সেলাই মেশিন পর্ব-১৩

0
203

সেলাই মেশিন
————-
(১৩)
————-
আসলে দেশে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল দাদির সাথে দেখা করা। অল্প দিনেই দাদি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বড় ছেলে, মানে মৌরির বাবা ডাক্তার দেখালে ঔষধ কিনতে বলে ছোট ছেলেকে, বড় মেয়ে শাড়ি কিনে বলে ব্লাউজ বানিয়ে দিতে বলে ছোট মেয়েকে -এভাবেই ঠেলা ধাক্কার জীবন কাটছে দাদির। ছেলে মেয়েরা কেউই দাদিকে স্থায়ী ভাবে নিজের কাছে রাখতে পারছে না। একেক পরিবারে একেক সমস্যা। দাদির জন্য বারবার জায়গা বদল খুবই কষ্টের। দুর্বল শরীরে চলাফেরা সহজ না। আবার বেশিদিন এক জায়গায় থাকতেও তার ভালো লাগে না। ফোন করলেই মৌরিকে দেশে আসতে বলেন। শেষ পর্যন্ত মৌরি সত্যি সত্যি দেশে আসবে জেনে দাদির কি ভীষণ আনন্দ! মৌরি মাত্র দুই সপ্তাহ দেশ থাকবে, দাদি এই সময়টা মৌরির বাবার বাসায় থাকবেন। মৌরির শাশুড়ি ওই সময় আদনানের বোনের কাছে আমেরিকায় বেড়াতে গেছেন, তাই মৌরিকে শশুরবাড়ি গিয়ে থাকতে হবে না। পুরো সময় দাদির সাথেই কাটাতে পারবে।

দেশে আসার দুইদিন পরে ইফতারে চাচা ফুফুরা সবাই এলো মৌরিকে দেখতে। ইফতার নামাজ শেষে সব মহিলারা বসে চা খাচ্ছিলো। হঠাৎ বড় ফুফু বললেন, “কী রে মৌরি, একলা একলা বিদেশ থেইকা চইলা আইলি? জামাইরে আনলি না ক্যান? কোনো ঝামেলা হয় নাই তো?”
“না ফুফু। কোনো ঝামেলা নাই। আদনানের তো ক্লাস চলতেসে। এইসময় দেশে আসলে পড়ার ক্ষতি হইবো। আমারে বললো কয়দিন দেশে ঘুইরা যাইতে।”
“আর কত পড়বো? দেশে কোনোদিন আসবো না?”
“আসবো না ক্যান? একটু গুছায় নিয়া আসবো।”
ছোট ফুফু পাশ থেকে বললেন, “মৌরি তোর হাত কান গলা সবই তো দেখি খালি? বিয়ার পরে জামাই নতুন কোন সোনার জিনিস দেয় নাই আর?”
মৌরি কোন উত্তর দেয়ার আগেই দাদি জবার দিয়ে দিলেন, “এইটা কেমন কথা? জামাই ছাত্র মানুষ, তার উপর গত বছর তো অসুস্থই ছিল। কই থেইকা গয়না দিবো? তোদের খালি এক গয়নার চিন্তা।”
বড় ফুফু বললেন, “খালি গয়নার চিন্তা না মা। বিয়ার আগে তো শুনলাম অনেক বড়লোকের ছেলে। ভাবলাম আমাগো মৌরিরে কত না জানি গয়না দিবো। বিয়ার সময় কিছুইতো তেমন দিতে দেখলাম না। ছেলের বাবা নাকি মারা গেছে, তাই তাদের একটু সমস্যা। কিন্তু বিয়ার পরেও কিছু দিলো না?”
দাদি আবারও বললেন, “দেওয়ার সময় কি চইলা গেছে? সামনে দিবো। পড়ালেখা শেষ হোক। আমি তো কইছিলাম, মৌরিরে ওর বিয়েতে আমার বালা জোড়া দেই , কিন্তু …..”
“মা, আপনে নিজের গয়না কারে দিবেন, সেইটা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু আপনার গয়নার উপরে হক কিন্তু আমাগো সবার আগে।আমাগোরে ঠকাইয়া আপনার শান্তি লাগবো?” বড় ফুফু গোমড়া মুখে বললেন।
সবাইকে হতবাক করে এবার রুনু বলে উঠলো, “সব দাবি তো আপনাদের। আমার আম্মা তো কোনো কিছুরই দাবি নাই। ছেলের বৌ না? ছেলের বৌয়ের আবার কিসের দাবি? আমার আম্মা কি আপনার জন্য কম করে, দাদি? কিন্তু আপনি ঘুরায় ফিরায় নিজের মেয়েদেরই সব দিবেন।”

শাহেদা ধমক দিয়ে বললো, “এইসব কী কথা রুনু? আমি বলছি, তোর দাদির গয়না আমার লাগবো? অসভ্য মাইয়া। দাদির কাছে মাফ চা এক্ষনি।”

রুনু রো মাফ চাইলেই না উল্টো চা শেষ না করেই উঠে গটগট করে চলে গেলো।

ছোটফুফু রেগে বললেন, “কী বেয়াদব মাইয়া রে বাবা! বছরে দুই একদিন আসি, তাও এমন মুখে মুখে কথা বললো। কী শিখাইলেন ভাবি?”

