হাতে রেখো হাত পর্ব-১৯+২০

0
228

#হাতে_রেখো_হাত (১৯)

সেনাবাহিনীর ট্রেনিংটা হচ্ছে সব থেকে যন্ত্রনাময় এক ট্রেনিং। তাঁর উপর ওরা দুজন স্পেশাল ফোর্সে নিয়োগ হতে চলেছে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই জগিং এর জন্য বের হতে হলো। জানুয়ারি মাস হওয়ার কারণে শীতের প্রকোপটা একটু বেশিই বলা চলে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে খবর এসেছে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল কিছু দিন পূর্বে। সেটা কমে যেতেই তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে হু হু করে। মাইনাস এর ঘরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে! যদি ও এখন আট দশে এ উঠা নামা করছে। দেশের আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনে ও থেমে নেই ওদের স্পেশাল ফোর্স। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ছুটে চলেছে আবরাজ ও সীরাত। মাথায় থাকা হ্যাট এর সাথে লাগানো রয়েছে ছোট্ট টচ লাইট। যেটার সাহায্যে রাস্তা দেখবে ওরা। এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার সাথে তীব্র কুয়াশা। গাঁয়ে জগিং কস্টিউম। তবে সেটা শীত মানাতে অক্ষম। বার বার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। প্রায় দুই কিলোমিটার জগিং করার পর হাঁপিয়ে উঠল সীরাত। অথচ অন্য সময় নিমিষেই পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নিত! হাঁটুতে হাত রেখে শ্বাস নিল বার কয়েক। মেয়েটার বাহু ধরে উঁচু করল আবরাজ। “খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে?”

“হ্যাঁ।”

“কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিবে?”

“আচ্ছা চলো।”

পাহাড়ের ঢাল থেকে একটু সমতল স্থানে এসে গাছের শিখরে বসল দুজনায়। মনে মনে দোয়া পাঠ করল। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল জার্নির সফলতার। সীরাতের দিকে তাকিয়ে আবরাজ লক্ষ্য করল মেয়েটার মুখ মন্ডল কেমন শুকিয়ে কাঠ। কয়েক দিনেই যেন বয়স বেড়ে গেছে। সীরাতের মাথাটা হাতের সাহায্যে আলগোছে বুকে চেপে নিল আবরাজ। সীরাত বলল “তোমার বুকের মধ্যভাগে যেন হয় শুধু আমার বাস।”

স্মিত হাসল ছেলেটি। সীরাতের এলোমেলো চুলের গুচ্ছে হাত গলিয়ে দিল। মাথায় বিলি কেঁটে দিতে দিতে বলল “শুধু তোমার ই বাস হবে সীরাত। শুধু তোমার ই বাস। এই যে ধরলাম তোমার হাত।”

“আমরা বিয়ে করছি কবে?”

বিয়ে শব্দটা টনক নাড়িয়ে দিল আবরাজের। ছেলেটি একটু সময় নিয়ে বলল “তুমি তো জানোই সেনাবাহিনী তে নিয়োগ দেওয়া হয় অবিবাহিতদের।”

“সেটা তো বুঝলাম। তবে নিয়োগ দেওয়া হবে সামনে মাসেই। আমরা কি পরের মাসেই বিয়ে করতে পারি না?”

ছেলেটা সম্মতি জানায়। আবরাজের গালে চুমু খেল মেয়েটি। ছেলেটার গলায় নাক ডুবিয়ে কয়েকটা শ্বাস ফেলল। যেন বুকের ভেতর পাহাড় সমান চিন্তাটা নিমেষেই নেমে গেছে।

প্রায় ঘন্টা খানেক জগিং করার পর পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসল দুজনেই। সীরাতের সাথে সাথে আবরাজ ও হাঁপিয়ে উঠেছে। ছেলেটার ঘর্মাক্ত মুখে ছোপ ছোপ লাল দাগ। আঁতকে উঠল মেয়েটি। আবরাজের মুখে হালকা হাতে হাত বুলাচ্ছে। “একি মুখে লাল লাল দাগ কেন?”

