স্পর্শ পর্ব-১৯

0
1127

#স্পর্শ
#পর্ব_১৯
#writer_nahida_islam

এভাবে ই কেটে যায় সাতমাস। অতসী এখন ও বাবার বাড়িতে আছে। ইফাজ অনেক কেয়ার করেছে দূর থেকে ই। অবশ্যই দেখতে এসেছে দুদিন পর পর। অতসী প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়েছে। অতসীর মনটা অনেকটা পাথর। ইফাজের সাথে ভালোভাবে কথা বলে ঠিকই কিন্তু ভালোবেসে না শুধু কথা বলা প্রয়োজন তাই বলে। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে নাহ্।
হঠাৎ অতসীর লেবার পেইন উঠে। অতসী বিছানা থেকে উঠে দাড়াতে গেলে ফ্লোরে পড়ে যায়। ফ্লোরে পড়ে ব্যাথা সহ্য করতে না পেড়ে জোড়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। কিন্তু অতসী রুমে ফ্যানের শব্দে অনেক ছিলো তাই অতসীর কান্না আওয়াজ বাহিরে যাচ্ছিলো না। অতসী বেশ কিছুক্ষণ ফ্লোরে পড়ে কান্না করতে থাকে হঠাৎ নীলু রুমে এসে এমন অবস্থা দেখে জোড়ে চিৎকার করে মাকে ডাকে।

অতসীর মা সাথে সাথে এম্বুলেন্স কল করে। ইফাজকে কল দিয়ে শুধু হসপিটালে আসতে বলে। অতসীকে হসপিটাল নেওয়ার সাথে সাথে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যায়। ইফাজ এসে সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে পরে পড়ে।

-আমি কেনো আপনাদের কাছে আমার কলিজাটা রেখে গিয়েছিলাম। এখন যদি অতসী বা বাচ্চার কিছু হয় আমি বাচবো না।

-বাবা তুমি দোয়া করো কিছু হবে না।

ইফাজ জোরে চিৎকার করে বলে উঠে।

-হাজার বার আপনাদের মা মেয়েদের বলেছি, খেয়াল রাখার জন্য। এই টাইমটা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। যেকোনো মুহুর্তে এক্সিডেন্টে হতে পারে। আপনারা মা মেয়ে তিনজন পারলেন না একটা দিন দেখে রাখতে। আমার বাসায় হলে আমি ওর পাশে থেকে উঠে যেতাম না।

-ইফাজ বাবা মাথা গরম করো না। এখন এমন করার সময় নয়।

মিসেস অতসীর বাড়ির লোক কে। আমার সাথে আসুন। ইফাজ বসা থেকে উঠে দ্রুত নার্সের সাথে চলে যায়।

-আপনি কে হন পেসেন্টর

-হাসবেন্ড।

-এমন অবস্থায় আপনাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।

-অতসীর কী অবস্থা।

-দ্রুত বি নেগেটিভ ব্লাড নিয়ে আসুন। পেসেন্টের অবস্থা খুব ই খারাপ।

-আমাকে একটু দেখতে দিবেন প্লিজ।

-পাগল আপনি এমন সিচুয়েশনে। আপনি ব্লাড ম্যানেজ করে নিয়ে আসুন দ্রুত। যদি লেইট করেন তাহলে বাচ্চা বা মা কাউকে বাচানো পসিবল হবে না।

ইফাজ আর দাড়ালো না অতসীর ব্লাড গ্রুপ তো ইফাজের সাথে মিলে না। হয়তো পরিবারের কারো সাথে মিলবে তাই নীলু শিমু আর অতসীর মাকে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনাদের তিন জনের মধ্যে কার ব্লাড গ্রুপ বি নেগেটিভ।

-ভাইয়া আমাদের ব্লাড টেস্ট করা হয়নি।

ইফাজ রেগে গিয়ে বললো, তোমরা ব্লাড টেস্ট করো যদি কারো সাথে মিলে যায় তাহলে আমাকে কল দিয়ো আমি দেখছি কারো কাছ থেকে ব্লাড সংগ্রহ করতে পারি কি না।

