অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব-৯+১০

0
227

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.

প্রিয়তার জীবনে বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। এত বছর জীবনে হাতে গোনা কয়েকটা বন্ধু হয়েছে তার। অনেক খুঁজে নীরার নাম্বার বের করলো সে। ভার্সিটির জীবনে নীরাই ছিল তার সবথেকে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু অনার্স শেষ করার পূর্বেই তার বিয়ে হয়ে যায়। পড়িশোনা টাও শেষ করা হলো না মেয়েটার। বিয়ে হতেই পরিবর্তন আসলো নীরার। সব মেয়েরাই বুঝি পরিবর্তন হয়?
এতদিন বাদে কল দিতে একটু সংকোচ অনুভব হলেও প্রয়োজন এর খাতিরে বাধ্য হয়ে কল করতে হলো। তার উপর রাত এখন দশটার বেশি। এত রাতে কাউকে কল দিয়ে বিরক্ত করা মোটেই শোভনীয় কাজ নয়। প্রিয়তার ভিষণ অপছন্দের তালিকায় থাকা অন্যতম কাজ এটি। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।

‘কে বলছেন?’

প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,

‘জ্বি এটা নীরার নম্বর?’

‘হ্যাঁ। কি চাই?’

‘নীরাকে।’

‘ওর কাছে কি চাই?’

প্রিয়তা বিরক্ত হলো এমন প্রশ্নে। ওর কাছে কি চাই সেটা না হয় ওকেই বলবো। তোর তাতে কি ভাই? কিন্তু প্রিয়তা এমন কিছু বললো না। সে ভিষণ বিনয়ের সুরে বলল,

‘ওকে একটু দরকার ছিল। আমি ওর ফ্রেন্ড প্রিয়তা। একটু যদি ওর কাছে ফোনটা দিতেন ভিষণ উপকৃত হতাম।’

লোকটার প্রতিক্রিয়া ঊ্এপাশ থেকে প্রিয়তা বুঝলো না। কিন্তু যতটুকু অনুমান করলো লোকটা ভিষণ রকম বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে আছে।

‘হুম অপেক্ষা করুণ। ও বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে।’

‘জ্বি অবশ্যই।’

প্রিয়তা ফোন কানে অপেক্ষা করলো। পাক্কা তিন মিনিটের মাথায় নীরার কন্ঠ ভেসে এলো।

‘হ্যালো! প্রিয়তা বলছিস?’

প্রিয়তা ভিষণ বিরক্ত বোধ করলেও হাসগ মুখে বলল,

‘হ্যাঁ। কেমন আছিস? কতদিন বাদে তোর সাথে কথা বলার সুযোগ হলো।’

প্রিয়তার কথা বলার ধরণ এমন যেন সে নীরার সাথে কথা বলতে পেরে ভিষণ আনন্দিত। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে সে প্রচন্ড রকম বিরক্ত। নীরার হাসবেন্ড শুরুতেই তার মেজাজের দফারফা করে ফেলেছে। টুকটাক কথা শেষে প্রিয়তা মলিন কন্ঠে বলল,

‘একটা হেল্প করতে পারবি?’

‘হুম বল।’

‘একচুয়ালি আমার একটা বাসা দরকার। ছোট একটা ফ্লাট। আমার একার থাকার মতো।’

‘আচ্ছা আমি তোকে জানাব।’

‘ধন্যবাদ।’

প্রিয়তা ফোন রাখল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ফোনের দিকে তাকাতে দেখলো আয়াজ ম্যাসেজ করেছে। প্রিয়তার রিপ্লাই দিতে মন চাইলো না। তার এখন ভিষণ ঘুম পাচ্ছে। ভিষণ বলতে ভিষণ। প্রিয়তা ফোন সাইলেন্ট করে টেবিলে রাখল। সে জানে কিছুক্ষণ বাদে আয়াজ কল করবে। একবার নয় দুবার করে টানা একঘন্টা কল করবে। অতঃপর প্রিয়তা ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সুন্দর করে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে। এই ছেলেটার জাবতীয় কাজ এখন প্রিয়তার মুখস্থ হয়ে গেছে।

__________

প্রিয়তা একটা বাসা খুঁজে পেয়েছে। এক বেডের ছোট্ট একটা ফ্লাট। ছয় হাজার টাকায় এর থেকে ভালো বাসা পাওয়া অসম্ভব। নীরার মামা শ্বশুরের বাড়ি হওয়ায় অল্প ভাড়ায় সহজে বাসাটা পেয়ে গেছে সে।

সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে প্রিয়তা কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,

‘আমি এ মাসেই শিফট করছি।’

জাহিদ অবাক চোখে তাকালো। বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,

‘শিফট করছো মানে?’

