অপরিচিতা_ভালোবাসা (পর্ব-৪)

0
2102

#অপরিচিতা_ভালোবাসা

(পর্ব-৪)

#ফাবিহা_নওশীন

রাফি ভাবছে সেদিনের কথা যখন ওর আর বর্ণালীর বন্ধুত্বের প্রায় ৪মাস চলছে।রাফির মনে হতো বর্ণা ওর বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু।নয়তো উঠতে,বসতে,শুতে,খেতে,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময়েও কেন বর্ণার কথা মনে পড়ে।যখন বর্ণাকে ভুলে যাওয়ার কথা ভাবে দম বন্ধ হয়ে যায়,যখন ভাবে বর্ণার বিয়ে হবে তখন মনে হয় ও মারা যাচ্ছে।তখন মন এক কথায় বলে না বর্ণা শুধু আমার। রাফি দিনরাত ভেবেও এই সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারছেনা।কি করবে,,কাকে বলবে।
তারপর অনেক ভেবে চিন্তে বুঝতে পারলো ও বর্ণাকে ভালোবাসে।ওর বাণুকে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু ওর বাণু কি ভালোবাসে,,কিংবা বাসবে।এক সমস্যার সমাধান করে আরেক সমস্যায় পড়লো।

বর্ণাকে ফোন করে।বর্ণা রিসিভ করতেই অসহায় গলায় বললো,
—বাণু,আমি যদি তোমাকে এমন কিছু বলি যা তোমার পছন্দ নয় তাহলে কি তুমি আমাকে ভুল বুঝে বন্ধুত্ব শেষ করে দিবে?

বর্ণা বুঝতে পারছেনা কি এমন হয়েছে।
—ভুল মানুষই করে,তুমি যদি ভুল করো তবে বন্ধু হিসেবে আমার তোমাকে ছেড়ে দেওয়া না তোমার ভুল সংশোধন করা উচিত তাই তোমার ভুল সংশোধন করে দেবো।
এখন বলো রাফু তো কি হয়েছে?

—-কিছুনা রাখছি।একটু পরে ফোন দিচ্ছি।রাতের বেলা।

—-রাতে আমি আসতে পারবোনা।

—-প্লিজ বাণু।

—আচ্ছা তবে লেইট নাইট।ওকে বায়।

রাফি প্রিপারেশন নিয়ে লেইট নাইট ফোন করে বর্ণাকে।
—হ্যা রাফু বলো।কি এমন ইমার্জেন্সি আর অদ্ভুত আচরণের কারণ কি?

—তুমি বাণু।তোমার জন্য এমন অদ্ভুৎ আচরণ করছি।

বর্ণা শোয়া থেকে উঠে বসে কিছুটা জোরে বললো,কিহ?

—হুম।তোমাকে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শোনো।
আমি তোমার বন্ধু না ভালোবাসা হতে চাই।আমি তোমাকে দূর থেকে নয় কাছ থেকে ভালোবাসতে চাই আজীবন প্রতি ঘন্টায়,প্রতি মিনিট,প্রতি সেকেন্ড আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই।একটা মুহূর্ত মিস করতে চাইনা।
আমি তোমাকে ভালোবাসার সাগড়ে ডুবিয়ে দিতে চাই।তোমাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই,তোমাকে ভালো রাখতে চাই।

একনাগাড়ে কথাগুলো রাফি বলে থেমে গেলো।
বর্ণা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে রাফি এমন কিছু বলবে ভাবতে পারেনি।যদিও কিছুদিন যাবত অদ্ভুৎ আচরণ করছে।

রাফি বর্ণাকে চুপ দেখে বললো,
—বলছিলে না আমি অদ্ভুৎ আচরণ করি,কেমন বদলে যাচ্ছি।কয়েকদিন আমি এর কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবি,তোমাকে ভালোবাসি বাণু।

রাফির মুখে বর্ণার ভালোবাসি কথা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি বয়ে গেলো।কেমন থমকে গেলো।

অপর পাশ থেকে রাফি বর্ণার সারা শব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো। হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।
—বাণু কথা বলো প্লিজ।আমি যদি ভুল কিছু বলে থাকি আমাকে শোধরে দেও,,তুমিই কিন্তু বলেছিলে।আমার উপর রাগ করোনা প্লিজ।আমার মনের অনুভূতি গুলো তোমাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি লাগছিলো না,অস্থিরতায় ভুগছিলাম তাই শেয়ার করলাম।আমার যেমন তোমাকে ভালোবাসি বলার অধিকার আছে তেমনি তোমারও আমাকে অপছন্দ কিংবা রিজেক্ট করার অধিকার আছে।

বর্ণা ছোট্ট করে বললো,
—-রাখছি।

বলেই ফোন কেটে দিলো।রাফি বারবার ট্রায় করেও ফোন বন্ধ পেলো।রাফি নিজেকে নিজেই গালাগাল করছে।

