শান্তি সমাবেশ পর্ব-১৭

0
784

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭

— আমি আর কখনো ওনাকে চাইব না আব্বু। হি ইজ এ লস্ট গায়।

মেয়ে’র অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মৃন্ময় হাওলাদার। এদিন তার কাছে পূর্ণ’র আবদার করেছে। কত প্রশংসা শুনেছে। যেই মেয়ে তার রাজনীতি বুঝে না সে কি না বাবা’র বুকে শুয়ে রাজনীতি’র গল্প জুড়ে দিত। কত কি জানতে চাইত। মেয়ে’র অভিমান তার অজানা নয়। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

— আমি আগেই বলেছিলাম আম্মা। কোন কিছুকে আসক্তি বানাতে নেই। তামাকের আসক্তি যেমন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনই এক রোগ হলো এই প্রেমাসক্তি। ধীরে ধীরে আপনাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিবে। একদিন ছেড়ে দিবে। তখন আপনি কুল খুঁজবেন৷ বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন কিন্তু কেউ হাত বাড়াবে না। আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।

মৃত্তিকা এক দৃষ্টিতে বাবা’র দিকে তাকিয়ে রইলো। এত গভীর কথা বাবা কেন বলছে তাকে। কখনো তো এসব বলে না। বাবা’র এক গালে নিজের হাত ছোঁয়াতেই বাবা তাতে চুমু খেল। মৃত্তিকা বাবা’র চোখে তাকালো। গাঢ় বাদামী রঙের মনি। ঘন পল্লব বিশিষ্ট তার চক্ষু। মৃত্তিকা ছুঁয়ে দিলো তাতে। পলক ঝাপটালেন তিনি। মেয়ে আঙুলে চুমু খেয়ে আবারও বলে উঠলেন,

— বাবা কখনো আপনাকে কিছুতে জোর করি নি আম্মা। আজও করব না। আপনি যথেষ্ট বড় হয়েছেন। ভেবে দেখুন ভুলটা আসলে কার?

— যেমন?

— ধরুন আজ পূর্ণ’র বুকে অন্য একজন মেয়েকে দেখলেন। পরিস্থিতি তো আপনি জানেন না। চোখের দেখা নিশ্চিত ভুল হবে না। মস্তিষ্ককে মানাতে পারবেন না। তখন ভুল ভাবাটা স্বাভাবিক। বিচলিত হওয়া টাও স্বাভাবিক। প্রিয়জন বলে কথা।

একটু থেমে আবারও বলে উঠলেন,

— ভাবুন। সময় নিন মা। নিজেকে কষ্ট দিবেন না৷ ওয়াদা করুন আব্বু’কে।

বাবা’র শক্ত হাতে হাত রেখে ওয়াদা করলো মৃত্তিকা। বেগুনি রঙের ঠোঁটটাতে হাসি ফুটে উঠলো মৃন্ময় হাওলাদারের। মেয়ে’র মন ভুলাতে বললেন,

— বৃষ্টি হচ্ছে এখনও আম্মা। পাকোড়া ভাজা আর চা হবে নাকি?

নাক টানলো মৃত্তিকা বরাবর বাবা’র কাঁধে নাকটা ঘঁষেও দিলো। উঠে বসতে বসতে বললো,

— একদম। মজা হবে।

নিমিষেই যেন মেয়ে’র মাইন্ড ডাইভার্ড করে দিলেন মৃন্ময় হাওলাদার। তবে চিন্তত মন তখনও। পূর্ণ’র থেকে এহেন আচরণ আশা করেন নি তিনি।