‘এটস সিম্পল। আপনাদের সংসারে আর কতদিন? তাছাড়া আমার জন্য আপনাদের কম ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছেনা। এখন যেহেতু আমি নিজেই চলতে পারি। নিজেকে চালাতে পারি তাই আমি আমার মতো করে থাকতে চাই। বলতে পারেন নিজের বাকি জীবনটা নিজের মতো করে চালাতে চাই। আপনাদের ও ছুটি দায়িত্ব থেকে।’

কত বড় একটা কথা কত সহজেই বলে ফেলল প্রিয়তা। প্রিয়তার গলা ধরে আসতে চাইছে কিন্তু সে শক্ত হয়ে বসে রইল। জাহিদ নির্বাক হয়ে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকালো। সে কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি প্রিয়তা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিবে। সে তো সবসময় প্রিয়তাকে নিজের মেয়ের মতো করেই দেখেছে। তার চোখের কোণে পানি জমলো। মুচকি হেসে সে বলল,

‘তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ এখানে আমার আর কি বলার! তুমি বড় হয়েছ। নিজের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পার। তোমার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।’

তিনি উঠে চলে গেলেন। সুজলা কোনো কথা না বলে স্বামীর পিছু পিছু রুমে চলে গেল। তুলি অনেক আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়তা টেবিলে বসে রইল। সবাই চলে যেতেই রত্না দৌড়ে এলো।

‘আপা আপনে সত্যিই চ‌ইলা যাবেন?’

প্রীয়তি মাথা‌ নাড়াল। রত্না মন খারাপ করলো একটু। পরক্ষণে বলল,

‘এতদিনে আপনি একটা সঠিক কাজ করছেন আপা। একটু খারাপ লাগলেও আমি খুশি হইছি। আপনি চিন্তা করবেন না। দুইদিন পরপর আমি আপনারে দেখতে যামুনি।’

প্রিয়তা হেসে ফেলল। কিছু ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ। এই যে রত্নার তার প্রতি ভালোবাসা। কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা আপন মানুষদের কাছ থেকেও পাওয়া যায় না।

দুদিনের মাথায় প্রিয়তা নতুন বাসায় উঠলো। রত্না পুরোটা দিন প্রিয়তার হাতে হাতে ঘর গুছিয়ে দিলো। প্রিয়তা ওর মামার বাড়ি থেকে কিছুই আনেনি। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস সব নিজেই কিনে নিয়েছে। যদিও জাহিদ অনেক জোরাজুরি করেছিল কিন্তু প্রিয়তা সাফ মানা করে দিয়েছে। সুজলা প্রিয়তাকে কঠিন ভাবে বলে দিয়েছে সে যেন আর এ বাড়িতে ফিরে না আসে। উত্তরে প্রিয়তা মুচকি হেসে বলেছিল,

‘চিন্তা নেই মামি।‌ আপনাদের মুক্তি দেওয়ার শপথ যখন করেছি সেটা পরিপূর্ণ ভাবেই সম্পন্ন করবো।’

তুলি ভিষণ কেঁদেছিলো। বারবার প্রিয়তাকে না যেতে বলছিল। প্রিয়তা ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে ছিল। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও ঝড়েনি। কষ্ট পেতে পেতে তার হৃদয় পাথর হয়ে গেছে।
বিকেল হওয়ার পূর্বেই রত্না চলে যায়। প্রিয়তা সব গুছিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। সূর্য হেলে পড়েছে। লাল রাঙা আকাশে কয়েকটা কাক উড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রিয়তা বিষন্ন মনে আকাশের দিকে তাকালো। চোখের কোণে জলরাশির দেখা মিলল। ধরে আসা গলায় বলল,’সব খারাপ কেন আমার সাথেই হয়? আমাকেই কেন সব হারাতে হয়?’

__________

‘কেন ইগনোর করছেন প্রিয়তা?’

