#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৯
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দুই নারী-পুরুষ। চোখে মুখে উচ্ছাসে ভরপুর। নড়াচড়ার দরুন নারীটির হাতের চুড়িগুলোর রিনঝিন শব্দ হচ্ছে। পাশে বসেই পূর্ণ একবার তাকালো সেদিকে। দুইজন তাদের প্রেম বিলাসে মত্ত। আশেপাশের হুস ছেলেটার নেই বললেই চলে তাই তো কাল ক্রম ভুলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো। নিজের শক্ত দেহের সাথে পেঁচিয়ে ঠাই দিলো নিজবক্ষে। মুখে উপচে পড়া চুলগুলো সুন্দর করে গুজে দিলো তার কানের পিছনে। পূর্ণ আর ওদিক তাকালো না। নজর দিলো ফোনের স্ক্রিনে। বেশি না একটু সময় অতিক্রম হতেই ছেলেটা সহিত মেয়েটা তার কাছে এসে বসে পরলো। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মেয়েটা হাত নেড়ে কিছু বলছে। পূর্ণ পাত্তা দিলো না। রাগ হলো নারীটির। উঠে চলে যেতে নিলেই সাফারাত ধরে আটকালো। প্রিয় নারীটির সুশ্রী চেহারায় এহেন রাগ মানায় না। নিজের পাশে বসিয়ে পূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— শ্যালা আমার বউ’কে রাগাস ক্যান?
— একদম শ্যালা ডাকবি না রাত।
বেশ রাগী কন্ঠে বললো পূর্ণ। সাফারাত পাত্তা দিলো না। পাশের নারীটিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে সরস গলায় বললো,
— আজ হোক বা দুইদিন পর সম্পর্কে তুই আমার শ্যালা ই হবি পূর্ণ।
বিরক্ত হয়ে উঠতে নিলেই হাতে বাঁধা পরলো। নারীটির মুখে পূর্ণ’র হাত। না ঘুরেই পূর্ণ শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
— হাত ছাড়ো। বাসায় যাব। তোমাদের প্রেম দেখতে আসি নি আমি।
নারীটি হাত ছাড়লো না। বরং সাফারাত’কে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পূর্ণ’র বাহু আঁকড়ে ধরে চটপটে গলায় জানালো,
— সামনেই ফুঁচকার স্টল। ওখানে চল। খাব আমি।
দু’জনের বিশেষ মুহূর্তের ছবিটা নিজের ক্যামেরাতে বন্দী করে নিলো সাফারাত।
.
পূর্ণ’র বাহু আঁকড়ে শাড়ী পরিহিত একজন নারী। দেখতে অবশ্যই সুন্দর। একেই তো বলে আগুন সুন্দরী। হ্যাঁ, ঠিক এটাই। মৃত্তিকা’র নিকট তাকে আগুন সুন্দরী মনে হলো। যাদের দেখা মাত্র পুরুষ গলে। নিজের কায়া ভুলে, মাথা ঝিমিয়ে উঠে ঠিক ততটাই সুন্দর এই রমনী। পাতলা ঠোঁটে গাঢ় রঙা লিপস্টিকে যেন সাদা চামড়ার নারীটির সৌন্দর্য বাড়লো বহুগুণ। পিঠ ছড়ানো তার ঝরঝরা কেশ। রঙটা ও মন্দ না। ব্রাউন কালার। মৃত্তিকা’র মনে হচ্ছে চুলগুলো কালো হলে মেয়েটাকে একদম বাঙালি লাগলো। এককথায় খাঁটি বাঙালী যাকে বলে। কারণ হাতে আলতা, চুলে গাজড়া, শাড়ী পরিহিত মেয়ের চুলের রঙ কালো ই মানায় বাঙালী হিসেবে।
পরপর নিজের সঙ্গে তাকে তুলনা দিলো মৃত্তিকা। কোথায় ছবির এই রমণী আর কোথায় মৃত্তিকা। শ্যামলা গায়ের রঙ। কোঁকড়ানো চুল। উচ্চতা ও ঠিক ততটা না। হিল পড়লেও পূর্ণ’র সমান হবে না সে। কাঁধ পর্যন্ত অথচ ছবির মেয়েটি পূর্ণ’কে ছুঁইছুঁই।
অসহ্য রকমের খারাপ লাগা কাজ করলো মৃত্তিকা’র যাকে বলে একদম বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ লাগা। এটাই তো স্বাভাবিক। নিজের পুরুষের বাহু ধরে একজন যুবতীকে কেন ই বা মৃত্তিকা সহ্য করবে? মনের গহীনে অঙ্কুরিত হলো হিংসা নামক দহনের। যদিও তার মনে হচ্ছে ছবিটি পুরাতন তবে ততটাও না। কয়েক বছর আগেরই ছবিটি। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো মৃত্তিকা’র।
অতটাও অবুঝ না মৃত্তিকা যে পূর্ণ’র অতীত নামক কিছু দেখে এতটা কষ্ট পাবে। কষ্ট লাগছে কারণ পূর্ণ শুরুতেই জানিয়েছে নারী সানিধ্যে যায় নি। কথাটি কি তবে মিথ্যা ছিলো?