________________

প্রায় রাত পর্যন্ত এই বেমৌসুম এর বৃষ্টিতে ভিজলো পূর্ণ। খোলা মাঠে সেই বট বৃক্ষের গোড়ায় বসে স্মৃতি চারণ করেছে বিগত মাসগুলোর। হঠাৎ এক মৃত্ত এলো জীবনে। একদম দমকা হাওয়ার মতো যা শীতল করে দেয় বদন’কে। ঠিক তেমনই তার মৃত্ত। এর আগেও খুব কমই নরম স্বরে কথা বলা হয়েছে তার সাথে। পূর্ণ দেখেছে। পরিক্ষা করেছে তার মৃত্ত’কে এবং তাতে সফল তার মৃত্ত। এত এত ধমক খেয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে কথা শুনে,তেঁজ যুক্ত বাক্য শুনেও মৃত্ত’টা তার অপেক্ষা করা ছাড়ে নি। বরং পূর্ণ’কে মেনেছে তার মতো। তবে আজ কেন তার মৃত্ত মানতে পারলো না? আজ কি তার সহ্য’র বাঁধ ভেঙে গেলো৷ বুকে যেন আগুনের স্ফুরণ ঘটল পূর্ণ’র। শুভ্র পাঞ্জাবিটা গায়ে সেটে গিয়েছে একদম। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ায় পূর্ণ। পকেট হাতড়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো রাত আট’টা। সেই কতঘন্টা ধরে কি না এখানেই বসা সে। হঠাৎ পূর্ণ’র মনটা বলে উঠলো, এভাবে বৃষ্টিতে ছাতা হাতে আর রোদে পুড়ে মৃত্ত’টা অপেক্ষা করতো। পূর্ণ দেড়ী করলেও তার অভিযোগ ছিলো না বরং মাঝে মধ্যে পানির বোতল এগিয়ে দিতো।
মনে পরে পূর্ণ’র। দুই মাস আগের কথা। মৃত্তিকা তখন ভালোই ভয় পায় তাকে। শুধু বুঝি ভয়? হাড় কাঁপানো ভয় যাকে বলে সেটাই পেত মৃত্তিকা। পূর্ণ সেদিন সকালে না খেয়ে বাসা থেকে বের হয়। দুপুরে ক্লান্ত শরীরে যখন মৃত্তিকা’র কাছে এলো তখন দেখলো মৃত্তিকা তার জন্য দুপুরের খাবার এনেছে। পূর্ণ চেয়েও না খেয়ে থাকতে পারে নি। এক বক্সেই ভিন্ন চামচে দুজন খেয়েছিলো সেদিন। তৃপ্তি’র পরিমাণটা ঠাওড় করে পারে না পূর্ণ। রান্নাটাও বেশ চমৎকার ছিলো। মৃত্তিকা বেশ গর্বের সহিত জানায় তার বাবা’র করা রান্না সেটা। পূর্ণ বিস্মিত হয় সেই কথায় তবে প্রকাশ করে নি।
এমন ছোটখাট টুকিটাকি বেশ ঘটনা আছে তাদের। সেগুলো মনে করে করেই পুলকিত হয় পূর্ণ। বাঁধা না থাকলে আজ বেশ সময় কাটাতো ও ওর মৃত্ত’র সাথে।

ফোন কলে ধ্যান ভাঙলো পূর্ণ’র। নাম্বারটা দেখেই তাড়াতাড়ি রিসিভ করে। ওপাশ থেকে শুনা যায়,

— ভাই শ্যালা’রে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় পালিয়েছে। লোক তবুও লাগিয়ে রেখেছি।

মাড়ি শক্ত করে পূর্ণ বলে উঠলো,

— ঐ জা*নো*য়া*রে*র বাচ্চা’কে আমার চা ই চাই। মাটির নিচে ঢুকলেও খুঁড়ে নিয়ে আয়। ওর হাত না ভাঙলে আমার মন শান্ত হবে না। আমার মৃত্ত’কে ছোঁয় ওর ঐ হাত…

পূর্ণ কল কেটে দিলো। খাঁমচে ধরলো চুল৷ কিসের জন্য এত কষ্ট? কার জন্য এত দূরত্ব? যার জন্য এতকিছু তাকে হারিয়ে শেষ মুহূর্তে কি না ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে গেলো? পূর্ণ দ্রুত কদমে হাটা দিলো। কিছুতেই হারানো যাবে না। খুঁজতেই হবে। বেঁচে থাকলে এই ঢাকা শহরের চাপ্পা চাপ্পা খুৃঁজে পূর্ণ তাকে বের করবে।
.
সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা’র সামনে। শোয়েব মির্জা ইজি চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন। সাফারাত হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। বাবা’র দিকে আরেকপলক তাকিয়ে বললো,

— যা বলার বলো আব্বু। নামাজ কাজা পড়া পছন্দ না আমার।

শোয়েব মির্জা চোখ মেললেন। ছেলেকে দেখে নিলেন ভালোভাবে। ছেলের লাল হওয়া চোখ দেখে কিছু ভাবলেন। পরপর বলে উঠলেন,

— পূর্ণ কিছু বলেছে আবারও? কেঁদেছো?

