“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
কিছু ঢেউ মৃদু বাতাসের বেগে তাল মিলিয়ে মৃদুজলে দোলে। সেই দোলে তরীর যাত্রী হেসেখেলে পাড় হয় স্রোতস্বিনীর সীমান্তে। না ভয়, না সংশয়। ভারি আরাম-আয়েশ করে সবাই ঢেউয়েরও দোলে দোলে। ফের কিছু ঢেউ দোলে রেগেমেগে। ঝড়ো বাতাসে মধ্যস্থান থেকে ঢেউ উড়িয়ে এনে আছড়ে ফেলে তীরে। বাতাসের শো শো শব্দ আর ঢেউয়ের গর্জন যাত্রীদের ভাবায়, ভয় পায়িয়ে দেয় পারাপারের পথে। তরীতে পা ফেলার আগেই ভীষণ চিন্তা থাকে, পার হতে পারবে কি না? নাকি তলিয়ে যেতে হবে ক্ষিপ্ত ঢেউয়ের ভীড়ে? পারলে সাবধান হও, নয়তো তলিয়ে যাও! শেষ পরিনতি এ-ই। কিন্তু তারও উর্ধ্বে একটা ঢেউ উতলা হয় অতি ভয়ংকর রূপে। যার শুরুটাও শান্ত, শেষটাও শান্ত। মাঝামাঝি শব্দটাই লণ্ডভণ্ড! শান্ত স্রোতস্বিনীর মৃদু ঢেউয়ের তালে তরীতে দোলতে দোলতে যখন মাঝপথে যাওয়া হয়, বিশ্বাসঘাতকের মতো ঝড়ো হাওয়া এসে মুহুর্তেই লণ্ডভণ্ড করে দেয় ভাসমান তরী। ভেঙে দেয় তার ধারাবাহিক গতি। কখনো ঘটে জীবনের সমাপন, কখনোবা ঘটায় স্তব্ধতা। ঠিক এমনই স্তব্ধতা ঘিরে নিয়েছে অতি সরল এই মনটাকে। কোনো আভাস ছাড়াই একটা বিশাল ঝড় ভেঙেচুরে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে মাহতাবকে। এ হয়তো তার সম্পূর্ণ জীবনের শ্রেষ্ঠ ঝড় হয়ে বেঁচে থাকবে। এরচেয়ে বড় ঝড় আর আসবে না তার ধারণা। জীবনে এরচেয়ে বড় ব্যাথা তার আর পাওয়া হবে না বলে ধারণা। এই মুহুর্তটা তার প্রাণপূর্ণ জীবনের সকল ব্যথিত মুহুর্তকে যেন হার মানিয়ে দিলো। আশপাশে একটা খুঁটিও খুঁজে পাচ্ছে না, যে তাকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষার্থে একটু প্রবোধ হয়ে দাঁড়াবে। নিশ্বাস বড্ড ভারি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শ্বাসতন্ত্রে। জীবনটা এতো বিষাদময় না হলেই কি পারতো না? এতো নিষ্ঠুর কেন এই পৃথিবী?