“দেখি, ফোনটা দাও তো।”

ফোন এগিয়ে দেয় সীরাত। নিজের মুখটা ক্যামেরায় দেখে ফোঁস করে দম ফেলে ছেলেটি। সীরাতের চিন্তিত মুখের যা তা অবস্থা। ফলে হেসে উঠে আবরাজ। “আরে পাগলী এটা এলার্জির জন্য হয়েছে। আমার খুব ই সামান্য এলার্জি রয়েছে। অনেক দিন ধরে মেডিসিনের প্রয়োজন হয় না। ”

“ইসস কেমন হয়ে গেল। চিন্তার কারণ নেই তো?”

“উঁহু। আসো আগে ক্যাম্প এ যাই।”

“হুম।”

তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছে। মোট আটাশ জন কে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে ছয় জন কে নেওয়া হবে। তাই একটু বেশি কসরত করতে হচ্ছে। প্রতিটা মানুষ ই চরম খাটুনি দিচ্ছে।

তাঁবুর ভেতরে এসে শুয়ে পরে সীরাত। আবরাজ যায় ক্যাম্পিং প্রধান এর কাছে। লোকটি কারো সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছেন। কথা শেষ হতেই আবরাজ বলল
“হ্যালো স্যার।”

“হ্যালো মাই বয়। হঠাৎ কি মনে করে?”

“স্যার ট্রেনিং চলবে কতদিন?”

“দেখা যাক। তবে শোনো আজ সন্ধ্যাতে একটা বিশেষ পরীক্ষা আছে সকলের। এটা কিন্তু খুব ই হার্ড।”

“কেমন পরীক্ষা?”

“উহু সন্ধ্যাতেই জানাব সকলকে।”

লোকটা দূর্ভেদ্য হাসল। আবরাজের পিঠ চাপরে চলে গেলেন তারপর। ছেলেটি বিধ্বস্ত পায়ে তাঁবুর কাছে আসল। মনে মনে প্রার্থনা করছে সেই পরীক্ষাটি যেন না হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। পুরো আকাশ জুড়ে ঘন কালো অন্ধকার। সবাই কাঁপতে কাঁপতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আগুনের উত্তাপে সকলে গা গরম করছে। ঠিক তখনি ক্যাপ্টেন মনসুর আহমদ বললেন “তোমাদের সকলকে আজ সন্ধ্যার আয়োজনে স্বাগতম। আজ খুব দারুন খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।”

সকলে কড়তালি দিল। হাত উঁচিয়ে থামতে বললেন তিনি। একটা পেপার বের করে বললেন “এই পেপারে রয়েছে একটি বিশেষ ঘোষনা। যা শোনার পর হয়ত সবাই শকড হতে পারো। তবে ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে যেভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয় আমরা ও সেভাবে ট্রেনিং দিতে চাচ্ছি। কারন একজন সেনাবাহিনীর মূল কথা হলো দেশের প্রতি ভালোবাসা। এই দেশপ্রেমের জন্য তাঁকে টিকে থাকতে হবে। মূলত শক্ত পোক্তদের ই সেনাবাহিনী তে নিয়োগ করা হয় বা হবে। কারণ দূর্বল রা নিজেকেই রক্ষা করতে পারে না। আর তাঁরা অন্যদের রক্ষা করবে কি করে?”

সকলের মাঝে টান টান উত্তেজনা কাজ করছে। আবরাজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। যা ভয় পেয়েছিল তাই হতে যাচ্ছে। সীরাত এখনো কিছু বুঝে উঠে নি। ওর হৃদয়ে দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকলেও সেনাবাহিনী নিয়ে তেমন গবেষণা করার সুযোগ হয় নি। তাই আবরাজের জ্যাকেট খামচে ধরে বলল “স্যার কি বললেন বলো তো?”