সাফারাত লজ্জা পেলো বাবা’র কথায়। এ যেন সে পাঁচ বছরের সাফারাত’কে জিজ্ঞেস করছেন যে ছেলে কারো বকা শুনে কেঁদেছে কি না? এই প্রসঙ্গে কথা বাড়াতে চাইলো না সাফারাত। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে বলে উঠলো,

— দলের ছেলেরা আজ কাঁকড়াইল মোড়ে ঝামেলা পাকিয়েছিলো৷ সেদিকটা সামাল দিলাম। তোমার ওমরার কি খবর আব্বু? ফ্লাইট কবে?

শোয়েব মির্জা বুঝলেন ছেলে এই বিষয়ে কথা বাড়াতে চায় না। কি দরকার ছেলেটার শুকনো ঘাঁ খুঁড়ে? আদৌ ঘা শুকিয়ে বলে সন্দিহান তিনি। বাবা’র থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে গেল সাফারাত। ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় শক্তিবান শক্ত পুরুষটা। বাইরের শক্ত খোলসটা মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সেজদায় কেঁদে ফেলে সেই আগের ছোট্ট সাফারাত। এমন কেন হলো তার জীবনটা? খুব কি বেশি ছিলো তার চাওয়া? আজ মৃত্তিকা’কে দেখে তার বুকের ছাই চাপা আগুন ফুঁসলে উঠেছে। সেই চেহারাটা কিভাবে ভুলবে সাফারাত? সেই চোখ, সেই চাহনি কি আদোও ভুলার? এতটা সহজ হলে আজ সাফারাত এমন থাকতো না। কোনদিন ও এমন থাকতো না। জীবনটা তার ও পুষ্পসজ্জিত হতো। একদম তার ছোট্ট পুষ্পটার মতো।

________________

আজ প্রায় দুই দিন হলো মৃত্তিকা কোন প্রকার কথা তুলে নি পূর্ণ’কে নিয়ে। বাবা’র সাথে আগের মতো ই থাকছে। তার কষ্ট যে বাবা মাত্রারিক্ত কষ্ট পাচ্ছিলো সেটা মৃত্তিকা টের পেয়েছিলো গভীর রাতে যখন হঠাৎ সজাগ পেয়ে দেখেছিলো গভীর রাতেও বাবা ঘুমায় নি। তার মাথায় বুলাচ্ছিলো গভীর ভাবে। কোন এক অদৃশ্য চিন্তায় ছিলো বাবা। মৃত্তিকা যখন ঘুমুঘুমু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো কেন ঘুমায় নি তখন মৃন্ময় হাওলাদার কোন এক ঘোড়ের মাঝেই মেয়েকে পাল্টা প্রশ্ন করে,

— আম্মা আপনি কাকে বেশি ভালেবাসেন? আমাকে নাকি পূ….

— তোমাকে আব্বু। পুরো পৃথিবী একদিকে তুমি একদিকে। না ভুল বললাম আমার সবটুকু জুড়ে তুমি আব্বু। মাই লাভ। কারো সাথে নিজের তুলনা দিবে না আব্বু। আই ডোন্ট লাইক ইট।

মেয়ের হঠাৎ ঘুমন্ত কন্ঠ থেকে এহেন তাঁজা কন্ঠে বেশ চমকান তিনি। বেরিয়ে আসেন ঘোর কেটে। ততক্ষণে মৃত্তিকা বাবা’কে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। বিচলিত হন মৃন্ময় হাওলাদার। প্রথমে ভাবেন পূর্ণ’র কথা মনে পরাতে কাঁদছে পরক্ষণেই তার ভেতরের বাবা সত্ত্বাটা টের পায় ভিন্ন কিছু। এই কান্না তার জন্য। নিশ্চিত এতরাতে তার ওমন প্রশ্নে ভয় পেয়েছে তার ছানা। তাতক্ষণিকভাবে মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে নেন। অভিযোগ করে মৃত্তিকা কান্নারাত গলায়,