শাহেদা ননদের কথা গায়েই মাখলো না। এরপর আর কেউ আড্ডা দিতে আগ্রহী থাকলো না, সবাই তারাবির নামাজ পড়ার কথা বলে যার যার বাসায় চলে গেলো।

গভীর রাতে দাদি মৌরিকে বললেন, “দেখসোস আজকের ঘটনা? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোর ফুফুরা আমার গয়নার আশায় আমার দেখাশুনা করতেছে।”
“এইসব যে কী বলেন দাদি। তারা আপনার নিজের মেয়ে, আপনার দেখাশুনা করবে না ? আর মায়ের গয়নার উপরে তাদের আগ্রহ থাকতেই পারে। আপনে এইসব মাথায় নিয়েন নাতো। গয়না আপনার ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভাগ কইরা দিয়া দেন। ”
“তা তো দিবই। গয়না নিয়া তো আর কবরে যাবো না। তোরে গয়না দিতে চাইছিলাম, কিন্তু ওরা তো দিতেই দিলো না। ”
“আমার গয়না লাগবো না। আমার ওইসব পরতেও ভালো লাগে না, শখও নাই।”
“শখ না থাকুক, স্বর্ণ হইলো বিপদের ভরসা। ধর, একটা কঠিন বিপদে পড়লে ওই স্বর্ণ ভাইঙ্গা খাইতে পারবি।”
“থাক, স্বর্ণ ভাইঙ্গা খাওয়া লাগবো না। স্বর্ণ কোনোদিন কিনার দামে বেঁচা যায়? পুরাটাই তো লস। ”
“কথা অবশ্য ঠিকই কইসোস।”
“তাইলে আর গয়না নিয়া সবাইরে খেপাইয়েন না। দিয়া দেন ওদের।তাইলেই সবাই চুপ হইয়া যাবে।”
“দিমু রে বইন দিমু। কিন্তু মরার আগে না। গ্রামে আমাদের যা অল্প জমি ছিল সব তো ওরা বিক্রি কইরা খাইয়া ফেলছে। বাড়িটাও বিক্রির চেষ্টা করতেছে, ওইটাও ওদের পেটেই যাইবো। আর আমার অবস্থা দেখ, আমার নিজের কোনো ঠিকানা নাই। এই বাসা ওই বাসা কইরা জীবন শ্যাষ। ওরা এমন ভাব করে , আমার দেখাশুনা করা একটা বিরাট ঝামেলা। আচ্ছা, আমার জমি আমার ঘর তোরাই তো নিলি, তাইলে এখন আমি কেমনে তোদের বোঝা হইয়া গেলাম? কত বলছি, আমারে গ্রামের বাড়িত ফালায় দিয়া আয়, মরলে ওইখানেই মুরমু। নাহ, ওইটা করবে না, ওইখানে চিকিৎসা নাই, আমারে দেখার লোক নাই। আরে বাবা, এইখানে আমারে দেখার কে আছে?”
কথাগুলো বলে দাদি কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মুখ চোখ লাল হয়ে আসে।
“এই যে দাদি, খালি রাগ করেন। আর কয়টা দিন যাক, আমি একটা চাকরি পাইলেই আমার কাছে আপনারে নিয়ে যাবো।” অসম্ভব এই আশার কথা আবার দাদিকে বলে মৌরি।
“থাক, আমি আর কারো কাছে যামু না। তুই আমারে বিদেশ নিতে পারবি না, আমি জানি। বেহুদা আশা দিস না।”
অভিমানী দাদিকে জড়িয়ে ধরে থাকে মৌরি। কী বলে শান্তনা দেবে এই মানুষটাকে? মৌরি তো চাইলেও তার একাকিত্ব দূর করতে পারে না। ও চাইলেও দাদিকে ওর কাছে নিতে পারবে না। যদি পারতো এক্ষুনি নিয়ে যেত।
পরদিন ছিল ছুটির দিন। বাবার সাথে বহুদিন পরে মার্কেটে গেলো মৌরি। নিজের টাকায় দাদির জন্য ঈদের শাড়ি জুতা কিনলো। বাবার জন্য একটা সাদা পাঞ্জাবিও কিনলো। মৌরির মনে হচ্ছিলো ঠিক ছোট বেলার মতো বাবার সাথে শপিংয়ে এসেছে। কী ভীষণ আনন্দ লাগছিলো ওর!
“আচ্ছা বাবা, রুনু ঝুনুর জন্য কিছু কিনবা না?” মৌরি জানতে চাইলো।
“ওরা তো অনেক আগেই নিজেদের পছন্দে কেনাকাটা কইরা ফেলছে।”
“আর মা?”
“তোর মা নিজে আইসা কিনবো। আমি কিছু কিনলে পছন্দ হইবো না।”
“আমি মায়ের জন্য কিছু কিনি?”
বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুই আবার কী কিনবি? বাদ দে।”
“না, কিনি একটা শাড়ি।”
মৌরি একটা গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি কিনলো। শাড়ি দেখে শাহেদা বললো, “আমি তো শাড়ি পরি না। খালি বাইরে বেড়াইতে গেলে মাঝে মাঝে পরা হয়। সব সময় তো ম্যাক্সি পরি।”
“তাইলে কি তোমার জন্য মৌরি ঈদে পরার ম্যাক্সি কিননা আনবে? কী কথা যে বোলো শাহেদা। মেয়েটা নিয়া আসছে, তুমি ঈদের দিন একবার পইরো।” বাবা বললেন। শাহেদার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। খুশি হলো নাকি বেজার হলো, বোঝা গেলো না। তবে মৌরি যতদিন ছিল , শাহেদা শাড়িটা পরেনি।

