হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০৫

0
2819

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০৫)
লিখাঃ- সুহাসিনী

প্রায় বেশ কয়েক মুহুর্ত পর ত্রাত্রি আমাকে কল দিয়ে বলে উঠলো- সুহাসিনী, আমরা দুজনে রিদমের লাশ নিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকে রিদমের লাশ মিসিং।”

রিদমের লাশ কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো ওরা, তা আমার অজানা। শুরু থেকেই সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে আমার। কোথায় কখন কী করা উচিত,সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। ত্রাত্রি কল কেটে দিয়েছে। গভীর রাত। ঘরজুড়ে রক্তের দাগ। আমার বন্ধু রিদমের শরীরের রক্তের দাগ। সেই রক্তের উপরেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। কী ভয়ংকর দুঃসাহস! আমার চিৎকার দিয়ে কান্না করা উচিত। অথচ কান্না পাচ্ছে না মোটেও। পৃথিবীতে আমার মতো এমনও স্বার্থপর বন্ধু হয়?

হঠাৎ বাসার ছাদে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। এই রাতে কেন ছাদে কেউ কান্না করবে? কান্নার আওয়াজটা ঠিক কার,সেটাও বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। এই বাসায় নিচের ফ্ল্যাটে বয়স্কা বাড়িওয়ালী এবং তার স্বামী। উপরের ফ্ল্যাটে থাকি আমরা কয়েকজন মেয়ে। তার মধ্যে মাত্র তিনজন আজ। অজান্তেই ধীরে ধীরে এক পা দুই পা করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কান্নার আওয়াজটা দীর্ঘ হয়ে আসছে। বাতাসে চাপা অনুভূতি। ছোট একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ। অনেকক্ষণ দম নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে কান্না করছে। ভারি অদ্ভুত সুর তার। প্রায় ছাদে পৌঁছে ছাদের দরজায় ধাক্কা দিতেই শব্দটা হঠাৎ থেমে গেলো। পুরো ছাদ জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েটা তো দূরের বিষয় কারোরই অস্তিত্ব পাচ্ছি না। কিন্তু একটা বিষয় বেশ ভাবাচ্ছে। সমস্ত ছাদ কেমন যেন ভার ভার হয়ে আছে। কেউ যেন ধীর পায়ে পদক্ষেপ ফেলছে,এমন অনুভূতি। পা পিছিয়ে ফিরে আসতেও ভয় লাগছে এবার। মনে হচ্ছে, পিছন ঘুরে ফিরে আসতেই কেউ আমার কাঁধে ভারি নিশ্বাস ফেলবে বা হয়তো কাঁধ চেপে ধরবে। পিছন দিকে ওভাবে চেয়েই সিঁড়ির দিকে পিছন ঘুরে ছাদ থেকে দ্রুত পায়ে নেমে এলাম।

ত্রাত্রি আর ফাইজা আপু চলে এসেছেন। ফাইজা আপু সম্পূর্ণভাবে ঘেমে একাকার। ত্রাত্রি ঘামেনি অবশ্য। তবে হাঁপাচ্ছে। মনে হয় একটু বেশিই ভয় পেয়ে গেছে। আমার মুখের দিকে চেয়ে ত্রাত্রি জিজ্ঞাসা করলো,
-এই রাতে একা একা ছাদে কী করতে গেছিলি? তোর কী ভয় ডর কিছু নেই?

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

আমি বললাম,
– কিন্তু ছাদে একটা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হলাম। একটা ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। কেমন যেন সুর করে করে কান্না করছিলো। আমি যেতেই থেমে গেছে।

-বাচ্চা কান্না করছিলো? কোথায় সে?