— আ…আর কখনো বলবে না। কখনো না। আমি তোমাকে অনেক ভালেবাসি বাবা। অনেক অনেক। তুমি কোথায় ছিলে? রাতে হঠাৎ চলে গেলে। আমি অপেক্ষা করতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

মৃন্ময় হাওলাদার মেয়ের মাথায় চুমু খান। আদর করেন তার শ্যামা রাজকণ্যাকে। কোঁকড়াচুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

— আপনাকে খারাপ কিছু ছুঁয়ার আগেই বাবা তা গায়াব করে দিবে আম্মা। কখনো কিছুর আঁচড় লাগতে দিবে না।

বাবা’র বুকে তখনও ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় ঢুকে ছিলো মৃত্তিকা। মেয়ে’কে ভুলাতে ডেকে উঠেন মৃন্ময় হাওলাদার,

— আমার ছানা ঘুমাবে না?

— হুলো বিড়াল ইদুর মা’রতে গিয়েছিলো তাই ছানা তার অপেক্ষা করছিলো।

পরপর শুনা গেলো বাবা-মেয়ে’র হাসির ঝঙ্কার। ছানা ডাকলেই মৃত্তিকা বাবা’কে হুলো বিড়াল ডাকবে।
.
জ্বরে’র ঘোরে মাথা কাজ করছে না পূর্ণ’র। এতটা ভয়াবহ তার শেষ কবে হয়েছে মনে পরে না। এরমধ্যে যোগ দিয়েছে মারাত্মক শরীর ব্যাথা। পাশেই ওর মা মাথায় জল পট্টি দিচ্ছেন একবার আর আঁচলে চোখ মুছছেন একবার৷ পূর্ণ’র শক্ত বলিষ্ঠ দেহের উপর দুটো কম্বল দেয়া তবুও যেন কাঁপুনি থামে না। মায়ের আঁচলের এককোণা মুঠোয় পুরে রেখেছে। বাবা গিয়েছে ডক্টর ডাকতে৷
ছেলের কপালে হাত রাখলেন তিনি। এখনও ছোঁয়া যাচ্ছে না। একবার কম্বলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বুকে হাতড়ে দিলেন। পূর্ণ একদম ছোট বাচ্চার মতো মায়ের কোল ঘেঁষে। এতেই যেন ওর মা’র বুক ফেটে কান্না পায়। ছেলেটা তার কঠিন শিলা’র মতো। আজ এমন অবস্থা সেই তার রাগি,জেদি ছেলেটার কিভাবে সহ্য করবেন তিনি?
তখনও বাবা এলেন ডাক্তার নিয়ে৷ জ্বর এখনও একশত তিন ডিগ্রি। পূর্ণ’কে কোনমতে উঠে বসানো গেলো না। মাথা ঘুরিয়ে পরে যেতে নেয় সে। এবার মা কেঁদে ফেললেন। পূর্ণ অস্পষ্ট স্বরে বললো,

— উহহু কাঁদে না।

এরপর আর মনে নেই পূর্ণ’র। সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যায় সে।

একে ঐদিন কয়েক ঘন্টা বেমৌসুম বৃষ্টিতে ভিজেছে তার মধ্যে ঐ ভেজা পোষাকেই ছিলো রাত দুটো পর্যন্ত। কিসের চিন্তা তা কেউ জানে না। বাবা-মা হাজার জিজ্ঞেস করেও তেমন কিছু জানতে পারে নি। গত দুই দিন ধরে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পাগল হয়ে ঘুরছে পূর্ণ। এদিক ওদিক কল দিচ্ছে। লাভ হচ্ছে না। হন্ন হয়ে খুঁজার ফল ছিলো শূন্য।
গতরাতে তার সকল অভিযানের অবসান ঘটে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সারারাত রাস্তায় ছিলো। গা গুলিয়ে উঠতেই পা বাড়ায় বাড়ীর দিকে। দলের ছেলে গুলো বাড়ী পর্যন্ত রেখে যায় তাকে৷
এত এত ধকল। রাজনৈতিক কাজ। দলের কাজ। সাথে গুরুত্বপূর্ণ সেই কাজ। এরমধ্যে খাওয়া দাওয়া, নিজের যত্ন ত্যাগের ফল আজকের এই পূর্ণ। অথচ পূর্ণ জানে তার এই অবস্থার জন্য দায়ী এক নারী। বিষাক্ত নারী নামকরণ করেছে পূর্ণ তাকে। সেই বিষেই জড়জড়িত সে। সেই নারী’র অভাবেই পূর্ণ আজ এতটা ভেঙে গিয়েছে। তার সুঠাম দেহ ভেঙে পড়েছে৷ আঙ্গার হয়েছে তার হৃদয়। বিষবাষ্প দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার শিরা উপশিরায় অথচ বেখবর সেই নারী। তার পূর্ণ্যময়ী।