“আজকের আয়োজন দেখেছ?”

“হুহম। দারুণ সব খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। উফ ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।”

“পেটুক হইয়ো না একটু পরে সব আনন্দ বের হবে।”

“কি সব বলছ?”

“যা বলছি তাই। দেখ শুধু কি হয়।”

“ধ্যাত!”

থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। সবার জন্য সুস্বাদু ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলেই পেট পুরে খেল।

ক্যাপ্টেন মনসুর সকলকে জড়ো হতে বললেন। সকলে জড়ো হতেই কাগজটা মেলে ধরলেন তিনি। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললেন “এখানে লিখা আছে আজ থেকে আগামী সাত দিন আপনারা কোনো রকম খাবার পাবেন না। সমস্ত খাবার এই বন জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে খেতে হবে। আর তাঁর পরের উইক এ চার দিন আপনাদের খাবার দেওয়া হবে তবে সে খাবারটা, আচ্ছা থাক এটা না হয় পরে জানলেন। আপাতত এই সাত দিনের জন্য প্রস্তুত তো?”

সকলে এক যোগে বলল “ইয়েস স্যার।”

সীরাতের ভ্রু কুচকে আছে। আবরাজের হাত চেপে বলল “স্যার পুরো কথা বললেন না কেন?”

“বললে আগামী সাত দিন পেটে ভাত যাবে না।”

“আবরাজ তুমি একটা যা তা। ধ্যাত আমি গেলাম, ঘুম পাচ্ছে।”

মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। কি যে হবে কে জানে! অফিসার আবুল তাকে বলেছিল সীরাত অনেক খুঁতখুঁতে। ওর মনে দেশ প্রেম জাগাতে কসরত করতে হয়েছে। তিনি তাই চেয়েছিলেন পাশে এমন কেউ থাকুক যে ওকে ভরসা দিবে। দেশকে ভালোবাসবে।

সকাল সকাল খিদে না পেলে ও জগিং করার পর পর ই পেটে ইঁদুর খেলা শুরু হয়ে গেল। সকলে বেরিয়ে পরল খাবারের সন্ধানে। বন জঙ্গলে সর্বোচ্চ ফল পাওয়া যাবে। অথবা কিছু শাক। সীরাতের সাথে জুটি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে আবরাজ। মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। “কি জঙ্গল এটা? যার কোনো আগা মাথা নেই। শুধু পাহাড়ি গাছের জঙ্গল।”

“কথা বলো না। এখন খোঁজ কর।”

চোখ বুলাতে থাকে সীরাত। কিছুই চোখে পড়ল না। পাশেই তীব্র স্রোতের নদী। ঝর্ণার পানি এসে মিলিত হচ্ছে। মেয়েটার লোভ জাগে। খাবারে সন্ধান ছেড়ে সেখানে এসে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে আবরাজের উদ্দেশ্যে করে ডাকে “এদিকে আসো।”

কথাটা যেন কয়েক বার বেজে উঠল। পাহাড়ের বুকে কথা আটকে প্রতিধ্বনি শুরু হয়েছে। মেয়েটার মনে প্রফুল্লতা ছড়িয়ে পড়েছে। চিৎকার করে যাচ্ছে। “ভালোবাসি।”

আরও কয়েক বার কথাটা শোনা গেল। পাশে এসে দাঁড়ায় আবরাজ। হাতে কিছু ফল। পাশেই ছিল গাছ টা। তবে খুব সাবধানের সাথে ফল গুলো নিতে হয়েছে। কারন গাছটা ভর্তি ছিল কাঁটা। যদি ও বেশ কিছু স্থানে কাঁটার আঘা*ত হয়েছে। “চলো পেয়ে গেছি ফল।”

“উহু। আমি যাব না।”

“কি করবে?”