-সেটা দেখতেই তো ছাদে গেছিলাম। পাইনি।

আমার কথা শুনে ত্রাত্রি কয়েক মুহুর্ত অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো। তারপর কোনো কিছু না বলেই একছুটে ছাদে। ফাইজা আপু নিরবে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মুখের দিকে চেয়ে। বেশ কয়েক মুহুর্ত পর উনি বললেন,
-তোমার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভেবে দেখো ভালো করে। তোমার রুমেই এমন সমস্যা হচ্ছে। আমার মনে হয় ভালো একজন সাইকোলিস্টের কাছে তোমার পরামর্শ নেওয়া উচিত হবে।

-আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি পাগল? আপনাদের কারো ভিতরেই সমস্যা। অথবা আপনিও হতে পারেন। আমি আমার বন্ধুকে মারতে পারবো? আমার তো মনে হচ্ছে, আপনারাই কোনোভাবে ওকে মেরে গুম করে দিয়েছেন। ওর হাতে কেমন জানোয়ারের মতোন আঘাতের চিহ্ন। পুলিশকে বললে জীবনেও বিশ্বাস করবে না। উলটো আমাকেই পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে।আপনাদেরও দেবে। আচ্ছা,আপনি সত্যিই মানুষ তো?

ফাইজা আপু আমার প্রশ্নে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। বিস্ময়ে তার ঠোঁটদুটো কেঁপে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। অনেক চেষ্টার পর সামান্য একটু আওয়াজ করে বললেন,
– তুমি একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে গেছো। কী বলছো৷ আর কী করছো একবারও ভেবে বলছো না। গ্রামে যাও,তোমার অনেক রেস্ট দরকার। যাও,এখন গিয়ে ঘুমাও।

ফাইজা আপু বেশ গম্ভীর মুখে আমার দিকে চেয়ে থেকে সিঁড়িতে ত্রাত্রির পায়ের আওয়াজ পেতেই সামনে থেকে চলে গেলেন। ত্রাত্রি একবার ভ্রু কুঁচকে আপুর দিকে তাকালো। তারপর ইশারায় জিজ্ঞাসা করল,
-কী হয়েছে?

আমি ছোট একটা শ্বাস নিয়ে বললাম,
-উল্টাপাল্টা রাগারাগি করেছি। অভিমান করেছেন। বললেন, আমার নাকি বাসায় চলে যাওয়া উচিত।

-বাসায়!

ত্রাত্রি যেন বেশ অবাক হলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলতে লাগল,
-কিন্ত এই অবস্থায় বাসায় যেতে পারবি কি না সেটাই তো চিন্তার বিষয়।দেখ, যেটা ভাল মনে হয় তোর।

বাকিটা রাত আর ঘুমুতে পারিনি। ত্রাত্রি আমার পাশেই জেগে ছিল। বারবার কেবল রিদমের কথাগুলোই মনে হচ্ছে। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তার এমন করুণ মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। কেবল আমি। অথচ ওর মৃত্যুটাকেও ধামাচাপা দিচ্ছি নিজের স্বার্থের জন্য। নাহ, নিজের স্বার্থ হয়ত না। পুলিশ জানলে আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। কখনোই করবে না। কেবল এই কারণেই আমরা চেপে গেছি। এটাই সত্যি। কিন্তু রিদমকে আমরা ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি। ওর খুনের রহস্য উদঘাটন তো আমাকে করতেই হবে। এতদিন থেকে যখন এই বাসায় কোনো সমস্যা হয়নি, তবে আজ কেন? ফ্ল্যাট ছেড়ে দিলে চলবে না।

কিন্তু সমস্যা আটকে আছে। আমাকে আর এখানে আপাতত থাকতে দেওয়া হবে না। ফাইজা আপুর ধারণা, আমার মানসিক সমস্যা আছে। আমাকে সে এখন কোনোভাবেই থাকতে দেবে না আর।

পরদিন সকালে ত্রাত্রি আর ফাইজা আপু আমাকে স্টেশনে এগিয়ে দিতে এলেন। ঠিক সময়েই ট্রেন এসেছে। ট্রেনে উঠে জানালা ধরে ওরা দুজনে দাঁড়ালো। আমি কেবল চুপচাপ দুজনের মুখের দিকে চেয়ে আছি। ওরা কী কষ্ট পাচ্ছে? নাকি স্বাভাবিক? ওদের মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না। সকালে আবারো অদ্ভুত সেই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। আমার রোজবাক্সে টুকটাক অনেক জিনিসই রাখি। সকালে ওটা বের করে খুলে দেখি যত্নে তুলে রাখা নূপুরগুলো নেই। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি নূপুরগুলো রোজবাক্সেই রেখেছিলাম। একথা কাউকে জানাইনি আর। জানাতে গেলেই ওরা আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলতে শুরু করবে।

