#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরে গেলাম। আম্মু, চাচীরা মিলে কাটাকুটি, রান্নাবান্না করছে। বুয়া ঘরদোর ঝাড়ছে। আমিও হাতে হাতে কিছু কাজ করে দিলাম। অনি লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে। দেখতে আসবে বলে কথা। অবশ্য বরকে আমরা সবাই চিনি। অনির বয়ফ্রেন্ড আরাফাত। আমার এটুকু বোনটাও যে প্রেম করতে পারে তা আমার এখনো বিশ্বাস হয়না। আফসোস হচ্ছে কেন জীবনে একটা প্রেম করলাম না! এই দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অর্নি তুই ঠিকই বলেছিলি, আমার একটা প্রেম করা উচিৎ ছিলো! সময়ে মানুষ বোঝেনা, অসময়ে বোঝে। আর এখন বুঝেও লাভ নেই, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
বেলা বারোটার দিকে আরাফাতের পুরো ফ্যামিলির লোকেরা এলো। আমার মেঝোচাচার মেয়ে অনি। চাচীমা ওকে বকে বকেই হয়রান করে ফেলছে। তার কারণ শাড়ি পরে দুবার উষ্ঠা খেয়ে পড়ছে। লিপস্টিক, মেক আপ নষ্ট করেছে। আমি প্রতিবার সাজিয়ে দিয়েছি। ও বেশ এক্সাইটেড। হয়তো ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেতে চলেছে তাই। কিন্তু আমি, বেহায়ার মতো সবকিছু করেও ধূসরের মনে জায়গা করে নিতে পারলাম না। তাঁর ভাগ্যে হয়তো আমি ছিলাম না; নেই!
অনিকে সাজিয়ে গুছিয়ে আমরা সব কাজিনরা মিলে বরপক্ষের সামনে নিয়ে গেলাম। বিশ জনের এক পল্টন লোক দেখে অনির রীতিমতো হাত-পা কাঁপছে। আরাফাত ওকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। অনিকে আরাফাতের ছোট বোন আলফি এসে অনিকে নিয়ে গেলো। ওকে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে সবাই এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। দু’বার তো অনি নিজের নামটা অবধি ভুল বলে ফেললো। সবাই হেসে উঠলেও বুঝতে পারলো ও বিব্রতবোধ করছে। দেখাদেখির পর্ব শেষ হতেই দুপুরের খাবারের আয়োজন শুরু হলো। আমার খুব ক্লান্ত লাগছিলো, এর মধ্যেই হঠাৎ এসে হাজির হলেন ধূসরের মা-বাবা। আমি অবাক। পরে আম্মু জানালো ওদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যাইহোক, ওনাদের দেখে আমি খুব খুশি হলাম। খাওয়াদাওয়া চলাকালীন সময়ে আমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঠেকে বসলাম। নিচে মানুষজন গিজগিজ করছে। এমনিই আজকাল চিল্লাচিল্লি বিরক্ত লাগে, তার উপর এত মানুষ! জানিনা আচমকা ঘুম এসে গেলো চোখে।
দরজার ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম নিকিতা মা। ওনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুমাচ্ছিলি বুঝি?’
-হুঁ। আসো ভেতর আসো।
-না থাক। ঘুমা তুই।
-আরেনা, আসো তো।
মাকে টেনে ঘরে এনে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। আম্মু এসে বললো ওরা আজ থাকবে। বাবা থাকতে চাইছিলোনা, কিন্তু বাসার সবাই জোর করেই রেখে দিলো। আম্মু মাকে নিয়ে নিচে চলে গেলো। আমি ফ্রেশ হয়ে এলাম। এর মধ্যে পুনম এসে আমায় জানালো আজ রাতে নাকি বাড়িতে বিয়ে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’কার বিয়ে?’
-অনি আপুর।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘কী বলিস?’
-হ্যাঁ ঠিক।
-কে বললো?