আজমাইনের হুটহাট না বলে মহল্লার দিকে চলে যাওয়া, ওই দিনগুলোতে কোথায় যাচ্ছে তা জানতে চাইলেও আজমাইনের এড়িয়ে যাওয়া খানিক সন্দেহ তৈরি করে ফেলেছিলো মাহতাবের চোখে। এখানে আজমাইনের একমাত্র অভিভাবক মাহতাব নিজে। আজমাইন বিপথে গেলে দায়ের চাপটা তার উপর আগে পড়বে পরিবার থেকে। তার কাছে থাকতে আবার সে বিপথে যায় কি করে? সন্দেহের ভিত্তিতে সে পিছু পিছু গিয়েছিলো দেখতে, মহল্লার দিকে সে কেন যায়? তাকে জানায় না কেন কিছু? বন্ধুবান্ধব জুটেছে? আড্ডার স্থান জমেছে ওদিকে? ধ্যানজ্ঞান কেড়ে নিলো নাকি কোনো বাজে সঙ্গ কিংবা আড্ডা? তার নিরীক্ষা করতেই পৌঁছে গেলো মৃত জনকের জীবিত দেহের কাছে। শুনে এলো মৃত হওয়ার কারণ ও ইতিহাস। একপলকের জন্য দরজার ওধার থেকে উঁকি দিয়েই তো বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠেছিলো। কথাগুলো শুনে মিথ্যে হয়ে দাঁড়ালো এই পৃথিবীর সম্পর্কের রস। বিষাক্ত হলো প্রবাহিত বায়ু। অসহায়ত্ব নিয়ে পেরিয়েছে পথ, পেরিয়েছে প্রাপ্ত সুখের আয়ু।
খানিক পরেই নিজেদের আবাসস্থলে ফিরেছে আজমাইন। তার মনের ভেতর কেমন একটা ভীতি কাজ করছে। সেই সাথে মাহতাবের বেদনাটাও তাকে প্রচুর নাড়ছে। ওই মুখে যেন তাকাতে পারছে না। নিজেই অস্বস্তিতে পরে যাচ্ছে। মাহতাব কিছুই বলেনি তাকে। একদম নিশ্চুপ, নিথর হয়ে আছে। আজমাইনও নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টায়ই যেন দমে রইলো। প্রহরের পর প্রহর কাটলো, কিন্তু ব্যাথা কেটে দূর হলো না মোটেও। ভাবনার সাথে বরং বেড়েই গেলো। অসহায়ত্বের ঢেঁকি গেড়েছে যেন হৃদয়টায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষত কেবল গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সন্ধ্যা হতে একটু বাকি। ফোন এলো গ্রাম থেকে। দাদাজানের ফোন হতে কল এসেছে। রোজা করেছে নিশ্চিত। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মাহতাবের। দেখেও চুপ করে বসে রইলো। ফোন রিসিভ হলো না। একের পর এক বেজেই যাচ্ছে। চতুর্থ বারের মতো বেজে রিসিভ হলো। রোজা সালাম দিলো, সালামের জবাবটা সে দিলো ঠিকই। কিন্তু রোজার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। জবাব তার মনের ভেতরই রয়ে গেলো। রোজা সাড়া নেওয়ার চেষ্টা করলো,
“হ্যালো? হ্যালো? শুনতে পাচ্ছো?”
মাহতাব অতি মলিন কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“বলো।”
“কথা বুঝা যাচ্ছে না?”
“যাচ্ছে।”
“কথা এমন শোনাচ্ছে কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
“না, বলো কি বলবে।”
“দাদাজানের অবস্থা ভালো না। খুবই আশঙ্কাজনক। সারাদিন এক ফোঁটা পানিও গলায় যাচ্ছে না। মুখে দিলে বেরিয়ে আসছে। অনেক্ক্ষণ ডাকার পর কখনো চোখ খুলছে, কাঁদছে। আবার বন্ধ করে নিচ্ছে। ডাক্তার ডাকলাম। তিনি বাঁচার লক্ষ্মণ দেখছেন না।”
কথা বলতে বলতে গলা ভিজে এলো রোজার। গলা ঠিক রাখার কৌশলে একটু থেমে আবার বললো,
“আব্বা বাড়ি চলে এসেছে সকালে। এসেই যে একটু ফলের রস খায়িয়েছেন, সেটুকুই আজ সারাদিনের খাওয়া। আর কিছু মুখে নিচ্ছে না দাদাজান। চোখদুটো বন্ধ করলেই ভয় লাগছে আমাদের। কাল আসবে? ফুপি কান্না করছে। তোমাকে খবর জানাতে বললো শীঘ্রই।”
মাহতাব শুকনো জ্বলসানো চোখ দুটো বুজে নিলো। দুচোখের পাতা বন্ধ করলেই খুব জ্বালা করছে আজ সারাটাদিন। যেন জলশূন্য হয়ে আছে চোখ জোড়া। ধীর নিশ্বাস ফেলে আবার চোখ খুললো সে। জবাবে বললো,
“আজই আসছি।”
“এই রাতে এখন আসবে?”
“সকাল পর্যন্ত যদি মৃত্যু অপেক্ষা না করে?”
