শ্যামারণ্য পর্ব-১৮+১৯

0
701

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

রাত দেড়টা। এখনো শ্যামাদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। কারো চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। কারো খাওয়া দাওয়াও হয়নি। নীলা চুপিচুপি কিছু খেয়ে নিয়েছে,বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে এই নাটক করতে করতে। জলদি জলদি সকালটা হলেই বাঁচে।

এমন সময় বাড়ির দড়জায় করাঘাত শুনে সকলে সজাগ হয়ে যায়,এই সময় কে এলো? মা ই হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে আগে দড়জা খুলে।
দড়জা খুলে শ্যামাকে দড়জার সামনে পড়ে থাকতে দেখে তাকে বুকে নিয়ে কান্না জুড়ে দেন। ততক্ষণে বাকি সবাইও এসে দাঁড়িয়েছে।
দিব্য আর নীলা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায়।তাদের প্ল্যান ছিলো সকাল বেলা শ্যামাকে যেখান থেকে তুলে নিয়েছিলো সেখানে ফেলে আসা,তাহলে লোক জানাজানি হবে। কিন্তু শ্যামাকে এতো জলদি ঘরের দরজা করাঘাত করে ঘরের দড়জার সামনে কে রেখে গেলো?
নীলা মনে মনে রাগে ফেটে পড়ে আবিরের উপর,একটা কাজ যদি তাকে দিয়ে ঠিকমতো হতো।

এদিকে বাবা তাগাদা দিতেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দিব্য হেনার সাহায্যে শ্যামাকে রুমে এনে শুইয়ে দেয়। মা বাবা দুজনেই তার দুপাশে বসে। শ্যামার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।
হেনা দ্রুত বাথরুম থেকে পানির বালতি নিয়ে এসে মগ দিয়ে তার মাথায় পানি ঢালতে থাকে। মা তার চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো। শ্যামার হুঁশ ফিরে এক সময়,তবে মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে তার।
চোখ খুলে সে নিজেকে নিজের রুমে তার পরিবারের মাঝে আবিষ্কার করে চমকে উঠে। মেয়ের হুঁশ ফিরতে দেখে বাবা তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কাঁদতে থাকে।

“কেমন লাগছে তোর মা?শরীর খারাপ লাগছে?”

শ্যামা আবছা আবছা ভাবে বলে,”মাথা ব্যথা করছে অনেক,আমি একটু ঘুমাবো বাবা।”

মা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”কে ছিলো ওরা?তুই কিভাবে ফিরে এলি?ওরা খারাপ কিছু করেনি তো?”

শ্যামা মাথায় হাত চেপে বলে,”জানিনা মা,কিচ্ছু মনে পড়ছেনা আমার। তবে ওরা কিছু করেনি,আমার সামান্য হুশ ছিলো,কিছু করলে বুঝতে পারতাম। আর আমি এখানে কিভাবে এসেছি আমি জানিনা।”

“হয়েছে আমার মেয়ে সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছে এই অনেক,ওকে ঘুমাতে দাও সবাই। এসব কথা কাল হবে।”
বাবার কথায় সবাই সায় দিয়ে যে যার রুমে চলে যায়। মা তার পাশে থাকতে চাইলেও শ্যামা মানা করে দেয়।
সবাই চলে যাওয়ার পর তার বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠে।
এটা কিভাবে এখানে এসেছে সে জানেনা,সেটা আজকের ঘটনার সময় ব্যাগসহ রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো। নীলা নিয়ে এসেছে হয়তো তাহলে।
ঘুমকাতুরে চোখে ফোনটা হাতড়ে কোনোমতে হাতে নিতেই অরণ্যের নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে দেখে,অরণ্যের নাম দেখেই প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে তার চোখে মুখে। সে ফোন রিসিভ করে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠে,
“অরণ্য……”

“তুমি ঠিক আছো?”

“হুমম….ঠিক আছি,আপনি কোথায়?”

“যেখানে থাকার কথা আমার,হটাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”

“অরণ্য…..আমাকে কি আপনি রক্ষা করেছেন আজকে?”

অরণ্য কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠে,
“আজকে তোমার ফিরে আসার কথা,ভুলে যেওনা কিন্তু”

শ্যামার হাসি আরও বিস্তৃত হয়,অরণ্য তার প্রশ্নের উত্তর দেন নি,
“হুমম ভুলে যাবোনা……”

“ঘুমিয়ে পড়ো এখন”

“অরণ্য……”

“হুম বলো….”