আয়াজের কন্ঠের গভীরতা অনেক। সাধারণত আয়াজ তাকে প্রিয়তা বলে ডাকে না। এটা তখনই ডাকে যখন আয়াজ খুব রেগে থাকে কিংবা যখন খুব বেশি কষ্ট পায়। প্রিয়তা তপ্ত শ্বাস ফেলল। শান্ত ভাবে বলল,

‘তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত আয়াজ। আমিতো পালিয়ে যাচ্ছি না।’

‘যেতে চাইলেও যেতে দিব‌ না।’

‘দিও না। তবুও পড়াশোনায় ফোকাস কর।’

আয়াজ হাসলো। প্রিয়তার নাক টেনে দিয়ে বলল,

‘আপনি প্রোফেশনাল টিচারের মতো ব্যাবহার করছেন প্রিয়।’

প্রিয়তা চমকালো। আজকাল সে একটুতেই চমকে যায়। এই ছেলেটার তাকে চমকে দেওয়ার বিশেষ রকম ক্ষমতা রয়েছে। প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। কন্ঠে তেজ এনে বলল,

‘তুমি এভাবে যখন তখন আমায় ছুঁবে না আয়াজ।’

আয়াজ ব্যাথিত হলো। হাত গুটিয়ে নিয়ে ছোট করে জবাব দিলো,’স্যরি।’

ইতিমধ্যে পার্কে অনেক কপোত কাপতির ভীড় জমেছে। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ঝিমিয়ে থাকা পার্কটি। প্রিয়তা আড় চোখে আয়াজের দিকে তাকায়। কালো রঙের শার্ট উজ্জল শ্যামলা দেহে দারুণ মানিয়েছে। হঠাৎ করেই প্রিয়তার মন খারাপ হলো। সে উদাস হয়ে বলল,

‘পিচ্চি! কেন তুমি আমার বড় হলে না?’

প্রিয়তার কথায় আয়াজ গম্ভীর হলো। প্রিয়তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকালো। কাঠকাঠ গলায় বলল,

‘আমাকে আর কখনোই পিচ্চি সম্মোধন করবেন না। এর শাস্তি দিতে আমি কৃপণতা করবো না।’

প্রিয়তার মনে হলো সে এই পিচ্চি ছেলেটাকে ভয় পাচ্ছে। তার ভয় পাওয়া উচিত না কিন্তু সে পাচ্ছে। এই শীতল গলার স্বর তাকে জমিয়ে দিচ্ছে। সে চেয়েও পারছে না আয়াজের কথার অমান্য করে তাকে পিচ্চি বলে ডাকতে। কিন্তু সে বলতে চাইছে,’পিচ্চি! আমাকে ধমকানোর আগে পাঁচ বার ভাববে। কেননা আমি তোমার থেকে গুনে গুনে পাঁচ বছরের বড়।’

চলবে…………

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১০.

একের পর এক ম্যাসেজ আসছে। প্রিয়তা কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই নিখিলের সমস্যা কি? এত ম্যাসেজ কেন দিতে হবে? আর সে ম্যাসেজ দিলেও বা প্রিয়তা কেন রিপ্লাই করবে? প্রিয়তা আবারো বইয়ে মন দিল। অবহেলায় পড়ে রইলো ফোনটি আগের স্থানে। এর মাঝে ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখল বাড়িওয়ালা দাদু থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা বুঝে না সবসময় এমন থমথমে মুখ করে থাকার কারণ। দিদাকি তাকে আদর যত্ন করে না? প্রিয়তা মিষ্টি হেসে সালাম দিল। জবাবেও দাদু থমথমে মুখে তাকালো।

‘কিছু বলবেন দাদু?’

‘আমার বাড়িতে থাকতে কিছু নিয়ম আছে। সেগুলোই জানাতে এসেছি।’

এমন কাঠকাঠ কথায় প্রিয়তা না চাইতেও বিভ্রান্ত হলো। মানুষ বুঝি শুরুতেই এমন কথা বলে!

‘জ্বি। ভেতরে এসে বসুন?’

লোকটা জবাব দিলো না। তবে হাতের ইশারায় বুঝাল সে এখানেই ঠিক আছে। প্রিয়তা নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার কেমন জানি নিজেকে আসামি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে জজ বলে মনে হচ্ছে। প্রিয়তার একটা ভুল কথা তার প্রাণ কেড়ে নিবে এমন দমবদ্ধ অনুভূতিতে প্রিয়তা হাঁসফাঁস করে উঠলো। বাড়িওয়ালারা বুঝি এমনই হয়!

‘চাকরি কর নাকি?’

