্লবে ঘুমি উঁকি দেয়নি। শ্যাম শ্রীতে গভীর চিন্তার ভাজ। তারাহীন দূরাকাশে আবদ্ধ পুরুষ চোখ। চোখ দুটোতে ক্লান্তির ছায়া। দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে কু’কুর গুলোর নিষ্ফল চিৎকার৷ রাত বিরেতে এদের মেলা বসেছে। এদের আর কোনো কাজ নেই। ওহ হ্যাঁ কাজ আছে তো! রাত বিরেতে ঘেউঘেউ করে অন্যদের ঘুমের বারোটা বাজানো। সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিল প্রলয়৷ মৃদুমন্দ বাতাস বইছে৷ হরিদ্রাভ বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে— বাতাসের তোড়ে মেহগনি গাছের পাতা গুলো নড়ছে। সেদিকে তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়৷ এই বারান্দায় ভূমির সঙ্গে কাটানো কতশত মুহূর্ত অন্তঃকরণে বাসা বেঁধে রয়েছে। ভাগ্যের পরিহাসে আজ সবই স্মৃতি। শুধুই স্মৃতি।

অস্থিরতার মাঝেই রজনি গড়াল। সকালের রবি উঁকি দিতেই ঘুম পালাল প্রলয়ের নেত্র থেকে। ঘুম পুরো না হওয়ায় চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ মথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে৷ আজ আর ঘুম হবে না৷ উঠে একেবারে গোসল করে বের হলো। নিজেকে একটু হালকা লাগছে এবার। ধবধবে পাঞ্জাবি পরিধান করে আয়নার সামনে দাঁড়াল প্রলয়৷ ঘণ্টা খানেক পর বের হতে হবে৷ হাত দ্বারা চুল ঠিক করছে প্রলয়। হঠাৎ খট করে দুয়ার খোলার প্রতিধ্বনি হলো।

“আসতে পারি?”

কথাটা বলেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল এক তরুণী। আয়নায় প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করা গেল৷ ঘাড় বাকিয়ে তাকাল পেছন দিকে৷ অচেনা কেউ যে বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে— তার জানা ছিল না। মেয়েটাকে চিনতেও অসুবিধে হলো৷ আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে মেয়েটা বলল‚

“হাই! আমি তৃপ্তি জুনাইরাহ।”

“আপনার নাম কেউ জিজ্ঞেস করেছে?”

থতমত খেয়ে গেল তৃপ্তি। প্রলয় আবারও বলল‚

“উইদাউট পারমিশন— আমার ঘরে প্রবেশ করার সাহস কারো নেই।”

“কিন্তু আমি তো আসতেই পারি।”

“হোয়াট? হু দ্য হেল আর ইউ?”

প্রলয়ের গম্ভীর শান্ত স্বরে ভরকে গেল তৃপ্তি। অপ্রতিভ‚ কিংকর্তব্যবিমূঢ় রমণীর পা সেখানেই স্থির হলো। অচেনা কারো সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? জানা ছিল না! ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষকে দেখে হৃদয়ে সুপ্ত ডঙ্কা বেজে উঠল। বুকে দ্রিম দ্রিম মাদল বাজছে৷ সাদা টাইলসের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখল তৃপ্তি। লোকটার চোখের দিকে তাকানো দায়। গম্ভীর স্বরে প্রলয় আবারও বলল‚

“আউট।”

তৃপ্তি মুখ তুলে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। প্রলয় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল‚

“কানে কী শুনতে পান না? আই স্যে আউট।”

কেঁপে উঠল তৃপ্তি। কোমল হৃদয় অপমানে জর্জরিত হলো। প্রলয়ের প্রতি কিঞ্চিৎ রাগ অনুভূত হলো৷ মাধুরীর কথা শুনে পারমিশন ছাড়া এই ঘরে আসা একদমই উচিত হয়নি তার। তিনি তো বলেছিলেন‚ এই লোক অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। অথচ দেখছে তার উল্টোটা৷ আজকের দিনটা বোধহয় তার জন্য শুভ নয়৷ নীরবতায় আচ্ছাদিত কামরা থেকে বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেল তৃপ্তি। প্রলয় নিজের কাজে ব্যস্ত হলো।

রান্নাঘর থেকে চা আর নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলো মৃত্তিকা। সুদর্শিনী আর তনুজা বসে অপেক্ষা করছে৷ সময় মতো নাস্তা আর ঔষধ খেতে হয় তনুজাকে৷ টি টেবিলের উপর ট্রে রেখে মৃত্তিকা দৌঁড়ে গেল শয়নকক্ষে৷ ঔষধের বক্সটা নিয়ে এসে টি টেবিলের উপরই রাখল সে। চা পান করার ফাঁকে সুদর্শিনী বলে উঠল‚

“মাসিমণি চল না কোথা থেকে ট্যুর দিয়ে আসি। বাড়িতে থাকতে বোর হচ্ছি খুব।”

খাওয়া ছেড়ে সুদর্শিনীর দিকে তাকিয়ে শুধালেন‚ “এই শরীর নিয়ে কোথায় যাবি?”

“এ সময় মন ভালো রাখতে হয়। আমার কিছু হবে না৷ প্লিজ চল না কোথাও যাই। অ্যাই মৃত্তিকা— তুই একটু বোঝা না মাসিমণিকে।”

ইশারায় মৃত্তিকাকে ইমোশনাল ব্ল্যা’কমেইল করল সুদর্শিনী। এবার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে মৃত্তিকা৷ একমাত্র সে-ই পারে মাসিমণিকে রাজি করাতে। হলো-ও তাই! তনুজাকে উদ্দেশ্য করে মৃত্তিকা বলল‚

“মামনি চল আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

তনুজা অবাক চোখে তাকালেন মৃত্তিকার দিকে৷ মেয়েটা তো আগে কখনো গ্রামের নাম মুখে আনেনি। আজ হঠাৎ যেতে চাইছে? মাহেন্দ্র বেঁচে থাকতেও তো কতবার যেতে চেয়েছিলেন অথচ মেয়ে কিছুতেই রাজি হয়নি। উনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা বলল‚

“প্লিজ মামনি। মাত্র দুদিনের জন্য যাব।”

“আমরা গিয়ে থাকব কোথায়?”

“তার ব্যবস্থা আমি করে নেব। তুমি শুধু পারমিশন দাও।”

“তাহলে চল।”

খুশিতে সুদর্শিনী আর মৃত্তিকা দুজনেই ‘ইয়ে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ তনুজা কানে হাত দিলেন। মেয়েদের বাচ্চামিতে খিলখিল করে উঠলেন তিনি।

চলবে?…..