“ভালোবাসি আপনাকে….”
পুকুর পাড়ের র’ক্তজবা গাছটির পাশে বসে থাকতে থাকতে এই প্রথম হাসি ফুটলো অরণ্যের মুখে। অপর প্রান্তে শ্যামার মৃদু শ্বাসপ্রশ্বাস এর আওয়াজ জানান দেয় সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অরণ্য অশ্রুসিক্ত নয়নে হাটু গেড়ে বসে জবাফুল গাছের সামনে,
“মা, অবশেষে আমি তাকে পেয়েছি যে আমাকে ঠিক তোমার মতোই নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। কিন্তু আমিও ওকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। আমি কি করবো এখন?”
—————————
এদিকে দিব্য আর নীলার চোখে ঘুম নেই। নীলা আবিরকে ফোন করেই চলেছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছেনা ফোন।
রাগে গজরাতে গজরাতে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মা’রে নীলা।

“একটা কাজ এগুলোকে দিয়ে হয়না। এতো কষ্ট করে প্ল্যান এতোটা এগিয়েছিলো, সব জলে গেলো।”

দিব্য এদিকে ইতস্তত করে বলে,”ওদের সাথে খারাপ কিছু হয়নি তো?নয়তো ওরা এমন করার কোনো কারণ নেই।”

“ওদের আবার কি হবে?চারটি জোয়ান ছেলেকে তোমার বোন একা কি করতে পারে?”

“শ্যামা আপু নয় নীলা,কিন্তু ওই স্বপ্নের ব্যক্তিটা..….” শুকনো ঢুক গিলে বলে দিব্য।

নীলা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে,”দেখো আমার মাথা কিন্তু এই মূহুর্তে এমনিতেই খারাপ,আবার এসব অবাস্তব কাহিনি শুরু করোনা এখন।”

“আমার কথা যদি অবাস্তব হয়ে থাকে তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবেনা নীলা,
চলো ঘুমিয়ে পড়ো। বাকিটা সকালে দেখা যাবে।
আমার আর ভালো লাগছেনা এসব।”
—————————-
শ্যামার সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে যায় ক্ষিধের কারণে,প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে তার। কাল সকালের পর কিছুই খাওয়া হয়নি তার। মাথা ব্যথাটাও এখনো কমছেনা। এক কাপ চা দরকার তার এই মুহুর্তে।
এতো সকালে কেউ উঠেনি হয়তো। নিজেই কোনোমতে টলতে টলতে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গোসল করে নেয়।

চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরে এগিয়ে যায় কিছু খাওয়ার জন্য,
সেখানে গিয়ে দেখতে পায় হেনা চুলোয় চা বসাচ্ছে। শ্যামাকে দেখে তার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠে,
“আপু তুই উঠেছিস?আমি চা বসিয়েছি,তোর জন্যও বানাই?”

শ্যামা হেসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রতিউত্তর করে,
“হ্যাঁ রে হেনা,এক কাপ কড়া করে চা বানা,মাথা প্রচুর ব্যথা করছে।”

হেনা সম্মতিতে মাথা দুলিয়ে বয়ম থেকে প্লেটে বিস্কুট বের করে রাখে।
“তো আজকে এতো জলদি উঠে গেলি যে সকালে?”

হেনা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”ঘুম ই আসেনি,কাল সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপু। একদিকে তোকে কারা তুলে নিয়ে গেছে,এদিকে বাবা মা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোমাদের কিছু হলে আমি কি করবো?”

শ্যামা তার ছোট বোনের মনোভাব বুঝতে পারে,পরিবারে যা হচ্ছে সেটা তার ছোট্ট মনটাতেও প্রভাব ফেলছে। সে চায়না তার বোন এই বয়সে হতাশাগ্রস্ত থাকুক। সে কিছু হয়নি এমন ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
“আরে পা’গ’লী বোন আমার,কিছু হয়নি তো,দেখ সব ঠিক আছে। এসব নিয়ে এতো ভাবিস না।”

তার শান্তনা হেনার উপর কতটা কাজ করলো কে জানে,সে আর কোনো প্রতিউত্তর করেনা। চা হয়ে গেলে দুই কাপ চা বানিয়ে এক কাপ শ্যামাকে দেয় আর আরেক কাপ নিজে নিয়ে টুল টেনে শ্যামার পাশে বসে পড়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনেকটা সুস্থবোধ করে শ্যামা।

একটু পর হেনা খানিকটা ইতস্তত কন্ঠে বলে,
“আপু তোর কি মনে হয় এসবের পিছনে দিব্য ভাইয়া থাকতে পারে?”