“একযোগে ভালোবাসি বলব।”

“সীরাত লেইট হচ্ছে তো।”

বায়না ধরে মেয়েটি। আবরাজের মন প্রশমিত হয়। সে ও মেতে উঠে প্রতিধ্বনির খেলায়। সীরাতের বাহুতে স্পর্শ করে। কাঁধে থুতনি রেখে পেছন থেকে দু হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে উঠে আচানাক
‘ভালোবাসি সীরাত। খুব বেশি ভালোবাসি। শুধু হাতে রেখো হাত, প্রমিস করছি আমি তোমার জন্য সব সুখ এনে দিব দু হাতের মুঠোয়।’

**রুস্মি একটি অপূর্ণ অধ্যায়। ওর গল্প ঐ অবধিই। পর্ব ১৭ তে আমি বি এস সির জায়গাতে বি সি এস লিখে ফেলেছি। 🤦‍♀️ মূলত সেটা বি এস সি হব্বে। এডিট এর সময় এই অপকর্মটি ঘটে।**

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

ভ#হাতে_রেখো_হাত (২০)

বন জঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে সবাইকেই। তবে মোটিমুটি সবাই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যেহেতু জঙ্গলে পর্যাপ্ত পরিমানে ফল গাছ ছিল তাই তেমন অসুবিধা হয় নি। সীরাত তো সব থেকে বেশি খুশি। একটু আগে সবাইকে ধরে ধরে নাচ শুরু করেছে। হেসে কুটি কুটি হয় আবরাজ। মেয়েটা আস্ত এক পাগলি। দুপুর হয় নি এখনো। সীরাতের ফোনটা বেজে উঠল। নাচ থামিয়ে কল রিসিভ করল। ভাগ্যিস নেট প্রবলেম নেই এখন। ভিডিও কল করেছে রকি। সাথে রাই ও রয়েছে। হাত নাড়িয়ে সীরাত বলল “হেইই মাই ডিয়ার ভাইয়া অর ভাবী। সব কেমন চলছে?”

“খুব ভালো তোমার ভাইয়া তো আজকাল অতিরিক্ত দরদ মাখা হয়ে গেছে। দেখ কেমন পাশে বসে আছে। যেন নড়তে গেলে ও ধরে রাখে হাত।”

“হুমম প্রেম চলছে দুজনের। এদিকে আমার ছোট্ট ময়না টা বাবা মায়ের প্রেম কাহিনী দেখে নিজেই না প্রেম শুরু করে দেয়। হা, এভাবে চললে তো আমাদের অন্তর পুড়ে যাবে। একটু দেখ,বুঝো আমাদের কষ্টটা।”

সীরাতের কথায় হেসে উঠল রকি আর রাই। মুচকি হাসছে সীরাত। ততক্ষনে মেয়েটার সঙ্গী হয়েছে আবরাজ। সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে বলল
“খুব দ্রুত বাবুকে দেখতে চাই। আমার তো ইচ্ছে করছে এখনি চলে আসি।”

“আরে থামো ভাই। এখনো কয়েকটা মাস বাকি। সময় হোক, একটু সবুর কর ইয়ার।”

“সেটা ও ঠিক। আচ্ছা সবাই কথা বল আমি যাই।”

“ওকে।”

“কি রে তোর প্রেম কতদূর?”

“পানি কত দূর গড়িয়েছে ননদীনি?”

“ভাবী প্লিজ।”

লজ্জা পেল সীরাত। রকি আর রাই দুজনেই স্বস্তি ময় একটি দম ফেলল। রাই আর আবরাজের সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক। অতীতের কথা স্মরণে নেই কারোর। প্রিয় মানুষ গুলো ভালো থাকলে কতটা সুখ অনুভব হয় তা মুখে বলা যায় না।
.

‘ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় সীরাত?’

সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কথাটা বলল আবরাজ। ঘোর লাগা চোখে তাকায় সীরাত। শরীরের সাথে কিছুটা চেপে বসেছে মেয়েটা। আবরাজের গা থেকে অদ্ভুত শুভ্রতা এসে নাকে এসে লাগছে। সেই সুবাস নিতেই ব্যস্ত হলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবরাজ। মেয়েটাকে হালকা হাতে জড়িয়ে ধরল। চোখ বন্ধ করতেই সীরাত বলল “অনুভূতি। ভালোবাসা হলো অনুভূতি। এটা কে অনুভব করতে হয় কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই যে ধরেছ হাত, এর চেয়ে সুখময় আর কি হয় বলতে পারবে? উহু পারবে না। উচিত ও না। এটা শুধু অনুভব করবে। শুধুই অনুভব।”

ইষৎ হাসে আবরাজ। সীরাতের হাতে হাত গলিয়ে চোখ বন্ধ করে। সত্যিই ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না। এটা কেবল অনুভব করতে হয়।

রাতের খাবার শেষ হতেই ক্যাপ্টেন মনসুর আহমদ এর ডাক। সকলে কাঁপতে কাঁপতে জড়ো হলো। একটা কাগজ হাতে নিলেন তিনি। সরকারি নির্দেশনার ফর্ম এটা। এক পলক তাকিয়ে বললেন “সবাই ফর্মটা তে লক্ষ্য করো। আমি তোমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ দিতে চলেছি। এটাই তোমাদের সর্বশেষ পরীক্ষা। ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয় সবার ই জানা। তাঁর মধ্য থেকে টিকে থাকার লড়াই এর জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা ধার্য করা হয়েছে। সবাই প্রস্তুত?”

সবাই সম্মতি জানায়। চার পাশে কুয়াশার আস্তরণ। মনসুর ঘন ঘন শ্বাস নিলেন। পরক্ষণেই মুখে তৃপ্তি এনে বললেন “ভালো খাবার, ময়লা জায়গায় ফেলে দেওয়া হবে। সেটা কুড়িয়ে খেতে হবে সবাই কে। সাত দিন চলবে এটা। এখন যারা যারা প্রস্তুত তাঁরা এগিয়ে আসো।”

কেউ এগোলো না। সবার মধ্য চাঁপা ভয় কাজ করছে। এমন একটা বিষয় যেন কেউ ই হজম করতে পারছে না। সীরাতের মাথায় হাত। প্রচন্ড পরিমানে আশংকা গ্রস্ত। আবরাজের দিকে তাকিয়ে হো হো করে কেঁদে দিল। মেয়েটি খাবারের বিষয়ে খুবই সেনসেটিভ। এটা প্রায় অসম্ভব। ছেলেটা এক হাতে জড়িয়ে নিল ওকে। কিছুটা দূরে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। সীরাতের হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরল “ভালোবাসো আমায়?”

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সীরাত। এ কেমন ধারার প্রশ্ন?

“বল ভালোবাসো কি আমায়?”

“আবরাজ!”

“কোনো কথা নয় যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর কর।”

“প্রচন্ড ভালোবাসি।”

“আমার জন্য হলে ও পারতে হবে তোমায়। মনে কর আমার মাথায় রাইফেল ঠেকানো। তুমি হেরে গেলেই আমার জীবন শেষ। তাছাড়া আমাকে শক্তি দিয়েছ তুমি। তোমায় দেখে আমি নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে চলেছি।”

শেষোক্ত কথা গুলোতে বুক কাঁপুনি দিয়ে উঠল। হাতটা ছাড়িয়ে দূরে এসে দাঁড়ায় মেয়েটি। বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছে। ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইল আবরাজের দিকে। ছেলেটার ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি। হাত উঁচিয়ে অবরাজ বলল “তুমি পারবে সীরাত। তুমি পারবে, আমার ভালোবাসার জোরে হলে ও তোমাকে পারতে হবে।”