ঈদের আগের দিন রাতে ঝুনু সবার হাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছিলো। মৌরি দুই হাতে মেহেদী পরে বারান্দায় বসে হেডফোনে গান শুনছিলো। পেছন থেকে বাবা হঠাৎ এসে কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন।

মৌরি ঘুরে তাকিয়ে বাবাকে দেখে হাসলো।
“ঝুনু কি সুন্দর মেহেদী দিয়ে দিছে, দেখো বাবা।” বাবার দিকে মেহেদী দেয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে মৌরি বললো।
বাবা হেসে বললেন, “হুম, ঝুনুর আঁকাআঁকির হাত ভালো, কিন্তু লেখাপড়ায় ডাব্বা। যাই হোক, মৌরি শোন, বিয়ার সময় তো তোরে তেমন কিছুই দিতে পারি নাই। মানুষ তোরে কত কথা বলে , আমি তো বুঝি। ঈদের সময়ও ভালো কাপড় কিননা দিতে পারলাম না। যাই হোক, তোর জন্য এই জিনিসটা আনছি।” বলে একটা লাল মখমলের বাক্স এগিয়ে দিলেন।
মৌরি বাক্স খুলে দেখে একটা সোনার চেইন! ও প্রায় চিৎকার করে বলে, “বাবা! এইটা তো স্বর্ণের!”
“আস্তে মৌরি। চেইন তুই লুকায় রাইখা দে, বিদেশ গিয়া পরিস। বাসায় কাউরে কিছু বলার দরকার নাই।”
“কিন্তু লুকায় দিতেছ ক্যান ?”
বাবা কাচুমাচু করে নিচু গলায় বললেন, “বাসায় কাউরে কিছু বলি নাই। তোর মেট্রিকের রেজাল্ট হওয়ার পরেই মনে ইচ্ছা ছিল, একটা ভালো কিছু উপহার দিমু। তখন তো পারলাম না, কত ঝামেলা গেলো। আস্তে আস্তে কিছু টাকা আলাদা করে জমাইছিলাম। শেষপর্যন্ত এইটা কিনতে পারলাম। পর তো গলায়, দেখি। তারপর আবার বাক্সে ঢুকায় সুটকেসে রাইখা দিস। ”
মৌরির চোখে পানি চলে এলো। তাড়াতাড়ি গলায় চেইন পরে বাবাকে সালাম করলো। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে উপহার নিতে ওর কিছুটা খারাপ লাগছিলো তবুও প্রাপ্তির আনন্দ সেই সংকোচ ঢেকে দিয়েছিলো। এটা শুধু একটা চেইন না, বাবার দেয়া একটা স্মৃতি, তার ভালোবাসার প্রকাশ। সোনার গয়না বলে এর মূল্য বেশি, তা না। বাবা আজ পর্যন্ত ওকে যা যা উপহার দিয়েছেন, সবই মৌরির জন্য মহামূল্যবান। কিন্তু এটা কিনতে বাবা সেই মেট্রিক পরীক্ষার পর থেকে পরিকল্পনা করছেন, তিল তিল করে টাকা জমিয়েছেন।এর মূল্য সেজন্যই অনেক বেশি।

রাতে দাদিকে চেইনটা না দেখিয়ে পারলো না মৌরি। দাদি মশারি গুঁজছিলেন। মৌরি ফিসফিস করে বললো, “দাদি, একটা দারুন জিনিস দেখবেন? বাবা আমারে একটা ঈদের উপহার দিছে।”
বলে লাল বাক্সটা খুলে চেইন দেখালো। দাদিও মহা উত্তেজিত। হাসতে হাসতে বললেন, “তোর বাপের মাথায় এতদিন পরে একটা ভালো বুদ্ধি আসছে। পর তো দেখি, তোর গলায় কেমন লাগে।”

মৌরি গলায় চেইন পরে দাদিকে দেখাতে এতই মগ্ন ছিল যে দরজায় রুনুর উপস্থিতি খেয়াল করেনি। রুনু চিলচিৎকার করে বললো, “আব্বা তোমার জন্য সোনার চেইন আনছে? আমাদের তো বলে নাই!”

মৌরি আর দাদি পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো। মৌরির বুক ধড়াস করে উঠলো। বাবা বলেছিলো চেইনের কথা কাউকে না বলতে, কিন্তু এখন রুনু যদি একটা তুলকালাম কান্ড করে?

(ক্রমশ)