অপ্রিয় শহরে আপনিটাই৷ প্রিয় পর্ব-১৫

0
256

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫.

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে প্রিয়তা সোজা হাঁটতে শুরু করেছে। বাসের জন্য তাকে আর নাহলেও দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো। অদ্ভুত ভাবে আজ একা হাঁটতেও ভিষণ আনন্দ অনুভব হচ্ছে। নিখিলকে সবটা জানাতে পেরেও নিজেকে হালকা লাগছে। হয়তো সে একটু কষ্ট পেয়েছে কিন্তু একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়তার আজকাল নিজেকে সুখি মানুষ মনে হয়। সম্পূর্ণ লাগে নিজেকে। টোনা টুনির সংসার তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। ছোট হাঁড়িতে করে ভাত রান্না, একটা মুরগি, একপদের মাছ আর সবজি দিয়ে সপ্তাহ পার করা। এসব যেন ভিষণ ইন্টারেস্টিং ঠেকছে তার কাছে। খুব বেশি বিলাসিতা নয় আবার অভাব ও না। একদম সচ্ছ সাচ্ছন্দ্যের সংসার তার। তার নিজ হাতে গড়া নিজের সংসার।

শীতের আমেজ পড়ে গিয়েছে। বিকেল হতেই ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস শরীর মন দুটোকেই শীতল করে দিচ্ছে। প্রিয়তার অবশ্য এই শীতকালটা ভিষণ অপ্রিয়। কাজে বড্ড আলসেমি অনুভব হয়। চোখ জুড়ে শুধু ঘুম ঘুম পায়। ভোরে উঠে স্কুলে যেতে প্রায় শরীর আর মনের সাথে যুদ্ধে নামতে হয়। তখন মন চায় বাচ্চাদের বলতে তোমাদের ছুটি। পুরো শীতকাল জুড়ে তোমরা কেবল ঘুমাবে। তোমাদের দায়িত্ববান শিক্ষিকা হিসেবে আমিও অত্র কাজ যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করব।

আয়াজ দুপুরে বাসায় ফেরেনি। একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। প্রিয়তা চিন্তিত হয়ে ডায়াল করলো আয়াজের নাম্বারে। কিন্তু অফ বলছে। প্রিয়তা মন খারাপ করলো। এভাবে গায়েব হ ওয়ার মানে কি? আয়াজ জানেনা প্রিয়তা তার জন্য অপেক্ষা করছে? তার লেট প্রিয়তাকে কতটা টেনশন আর পীড়া দেয় তা সে বোঝেনা?
__________

আয়াজ যখন ফিরল তখন রাত দশটা। ক্লাঞ্ত শরীরটাকে টেনে দ্বিতীয় তলা অবদি তুলতে তার ভিষণ কষ্ট হলো। পরিপাটি মানুষটার চেহারায় কেমন বিধ্বস্ত অবস্থা। পরপর দুবার বেল দিতেই দরজা খুলে গেল। প্রিয়তা দরজা খুলে চুপ করে পাশ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভুল করেও একবার চাইল না আয়াজের পানে। আজ তার মন ভিষণ খারাপ। আয়াজ প্রিয়তার দিক তাকিয়ে অল্প হাসার চেষ্টা করল। ক্লান্ত মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘খেয়েছেন?’

প্রিয়তা এ কথার উত্তর দিল না। রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,

‘ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার গরম করছি।’

আয়াজ ব্যথিত হলো। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে প্রিয়তার পানে চাইল। কিন্তু পাষাণ রমণী মুখ তুলে চাইল না। না দেখলো আয়াজের করুণ সে দৃষ্টিকে। আয়াজ লম্বা করে বেডে শুয়ে পড়লো। মাথাটা ধরেছে খুব। গলা উঁচিয়ে সে প্রিয়তাকে ডাকল।

‘এক কাপ কফি হবে?’

জবাব এলো না। আয়াজ চোখ বন্ধ করলো। চাকরিটা তার হয়নি। চাকরির সন্ধানে তার এক বন্ধুর মামার সাথে দেখা করতে মিরপুর গিয়েছিল। ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে থেকে তবেই তার দেখা পেয়েছে। সেখান থেকে বের হতেই জানতেপারে শাকিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। সে অবস্থাতেই সে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটেছে। আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার কারণ বসত দুর্বল হয়ে সেন্স হাড়িয়েছে। সেলাইন দিয়েছে ডাক্তার। আজ রাত থেকে কাল তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল থেকে একনাগাড়ে এত দৌড়াদৌড়িতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাছাড়া দুপুর থেকে‌ পেটে কিছু পড়েনি।

‘কফি নাও।’

আয়াজ চোখ মেলল। প্রিয়তা এখনো তার দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বউয়ের অভিমানটা তার ভালো লাগলো। আয়াজ ধীরে উঠে বসলো। প্রিয়তার হাত থেকে কাপ নিয়ে তার হাত ধরে কাছে টেনে বসালো। যত্ন করে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিল। আদুরে ভাবে বলল,

‘এত অভিমান এর কারণ?’