ইফাজ আর দেরি করলো না, বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু সব হসপিটালের এক কথা নেগেটিভ ব্লাড এই মুহুর্তে নেই। ইফাজ তার বন্ধুদেরকে ও কল দেয় কিন্তু বি নেগেটিভ ব্লাড নেই বলে কল কেটে দেয়। লাস্ট ইফাজকে একটা হসপিটাল থেকে ব্লাড ডোনেট করে যারা তাদের নামের লিস্ট আর নম্বর দিয়েছে। ইফাজ অনেক জায়গায় কল দিয়ে একজনকে খুজে পেয়েছে। ইফাজ ব্লাড সংগ্রহ করে হসপিটালে ডুকে। দূর থেকে অতসী মা একটা বাচ্চা নিয়ে দাড়িয়ে আছে দেখে দৌড়ে যায়।

-মা অতসী কেমন আছে।

অতসীর মা চোখ তুলে উপরে তাকাতে ই চোখের পানি টপটপ করে নিচে পড়তে থাকে।

-মা কাদছেন কেনো, বলেন না অতসী কেমন। এই দেখুন অতসীর জন্য ব্লাড নিয়ে এসেছি আচ্ছা ওয়েট আমি ব্লাড দিয়ে আসছি তারপর বাবুকে কুলে নিবো।

-ইফাজ অতসী আর নেই।

-নেই মানে।

ইফাজ পাশ ফিরে তাকাতে ই দেখে নীলু শিমু ওড়নায় মুখ গুজে কাদছে। ইফাজের দাদিম আর তানিয়া বেগম এক সাইডে বসে আছে। দাদিমা তানিয়া বেগমের কাদে মাথা দিয়ে আছে। তানিয়া বেগমের চোখে ও পানি। ইফাজ দৌড়ে ইমার্জেন্সি কক্ষে ডুকতে ই দেখে প্রচন্ড ব্লিডং হয়েছে। ব্লাড দিয়ে পুরো বেড প্লাস কেবিনের কিছু অংশ ও ভরে গেছে। অতসীর উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে এখনো পানি জমে আছে। একটা হাত পেটে অন্য হাতটা নিচের দিকে ঝুলে আছে। উপরে সাদা কাপড় দেওয়া শুধু মুখটা বের করানো।
ইফাজ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। বেড সাইডে বসে অতসীর মাথাটা বুকে নিলো,

-অতসী এখন বলবা না আমাকে দেখলে তোমার কষ্ট হয়,আমি সামনে আসলে আমি যে একটা জানোয়ার ছিলাম তা তোমার পুনরায় মনে পড়ে যায়। এই অতসী বলবা না এখন। অতসী তুমি চাইতা না আমার থেকে দূরে যেতে।দেখো না আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করেছে। এই অতসী শুনো না, তুমি আমার জন্য দোয়া করতে পারতে না যেনো আমি মরে যাই। অতসী বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি নিজেকে শাস্তি দেওয়া জন্য তোমার থেকে দূরে থেকেছে। যদি জানতাম আমি তোমাকে এভাবে হারিয়ে ফেলবো তাহলে আমি কখনো দূরে থাকতাম নাহ। এই অতসী শোন না,ভালোবাসি তো। কথা বলবে না আমার সাথে, একবার কথা বলো,নাহ্।

-এসব কি করছেন আপনি, পাগল হয়ে গেলেন নাকি লাশকে এভাবে জড়িয়ে কথা বলতে দেখেছেন কখনো।

ইফাজ অতসীকে বেডে শুইয়ে বলল,

-লাশ কাকে বললেন।এটা আমার অতসী। ও আমার অতসী বুঝলেন। লাশ কেনো বললেন।

ইফাজ নার্সের দিকে তেড়ে আসছে। ইফাজ বেশ শকট তাই এমন করছে এটা বুঝতে পেড়ে ইফাজকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।

অতসী লাশ দাফন করে ফেলা হয় দু’ঘন্টা মধ্যে। ইফাজ ফ্লোরে বসে আছে। ইফাজ জোরে কাদতে পারেনা কিন্তু দুচোখ লালা হয়ে আছে।

-ইফাজ বাবা দেখবে না তোমার ছেলেকে।

ইফাজ বললো,

-মা অতসী তো চেয়েছিলো ওর স্পর্শে নিজের ভেতর সুপ্ত অনুভূতির প্রকাশ করতে। অতসী আমাকে বলেছিলো ওর মা হওয়ার অনুভূতি চাই ই চাই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার নিয়ে গেলো এভাবে।

-ইফাজ এসব না বলে ছেলেটাকে কোলে নেও।

ইফাজ দুহাত বাড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে কোলে নেয়। কোলে নিয়ে ই বুকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ বাচ্চা বুকে নিয়ে রাখে।