যখন গ্রামের স্টেশনের মোড়ে পৌঁছালাম, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আশেপাশে মানুষজন কমবেশি আছে। তবে সন্ধ্যা হলে গ্রামের মানুষগুলো বাইরে তেমন ঘুরাঘুরি করে না। ওরা এক জায়গায় বসে চা খায়, গল্পগুজব করে। নয়তো চুপচাপ ঘরের বারান্দায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। স্টেশন থেকে বাড়ি অব্দি বেশ খানিকটা হেঁটে যাবার পথ। পাঁচ মিনিট তো হবারই কথা। এতদিন নিজের ফ্ল্যাটে অতসব ভয়ংকর অদ্ভুতুড়ে ঘটনা দেখেও ভয় পাইনি তেমন। কিন্তু এই মুহুর্তে কেমন যেন একাকী অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, তামাম দুনিয়ায় আমি কোনো অচেনা মানুষ। একটা গাছের পাতা পড়লেও বুকের মাঝখানটায় কেঁপে উঠছে। উফফ! কী বিচ্ছিরি অনুভূতি! কোনোদিকে তাকাতে পারছি না। কেবল একমনে চোখ নামিয়ে ঘাড় গুঁজে হেঁটে যাচ্ছি।
হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ যেন খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে বলছে,
-আরে, এত ভয় পাও কেন? ভীতু মেয়ে একটা। আমি কী তোমাকে খেয়ে ফেলছি নাকি? এত ভয় পেলে আমি কিন্তু তোমার সামনে এসেই ধরা দেবো।

মাথা তুললাম না। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। কপালের মাঝ বরাবর ঘাম এসে জমে আছে। পাশেই কোথাও যেন একটা পাখি ক্যাক করে ডেকে উঠলো। তারপর ছুটে পালালো দূরের পথে। ছুটে পালাতে পারছি না কেবল আমি। পা উঠতে চাইছে না। নিজের উপরেই যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। কাছেই কোনো একটা ডালে হুতোম পেঁচা ডাকছিলো। এখন থেমে আছে।

প্রায় কতক্ষণ সময় নিয়ে তবু বাসায় পৌঁছাতে পারলাম, আমি নিজেই সেই সময়ের হিসাব জানিনা। ওই অদৃশ্য কন্ঠস্বরটা আমার সামনে তো এল না। আমি আরো বেশি ভয় পাবো বলে? জানিনা, আমার কাছে কোনো যোগ বিয়োগের হিসাব নেই। রাতে খাওয়া দাওয়া করে টেবিলে বই নিয়ে বসলাম। মা বাইরের উঠোনের চুলোয় কী জানি বানাচ্ছেন। ছোটবোন সানা মায়ের সামনে বসে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ওর এই একটা স্বভাব। কেউ কিছু করতে বসলেই তার কাছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে।

কিছুক্ষণ পর দরজা ঠেলে কারো ভিতরে আসার শব্দ হলো। সানা এসেছে। এসেই আমার টেবিলের পাশের বিছানায় পা দুলিয়ে বসে পড়লো। আমি বই থেকে মুখ তুলিনি তখনো। রবীন্দ্রনাথের “চোখের বালি” পড়ছি। বইয়ের পৃষ্টায় দৃষ্টি স্থির রেখেই সানাকে বললাম,
“বুকসেল্ফের তাকে দেখ একটা বাক্স আছে। ওখান থেকে কালার পেনটা দে তো।”

চাইতে চাইতেই অপর পাশের বুকসেল্ফে খটখট শব্দ করে উঠলো। কেউ বাক্সটা খুলছে। কিন্তু এপাশে তো সানা ঠিকই বসে আছে। ওর অস্তিত্ব ঠিকই বুঝতে পারছি। চমকে উঠে বুকশেলফের দিকে চোখ ফেরালাম। কেবল একটা বড় লম্বা হাত শেলফের বাক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অথচ কোনো মানুষ নেই। “সানা” বলে চিৎকার দিয়ে এপাশে তাকালাম, ঠিক সেই মুহুর্তে….

to be continued…