অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব-১৩+১৪

0
226

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৩.

‘তুমি অবিবাহিত মেয়ে। তোমার ঘরে একটা ছেলে কি করছে?’

প্রিয়তা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘দাদু ভেতরে আসুন না! ভেতরে এসে কথা বলি।’

বৃদ্ধ গোমড়ামুখি বাড়িওয়ালা নড়লো না। ধারালো দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর মাঝে রুম থেকে আয়াজ বের হয়ে এলো। প্রিয়তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে সালাম দিল বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে।

‘আপনি আমার বউকে ধমকাচ্ছেন এটা কিন্তু মোটেই ভালো কাজ নয় দাদু।’

লোকটা বিষ্ময় নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো।

‘মেয়ে তুমি বিয়ে করলে কবে?’

প্রিয়তা উত্তর দেওয়ার আগেই আয়াজ উত্তর দিলো,

‘এইতো আজ। দুপুর বারোটা পয়ত্রিশ মিনিটে।’

লোকটার দুভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়লো। সে হয়তো আয়াজের কথাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই সে সন্দিহান গলায় প্রিয়তাকে বলল,

‘এই ছেলেকি তোমার স্বামী? নাকি ফাঁকি দিতে চাইছ আমাকে?’

আয়াজ কথা বলতে নিলে প্রিয়তা থামিয়ে দিলো তাকে। মুখে হাসি এনে বলল,

‘সত্যিই আমরা বিবাহিত দাদু। বিশ্বাস না হলে আসুন কাগজ পত্র দেখাচ্ছি আপনাকে।’

বৃদ্ধ এবার মাথা নাড়ালো। চলে যেতে নিয়ে আড়চোখে একবখর আয়খজের দিকে তাকালো। আয়াজ তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ নাক কুঁচকাল। বিরবির করল,

‘বিচ্চু ছেলে।’

___________

রাতের রান্নাটা প্রিয়তা নিজ হাতেই করলো। খুব যত্ন নিয়ে সে আয়াজের জন্য রুই মাছ ভুনা করেছে সাথে বেগুন ভাজি। এ দুটো খাবার আয়াজের পছন্দের। ফ্রিজে মাংস নেই। তাই এ দিয়েই আজ চালাতে হবে। প্রিয়তা রান্নার ফাঁকে বেশ অয়েকবার উঁকি দিলো। আয়াজ ঘুমাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডে হেলান দেয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা। ঘাড় ব্যাথা করবে তো! প্রিয়তা ভাবলো একবার ডেকে দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই আয়াজের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা হলো না তার। প্রিয়তা ঘুমন্ত আয়াজকে অবলোকন করল। সুঠামদেহী প্রিয় পুরুষটার ঘুমন্ত রূপ ভয়ংকর। এত কেন সুন্দর! আয়াজের ঘুমন্ত সরল মুখ দেখে প্রিয়তার মনে কিছু অবাধ্য ইচ্ছা ছুটাছুটি করতে লাগলো। সে কি একটু ছুঁয়ে দিবে? পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার গাল। বিয়ে করতে না করতেই তার ভিতর এমন লুচু স্বভাব চলে এসেছে। নট ফেয়ার! প্রিয়তা জোরে নিঃশ্বাস নিলো। প্রিয়তা নিজেই আয়াজকে বিছানায় শুয়ে দিতে চাইলো।

‘আপনার এই চুনোপুঁটির শরীর এতবড় আমাকে নাড়াতে পারবে না।’

প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে তাকালো। রাগি কন্ঠে জবাব দিলো,

‘ঘুমাওনি যখন ভান ধরে ছিলে কেন?’

‘দেখছিলাম। একা পেয়ে আমার সুযোগ লোটার চেষ্টা করেন কিনা।’

আয়াজ কথাটা বলে চোখ টিপল। প্রিয়তা লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করলো না। এই ছেলে যদি একবার বুঝতে পারে প্রিয়তা লজ্জা পেয়েছে তবে সময়ে সময়ে সে প্রিয়তাকে লজ্জায় ফেলবে। সে আয়াজকে চোখ গরম দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। এমন বিচ্চু ছেলের সাথে সংসার কিভাবে করবে সে?

______________

রাতের আকাশ ভিষণ সুন্দর। শিরশির বাতাসে শীতশীত লাগছে। আজ আবহাওয়া বেজায় ঠান্ডা। প্রিয়তা গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে গায়ে পেঁচিয়ে নিল। প্রায় রাতে সে এভাবে ছাদে এসে দাঁড়ায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। মনের সকল অসুখ যেন এভাবেই বের করে ফেলে সে। প্রিয়তার ফোনে টুংটাং শব্দ হয়।

‘লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? রুমে আসুন। অনেক রাত হয়েছে।’

প্রিয়তা ম্যাসেজটা দেখে ফোন পাশে রেখে দিল। তার ভিষণ রকম লজ্জা অনুভব হচ্ছে। এটা তাদের প্রথম রাত। লজ্জাটা স্বাভাবিক। প্রিয়তা দাড়িয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ। দুরুদুরু মন নিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামল। ফ্লাটের দরজাটা চাপানোই আছে। পুরো ফ্লাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রিয়তা আলগোছে দরজা বন্ধ করে অন্ধকার হাতড়ে রুমে প্রবেশ করে। আবছা আলোয় সে দেখতে পায় আয়াজ বেডে অন্যপাশ ঘুরে শুয়ে আছে। প্রিয়তা ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। কোনো শব্দ ছাড়া একপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ে। বিরবির করে,রাতটা যেন দ্রুত কেটে যায়। খিচে চোখ বন্ধ করে রাখতেই অনুভব হয় একটা হাত তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার খোঁপা করা চুলরাশি মেলে দিয়ে মুখ গুঁজেছে তার উন্মুক্ত ঘাড়ে। প্রিয়তা জমে যায়। নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যেন। তার মনের সাথে সাথে দেহ ও যেন শত্রুতা শুরু করেছে তার সাথে। আয়াজ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

‘এবার পালান!’