–বাবা বলছি কী বাচ্চাটা আমি নিয়ে যাই।

-আপনি আর কখনো এই কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না। আমার ছেলে আমি ই ভালো মানুষ করতে পারবো।আমার অতসীকে আপনাদের জন্য হারিয়েছি।

-বাবা তুমি ছেলে মানুষ এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারবেনা।

তানিয়া বেগম বলে উঠলো,

-আমি আছি, ইফাজকে যেমন মানুষ করেছি ঠিক এই বাচ্চা ও আমি ঠিক ই মানুষ করতে পারবো।

ইফাজ আর তানিয়া বেগম মিলে ছেলেটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নেয়। ইফাজ ছেলেকে বাবা মায়ের আদর দুটো ই দেয়। ছেলের নাম রেখেছে, আহমদ আব্রাহাম স্পর্শ।

__________________________________

বিশ বছর পর,

রোল কল করা হচ্ছে সবাই মনোযোগ দেও। রোল এক দুই তিন এভাবে বলতে বলতে ছাড় যখন রোল নম্বর তেষট্টি স্পর্শ। স্যার নামটা উচ্চারণ করতে ই দুইজন একবারে বলে উঠলো প্রেজেন্ট স্যার।

পুরো ক্লাস দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন ছেলে একজন মেয়ে।

-এই মেয়ে বসো তুমি।

-তুমি কী স্যার নাকি স্পর্শ।

-সরি স্যার কিন্তু এই মেয়েটা দাড়ালো কেনো।

মেয়েটা বলে উঠলো,

-স্যার আমার নাম ও স্পর্শ।

-এই তোমার ফ্যামেলি কী আর নাম খুজে পায়নি তোমাকে ছেলেদের নাম দিয়ে বসে আছে। হাফ ছেলে হাফ মেয়ে কথাকার।

-স্পর্শ সব সময় বেয়াদবি না করলে ও পারো। সারা বছর রোল ছিলো তোমার একশের পরে আজ কীভাবে তেষট্টি হয় তোমার। হতে পারে না নাকি এমন যে মেয়েটার নাম ও স্পর্শ।

স্পর্শ আর কোনো কথা বললো না। আজকে প্রথম ক্লাস নয়তো বুঝাতো মেয়েটাকে স্পর্শে মুখে মুখে তর্ক করলে কী হয়।

মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে স্পর্শ, বার বার ফেল করে কোনো রকম এসএসসি টপকে এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো। এই কলেজের সবাই তাকে এক নামে চিনে, কারন সবাই দশ বছর যাবৎ স্কুল পরলে ও স্পর্শ তেরো বছর যাবৎ পড়ছে। জে এস সি তে একবার ফেলে এসএসসিতে দুইবার ফেল। তাই সবাই এফ টু দি পাওয়ার থ্রি নামে ই ডাকে। এফ টু দি পাওয়া থ্রি মানে তিন বার ফেল। কিন্তু স্পর্শে আড়ালে সবাই এই নাম ধরে ডাকে সামনে কেউ ডাকার সাহস পায় না। পড়ালেখা না পড়লে ও মারপিটে দুষ্টুমিতে এক নম্বর।

ক্লাস শেষ স্পর্শ ক্যাম্পাসের বকুল তলায় বসে আছে, সাথে তার আর ছেলেপেলে। ক্লাসের সেই মেয়েটা যাচ্ছিলো স্পর্শ জোরে ডাক মারে,

-এই যে হাফ লেডিস্। আর কোনো নাম পেলো না আমার নাম রাখলো কেনো তোমার বাবা মা।

মেয়েটা বুঝতে পারে তাকে ই এই কথা বলেছে মেয়েটা রেগে এসে বললো,

–শুনোন আমার নাম স্পর্শিয়া। কিন্তু পিএসসি এক্সামের সময় স্যার আমার নাম ভুল করে স্পর্শ লিখে দেয়। সংশোধন করতে পারিনি তাই এই ভুল হয়েছে।

-নিজের অন্য নাম দিবা কলেজে।

-আমি কী করবো সবাই আমাকে এই নাম ধরে ডাকে।

-সবাইকে তোমার আকিকা দিয়ে দাওয়াত খাওবা তাহলে নতুন নাম ধরে সবাই ডাকবে। আর যদি কেউ স্পর্শ বলে ডাকে তাহলে মেরে তোমার কোমর ভেঙ্গে দিবো।

চলবে,