শ্যামা অবাক হয় যে হেনাও ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে,সে এই কথাটা তুলতে চাইছিলো না কারো কাছে। অবশ্যই এর পিছনে দিব্য আর নীলা রয়েছে। দিব্য আর নীলার ফিরে আসা,বিয়ের প্রস্তাব,নীলার সাথে বের হতেই কিড’ন্যা’প হওয়া সবকিছু কাকতালীয় ঘটনা হতে পারেনা।

শ্যামা চায়ের কাপ রেখে হেনার হাতে হাত রাখে,
“এই কথাটা মা বাবার সামনে কখনো বলিস না হেনা।”

হেনা বিস্মিত হয়ে বলে,”তার মানে তুইও এটা ভাবিস এসব ভাইয়া ভাবী করেছে, তাহলে বাবা মাকে বলবিনা কেনো? তাদের জানা উচিত এসব।”

“হেনা আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শোন,আর বোঝার চেষ্টা কর,তুই ছোট মানুষ তাই এখনো অনেক কিছুই বুঝিস না তুই।
তুই তো কাল নিজের চোখেই দেখলি আমার অপহরণের পর বাবা মায়ের কি অবস্থা হয়েছিলো। একবার ভাব আমি যদি বলি উনাদের ছেলেই এসব করেছে তাহলে কি হবে? মা তো আত্মগ্লানিতেই শেষ হয়ে যাবে যে তিনি দিব্যকে ক্ষমা করেছেন বলে,নীলার সাথে আমাকে পাঠিয়েছেন বলে এসব হয়েছে। বাবা দিব্যর উপর রেগে থাকলেও উনি আমাদের ভাই বোন সবাইকে সমান ভালোবাসেন। তারা দুজনেই সহ্য করতে পারবেন না যে তাদের ছেলের এতটা অধপতন হয়েছে। আর আমি নিজেও আমার ছোট ভাইকে পুলিশে কিভাবে দিই, ওর নাহয় বুক কাঁপেনা আমার জন্য কিন্তু আমি ওর মতো পাষাণ কিভাবে হই?”

“আপু আমি সব বুঝতেছি,কিন্তু ওরা তো থেমে থাকবেনা। এর পর নতুন কি করবে কে জানে? আমার এখন দিব্য ভাইয়াকে দেখলেই ভয় হয়,সে কি আমাকেও গু’ন্ডা দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে?”

“তুই দুশ্চিন্তা করিসনা এসব নিয়ে হেনা,তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর শুধু।
ওরা আর কিছু করতে না পারে মতো ব্যবস্থা করবো আমি। আমি ঠিক করেছি ভালো একটা উকিলের পরামর্শ নিয়ে থানায় জিডি করে রাখবো, আমাদের কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা হলে যেনো তারা দায়ী থাকে এমন লিখিত স্বীকারোক্তি দিবো। সেটা দিব্যকে দেখিয়ে দিলেই হবে। আমাদের তোয়াজ না করুক,আইনকে তো করবে।”

“এমন করলে সত্যি সব ঠিক হবে?”

“হ্যাঁ তবে ততোদিন নিজে সতর্ক থাকবি,এরা জানে মা বাবার আসল দুর্বলতা আমরা সন্তানরা,সেই সুযোগই নিচ্ছে তারা। আমি নিজেও আজ ফিরে যাবো।”

“ফিরে যাবি মানে?” হঠাৎ মায়ের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে দুজনে। মা আবার কিছু শুনেনি তো?

মা চিন্তিত স্বরে বলে উঠে,”এই অসুস্থ শরীরে কোথায় যাবি?কাল এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো,তুই এই কদিন ঘরের বাইরে যাস না।”

শ্যামা নিশ্চিত হয় যে মা কিছু শুনেনি,সে হেসে জবাব দেয়,
“মা, আমার মনে হয় ওরা ভুলে অন্য কাউকে কিড’ন্যা’প করতে গিয়ে আমাকে নিয়ে গেছে। নয়তো দেখোনা,ওরা এভাবে আমাকে কিছু না করেই ফেরত দিয়ে যাবে কেনো?”