প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব এলো না রোজার কাছ থেকে। তারা সবাই আজ বড্ড ভীত হয়ে রয়েছে। মাহতাবের কথায়ও বুকের ভেতরে ধুক করে উঠলো। ঠিকই, তারাও এসবই ভাবছে। এই বুঝি প্রাণটা চলে গেলো। দাদাজান বিদায় নিলো!
কল কেটে গেলো। মাহতাব সময়টা দেখে নিলো। মাগরিবের আগেই রওনা হতে পারবে নাকি মাগরিবের নামাজ আদায় করেই রওনা হবে, ভাবছে সে। আজমাইন বিকেলের শুরু পর্যন্ত ঘরেই ঘুমাচ্ছিলো। এখন ঘরে নেই। দূরে কোথাও গেছে নাকি কাছেই আছে, তা দেখতে রাস্তায় বের হলো। দূরে নেই। এদিকেই ছিলো হয়তো, এখন নীড়েই ফিরছে। মাহতাবকে দেখে যেন তার পায়ের গতি কিছু ধীর হয়ে এলো। তবে থেমে যায়নি। মাহতাব এখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আজমাইন একটু একটু শঙ্কায় থাকে, তাকে না আবার সকালের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে চুপচাপ মাহতাবের সামনে দিয়েই ঘরের দিকে যাচ্ছে। মাহতাব মলিনতা ঘেরা শান্ত কণ্ঠে বললো,
“নানাজানের অবস্থা ভালো না। বাড়ি যাবো, চলো।”
আজমাইন থেমে ঘুরে দাঁড়ালো। কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন?”
“হ্যাঁ। বাঁচার সম্ভাবনা নেই জানিয়েছে ডাক্তার। যখন তখন যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।”
আর কোনো কথা হলো না দুজনের। ঘরে এলো। আজমাইন শার্টটা পাল্টে নিলো। টাকাপয়সাও নিলো পকেটে। বাইরে বের হতেই মাহতাব বললো,
“আজান দিবে৷ নামাজটা পড়েই রওনা হই।”
“ঠিক আছে।”
মাহতাব ওজু করতে কলের কাছে গেলো। আজমাইনও এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে। মাঝে মাঝে বাদ পড়ে যায়। মাহতাব একদমই বাদ দেয় না বললেই চলে। মাহতাবের ওজু করা দেখে আজমাইন ভাবতে লাগলো সেও এখানে ওজু করে যাবে নাকি মসজিদে ওজু করবে? পরক্ষণে হঠাৎ মনে হলো নূর আলমের কথা। তারা গ্রামে যাচ্ছে, দাদাজানের বাঁচার সম্ভাবনা নেই। তিনি কি এই মুহুর্তেও দেখতে যাবেন না? খবরটা তাকে না জানালে কেমন হয়? হতে পারে শেষ সময়টায় তিনি একটু দেখা করলেন। আজমাইন মাথায় টুপি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজান দিতে মিনিট পাঁচেক বাকি। দ্রুত গিয়ে একটু খবরটা দিয়ে আসা যাক। যদি যেতে ইচ্ছুক হোন তাদের সাথে। বাড়ি পাবে তো এসময় তাকে? আজমাইন যথাসম্ভব দ্রুত পা চালালো। মহল্লার ওই বাড়ির পথে যেতেই আজান পড়ে গেলো৷ তবুও তার ঝটপট পথ ফুরানোর চেষ্টা। খবর জানিয়েই মসজিদে যেতে হবে। নূর আলমের ঘর পর্যন্তও যেতে হয়নি তাকে। নূর আলম এসময় বাড়িতেই ছিলেন। আজান শুনে এখন বেরিয়েছিলেন মসজিদের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখা। আজমাইনকে দেখে থামলেন তিনি। আজমাইন ঝটপট বললো,
“দাদাজানের অবস্থা ভালো না, ফুপা। একদমই খারাপ। আমরা গ্রামে যাচ্ছি। আপনি কি যাবেন?”