-নিচে সবাই আলোচনা করছে। বাবুর্চিকে খবর দেওয়া হয়েছে, আসছে তারা।
-তোর খারাপ লাগছেনা?
-খারাপ লাগবে কেন?
-তোর বড় বোনের বিয়ে…
-তাতে কী? আমিতো দুলাভাই পাবো আরেকটা। তাছাড়া খাওয়াদাওয়া হবে ভারী ভারী। আহা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এই দুই কারণেই তোর ভালো লাগছে?’
-হুম। জানো ভাইয়াও আসছে।
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘কোন ভাইয়া? মামাবাড়ির কেউ?’
-ধুর! কি যে বলনা, ধূসর ভাইয়া আসবে।
আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘কেন আসবে? কী দরকার ওনার?’
-আহা, রাগো কেন। এ বাড়ির বড় জামাই বলে কথা। তাকে দাওয়াত দেবনা? সত্যি আপুনি, তুমি বড্ড পালটে গেছো।
-বেশ করেছি। যা ভাগ এখান থেকে।
পুনম ঘর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরুতে গিয়ে থেমে গেলো। আমায় ডেকে বললো, ‘বড়মা বলেছে আজ বিয়ে তো, তাই তুমি বড়মার জামদানি শাড়িটা পরতে। ওই সাদা আর আকাশী রঙের মিশ্রণে যে ওটা!’
-আমার শাড়ি পরতে ভালো লাগেনা।
-প্লিজ পরো। তাহলে আমিও পড়বো, আন্ডাবাচ্চার দলেরাও তোমার অপেক্ষায় আছে। নইলে সবার শাড়ি পরার প্ল্যানটা ফ্লপ করবে।
পুনমের অনুরোধে আমি শাড়ি পরতে রাজি হলাম। নিচে গেলাম। এলাহি আয়োজন। বরপক্ষের লোকেরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আরাফাত আর অনিকে গেস্ট রুমে বসানো হয়েছে। সবাই তাদেরকে বিভিন্ন কথা বলে লজ্জা দিচ্ছে। অনি লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে, আরাফাত লজ্জা না পেয়ে উল্টো অনিকে লজ্জা দিচ্ছে। সবার হাসাহাসি দেখে ভালোই লাগলো। রান্নাঘরে মা-চাচীরা সবাই ব্যস্ত। আমি ওদেরকে কাজে হেল্প করলাম। গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। নিকিতা মা আমায় সাজিয়ে দিলো। অতি সাধারণ ভাবে, কিন্তু লুকটা আমার খুবই পছন্দ হলো। আমার চশমার সাথে মানানসই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছি।নিকিতা মা বলে উঠলেন, ‘বাহ আরুণী! তোকে তো রুপালি অপরুপা লাগছে।’
-মানে? রুপালি অপরুপা হয় নাকি?
-হয় তো!
আমি হেসে বললাম,
-কী বলো!
-ঠিকই তো বলছি। সাদা জামদানিতে তোর চেহারা ঝলমলে দেখাচ্ছে। মাশাল্লাহ!
-থ্যাংক ইউ!
নিকিতা মা ও রেডি হলেন। বাড়ির সবাই সেজেগুজে নিচে চলে গেছে। আমিও মাকে নিয়ে চলে এলাম। ঘরোয়া আয়োজন। চারদিক ফুলের সৌরভে ‘ম ম’ করছে। মরিচ বাতির আলোয় ড্রয়িং রুমটা হলদে আভায় ছেয়ে আছে। কাজিনরা সবাই ছবিটবি তুলছে। কাজি এলো। একসময় অনি আর আরাফাতের বিয়েও হয়ে গেছে। অনেক ধৈর্য-সাধনার পরে ওরা আজ এক হতে পারলো। বিয়ের ঝামেলা শেষ করে আমি ঘরে চলে এলাম। বরপক্ষ আজ এখানেই থাকবে। ফুলসজ্জার খাট সাজানো হচ্ছে। আমি বড়, ছোটবোনের ঘর সাজাতে কেমন কেমন লাগে তাই আমি ওসবে থাকিনি। সাজগোজ তুলে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম। আজ আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু আকাশে মেঘ আছে, বাইরে হিম করা হাওয়া আছে। প্রকৃতির অপরুপ রুপের সৌন্দর্যের একাংশ রাতে দেখা যায়। বাতাসে মন উদাস করা অনুভূতি!