“সেসব আমি জানিনা,তুই ঘরের বাইরে যাবিনা।”

শ্যামা উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”লক্ষী মা আমার,এতো চিন্তা করোনা। আমার কাজ আছে,আমাকে তো যেতেই হবে। আর সেখানে আমাকে কেউ কিছু করতে পারবেনা।”

শ্যামা মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবশেষে রাজি করায় তার যাওয়ার জন্য।
শ্যামা যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যেতে চায় অরণ্যের কাছে। কাল রাতে ঘুমের ঘোরে ওর সাথে কি কথা হয়েছে তেমন মনে নেয় তার। শুধু আবছা আবছা ভাবে মনে আছে সে তাকে ‘ভালোবাসি’ বলেছিলো।
সে কথা মনে পড়তেই লজ্জায় গাল গরম হয়ে যায় তার।
—————————
শ্যামা নাস্তা করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাবা উঠার আগেই বেড়িয়ে পড়েছে। বাবাকে মানানো এতো সহজ নয়,তিনি তো বলেই দিবেন বাড়ির বাইরে যেনো পা না রাখি। তাই আগে ভাগেই বেড়িয়ে পড়েছে। আজ সকালে দিব্য আর নীলার সাথে দেখা হয়নি, রুম থেকেই বের হয়নি তারা। অবশ্য ভালোই হয়েছে। এসব মানুষের মুখ দর্শনও করতে চায়না সে।

অনেকক্ষণ যাবত মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে স্টেশনে যাওয়ার বাসের অপেক্ষা করছে শ্যামা। কিন্তু কোনো বাসে সিট খালি পাচ্ছেনা সে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবশেষে একটা বাসের সিট খালি পেলো সে। সে উঠতে নিতে যাবে তার আগেই কেউ তার হাত চেপে ধরে। হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে পিছনে তাকায় সে,দেখে সেদিন স্টেশনে দেখা হওয়া ফকিরটা।

আজও সেই একি ছেড়া আলখেল্লা,মাথায় রংচটা গামছা,কাধে সেই পুটলি,এক গাল দাঁড়িতে লুকায়িত অমায়িক এক হাসি দিয়ে লোকটি বলে উঠে,
“মা রে,উপরওয়ালার নামে কিছু দিবি?বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”

এদিকে বাসের হেল্পার তাগাদা দেয়,ম্যাডাম উঠলে উঠেন বাস ছাইড়া দিবো এখন।
শ্যামা পড়ে যায় দোটানায়,সেদিনের অভুক্ত বৃদ্ধটা যে টাকা নেয়না,শুধু ক্ষিধে লাগলে কিছু খাবার চায়,তাকে মানা করে দিবে?
আবার আজকে বাসের যা ঝামেলা,এই বাস ছেড়ে দিলে এর পরের বাস কখন পাবে তার ঠিক নেই।
দোটানার মাঝে সে ঠিক করে সে নাহয় পরের বাসটাই নিবে,এই বুড়োটাকে খাবার না দিয়ে গেলে সারা রাস্তা তার মন খারাপ থাকবে।
সে হাসিমুখে হেল্পারকে বলে,”ভাইয়া আপনি অন্য যাত্রী নিয়ে নিন,আমি উঠবোনা।”

হেল্পার বিরক্ত হয়ে বলে,”আফা উঠবেন না যখন কেনো শুধু দেরি করাইলেন?”

শ্যামা কোনো মতে মাফ চেয়ে চলে আসতে নেয়,তখন বৃদ্ধ ফকির মুখ বেজার করে বলে,
“আরে যা যা,তোর গাড়ি এমনিতেও কাউকে গন্তব্যে নিতে পারবেনা।”

হেল্পার তার কথা গায়েও মাখলোনা,শ্যামারও তার কথাটি বোধগম্য হয়না।
সে স্মিত হেসে লোকটিকে অপেক্ষা করতে বলে দোকান থেকে খাবার কিনতে যায়,দাম মিটিয়ে ফিরে আসতে আসতে দেখে বাস ছেড়ে দিয়েছে।

সে বৃদ্ধ ফকিরের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে,”এই নিন চাচা,গরম গরম পরোটা বানিয়েছে। আর কিছু খাবেন?”

বৃদ্ধ ফকির হেসে মাথা দুলিয়ে তার হাত থেকে খাবার নিতে নিতে বলে,
“না রে মা,আর কিছু লাগবেনা। তোর উপর আমি সন্তুষ্ট। তুই আমাকে দুই দুইবার খুশি করেছিস,তোকে আমিও কিছু দিতে চাই।”

শ্যামা আশ্চর্য হয়ে যায় উনার কথা শুনে,উনি আবার কি দিবেন তাকে? সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দেখে বৃদ্ধটি তার পুটলি হাতড়াচ্ছেন। সেখান থেকে তিনি দুটো কালো সুতো বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নে ধর, একটা তোর স্বামীর হাতে বাঁধবি আরেকটা নিজের হাতে। ভাগ্য তোদের জোড়া চিরকালের জন্য বেঁধে দিবে।”
শ্যামার লোকটির আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বোধগম্য হওয়ার আগে চারদিকের হট্টগোলের আওয়াজ দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার। লোকজন হইচই করে রাস্তার দিকে ছুটছে।
লোকমুখে যা শুনলো তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে একটু আগের বাসটি সামনের মোড়ে এক্সিডেন্ট করেছে। বাস আর ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে কারো বেঁচে ফেরার আশঙ্কা তেমন নেই।