আহমদ আলীর খবর শুনে চেহারাটা তৎক্ষনাৎ ব্যথিত হয়ে উঠলো তার। তিনি যেন ভীষণ চিন্তায় ডুবে গেলেন। আজমাইনের তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তাই সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“যাবেন?”
ব্যথিত চোখজোড়া আজমাইনের দিকে তুলে ধীর গতিতে মাথা নাড়লেন, তিনি যাবেন না। ব্যর্থ গলায় দোয়া প্রকাশ করলেন,
“আল্লাহ ভালো করুক উনার। পরকালও সুখের স্থানে হোক।”
আজমাইন হতাশ হলো। ভেবেছিলো সাথে যাবে নূর আলম। কিন্তু তিনি যাবেন না ফিরে। তবে সময় নষ্ট করেনি আজমাইন। দ্রুত আবার ফিরে গেলো৷ তাদের সেখানকার মসজিদেই নামাজ আদায় করবে তাই ফাঁকা পথে কখনো কখনো দৌড়েও যাচ্ছে। ওজু করে প্রবেশ করেছে আল্লাহর ঘরে। মাহতাবকে পেয়েছে নামাজে দাঁড়িয়ে। নামাজ আদায় করেই তারা গ্রামপথে রওনা হবে।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৯
(নূর নাফিসা)
.
.
অন্যান্য দিন নানান বিষয়ে নানান কথা হয়। আজ শহর থেকে গ্রামে এলো, কারো মুখেই কথা ফুটলো না। মাহতাব ব্যাথা নিংড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলো, পাশে থাকা আজমাইন মাহতাবকে বুঝে উঠার চেষ্টায় মগ্ন রইলো। মাহতাবকে সান্ত্বনা দানের মতো ক্ষমতা তার হয়নি। ভেবে ভেবেই বড় অস্বস্তিতে পড়ে আছে, তাকে কোনোভাবে অপরাধী ভেবে বসে আছে কি না। আবার নূর আলমকে নিয়েও ভাবছিলো। তিনি এলেন না। দাদাজানের সাথে শেষ দেখাটুকুও হলো না। তারাই বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাদাজানের দেখা পাবে কি না, অনিশ্চিত রইলো। রাত বেড়ে গেছে। ঘুম নেই বাড়ির কারো চোখেই। তারা দুজন বাড়ির গেইটে প্রবেশ করতেই মাথায় ওড়না প্যাচানো মৌসুমীকে বারান্দায় দেখা গেলো। মৌসুমী চলার পথে থেমে গিয়ে এদিকে আবছা আলো আঁধারের মিশ্রণে মনযোগে তাকালো কে এসেছে দেখতে। মাহতাব সোজা আহমদ আলীর ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলেও আজমাইন মৌসুমীর দিকে এগিয়ে এলো। মৌসুমী এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মন ভালো থাকলে হয়তো আজমাইনকে দেখে হাসতো, ভারি খুশি হয়ে যেতো। এখন কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ, মুখটা বেদনায় মলিন। চোখ জোড়া ভেজা ভেজা। আজমাইন পাশে এসে দাঁড়াতেই মৌসুমী ভাঙা গলায় বললো,
“দুই ঘন্টা হয়ে গেছে। দাদাজান তাকায় না। শ্বাস চলে।”
কথার সাথে চোখদুটো আবারও টলমল করতে লাগলো। আজমাইন সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে তার মাথায় রাখলো। মাথাটা টেনে মেশালো নিজের সাথে। জিজ্ঞেস করলো,
“মা কোথায়?”