‘জ্বি।’

‘রাত করে বাড়িতে ফেরা চলবে না। সে তুমি যত বড় চাকরিই কর না কেন।’

প্রিয়তা ঝটপট জবাব দিলো,

‘জ্বি না বড় চাকরি করি না। প্রাইমারি স্কুলের গেস্ট টিচার।’

লোকটা চশমার উপর থেকে কপাল কুঁচকে তাকালো। এখানে কপাল কুঁচকানোর কি আছে? প্রিয়তার ইচ্ছা হলো লোকটাকে বলতে,’দাদু আপনার কপালের চামড়া কি ছোট থেকেই অমন কুঁচকানো?’

‘দরজা জানালা আটকাই থাকবে। একা মেয়ে মানুষ। সাবধানতা নিজের মধ্যে। আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম মাত্র। আমি এখন যাচ্ছি তুমি দরজায় খিল দাও।’

‘জ্বি দাদু।’
____________

কিছুদিন ধরে আয়াজ ভিষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রিয়তার সাথে তার দেখা হয়না এক সপ্তাহের বেশি। কেবল রোজ রাতে সময় করে দশ মিনিট ভিডিও কলে কথা হয়। দুজন মানব মানবী নিরবে একে অপরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। দুজনেই সারাদিন বাদে তার প্রিয় মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখে নেয়। তাদের সকল ক্লান্তি একে অপরের চোখে তাকিয়েই যেন দূর হয়ে যায়। তবে এ নিয়ে দুটো মানুষের কারোর কোনো অভিযোগ ছিল না। সুন্দর করে মানিয়ে নিয়েছে তারা। তবে আজ ঘটনা ভিন্ন। রাত একটা বাজতে চলছে কিন্তু আয়াজের কোনো খোঁজ নেই। কল করলেও রিসিভ হচ্ছে না। চিন্তিত হয়ে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে প্রিয়তা। একটুতে উত্তেজিত হওয়া মানুষ নয় সে। তবুও সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেতে শুরু করেছে। মাথার মাঝে এলোমেলো অগুছালো খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু হলো না তো ছেলেটার!

ঘড়িতে রাত একটা বেজে সাতাশ মিনিট। ঘড়ির কাঁটার টিক টক শব্দ আর মশার গুনগুন গান পরিবেশকে থমথমে করে তুলেছে। প্রিয়তার রুমের লাইটটি এখনো জ্বলছে। ঘুমঘুম চোখে প্রিয়তা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বুঝে আসতে চাইছে যেন। কিন্তু তার অবচেতন মন বলছে‌ এখনি কল আসবে। তার মনের কথা বৃথা যায়নি। নিঃশব্দ কামরার দ্যজা জানালা কাঁপিয়ে বেজে উঠলো ফোন। প্রিয়তার ঠোঁট কোনে খেলে গেল এক টুকরো হাসি। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সময় নিয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,

‘ক্ষুদা পেয়েছে প্রিয়তা। একটু নিচে আসবে? ভাত আছে?’

প্রিয়তার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। চোখ ভরা ঘুম যেন নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। শিরশির করে কেঁপে উঠলো দুচোখের পাতা। প্রিয়তা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,

‘আমি আসছি।’

কল কেটে যাওয়ার পরও দু মিনিট থম মেরে বসে রইল সে। আয়াজ ছেলেটা দিন দিন বড্ড পাজি হয়ে যাচ্ছে! কেমন করে ডাকে! “প্রিয়তা!” আবার তুমি করেও বলছে! প্রিয়তা বড় করে শ্বাস নিলো। ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে যেয়ে প্লেটে ভাত তুলে নিল। ডাল ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যস্ত হাতে একটা ডিম ভেজে নিল। ব্যাস এতেই চলবে।

ল্যাম্প পোস্টের আলোতে ফরমাল পোশাক পরিহিত আয়াজকে প্রিয়তার একজন অতিবসুদর্শন পুরুষ বলে মনে হলো। আয়াজের ক্লান্তিতো মোড়ানো মুখটা তার সৌন্দর্যের কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। প্রিয়তা এগিয়ে আসতেই আয়াজ গাড়ির ডোর খুলে দিল। প্রিয়তা কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ উঠে বসলো। আয়াজ গাড়ির ভেতর ঢুকে ডোর লক করে দিল।

‘এত রাতে আমার বাসার সামনে কেন?’