শ্যামা চমকে উঠে দ্রুত তার সামনের বৃদ্ধটির দিকে তাকায়। কিন্তু সামনে কেউ নেই,সে আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজেও লোকটিকে আর দেখতে পেলোনা। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে যেনো গায়াব হয়ে গিয়েছেন তিনি।
শ্যামা সেখানেই বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে,
লোকটি কি তাহলে এজন্যই বলেছে বাস গন্তব্যে যাবেনা?আর তিনি সেসময় না আসলে এই মুহুর্তে সে এই বাসে উঠে যেতো,হয়তো আজই মৃ’ত্যু ঘটতো তার। তাহলে লোকটি কি তাকে রক্ষা করলো? কে উনি?
ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই শ্যামা তার হাতের কালো সুতো দুটি শক্ত হাতে মুঠ করে নেয়।

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

বেলা এগারোটা। নীলার ফোন বেজে উঠে হঠাৎ। মাত্রই নাস্তা সেরে এসেছে,রাতে দেরি করে ঘুমানোর ফলে দেরিতেই উঠেছে সে আর দিব্য। দিব্য আজ অফিস যায়নি।
ফোন হাতে নীলা দেখে আবিরের নাম্বার থেকে এসেছে কল। ফোনটা সাথে সাথে রিসিভ করেই রাগে ফে’টে পরে নীলা,
“এতোক্ষণ পর ফোন করার সময় হয়েছে তোর?জলদি এসে দেখা কর,আমার অনেক কথা আছে তোর সাথে..”

“আমি পুলিশ বলছি….” অপর প্রান্ত থেকে অজ্ঞাত পুরুষকন্ঠের বলা বাক্যটি শুনে চমকে উঠে নীলা।

দিব্য কিছুটা দূরেই নীলাকে লক্ষ্য করছিলো আবিরের ফোন আসার পর থেকে,নীলার অভিব্যক্তি এমন রাগ থেকে ভীত হতে দেখে চিন্তায় পড়ে যায় সে। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।

নীলা দিব্যর দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“পুলিশ?”

“জ্বি এই ফোনের মালিক কি আপনার পরিচিত কেউ?আপনার অনেক গুলো মিসডকল দেখা যাচ্ছে,শেষ কথাও আপনার সাথে হয়েছে। উনার সাথে কি সম্পর্ক আপনার?”

নীলা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,”উনি আমার আপন বড় ভাই।কেনো কি হয়েছে?আর তার ফোন আপনার কাছে কেনো?”

অপর প্রান্তের লোকটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমরা একটি নির্মাণাধীন ভবনের নীচে আজ সকালে ৪টি লা’শ পেয়েছি,লা’শের অবস্থা শোচনীয়। সার্চ করতে গিয়ে এই ফোনটি পেয়েছি আমরা। লা’শ আপনার ভাইয়ের কিনা তা শনাক্ত করার জন্য আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে ম্যাডাম।”

সবটা শুনে নীলা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়,আবির ও তার বন্ধুদের কেউ মে’রে ফেলেছে?সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দিব্যর দিকে তাকায়। সে দেখতে পায় দিব্যর মুখের রক্ত সরে গিয়েছে যেনো,ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে।
—————————
শ্যামা সুতো দুটি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে অরণ্যের।
সে অনেক ভেবেছে এটা নিয়ে। আধ্যাত্মিক কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতে মন চায়না তার। হতে পারে তার সাথে যা ঘটেছে তা নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা।
কিন্তু তবুও সেই ফকির যদি সত্যি কোনো অলৌকিক ক্ষমতাধর সত্ত্বা হয়ে থাকে,এই সুতো তার আর অরণ্যের কলাইয়ে বাধতে তো ক্ষতি নেই।
শ্যামার কানে এখনো বাজছে সে কথাগুলো,
‘ভাগ্য তোদের জোড়া চিরকালের জন্য বেঁধে দিবে’
যদিও সে বুঝতে পারছেনা নতুন করে কি জোড়া বাঁধবে তাদের,তারা তো ইতিমধ্যেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তবুও সে ঠিক করলো অরণ্য আজ আসলে সবার আগেই এগুলো তাদের কলাইয়ে বাঁধবে।