অতঃপর একটা ছবির উপর ভিত্তি করে ততটাও নিজের ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলো না যদিও ছবিটাতে দুইজন’কে এক জোড়া মনে হচ্ছে। পূর্ণ আসলেই তাকে জিজ্ঞেস করবে মৃত্তিকা। নিশ্চিত পূর্ণ বলবে ছবিতে থাকা নারীটির সাথে তার তেমন কোন সম্পর্ক নেই।
কথাগুলো বলে নিজেকেই সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো মৃত্তিকা। না চাইতেও তার মন মাঝারে খারাপ লাগাটা ছেয়েই যাচ্ছে। হাজার হোক প্রিয় পুরুষের এতটা কাছে কোন নারী অবশ্যই তৃতীয় কাউকে পছন্দ করবে না।
ছবিটা আলমারির ড্রায়রে থাকা একটা ফ্রেম থেকে পেয়েছে মৃত্তিকা। দেখার পর থেকেই মন বিষিয়ে আছে। ছবিটা নিজের শাড়ীর ভাজে রেখে রুম থেকে বাইরে চলে এলো সে। শাশুড়ী নামক চমৎকার নারীটির সাথে এক কাপ চা খাওয়া বাকি তার। অতঃপর তাকে তৈরী হতে হবে। পূর্ণ বলেছে আজ কোথাও নিয়ে যাবে তাকে।
______________
শোয়েব মির্জা বেজায় চটে আছেন পূর্ণ’র উপর। ছেলেটা নির্বাচন থেকে পিছু তো হটবেই না উল্টো তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে আজ জন সম্মুখে ভাষণ দিয়েছে ভার্সিটির সামনে। মিছিল করেছে পুরো এলাকা হয়ে ভার্সিটির সড়ক পর্যন্ত। জনগন এতে আরো উতলা হয়েছে। এতটা সুশৃঙ্খল মিছিল তারা পূর্বে দেখে নি। রাস্তা ঘাট অবরোধ করে কিংবা জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে দেয় নি পূর্ণ তার মিছিলকে বরং দুটো লেট খোলা রেখেছিলো যাতে জনগণের দুর্ভোগ না হয়। এরপর চার রাস্তায় মোড়ে সিনা টান করে জনসম্মুখে প্রকাশ করে তার নমিনেশন পাওয়ার খবর।
ছেলেটা বড্ড চতুর তা জানেন শোয়েব মির্জা।
টিভির চ্যানেলটা পাল্টে মাহিন মিয়া’র দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— ও আমাকে কি বলে জানি?
–কু..কুতত্তার বাচ্চা।
গর্জে উঠলেন শোয়েব মির্জা। ভয়ে সিটিয়ে গেলো মায়িন মিয়া। ভুল কিছু কি উগড়ে ফেললেন?
শোয়েব মির্জা কঠিন গলায় বলে উঠলো,
— আমি কি সেটা জিজ্ঞেস করেছি? হাঁদারাম কোথাকার!
ঢোক গিললো বারকয়েক মাহিন মিয়া। কন্ঠে অপরাধ বোধ ঢেলে বললেন,
— দুঃখীত স্যার। পূর্ণ বলেছিলো আজকে এবার জয়ী হয়ে দেখিয়ে দিবে।
শোয়েব মির্জা দাঁত কটমটালেন। দেখে নিবে ভালো করে সে এই দুই দিনের ছেলেকে। রাগ তার শুধু পূর্ণ’র উপর না বরং নিজ ছেলের উপর ও। এতটা কেন নির্বিকার সে? কেন এগুচ্ছে না কিছুতে?
.