_________________

কাঁচা বাজারের ব্রিজের নিচে হাত কাটা লা*শ ভেসে উঠেছে। পঁচা অর্ধগলিত দেহ। এক দেখায় চেনা গেলো না। বুঝা গেলো না কে সে। পুলিশে খবর দিতে দিতেই শোরগোল ভেসে উঠলো। মেতে উঠলো জনগণ। নাহলেও দুই দিন আগে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ আসতেই ডেঞ্জার জোন এর বর্ডার দিয়ে দিলেন। হৈ চৈ লেগে গেল এই রাতে৷ টর্চ হাতে জঙ্গলে পাঠানো হলো কয়েকজন পুলিশ’কে৷ তাদের নিকট তেমন কোন নিখোঁজ রিপোর্ট নেই৷ ফুলে উঠেছে পঁচা শরীরটা। বিভৎভাবে হাতটা ছিন্ন করা হয়েছে৷ চোখ দুটো উপড়ানো। পুলিশ অফিসার জোহানেরই গা গুলাচ্ছে৷ নাকে রুমাল চেপে ও রক্ষা নেই। মানুষ জনও তীব্র গন্ধে দূরে দূরে সরে। ম*রা মানুষের গন্ধ বুঝি এতটাই বাজে৷ বলিষ্ঠ দেহটা পঁচা ডোবার পানি খেয়ে খেয়ে ফুলে উঠেছে। লা*শ*টা উল্টো হওয়া ছিলো৷ মূলত ভেসে উঠেছে। যেই না উল্টানো হলো ওমনিই চমকে তাকালেন অফিসার জোহান।

এতক্ষণ চলছিলো লাইফ টেলিকাস্ট। খবরের সেই অর্ধগলিত শরীর এবং চেহারাটা দেহেই ধপ করে বসে পরলেন শোয়েব মির্জা। মাথা ভনভন করছে তার।
.
সকালের আলো ফুটলো। বেশ ঝলমলে দিনটা। তবে কারো কারো কাছে বিষাক্ত বটে। মৃত্তিকা’র বাসায় আজ হিমু আর উজ্জ্বল আসবে। মূলত বাবা’র সাথে দেখা করাবে ও। বাবা ও তো বাসায়।
ওদের সাথে প্রায় ঘন্টা দুই এক কাটিয়ে বাবা অফিসে যান। মিঠি’র মা মিঠি’কে ডাকতেই মৃত্তিকা বলে উঠলো,

— থাকুক না। তুমি যাও। ও থাকুক আমার সাথে।

মিঠি’র মা যেতেই উজ্জ্বল তাকালো মিঠি নামক মেয়েটার দিকে। ছিমছাম গড়নের রোগা পাতলা একটা মেয়ে অথচ সুন্দর। বয়স সতোরে বা ষোল হবে। আন্দাজ করা যায়। ফিনফিনে শরীরে অতি সাধারণ একটা থ্রি পিস পড়া। মাথা এমন ভাবে ঢেকেছে যে মুখটা ও ঠিকঠাক দেখা যায় না। ওর ভাবনার মাঝেই হিমু মৃত্তিকা’কে বললো,

— ভাইয়ের সাথে কথা হয় নি?

মৃত্তিকা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করলো,

— ওনার বিষয়ে কথা বলতে চাই না আমি হিমু৷ ইনায়া কোথায়? ও না আসবে?