তার অপেক্ষা এক সময় শেষ হয়,অরণ্যের আগমণ ঘটে।
শ্যামাকে দুদিন এভাবে তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখেনি,এর মধ্যে মনে হচ্ছে দুই যুগ কেটে গিয়েছে।
মেয়েটি তার উপর কি মায়া করেছে কে জানে।
মেয়েটা সচরাচর সে আসলেই টের পেয়ে যায়,কিন্তু আজ না জানি কোন ভাবনায় ডুবে আছে মেয়েটি। খাটের উপর বসে একমনে কিছু ভেবে চলেছে। সে যে এসেছে তাকে দেখে মনে হলোনা সে বুঝতে পেরেছে।

অরণ্যের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসে তাকে অন্যমনস্ক দেখে, সে ক্রুর হাসি হেসে এগিয়ে যায় তার দিকে,আজ শ্যামাকে ভালো করে চমকে দেওয়া যাবে।
অরণ্য ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে শ্যামাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরাতে শুরু করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে শ্যামা,অরণ্যের গলা খামচে ধরে শক্ত করে। শ্যামার অবস্থা দেখে অরণ্য হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ার যোগাড় হয়।
সে শ্যামাকে নামিয়ে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
শ্যামার মাথা তখন ভনভন করে ঘুরছে,টলতে টলতে সে অরণ্যের বুকে আছড়ে পড়ে আর অরণ্য তাকে পরম ভালোবাসায় তার বুকে মিশিয়ে নেয়। শ্যামার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নেয় তার শরীরের। এই দুদিন ঠিক এই মুহুর্তটার জন্য কতটা ব্যকুল ছিলো সে সেটা শুধু সে জানে।
শ্যামাও অরণ্যের বুকে মাথা রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে এক সময় ধাতস্থ হয়। পুরোপুরি শান্ত হওয়ার পর রেগেমেগে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় অরণ্যের বুকে,অরণ্য আবার হেসে ফেলে শ্যামার রাগ দেখে।
শ্যামা গাল ফুলিয়ে বলে,
“এটা কি ছিলো?কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি জানেন?”

“কি করবো বলো?দুদিন বাইরে কাটিয়ে এসে দেখছি আমাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছো তুমি। আগে আমি আসলেই বুঝে যেতে,আর আজ আমি এসেছি বুঝতেও পারোনি তুমি। তাইতো তোমার মস্তিষ্ক থেকে অন্য ভাবনা গুলো ঝেড়ে ফেলে দিলাম। তোমার সমস্ত ভাবনা জুড়ে শুধু আমি থাকবো শ্যামাবতী”

“আমি আপনার কথা ভুলে যাইনি,আপনার কথা ই ভাবছিলাম আমি।”

অরণ্য শ্যামার উন্মুক্ত কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নিয়ে ঘাড়ে চুমু খায়,শ্যামা অরণ্যের স্পর্শে কেঁপে উঠে তার ঘাড় খামছে ধরে,অরণ্য শ্যামার কানে মুখ নিয়ে গিয়ে নে’শালো কন্ঠে বলে উঠে,
“এতো গভীরভাবে কি ভাবছিলে আমাকে নিয়ে শ্যামাবতী?”

অরণ্যের প্রশ্নটা বোধগম্য হতে কিছু সময় লাগে শ্যামার,সে ঘোরের মধ্যে চলে যায় যতবার অরণ্য এভাবে স্পর্শ করে তাকে। তার হুঁশ ফিরে যখন মনে পড়ে সে কোন গভীর চিন্তার মাঝে ছিলো সে একটু আগে। সাথে সাথে অরণ্য কে ঠেলে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় সে।
অরণ্য এদিকে হঠাৎ তার রোমান্সে ভাটা পড়ায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়,সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এটা কি হলো?তুমি সত্যি দুদিনেই অনেক পাল্টে গিয়েছো শ্যামা” তার কন্ঠে অভিমান স্পষ্ট।

শ্যামা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে তার তীব্র হৃদস্পন্দনকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে করতে বললো,
“আমার থেকে দুই মিনিট দূরে থাকবেন অরণ্য?আমার অনেক জরুরি একটা কাজ আছে,আপনি কাছে আসলে আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনা।”

অরণ্যের অভিমান আরও গাড়ো হয়,সে দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলে,
“এখন তুমি আমাকে সরাসরি তোমার থেকে দূরে থাকতে বলছো?”

শ্যামা জবাবে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারেনা,সে তার বিরক্তি কোনোমতে দমন করে শান্ত গলায় বলে,
“আপনি একটু চুপ করবেন?কথাটা তো শুনবেন আমার।”

“আরও কি শোনার বাকি আছে?”