“দাদাজানের ঘরেই আছে।”
“কাঁদিস না।”
হাতের ব্যাগটা মৌসুমীর হাতে দিয়ে সে গেলো আহমদ আলীর ঘরের দিকে। দরজার সামনেই আমজাদ আলীকে দেখে ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হলো আজমাইন। বাবা এসেছে, সে জানে না। মাহতাব জানলেও তাকে বলার মতো মানসিকতা পায়নি। পরিবারের সবাই-ই এই ঘরে যাতায়াত করছে। কেউ আসছে তো কেউ যাচ্ছে। আহমদ আলীর শিয়রে বসে কান্না করছে মরিয়ম। বাড়ির পরিবেশটা একদমই ভালো লাগছে না আজমাইনের। এই সময়গুলো না এলে কি এমন হয়? সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কখন এলো? আমজাদ আলী মলিন মুখে জানালেন, সকালে। দাদাজানের এপাশের ঘরটা আজমাইনের। সেখানে বসে বসে কুরআন তিলোয়াত করছে রোজা। মৌসুমী এসে হাতের ব্যাগটা রেখে নিস্তেজ গলায় বললো,
“আপু, ভাইয়া আসছে।”
রোজা শুনলেও তিলোয়াত থামালো না নির্দিষ্ট আয়াত পর্যন্ত না এসে। আজ সারাদিন সে থেমে থেমে কুরআন নিয়ে বসেছে। মৌসুমীও কতক্ষণ কুরআন নিয়ে বসে, কতক্ষণ দাদাজানের শিয়রে বসে থাকে। রোজার গলাটা শুকিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে সে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। রোজা বললো,
“তুই আনতে গেলি কেন, আমিই তো যাচ্ছিলাম।”
“থাকুক, নাও। কিছু খাও না এইবার।”
“একটু পরে। তুই খেয়েছিস?”
“হু।”
দাদাজানের ঘরে এসে মাহতাবকে চুপচাপ আহমদ আলীর চেহারায় তাকিয়ে থাকতে দেখলো। এখানে বসেই এতোক্ষণ কথা বলেছিলো সে আমজাদ আলীর সাথে। আহমদ আলীর আজ সারাদিনের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেই জানাচ্ছিলো মামা এবং মামীরা। মায়ের কান্না থামাতে সে মাকে সান্ত্বনা দিলো দু-তিন বাক্যে। ওদিকে রোজা ও মৌসুমী চলে গেছে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। হালিমা খাতুন হাড়ি ভরে ভাত রেঁধেছেন সবার জন্য। রাত গভীর হয়ে এসেছে, এখনো ঘরের অধিকাংশ লোকজনই না খেয়ে আছে। এমতাবস্থায় কারো গলা দিয়ে খাবার নামতেও যেন চায় না। সারাদিন তাদের এভাবেই কেটেছে। বেশ কিছুক্ষণ মাহতাব বসেছিলো এখানে। পরবর্তীতে বেরিয়ে গেছে। রোজা যখন খাওয়ার জন্য সবাইকেই ডাকতে এলো, মাহতাবকে পেলো না। ফুপু এবং বাবামাকে পাঠিয়ে সে আজমাইনের ঘরে গেলো, সেখানে আছে কি না দেখতে। কিন্তু এখানে আজমাইন একা। হাতমুখ মুছে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো,
“তোর ভাইয়া কোথায় রে?”
“দাদাজানের ঘরে।”
“নেই তো।”
“কি জানি, দেখিনি তবে।”
“কোথায় গেলো আবার! ভাত খেতে আয়।”
রোজা বেরিয়ে যাওয়ার আগেই সে বললো,
“আপু, আলোর সন্ধান পেয়েছি।”
থেমে গেলো রোজা। ভাবুক দৃষ্টিতে একবার তাকালো আজমাইনের দিকে। পরক্ষণে দরজাটা চাপিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কে সে? দাদাজানের সাথে কিসের সম্পর্ক?”
আজমাইনের মুখে পরিচয় শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রোজা। এসব কি শুনছে সে! আজমাইন পুরো ব্যাপারটাই জানালো তাকে। আহমদ আলীর সেই পুরনো চিঠিটাও রোজার হাতে দিলো। মাহতাবের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাটাও বললো। সারাদিন যেই প্রলয়ের ছাপটা তার মুখে ভেসেছিলো, তার বর্ণনাও দিলো। রোজার দেহের লোমগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে। দেহটা ভারি হয়ে গেছে মনের ব্যাথার ভারে। চোখদুটো ছলছল করছে। বড্ড বেশি বিধস্ত হলো মাহতাবের উপর প্রবাহিত ঝড়টাকে ভেবে। লোকটার চেহারা এজন্যই এতোটা ভঙ্গুর হয়ে ছিলো তখন। ফুপু জানলে কেমন হবে এসব! নাকি জানে?