— হ্যাঁ আসছে। রাস্তায় আছে।

উজ্জ্বল উত্তর দিয়ে আবারও বললো,

— পূর্ণ ভাইয়ের সাথে কি হইসে তোর বা*ল? মেজাজ চটে যায় একদম। শ্যালা মাইয়া মানুষ ই ঝামেলা তোরা।

মৃত্তিকা আর হিমু উভয়ই কপাল কুঁচকে তাকালো৷ উজ্জ্বল পাত্তা না দিয়ে বললো,

— ওমনি তাকায়া লাভ নাই। তুই ক্যান ওনার সাথে কথা বলস না। ভাই কি না করলো তোর জন্য।

মৃত্তিকা থমকালো। নিজেকে শক্ত করে বললো,

— তুই জানিস না উনি বাজে কথা বলেছে আমাকে উজ্জ্বল। সেই সব কথা শুনার যোগ্য ছিলাম না আমি।
একমাস চৌদ্দ দিন পাগলের মতো ছিলাম। এত অবহেলা সহজ ছিলো না। মেয়ে হয়েও যথেষ্ট সহ্য করেছি ওনার সকল কিছু তবুও বলবি আমার দোষ?

উজ্জ্বল চুপ রইলো কিছু সময়। একে একে খুলে বললো মৃত্তিকা’কে কিছু কিছু। সবটুকু তারাও জানে না। শুধু বললো,

— আমাকে আর হিমু’কে ডেকে নিলো ভাই প্রায় দেড় মাস আগে। একটাই দায়িত্ব দিলো তোকে দেখে রাখতে। তোর সাথে নাকি দেখা করতে পারবে না কিছু কারণে সেটা পরিক্ষা তোকে বলেছে কিন্তু সত্যিটা ভিন্ন। অন্য কিছু আছে। রাজনৈতিক ব্যাপার। তিনি বলেন নি আমরাও ঘাটি নাই।

এতটুকু বলে থামলো উজ্জ্বল। তখনই হিমু বললো,

— রোজ তোর খবর নিতো। একদিন ভোর চারটায় পড়া শেষ করে আমাকে কল করে। প্রায় এক ঘন্টা লাগিয়ে পইপই করে তোর হিসেব নেয়। তুই যে সিঁড়িতে হোচট খেলি সেটা শুনে কেমন করছিলো। আমি না দেখলেও বুঝেছিলাম মৃত্তিকা। পূর্ণ ভাই আর যাই হোক খারাপ না। তোকে ভালোবাসে।

তখনই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠে একজন বললো,

— আমিও তোর বান্ধবী কম চামচা বেশি জান।

ইনায়ার কন্ঠে সবাই পেছনে ঘুরলো। উজ্জ্বল হেসে বললো,

— পূর্ণ ভাই তোর জন্য ওকে কাজের বুয়া রাখসে।

অবুঝ গলায় মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করলো,

— মানে?

ইনায়া দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বললো,

— জান পূর্ণ ভাই তোকে দেখে রাখতেই আমাকে তোর সাথে মিশতে বলেছিল বাট ট্রাস্ট মি আমি মন থেকেই তোকে ভালোবাসি।

মৃত্তিকা থ বনে আছে। সিনিয়র ভাই’টার কোন রুপ এটা? এত এত কেয়ার কোথায় ছিলো এতদিন? মৃত্তিকা তো একবার ও দেখলো না। কেয়ার বলতে চাপা ধমক আর গর্জন ই শুনেছিলো এতদিন মৃত্তিকা।
মস্তিষ্কে তখনই তুখোড় ভাবে ধাক্কা খেলো উজ্জ্বলের কথা,

— ভাই তো দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছে৷ ডেঙ্গু টেস্ট করালো কিন্তু ডেঙ্গু হয় নাই। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে ভর্তি ও রাখতে পারে।

মৃত্তিকা উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা ভনভন করছে যেন। ঢোক গিললো অনবরত। মনে পরলো বাবা’র কথা। বাবা বারবার বলে “তারাহুরোর সিদ্ধান্ত শয়তানের”।

#চলবে…..