“আপনার হাতটা দিন এদিকে”,শ্যামা আর কথা না বাড়িয়ে বলে।

অরণ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,” কেনো?হাত দিয়ে কি করবে?”

শ্যামা তার হাতের সুতো জোড়া দেখিয়ে হাসিমুখে বলে,”একজন গুণী মানুষ দিয়েছে আমাকে। বলেছে একটা স্বামীর হাতে বাঁধতে আর আরেকটা নিজের হাতে,তাহলে আমাদের জুটি চিরকালের জন্য বেঁধে যাবে।”

অরণ্য ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায় শ্যামার হাতের সুতোর দিকে,
“তোমাকে কোনো এক ভন্ড এসব বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে?এতো সহজে তো আমাকেও বিশ্বাস করোনি তুমি”

শ্যামা বিরক্ত হয়ে ঊঠে এবার,”আহহ আবার এসব কথা আসছে কেনো?হাতে একটা সুতো বাধলে তো কোনো ক্ষতি নেই,তাহলে পড়তে সমস্যা কোথায়?”

“অবশ্যই সমস্যা আছে শ্যামা। এসব রশি সুতো হাতে তোমরা মেয়েরা বাঁধো,ছেলেরা পড়েনা এগুলো। আমি এসব মেয়েলি জিনিস একদম পড়বোনা”

শ্যামা অরণ্যের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি অরণ্য এমন একটি কারণ দেখিয়ে অমত করবে,সে আশাহত মনে খাটের একপাশে বসে পড়ে।
অরণ্য শ্যামাকে এমন উদাস দেখে তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরতে যায়,কিন্তু শ্যামা অরণ্য থেকে দূরে সরে বসে অভিমানী কন্ঠে বলে,
“একদম ছোঁবেন না আমাকে,আপনার সাথে কোনো কথা নেই”

“শ্যামা তুমি এতো ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে রাগ করছো কেনো?প্লিজ এমন করোনা।”

শ্যামা ধরে আসা গলায় বলে,”কেনো করবোনা রাগ?আজ যদি আর দশটা বিবাহিত জুটির মতো আমাদের বিয়েটাও নিয়ম মেনে হতো তাহলে আমাদেরও বাগদান হতো,আংটিবদল হতো। কিন্তু আমার শরীরে আমাদের বিয়ের কোনো চিহ্ন নেই। আমার মাঝে মাঝে অনেক ভয় হয় অরণ্য,থেকে থেকে ভাবনা আসে একদিন আমি উঠে দেখবো আপনার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই আর আমি বুঝতেও পারবোনা আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি।
প্লিজ আমার এই কথাটা রাখুন শুধু,আমি আর কোনো আবদার করবোনা আপনার কাছে।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে শ্যামা।

অরণ্য শ্যামার কথাগুলো শুনে দারুণভাবে চমকে উঠে,উৎকন্ঠায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্যামাকে। তার বুকও অনেক জোরে উঠানামা করছে।
সে বেদনামিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,”আমার কারণে তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় তাইনা?”

শ্যামা তীব্র গতিতে মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানায়,”নাহ অরণ্য আপনি আমার জীবনের একমাত্র সুন্দর অংশ,আমি শুধু আপনাকে হারাতে চাইনা কখনো। শুধুমাত্র আপনাকে হারানোর ভাবনাটাই কষ্ট দেয় আমাকে।”

অরণ্য নীরবে শ্যামার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্তনা দেয়,কিছুক্ষণ নীরবতার পর সে বলে উঠে,
“বেঁধে দাও সুতো শ্যামা,পারলে এতো শক্ত করে বাঁধবে যাতে আমি কখনো হারিয়ে গেলেও এই বাঁধনের টান আবার আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনে।”

শ্যামা অরণ্যের বুক থেকে মাথা তুলে সম্মতিতে মাথা দোলায়,অরণ্য তার বাম হাত এগিয়ে দেয় শ্যামার হাতে। সে কাতর দৃষ্টিতে দেখতে থাকে মেয়েটা আসলেই মনোযোগ সহকারে সুতোর গাঁট বাঁধতে ব্যস্ত। অরণ্য চোখ সরিয়ে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ হওয়া থেকে নিবারণ করে।
তার হাতে সুতো বাঁধা শেষ করে শ্যামা অরণ্যের দিকে অন্য সুতোটা এগিয়ে দেয় তার হাতে বাঁধার জন্য।
অরণ্য তা হাসিমুখে গ্রহণ করে শ্যামার হাতে শক্ত করে বেঁধে দিতে দিতে মনে মনে প্রার্থনা করে এই বাঁধন যেনো সত্যিই তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে তাকে বেঁধে দেয় চিরকালের জন্য।