মৃন্ময় হাওলাদারের সঙ্গে প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে কথা বলছে পূর্ণ। সম্পূর্ণ টা রাজনীতি ঘিরে। দারুন তার সকল বুদ্ধি। নিজ দল সহ এবার এমপি পদে দাঁড়ানোর বুদ্ধিটাও তারই ছিলো৷ পূর্ণ অবশ্য শাজাহান খান এর প্রস্তাবে প্রথমে রাজি না হলেও কিছুটা দ্বিধায় ছিলো যা সম্পূর্ণ কেটেছে শশুরের কথায়।
কথার এক পর্যায়ে মৃন্ময় হাওলাদার বললেন,
— আম্মাকে দেখো পূর্ণ। সামনেই হয়তো যাব।
পূর্ণ দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো। পরপর শুধালো,
— উনি থাকতে পারবে না বাবা।
— জানি আমি। একদিন না দেখেই তো থাকতে পারেন না। তবে পারতে হবে পূর্ণ। আমি জানি সেই কাজে তুমি তাকে সাহায্য করবে।
পূর্ণ উঠে দাঁড়ালো। মৃন্ময় হাওলাদার খেতে বলতেই পূর্ণ জানালো,
— ওনাকে নিয়ে বের হব আজ বাবা। ওয়াদা করেছি।
মৃন্ময় হাওলাদার হাসলেন। প্রাপ্তির সেই হাসি। বিদায় জানিয়ে পূর্ণ চলে গেল। এদিকে অতৃপ্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন মৃন্ময় হাওলাদার। অতীতটা তাকে ছাড়ছে না। একদমই না।
___________
মৃত্তিকা দরজায় দুইটা টোকা দিয়েই ডাকলো,
— আম্মু? আসব?
অপর পাশ থেকে অনুমতি এলো না। তবে মাথা ঢুকিয়ে ঢুকে পরলো মৃত্তিকা। হাতে থাকা চা আর ভাজাপোড়া গুলো পাশের টেবিলে রেখে বললো,
— বাইরে এসো না। বারান্দায় বসে খাই?
— খাব না।
— আমি কি করলাম?
উঠে বসলেন পূর্ণ’র মা। মৃত্তিকা কিছু বলতে নিলেই রাগী কন্ঠে বললেন,
— একদম স্বামী’র হয়ে গান গাবে না। বেয়াদব ছেলে। কোন কথা শুনতে চাই না ওর নামে।
মৃত্তিকা ঢোক গিললো। একটা সময় ছিলো যখন সে হাড়ে হাড়ে ভয় পেত রাজনীতি নামক পেশাটাকে এমনকি এর সাথে জড়িত মানুষদের। কিন্তু পরিস্থিতির বদলে আজ এক রাজনৈতিক কাজে জড়িত পুরুষের বউ সে। ভয় লাগে না এমন না। পেশাটাই এমন।
পূর্ণ’র মা কখনোই রাজনীতি পছন্দ করেন না৷ পূর্ণ’কে সবসময় ছাড়তে বলেছে এসব। ছেলেটা ছাড়বে তো দূর উল্টো এখন কি না এমপি পদে দাঁড়াচ্ছে। একথা আজ সকালে জানতে পেরেছেন তা ও কি না সরাসরি সংবাদে! তার ছেলে এমপি পদে দাঁড়ায় আর এটা কি না তাকে কেউ জানায় নি? এতটাই ফেলনা? পূর্ণ জানত মা রাজি হবে না তাই বাবা সহ মৃত্তিকা’কে নিষেধ করে মা’কে জানাতে।
সকালে জেনেই ছেলেকে সাফসাফ না করেন। এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। লাভ হয় না। পূর্ণ ছাড়বে না এই রাজনীতি। তার র*ক্তে মিশা এই রাজনীতি। কিভাবে ছাড়বে এত সহজে?
মৃত্তিকা বহু কষ্টে শাশুড়ী’কে মানিয়ে বারান্দায় গেলো। একসাথে মনোযোগ দিলো চায়ের কাপে। ততক্ষণে শশুর হাজির ওর। মৃত্তিকা চা ঢেলে দিতেই তিনি চুমুক বসিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে স্ত্রী’কে বললেন,
— কি কেঁদে কেটে ছেলেকে আটকাতে পারলে?