ভারি চিন্তিত বেশে আজমাইনের ঘর থেকে বের হতেই দেখলো মাহতাব হাতমুখ ধুয়ে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বারান্দায় উঠছে। রশিতে ঝুলানো গামছাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো রোজা। মাহতাবের হাতে দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওই মুখখানার দিকে। হাতমুখ মুছতে মুছতে মাহতাব জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার শরীর কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“ভালো দেখছি না তো। খাওয়ার অনিয়ম করছো চেহারা বলে। রাতের ঘুমও হয় না জানি। মামী ডাকলো, চলো।”
হালকা করে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গামছাটা রশিতে রাখলো রোজা। দুজনেই চললো সেদিকে৷ ধাপে ধাপে খাওয়া হলো সবারই। অনাহারে পড়ে রইলেন যেন একজনই। দুদিন যাবত স্যালাইন চলেছে কেবলই। ছেলের হাতে ফলের রসটুকু নিয়ে আর মুখই খুললেন না। কোনো সাড়া দেন না আর। চোখ জোড়াও বন্ধ করে নেন দীর্ঘ সময়ের জন্য।
মধ্যরাত। মমো আর সিয়াম ব্যতীত ঘুম নেই কারো চোখেই। আজমাইন ঘুমাতে গিয়েও ছটফট করে উঠে এসেছে। কখনো এঘর, কখনো ওঘরে আলোচনা চলছে বড়দের। কখনো শিয়রে অবস্থান করে আয়ু গুনছে বৃদ্ধ লোকটার। মাহতাবকে মৌসুমীদের ফাঁকা ঘরটার সামনে বারান্দায় নিরিবিলি বসে থাকতে দেখা গেলো এসময়টায়। এগিয়ে গেলো রোজা। পাশে বসলো। মাহতাবের শুকনো চোখজোড়ায় ভেজা লক্ষ্য করতেই রোজার চোখে ভীড় জমালো টলমলে অশ্রু। মাহতাব ফিরে না চাইতেও অনুভব করেছে পাশে যে কে বসেছে। একইভাবে স্থির থেকে সে জিজ্ঞেস করলো,
“রোজ, প্রাণ অদলবদল হয় না?”
কথার ভাবার্থ অনেক। রোজা কোন ইঙ্গিতে যাবে, বুঝতে পারলো না। জবাব না পেয়ে মাহতাব ঘাড় ঘুরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“যায় না?”
“কেন?”
“যদি আমার তাজা প্রাণটা নানাজানের হয়ে যেতো। আর নানাজানের সায়াহ্নে চলে যাওয়া প্রাণটা আমার মাঝে স্থির হতো। যদি হতোই, এক্ষুণি হতো!”
“নাউজুবিল্লাহ। এসব বলে না।”
চোখের অঝোর শ্রাবণ প্রবাহিত করে মাহতাবের কাঁধ চেপে শক্ত হতে প্রবোধ করলো রোজা। মাহতাব যেন কান্নায় ভেঙে পড়লো আরও। সেই ভোর হতে শুরু করে অবশেষে শেষ বেলায় তার ভাঙনের কান্না ঢলে পড়লো চোখে। একটা খুঁটি আছে পাশে। কতটুকু শক্ত আর তার ব্যাথার ভার রাখতে সক্ষম কি না এই খুঁটি, জানে না সে। তবুও কান্না ঢলে পড়ার অপেক্ষা রাখে না আর। রোজার কাঁধে আচমকা মাথা চেপে দিলো মাহতাব। নিশ্বাস ব্যাতিত কোনো শব্দ নেই। নিরবে শুধু চোখের জলটা আড়াল করলো যেন। অথচ মনে কত শত আর্তনাদ! কেউ দেখে না, কেউ শোনে না। চাইলে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে, না চাইলে পারে না। রোজা পারছে। খুব পারছে। কিভাবে এই প্রাণটাকে শান্ত করা যায়, সেই সামর্থ্য টুকু নিজের মাঝে খুঁজে পাচ্ছে না শুধু। এই পৃথিবীর কারো কি সেই সামর্থ্য আছে? আছে এই মনটাকে স্বাভাবিক করে তোলার সামর্থ্য? তবে আসুক না। দেখাক না এই চমক। সে জানে, কারোই নেই। একমাত্র রাব্বুল আলামিনই পারেন তার বান্দাকে পুরোপুরি বুঝতে এবং তিনিই পারেন বান্দার মনটাকে শান্ত রাখতে। রোজা কিছুক্ষণ মাথাটা একহাতে চেপে রাখলো নিজের কাঁধে। চুলে হাত বুলিয়ে গেলো। মুখের ভাষা পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ ব্যর্থ। কিছুটা সময় নিলো মাহতাব, চোখের জল শুকিয়ে নিতে। এই ধারা বইতে দিতে ইচ্ছুক না সে। পরক্ষণে সোজা হয়ে বসলো। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। রোজা শুধালো,
“দেখা হয়েছে উনার সাথে?”