প্রিয়তা জবাব দিল না। আজ সে পন করেছে আয়াজের কোনো মিষ্টি কথায় সে ভুলবে না। আয়াজ মুচকি হাসলো। সে জানতো উত্তর পাবেনা সে। এতদিনে প্রিয়তার এসব স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছে সে।

‘মা অসুস্থ প্রিয়। হসপিটালে এডমিট। হঠাৎ করে খবর পাওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আপনাকে জানানোর কথা মাথায় ছিল না। প্রমিস আর এমন হবে না।’

প্রিয়তা চমকালো। মা সুলভ মানুষটা অসুস্থ শুনতেই বুকের ভেতর কেমন করলো। যদিও পরিচয় খুব বেশি দিনের না। কিন্তু অল্পতেই মানুষটা কেমন করে যেন প্রিয়তার প্রিয়ের তালিকায় নাম করে নিয়েছে। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। তার মন খারাপ হলো ভিষণ রকম। তার মুখে আঁধার নামতে দেখে আয়াজ তাকে নিশ্চিত করলো তিনি সুস্থ আছেন। তবুও প্রিয়তার অশান্ত মনটা শান্ত হলো না।
_____________

‘আপনি আমার যত্ন নিচ্ছেন না বউ।’

তোয়ালে হাতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল আয়াজ। সদ্য গোসল করায় চুল থেকে টুপটাপ পানি পরছে। উদম দেহটাতেও পানিকণা বিন্দু বিন্দু আকারে জ্বলজ্বল করছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকালো প্রিয়তা। প্রেম সাগরে উপচে পড়লো ঢেউ। এত সুন্দর কেন! প্রিয়তা জানে আয়াজ ইচ্ছে করেই এরূপে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তবুও সে নিজেকে আটকাতে পারল না। যাকে বলে নিজ পায়ে কুড়াল দেওয়া। তেমনটাই করলো সে। তার অবাধ্য চোখ দুটো স্হির হয়ে রইল আয়াজের উদম বুকের দিকে। আয়াজ ক্রুর হাসলো। এগিয়ে এসে তোয়ালে প্রিয়তার দিকে ছুড়ে দিল। শুধাল,

‘তাকিয়ে না থেকে পতি সেবা করুণ। বেহেস্তে যাওয়ার কতশত পথ দেখেছেন? তবুও আপনারা মেয়েজাতি আমাদের স্বমীদের মূল্য দিলেন না। কবে বুঝবেন বলুনতো!’

শেষের কথাটা খানিকটা আফসোস নিয়ে বলল আয়াজ। প্রিয়তা কথা বাড়ালো না। তার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এখন জবাব দেওয়া মানেই ঘুমের গলায় ফাঁস পড়ানো। যা সে একদমই চায় না। প্রিয়তা আগালো। চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো আয়াজের চুল মুছে দিতে লাগলো।
___________

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করতে লেগে পড়েছে প্রিয়তা। নাস্তা সাথে নিয়ে শাশুড়ি মাকে দেখতে যাবে। শাকিলা বেগমের সাথে তার তেমন একটা আলাপ হয়নি। তবুও তার কাছে ভিষণ আপন মনে হয়। কেমন মায়া জাগে। প্রিয়তার একটা মায়ের সখ বহুদিনের। এতদিনে সে একটা মা পেয়েছে। ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে। সেই কবে মা কে হারিয়েছে সে। চেহারাটাও মনে নেই। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে। মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই পেল না।

‘দুটো সংবাদ আছে। একটা গুড অন্যটা ব্যাড। কোনটা আগে শুনতে চান?’

প্রিয়তা কপাল কুঁচকে তাকালো। রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখ মুখ জুড়ে বিস্তার হাসি। প্রিয়তা আগাগোড়া আয়াজকে অবলোকন করল। সকাল সকাল কোন ড্রামা স্টার্ট করলো আবার? প্রিয়তা পুনরায় রুটি বেলায় নজর দিল। মুখে বলল,

‘যদি সত্যি কিছু বলার থাকে ঝটপট বলে বিদায় হও। হাতে একদমই সময় নেই।’

‘আপনাকে জব করতে হবে না। ছেড়ে দিন।’

প্রিয়তার হাত থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ছেলেটার নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়েছে। পরক্ষণেই হেসে দিয়ে বলল,

‘জব ছাড়লে চলব কি দিয়ে পিচ্চিছেলে?’

আয়াজ রাগ করলো না। হাসি মুখে প্রিয়তার পেছনে এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে হাত গলিয়ে মাজা আঁকড়ে ধরলো। প্রিয়তার নরম কাঁধে থুতনি রেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,

‘একটা জব পেয়েছি প্রিয়তা। একটু কষ্টের। কিন্তু মাস শেষে যা পাব তা দিয়ে খুব সুন্দর করে হয়ে যাবে। দু তিনমাস এভাবে চলি। তত দিনে নাহয় একটা ভালো জব খুজে নিব।’

প্রিয়তা মুচকি হাসলো। উত্তর করলো না। কিছু কিছু সময় উত্তর না দেওয়াই ভালো। পরে নাহয় বুঝিয়ে নিবে।

‘ব্যাড নিউসটা কি ছিলো?’

আয়াজ প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়ালে হেলান দিল। ভিষণ রকম মন খারাপ নিয়ে বলল,

‘ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম যেখানে সেখানে জবটা হয়নি।’

প্রিয়তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না। সে আগের মতোই রুটি বেলতে বেলতে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘মানুষের অফিসে কাজ করে লাভ নেই আয়াজ। চলো নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাই। নিজেদের এতবড় অফিস থাকতে মানুষের হয়ে কাজ করে কি লাভ?’

আয়াজ ভ্রুকুচু করলো। প্রিয়তাকি জানেনা ও বাড়ি তাদের জন্য নিষিদ্ধ!

চলবে………