দুদিন যাবত বর্নার ফোন অফ,ফেসবুকেও আসছেনা।রাফি অপরাধবোধে ভুগছে।কেন এসব বলতে গেলো। বর্ণা রাগ করেছে এসব শুনে, হয়তো আর বন্ধুত্ব রাখতে চায়না।
রাফি ফেসবুক, ফোনে কয়েকশ মেসেজ দিয়ে রেখেছে।কিন্তু ডেলিভার হয়নি মেসেজগুলো।

২দিন পর রাত ১২টায় রাফির ফোন বেজে উঠলো। রাফি ফোন হাতে নিয়ে দেখে বর্ণা ফোন করেছে তাড়াতাড়ি ফোন পিক করে বললো,
—-বাণু আ’ম রিয়েলি সরি।প্লিজ আমি আর কখনো এমন করবোনা।তবুও তুমি রাগ করে থেকোনা প্লিজ।প্লিজ।

বর্ণা মুচকি হেসে বললো, তারমানে এখন আর ভালোবাসোনা?

রাফি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, মানে??

বর্ণা কাচুমাচু করে বললো, ইয়ে মানে রাফু,,মানে,

—-মানে??মানে কি বাণু??

—আমি দুদিন সময় নিয়েছিলাম ভাবতে।দিনরাত ভেবেছি আর ভেবে বুঝতে পেরেছি….

রাফি আগ্রহ নিয়ে বললো, কি বুঝতে পেরেছো?

—-আমিও তোমাকে ভালোবাসি।

রাফি নিস্তব্ধ।ওর কানে বারবার বর্ণার কথা বেজে উঠলো।তারপর জোরে চিতকার করে লাফিয়ে বললো,
—-ইয়েস,,ইয়েসস,আই গট ইউ।

রাফির চিতকারে বর্ণার কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম।
রাফি মা চিতকার করে বললো,
—-রাফি চিতকার করছিস কেন?কি হয়েছে?