তখনি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল সীরাত। হুটহাট জড়িয়ে ধরা যেন ওর জীবনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। সীরাতের চোখে মুখে ভয় নেই এখন। যা আছে তা ভাষায় ব্যক্ত সম্ভব নয়। কারণ এটা কেবল অনুভব করা যায়।

পরদিন খুব ভোর বেলা উঠে আবরাজ। সীরাত এখনো ঘুমে। তাঁবুর কাছে গিয়ে বলল “সীরাত উঠ। লেইট হয়ে যাচ্ছে।”

হাই তুলতে তুলতে তাঁবু থেকে বের হলো সীরাত। ইদানিং মেয়েটার মাঝে অলসতা এসেছে। আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে বলল “গুড মর্নিং।”

“গুড মর্নিং। ফ্রেস হবে, চল।”

“হ্যাঁ।”

“সীরাত, আবরাজ।”

কারো কণ্ঠ শুনে পেছন ঘুরে তাকালো দুজনেই। একজন কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা হাসি টানা ঠোঁটে। “আপনারা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন। শুধু মাত্র বাথরুম ব্যবহার করতে পারবেন। ব্রাশ পেস্ট ছাড়াই ফ্রেস হতে হবে।”

“হোয়াট!”

সীরাতের মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠল। মেয়েটা যতই শারীরিক পরিশ্রম করে থাকুক না কেন এসব বিষয়ে খুঁতখুঁতে। ওকে সামলে নিল আবরাজ। সীরাতের চেহারায় যেন ছোপ ছোপ কালি পরে গেল। মুহূর্তেই যেন বয়স বেড়ে হলো কয়েক হাজার গুন।

কোনো মতে ফ্রেস হলো দুজনেই। ব্রাশ পেস্ট ছাড়া মুখ ধোঁয়াটা যথেষ্ট বাজে বিষয় বলে মনে হয় সীরাতের কাছে। খাবার নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে সবাই। আটাশ জন থেকে বিশ জন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করবে বলে সম্মতি জানিয়েছে। এক বস্তা খাবার নিয়ে এলেন একজন সার্ভেন্ট। মনসুর বললেন “এই প্রথম নিজ হাতে খাবার নষ্ট করছি। সবাইকৃ লড়তে হবে।”

খাবার গুলো মাটিতে ফেলে দিলেন তিনি। রুটি ডিম সেদ্ধ আর কিছু ফল ছিল। সবাই কে সেগুলো উঠিয়ে নিতে হচ্ছে। সীরাতের গা গুলিয়ে আসল। মেয়েটা সইতে না পেরে বমি করে দিল প্রথমবার। এক হাতে খাবার অন্য হাতে সীরাত কে ধরে একটা খোলা জায়গায় নিয়ে আসে আবরাজ। হঠাৎ ই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল সীরাত। নিজের উপর থেকে ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে। “আমি পারব না এটা করতে।”

“পারতে হবে তোমায়। এ দেশ তোমার আমার। এ দেশ আমাদের সকলের। টিকে থাকার লড়াই এ হেরে গেলে চলবে না।”

“কিন্তু এসবের কি খুব প্রয়োজন? ওমন পরিস্থিতি এলে সময়ের সাথে সাথে সবাই মানিয়ে নিত।”

“পারবে তুমি। নিজের ভেতরে সাহস রাখো। তাছাড়া সবাই মানিয়ে নিতে পারে না। তুমি এমন কেন হয়ে যাচ্ছ। কয়েক মাস আগেও কতটা স্ট্রং ছিলে। আর এখন!”