‘তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রেমিকা নেই আমার তাই।’

আয়াজের উত্তরে প্রিয়তার বুকের ভেতর আবারো ছলকে উঠলো। ছেলেটার কথা এমন কেন? তার প্রত্যেকটা কথা প্রিয়তার বুকের ভেতর কাঁচের মতো গেঁথে যায় তা কি সে জানে না? নাকি জেনে বুঝেই প্রিয়তাকে ঘায়েল করতে এই অস্রের ব্যাবহার!

‘বাড়িতে তোমার মা রান্না করেনি?’

আয়াজ গম্ভীর উত্তর দিলো,

‘আমার মা তোমারও মা হয় প্রিয়তা। এরপর আর কখনো এভাবে বলবে না। মা বলে সম্বোধন করবে। আমার সবকিছু তোমার। ইভেন মা টাও।’

প্রিয়তা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল।

‘খাইয়ে দাও।’

প্রিয়তা পিটপিট করে তাকালো। এই পুচকে তার উপর হুকুম জারি করছে!

‘হাত নেই তোমার? খেয়ে নাও। আর কখনো এমন পাগলামি করবে না। যদি কেউ দেখে নেয় কি হবে বুঝতে পারছ?’

‘বিয়ে করে নিব। প্রবলেম সলভ।’

প্রিয়তা রেগে গেল। সিরিয়ায় ব্যাপারেও ছেলেটার গা ছাড়া ভাব। তার এ ধরণের ব্যাবহার একদম পছন্দ না। প্রিয়তা কিছুটা কঠিন হয়ে বলল,

‘তোমার বাচ্চামি বন্ধ কর আয়াজ। বিয়ে বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। তুমি এখনো বাচ্চা রয়ে গেছ। তোমার পরিবার কখনো আমায় মেনে নিবে? আমার যোগ্য সম্মান তোমার পরিবারের কাছ থেকে দিতে পারবে তুমি?’

প্রিয়তা রাগে ফুঁসে চলছে এখনো। আয়াজ একমনে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়তার দিকে। হঠাৎ বলে উঠল,

‘নেমে দাঁড়ান প্রিয়তা।’

প্রিয়তা না বুঝতে পেরে আয়াজের চোখে তাকালো। আয়াজ পুনরায় একই কথা আওড়াল।

‘বাহিরে নেমে দাঁড়ান।’

অবুঝের মত প্রিয়তা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতে শব্দ করে গাড়ির ডোর বন্ধ করে দিল আয়াজ। জোর শব্দে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। কিছু বোঝার আগেই শো করে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আয়াজ। খাবার প্লেট হাতে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। পরক্ষণে অপমান আর খারাপ লাগায় চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো পানি। আয়াজের এমন ব্যবহার তীব্রভাবে আঘাত করল প্রিয়তার আত্মসম্মানকে। এই পুচকে ছেলের এত কিসের দাপট? রাগে মুখশ্রী লাল হয়ে এলো। বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে নিঃশব্দে মেইন গেট লক করে নিজের ফ্লাটে চলে এলো সে। রাতে আর ঘুম হলো না। রুমের বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে বসলো প্রিয়তা। ধোঁয়া ওঠা কাঁপে চুমুক বসাল। তার মুখে আঁধার ছেয় আছে। তার গভীরতা এই রাতের আঁধারকেও হার মানাবে। প্রিয়তা নিজের বিহেভে অবাক হলো। সে কি বদলে যাচ্ছে? এই যে সে আয়াজের উপর রাগ করার চাইতে বেশি মন খারাপ করছে। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? তার এখন উচিত ঝটপট আয়াজকে তার সকল সাইট থেকে ব্লক করে দেওয়া। কিন্তু সে তা না করে দেবদাসের মতো চা খেয়ে শোক পালন করছে। দেবদাস! মেয়েরাও দেবদাস হয়? নাকি দেবদাসি!
প্রিয়তা আবারো চায়ের কাপে চুমুক বসাল। তার এভাবে আয়াজকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। ছেলেটা দিনকে দিন চরম বিয়াদপ হয়ে যাচ্ছে। সবটাই শাসনের অভাব!
প্রিয়তা আড় চোখে ফোনের দিকে তাকালো। নাহ এখনো কোনো টেক্সট বা কল আসেনি। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান হলো খুব। একটা মেসেজ দিলে কি এমন হতো?

চলবে……….

(ভুলত্রুটি, ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)