শ্যামা অনেক খুশি হয় অরণ্য তার কথা মেনে নেওয়ায়। সে হাসিমুখে অরণ্যকে খাওয়া শুরু করার জন্য তাগাদা দেয়।
দুজন দুজনকে খাইয়ে দিতে দিতে শ্যামা তাকে সবকিছু খুলে বলে কি হয়েছে এই দুদিন তার সাথে,কিভাবে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো,কিভাবে সে আশ্চর্যজনক ভাবে ফেরত এসেছে ঘরে। অরণ্য চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। তার মন অনেক বিক্ষিপ্ত এই মুহুর্তে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরণ্য খাবারের ট্রে টা পাশের টেবিলে সরিয়ে রাখতে রাখতে শ্যামা তাকে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা অরণ্য সেদিন যে আমাকে রক্ষা করেছিলো সেটা আপনিই…..”

তার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অরণ্য তার ঠোঁট দিয়ে শ্যামার মুখ বন্ধ করে দেয়। আকস্মিক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে চমকে উঠে শ্যামা। সেই প্রথম রাতের পর এই প্রথম অরণ্য তার অধরে চুমু খেয়েছে,আর এবারেরটা অনেক সময়,অনেক বেশি সময় নিয়ে ছিলো। অরণ্য তাকে নিয়ে সেই অবস্থায় খাটে শুয়ে পড়ে,শ্যামা উত্তেজনায় অরণ্যের চুল খামছে ধরে। এভাবে কতটা সময় অতিবাহিত হয়েছে শ্যামা জানেনা তবে অরণ্য যখন অবশেষে তার ঠোঁট ছাড়ে তখন তারা দুজনেই হাঁপাচ্ছে।
অরণ্য শ্যামার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে বলে,
“বড্ড বেশি কথা বলো তুমি শ্যামা…”

শ্যামার মস্তিষ্ক কেমন শূন্য মনে হয় তার,আবেশে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে সে। সে ভুলেই যায় কি নিয়ে কথা বলছিলো সে। দীর্ঘক্ষণ এভাবেই নীরবে থাকার পর অরণ্য তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“ঘুমিয়ে পড়ো শ্যামা,আজ আমার একটা কাজ আছে, তাই আজ আমাকে একটু জলদি যেতে হবে।”

হঠাৎ এই মুহুর্তে এমন কথা বলায় অবাক হয়ে যায় শ্যামা, খানিকটা আশাহত গলায় বলে সে,
“ঘুমিয়ে যাবো মানে?আপনি এতো জলদি চলে যাবেন?”

শ্যামার আশাহত গলা শুনে অরণ্য দুষ্টু হেসে শ্যামার নাকে নাক ঘসে বলে,”কেনো শ্যামা?না ঘুমিয়ে তোমার অন্য কোনোকিছু করার ইচ্ছা ছিলো নাকি?”

কথাগুলো শুনে লজ্জায় গাল গরম গয়ে যায় শ্যামার,অরণ্যের বুকে ধাক্কা দিয়ে অন্য পাশ ফিরে বালিশে মুখ লুকিয়ে বলে সে,”আপনি একটা অসভ্য!”

অরণ্য হেসে শ্যামাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে বলে উঠে,”তোমার ইচ্ছাটা আজ পূরণ করতে পারছিনা বলে রাগ করোনা শ্যামা,আজকের কাজটা শেষ করে আসি। কাল নাহয়….”

শ্যামা কনুই দিয়ে গুতা দেয় অরণ্যকে চুপ করার জন্য,অরণ্য শ্যামাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে হেসে ফেলে। তার এখন আরকটু থেকে তাকে আরও লজ্জা দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার মনের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখে সে।
আজ তার অসমাপ্ত কাজটা সম্পূর্ণ করতে হবে,তার কাজ সে ফেলে রাখা পছন্দ করেনা। সে শেষবারের মতো শ্যামার হাতে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।

অরণ্য চলে যেতেই চোখের বাঁধন খুলে ফেলে শ্যামা,বালিশ জড়িয়ে ধরে লজ্জায় মুখ চেপে ধরে দুহাতে। মনে মনে বলে,
‘অসভ্য লোক একটা!খালি আমাকে লজ্জা দেয়। কিন্তু এতো রাতে উনার কি কাজ থাকতে পারে?’

(চলবে)