দুদিকে মাথা নাড়লো মাহতাব। রোজা নিজের ঘাড়টা হেলিয়ে দিলো তার কাঁধে। কিছু সময় ব্যাথা বিনিময়ে, কিছু সময় নিরবে কাটিয়ে দিলো এখানে।
ফজরের আজান পড়লে কেউ মসজিদে চলে গেলেন, কেউ বাড়িতে নামাজ আদায় করলেন। পুরুষেরা বাড়ি ফিরে শুনলো আহমদ আলী চোখ খুলেছে। অতি সামান্য স্বস্তি এলো তাদের। কিন্তু এই স্বস্তি ভয় কাটাতে সক্ষম না। রমনীরা নামাজে, মোনাজাতে কত দীর্ঘ চাওয়া পেতে বসেছেন আল্লাহর দরবারে। কোনো আশা কি রাখতে পারে তারা, এই মানুষটার ভালো হওয়ার প্রেরণায়? নির্ঘুম রাত যে ফুরিয়ে এসেছে। সময়ে সময়ে কুরআনের ধ্বনি স্পষ্ট হচ্ছে আহমদ আলীর ভিটাতে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। আহমদ আলী তাকিয়েই আছেন। একে একে সামনে আসে তার প্রজন্মরা, মুখগুলো দেখতে পায় তিনি। কিন্তু কোনোরকম সাড়া ফেলেন না। বুকের ভেতর তৃপ্তি মেলে না, চোখেরও পলক পড়ে না। কি বিদারক যন্ত্রণা! মাহতাবও সামনে এসে অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। মনে মনে কথা তুলছিলো। আহমদ আলীর চোখের ধার গড়িয়েছে অশ্রু। আজমাইন দাদাজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, একসময় দাদাজান যেমন জ্ঞান দিতে তার মাথায় হাত বুলাতো। তেমনই। মৌসুমী কিছুক্ষণ দাদাজানের হাত তুলে গালে চেপে ধরে বসেছিলো৷ এমনই সময় পুরো বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেলো যেন! দুই পায়ে জড়তা নিয়ে হেঁটে প্রবেশ করা পথিককে প্রথমে দেখলো মাহতাব। আহমদ আলীর ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় পাথর চোখে তাকিয়ে রইলো ওইদিকে। শেষ কবে দেখেছিলো, দিনতারিখ মনে নেই। কিন্তু এই চেহারার আজ বিশাল পরিবর্তন। তখন গোঁফ দাড়ি ছিলো না। শরীরের গঠন ছিলো তাজা। খেটে খাওয়া পাকাপোক্ত যুবক। আজ তিনি বার্ধক্যে অর্ধগাঁথা। ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন নূর আলম। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সামনাসামনি দেখে মনটার কাঁদোকাঁদো অবস্থা। তিনি ব্যাথায় কাঁপা হাত তুলে দিলেন মাহতাবের মাথায়। পাথর চোখজোড়া নত হয়ে গেলো। বাহ্যিক কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেলো না তাছাড়া। বাড়ির আরও সদস্যদের চোখেও পড়ে গেলো সোনালী দিনের সেই আলো। স্তব্ধতা ঘিরে ধরলো প্রত্যেককে।
চলবে।