রাফি বললো, মা খেলা দেখছি।কিছু হয়নি।

বর্ণা রাফির মিথ্যা কথা শুনে হাসছে লাগলো।

~~~~

মাসখানেক পরে-
বর্না আর রাফি মেসেঞ্জারে কথা বলছে।
—-আচ্ছা বাণু আমি তোমাকে কবে দেখবো?চলো একদিন মিট করি ঢাকা এসে।

—উহু,,তোমার আসতে হবেনা।নিউ চাকরিতে মন দেও।

—-তাহলে একটা ছবি,

—-কেন দেখতে চাইছো আমি সুন্দরী কিনা?তোমাকে তো বলেছিই আমি দেখতে সুন্দরী নই।

—-উফফফ বাণু এক কথা কেন বলো বারবার। ঠিক আছে দেখতে চাইনা।একবারে বিয়ের পর দেখবো।আমি তো আর তোমার ফেস দেখে ভালোবাসিনি তোমার অনুভুতি,মন মানসিকতাকে ভালো বেসেছি।

বর্ণা মেসেজ পড়ছে আর হাসছে আর তখনই বর্ণার মা এসে বলে,
—-কি ব্যাপার এভাবে হাসছিস কেন?কারো সাথে চক্কর চলছে নাকি হাহ?মানইজ্জত ডুবানোর প্ল্যান করছিস?

বর্ণা ভয় পেয়ে গেলো।ঢুক গিলে বললো,
—-না মা তেমন কিছু নয়,ফেসবুকে একটা জোক্স পড়ে হাসছি।

—-জোক্স না পড়ে টেবিলে খাবার দে।আর খবরদার মেয়ে যদি কখনো শুনেছি তুই উল্টো পাল্টা কিছু করছিস তবে সেদিন আমার হাত থেকে রক্ষে পাবিনা।
এখনকার মেয়েদের বিশ্বাস নেই।বেশিভাগ মেয়েরা বাড়ির ড্রাইভার, কেয়ারটেকারের সাথে প্রেম করে পালিয়ে যায়।ছিহ ছিহ।তোর কি সেই প্ল্যান নাকি?

মায়ের মুখে এমন জঘন্য কথা শুনে বর্ণার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।সারাদিন ওকে নানান বিষয় নিয়ে কথা শুনাই কিন্তু তা হজম করে নেয় কিন্তু চরিত্র নিয়ে বাজে কথা কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারেনা।

—-এসব ন্যাকামি বন্ধ হলে কাজে আয়।
বর্না রাফিকে বায় দিয়ে টেবিলে খাবার গুছাতে বিজি হয়ে গেলো।

চুপচাপ সবার খাবার দিচ্ছে।নিজে খেতে বসছে না।রুপা বললো,
—কিরে বর্ণা খেতে বসবি না?

বর্ণা বললো, ক্ষিদে নেই একটু পর খাবো।তোমরা খাও।
বর্ণার খাওয়ার ইচ্ছে হারিয়ে গেছে।বর্ণাকে আর কেউ বললো না খাওয়ার কথা।ওর বাবা নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে।বর্ণা নামে কেউ আছে সেদিকে হুশ নাই।

বর্ণা বিছানায় শুয়ে পরলো মন খারাপ করে।কিছুই ভালো লাগছে না।ফেসবুকে রাফিকে এক্টিভ দেখাচ্ছে।বর্ণা মেসেজ করার আগেই রাফি মেসেজ দিলো।

বর্ণা প্রথমেই বললো,
—-আচ্ছা রাফু আমি যদি মরে যাই তাহলে তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?

—-হটাৎ এই আজাইরা কথার কি মানে হুম?

—না বলো।

—-আরেকবার এসব বাজে কথা বলবে সোজা ঢাকায় চলে আসবো তারপর তোমার গাল ফাটিয়ে ফেলবো থাপড়িয়ে।

বর্ণা বুঝতে পারলো রাফি রেগে গেছে।
—-ওকে বাবা,,ওকে আর বলবোনা।খেয়েছো?

—-হুম।তুমি খেয়েছো?

—-না,,ইচ্ছে করছে না।

সাথে সাথেই রাফির ফোন।

—-কি হলো ফোন কেন দিলে?

—-কি হয়েছে তোমার?

—-কিছু হয়নি রাফু।কি হবে?

—তাহলে এমন আজেবাজে কথা বলছো আবার খাওনি।

—খাইনি এমনি ইচ্ছে করছে না।কোনো রিজন নেই।

—-তাহলে এক্ষুনি যাও খেয়ে এসো।নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।

—-আমার ভালো লাগছে না প্লিজ।

—-তুই যাবি??

—-যাচ্ছি যাচ্ছি।রাগ করোনা।

—গুড গার্ল।

??
এভাবেই চলছিলো বর্ণার আর রাফির সম্পর্ক।রাগ,অভিমান,ভালোবাসার মধ্য দিয়েই কেটে গেছে একটা বছর।

একদিন রুপা ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো।সেটা বর্ণা দেখে বললো,
—-কিরে আপু।কি দেখে এমন মুচকি মুচকি হাসছিস?

—-কিছুনা।
(ফোন লুকিয়ে)

বর্ণার সন্দেহ হলো।তাই ও বারবার খোচাচ্ছে রুপাকে কিন্তু রুপা ওকে বলছেনা।বারবার রুপা ফোন লুকাচ্ছে।তাই বর্ণা রুপার ফোন কারা কারি করছে।কিন্তু রুপা বারবার ফোন সরিয়ে ফেলছে।
বর্ণা একসময় রুপার ফোন কেড়ে নিতে সক্ষম হলো বর্ণা তারপর ফোনের লক খোলে স্কিনের মানুষকে দেখে বর্ণা স্তব্ধ হয়ে গেল। রাফির ছবি।রাফির ছবি রুপার কাছে কিভাবে এলো নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বর্ণার মাথায়।

—-আপু কে ছেলেটা?

রুপা লজ্জা পেয়ে বললো,
—ওর নাম রাফি।

—সে নাহয় বুঝলাম কিন্তু এই ছবি তোমার ফোনে কেন?কে ইনি?

—রাফি মায়ের বান্ধবীর ছেলে।কুমিল্লা থাকে।রাফির মা চায় রাফির সাথে আমার বিয়ে দিতে।

রুপার কথা শুনে মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো বর্নার।বর্ণা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

রুপা আবার বলতে শুরু করলো,
—পরীক্ষা শেষ হলেই আমাদের বিয়ের কথা বলবে।আমিও ওকে ভালোবাসি।অনেক ভালোবাসি। প্রথম দেখায় ফিদা হয়ে গেছি।

বর্ণার চোখে পানি ছলছল করছে।রাফিকে রুপা ভালোবাসে,ওদের বিয়ের কথা হচ্ছে তাহলে আমি এসবের মধ্যে কোথায়?
বর্ণা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,
—-আপু যদি এমন হয় রাফির গার্লফ্রেন্ড আছে।অন্য কাউকে ভালোবাসে তবে?

বর্ণার কথা শুনে রুপা ভয় পেয়ে গেলো। তারপর বললো,
—না এটা হতে পারেনা। যদি তেমন কিছু হয় আমি মরে যাবো বর্ণা।আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।আমি ওকে ভালোবাসি।
কাদতে কাদতে বসে পড়লো।

বর্ণা ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—আপু আমি তো এমনি বলেছি।তুই সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?
রাফির কেউ নেই।দেখিস তোর সাথেই বিয়ে হবে।কান্না থামা আপু।

চলবে….