সাহস এলো সীরাতের। চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করল আবরাজের হাতটা ওর হাতের তালু কে ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ করছে। ভালো লাগে বেশ। চোখ দুটো ভিজে যায় সুখে। বলতে ইচ্ছে করে এভাবেই হাতে রেখো হাত। অন্ততকাল, অন্ততসুখে।

নাক টেনে নিল সীরাত। জীবনের সব থেকে বেশি কান্না এই ট্রেনিং এ এসেই করেছ ওহ। দম বদ্ধকর একটি পরিস্থিতি। খাবারটা বাড়িয়ে দিল আবরাজ। ওহ নিজে ও খেতে পারছে না। সীরাত কোনো মতে মুখে তুলে আবার ফেলে দিল। আবরাজের ও প্রায় একি অবস্থা। ভেতর থেকে নাকোচ করছে। দুজনেই মাটিতে বসে পরল। সত্যিই বলতে এটা খুব বেশি কষ্টকর। নর্দমার ময়লা থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া যেন ইতিহাসের পাতায় পাতায় নীল বি’ষ হয়ে রয়ে গেছে। সেই বি’ষ পান করেই অমর হতে হবে সকলের।

সকাল থেকে কয়েক বার বমি করে কাহিল অবস্থা সীরাতের। অনেকেই হার মেনে নিয়েছেন। কোনো মতে টিকে আছে দশ জন। না জানি কি হয়। পারফর্মেন্স খুব ভালো ছিল সীরাতের। তবে খাবারের বিষয়টা ওকে একদম শেষ করে দিচ্ছে। আবরাজ নিজে ও দ্বিধায় দ্বিধান্বিত। মুখের ভঙ্গিতে বোঝা যায় ঠিক কতখানি হতাশাগ্রস্ত। খাবার খেতে পারে নি। পেট যেন চিপে ধরেছে খাবারের নেশায়। তবে সেই নর্দমার কথা মনে হতেই খাবারের রুচি চলে যাচ্ছে কোথাও। “ভালো লাগছে না আমার।”

“কি করবে বল। এটাই নিয়ম।”

“বাবা কে কল করি?”

“কর।”

সীরাত কল করল। আবুল সাহেবের মুখে কাঠিন্য। তিনি বুঝতে পারছেন মেয়েটি ক্রমশ দূর্বল হয়ে এসেছে। একটা সম্পর্কের মায়ায় জড়িয়েছে। কোনো কিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন “দেশ কে ভালোবাসে যে জন সেই হয় অমর। আমি আশা করব বিষয়টা স্মরণে রাখবে।

“কিন্তু বাবা।”

“কোনো কথা নয় সীরাত। আমি জানি কি বলতে চাও তুমি। মনে রেখো কাগজে কলমে একজন নাগরিক হলেই সব কিছু হয় না। এর জন্য কিছু কাজ করতে হয়। আরে নিজের জীবন দেশের জন্য রাখতে হয় সর্বদা। আর সামান্য খাবারের বিষয়টা মেনে নিতে পারছ না তোমরা?”

আবরাজের মাথাটা নিচু হয়ে গেল। আবুল ফের বললেন “অরিতা কে মনে পরে আবরাজ? জান দিতে রাজি ছিলে তুমি। তবে কিছু ভুলের কারনেই বাঁচাতে পারো নি ওকে। মাথাটা ঠান্ডা কর। দেশকে রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্ব। বোনের জায়গায় দেশ কে রাখো। এগিয়ে যাও দুজনেই। রাখছি।”

টুট টুট শব্দ তুলে কল কেঁটে গেল। সীরাত চোখ থেকে পানি মুছে নিচ্ছে। মনের ভেতর অদ্ভুত প্রশান্তি।আবরাজের হাতটা মুঠোয় নিল।
“চোখ বন্ধ কর।”

বিনা বাক্যে চোখ বন্ধ করল ছেলেটি। মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরন করলো দুজনেই। এক যুগে বলে উঠল “ভালোবাসি দেশকে। নিজের জীবন দিতে রাজি তবু ও দেশ কে রক্ষা করবোই। শুধু পাশে চাই তোমার হাত। এভাবেই থেকে যেও হাতে রেখো হাত।”

কলমে ~ ফাতেমা তুজ
চলবে……