স্বামী’র খোঁচা গায়ে মাখলেন না তিনি। শুধু এক কামড় চপ খেয়ে বললেন,
— রাতে দেখছি তোমাকে।
ব্যাস কাজে দিলো তার হুমকি। দমে গেলো মৃত্তিকা’র শশুর। তাদের এই টোনাটুনির ঝগড়া বেশ লাগে মৃত্তিকা’র কাছে।
.
পূর্ণ’র জন্য নিজেকে একদম সাজিয়ে রেখেছে মৃত্তিকা। শাড়ী পড়ে হিজাব ও বেঁধেছে অথচ জানা আছে পূর্ণ এমন জায়গায় নিবে যেখানে মানুষ কদাচিৎ থাকে। তার বউ সে মোটকথা লুকিয়ে রাখবে।
পূর্ণ এলো একটু বাদই। মৃত্তিকা দেখেই সালাম জানালো হাসি মুখে। পূর্ণ এগিয়ে এসে পাঞ্জাবিটা খুলে ওয়াসরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
— কাপড়গুলো দিন মৃত্ত।
মৃত্তিকা তাই করলো। নিজ পছন্দ অনুযায়ী পাঞ্জাবি বের করলো। পূর্ণ গোসল করে আসতেই দেখলো সব গোছানো বিছানায়৷ তখনই নজর গেলো তার নারীর উপর। অল্প সাজে তার হৃদমোহীনি। পূর্ণ একটানে নিজের কাছে নিয়ে গুমড়ে যাওয়া স্বরে বললো,
— আপনি একটা আতড়ের শিশি মৃত্ত। যেখানেই খুলা হোক না কেন, ঘ্রাণে মাতিয়ে দেন আমায়।
মৃত্তিকা লজ্জা পেলো। পূর্ণ তখন আধ উন্মুক্ত। ঢোক গিললো মৃত্তিকা। পূর্ণ ততক্ষণে নিজের ভেজা অধরের ছোঁয়া দিলো ওকে। কম্পমান মৃত্তিকা সরতে সরতে বললো,
— যাবেন না?
— হু। যেতে হবে বলেই ছাড় পেলেন মৃত্ত।
মৃত্তিকা’র হঠাৎ ছবিটার কথা মনে পরলো। সেটা বের করতে করতে বললো,
— কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো?
পূর্ণ পাঞ্জাবী গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,
— আমি তো আপনার নিকট খোলা বই মৃত্ত। পড়ে নিন আমায়।
হঠাৎ চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি দেখে থমকে গেলো পূর্ণ। মাথায় দপদপ করে আগুন জ্বলে উঠলেও তা দমিয়ে রেখে বললো,
— যেখান থেকে নিয়েছেন সেখানেই রাখুন এটা।
মৃত্তিকা ভীত কিছুটা। পূর্ণ’র কন্ঠ বা চাহনি কোনটাই স্বাভাবিক নয়। তবে সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করলো পুণরায়,
— মেয়েটা কে?
— রাখুন এটা!
কিছুটা জোড়েই বললো এবার পূর্ণ। মৃত্তিকা’র চোখ তখন ছলছল করে উঠলো। এভাবে ধমক দেয়ার কি আছে? মৃত্তিকা দমলো না। জানতে চাইলো নিজের করা প্রশ্নের উত্তর। পূর্ণ এবার ধমকে উঠলো,
— কি কি জানতে চান আপনি?
— মেয়েটা কে?
— সব। সব সে আমার।
— আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন? বলেছিলেন কোন নারী ছিলো না আপনার জীবনে।
পূর্ণ’র রাগ এবার আকাশচুম্বী। ছবিটা মৃত্তিকা’র হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একহাতে গাল চেপে ধরলো মৃত্তিকা’র। ঘটনার দ্রুততা কল্পনা করতে পারলো না মৃত্তিকা। পূর্ণ শুধু দাঁত খামটি মে’রে বললো,
— খুব খারাপ করলেন মৃত্ত। খুব খারাপ। আজ রাতটা আপনার আর আমার জন্য রেখেছিলাম। সব নষ্ট করার শাস্তি আপনি পাবেন।
কথাগুলো বলে ধাক্কা দিয়ে মৃত্তিকা’কে ফেলে চলে গেল পূর্ণ।
মৃত্তিকা’র চোখ গলিয়ে তখন পানির ফোয়ারা। পূর্ণ’র এহেন আচরণ আশা করেন নি ও। মেয়েটা নাকি পূর্ণ’র সব। তাহলে মৃত্তিকা কে? কি ভূমিকা তার পূর্ণ’র জীবনে?
#চলবে….