ঠিক তখন আমার মনে হলো বিয়েতে তো ধূসরের আসার কথা ছিলো, সে কী আসেনি? পরক্ষণেই ভাবলাম, ওনি আসবেন কেন? ওনার না আসাই উচিৎ। বজ্জাত, ইতর একটা লোক। যতই ভাবি এর কথা ব্রেন থেকে একেবারে রিমুভ করে দিবো ততোবারই ব্রেন আমার সাথে দুশমনি করে ওনার চেহারাটা মনে করায়। অবশ্য লোকটা দেখতে শুনতে যতোই ভালো, স্বভাবে ততোটাই একগুঁয়ে আর অহংকারী। হুহ! যাকগে, আমার কী!
আসলে পবিত্র সম্পর্ক বলে তো কিছু একটা আছে, সেটাই বারবার ওনার কথা ভাবতে বাধ্য করে। সেদিন যে ডিভোর্সের কথাটা বললাম এটা আমি করতে পারবো কিনা জানিনা। ছোট এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুধু করলো। আমি উঠে গিয়ে খুললাম।
-কিরে আরুণী? আজকাল এতো দরজা বন্ধ করে রাখিস কেন বলতো?
-এমনি। কিছু বলবে?
-নিচে যা। তোর শ্বাশুড়ির সাথে গিয়ে গল্প করনা একটু।
আমার হাতে কাজ আছে, ওনাকে তো একটু টাইম দিতে হবে। তাইনা?
-আম্মু কোথায়?
-মেহমানদের ওখানে।
-আচ্ছা যাচ্ছি।
নিচে নেমে দেখি হৈ-হল্লা কমেছে। সবাই গেস্টরুমে বর-বউয়ের সাথে। সেদিকে আর গেলাম না। আমি নিকিতা মাকে খুঁজে পেলাম আম্মুর ঘরে অনেক মহিলাদের সাথে নিকিতা মা গল্প করছে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিছু লাগবে কিনা, সমস্যা হচ্ছে কিনা, গল্প করার মানুষ আছে কিনা!
মা বললেন, ‘বিয়েবাড়িতে মানুষের অভাব নেই। তুই গিয়ে মজা কর। আমার চিন্তা করিস না।’
-ঠিক তো?
-হ্যাঁ রে হ্যাঁ!
-আমি আসছি। কিছু লাগলে বলবে কিন্তু।
মা মুচকি হাসলেন। কতো সুন্দর, আমি ওদের বাড়িতে ফিরে যাইনা, ছেলের সাথে ভালো সম্পর্ক পর্যন্ত নেই তাও আমার সাথে কি ভালো ব্যবহার করছে। অন্য কেউ হলে আমাকে চাপকিয়ে নিয়ে যেতো। এদিক থেকে আমি অবশ্য ভাগ্যবতী। এমন শ্বাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
গেস্টরুমের দিকে যাওয়া উচিৎ বলে গেলাম। কাজিনরা সবাই ওখানেই। কি সাজানো হচ্ছে দেখে আসা দরকার। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া। ওমা! এ আমি কাকে দেখছি? ধূসর! ও মাই গড। ওনি এখানে কীভাবে? আর কখন এলেন?
আমি ঘরে ঢুকতেই এক পল্টন মানুষ আমার দিকে তাকালো যেন ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন আইকন আমি। আমি বিব্রত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা?’
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘দুলাভাই অনি আপুর ফুলসজ্জার খাট সাজিয়েছে। কেমন হয়েছে এবার বলো!’
আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। একী শুনলাম আমি?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!