প্রিয়তা উত্তর দিতে পারলো না। কেবল নিজেকে শুধাল,’আমার দেহ,আমার মন আজ আমার-ই বিরুদ্ধে রুখেছে।’
_____________

সকালে প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে বেশ বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে সে আয়াজকে পেল না। চুল হাতখোপা করে বিছানা থেকে নামতেই ব্যাথায় টনটন করে উঠলো শরীর। বিছানার একপাশে আয়াজের শার্ট পড়ে আছে। প্রিয়তা শার্টটা স্বযত্নে তুলে নিলো। শার্ট থেকে পরিচিত সিন্ধ একটা সুবাস এসে ধাক্কা লাগলো নাকে। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে সুবাস নিলো। কেমন একটা আয়াজ আয়াজ ঘ্রাণ।

আয়াজ মার্কেটে এসেছে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনতে। প্রিয়তার বাসায় শোবার খাট, টেবিল আর টোট্ট একটা কাপর রাখার র ্যাক ব্যতীত কিছুই নেই। সামনের রুমটা পুরোটাই ফাঁকা পড়ে আছে। কাল থেকেই আয়াজ চাকরির খোঁজ করতে নামবে। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছোট ফ্লাটেই মানিয়ে নিতে হবে। আয়াজের ফোন বেজে উঠলো। শাকিলা বেগম কল করেছেন। আয়াজ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শাকিলা বেগম কেঁদে ফেললেন।

‘কেমন আছ বাবা?’

‘ভালো আম্মু। আপনার দোয়ায় ভালো আছি। কাঁদছেন কেন?’

আয়াজের কথা শুনে শাকিলা আরো জোরে কেঁদে ফেললেন।

‘বাবা প্রিয়তাকে নিয়ে বাসায় চলে আসো। তোমাকে ছাড়া সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তোমার বাবার কথায় রাগ করো না।’

আজায় জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘প্রিয়তা আমার স্ত্রী আম্মু। তার অসম্মান আমি মেনে নিব না। আমার জন্মদাতা পিতা আমার ভালোবাসাকে একান্তই ছেলেখেলা ভেবে নিয়েছে। তিনি টাকার মাধ্যমে আমার ভালোবাসা কিনতে চেয়েছে আম্মু। এতটা অসম্মানের পর কিভাবে ফিরে আসি?’

‘আমি কি অপরাধ করেছি বাবা? শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছ?’

‘আপনি কোনো অপরাধ করেননি আম্মু। আপনার যখন ইচ্ছা হবে নাজিম চাচাকে বলবেন। তিনি আপনাকে আমার বাসায় পৌঁছে দিবে।’

আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিল আয়াজ। তার বাবা ভিষণ ভালো মানুষ। আয়াজ তাকে অনেক সম্মান করে। কিন্তু তবুও তিনি তার প্রিয়তাকে হেলা করেছেন। এর মাফ তখনি হবে যখন সে নিজ থেকে আয়াজকে প্রিয়তার সহিত ঘরে ফিরে আসতে বলবে।
___________

আয়াজ যখন ফিরল তখন দুপর বারোটা। প্রিয়তা গালে হাত রেখে বারান্দায় বসে ছিল। অপেক্ষা করছিল আয়াজ আসার। লজ্জার কারণে আয়াজকে কল দিতে পারেনি। ছোট একটা ট্রাক ভর্তি মালজিনিস এনে থাকম গেটের সামনে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। সোফা,কাবার্ড,ডায়নিং টেবিল,ড্রেসিং টেবিল। এতকিছু? এতকিছু কোথায় রাখবে? প্রিয়তা একবার ঘরে নজর বুলাল। সবকিছু ধরবে তবে একটু গাদাগাদি হবে।
গোছগাছ করতে করতে তিনটা বেজে গেল। খাওয়া দাওয়া হয়নি। রান্নাটাও করা হয়নি। ঘামে আয়াজের শার্ট ভিজে চুপচুপ করছে। প্রিয়তা রান্নাঘরে গেল। লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত করল। আয়াজকে শরবত দিতেই আয়াজ বাঁকা চোখে তাকালো। মিষ্টি হেসে বলল,

‘ধন্যবাদ বউ।’

এই সামান্য কথাতেও প্রিয়তার গাল কেমন লাল হয়ে উঠলো। আয়াজের মুখে্য বউ কথাটা তার ভিষণ প্রিয়। বুকের ভেতর আলাদা রকম শান্তি লাগে।

‘আজ স্কুল ছিল না?’

আয়াজের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় প্রিয়তা। ছোট করে উত্তর দেয়।

‘ছিল। ছুটি নিয়েছি দুদিনের।’

‘বরকে সময় দিতে?’

প্রিয়তার কান গরম হয়ে গেল। ছেলেটা সবসময় তাকে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করে। প্রিয়তাকে লজ্জা পেতে দেখে আয়াজ প্রগাঢ় হাসলো। কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘রান্নাতো হয়নি। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিন। বাইরে থেকে খেয়ে আসবো।’

চলবে……..

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৪.

হাঁটার মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা বারবার আয়াজের পানে তাকাচ্ছে আবার নিজেকে দেখছে। কখনোবা নিরবে দুজনের হাইট মাপছে। সে আয়াজের থেকে অনেকটাই খাটো। মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট লম্বা হলেও আয়াজের কাঁধ সমান তার হাইট।

‘ফুচকা খাবেন?’

প্রিয়তার পেট ভরা। তবুও সে এমন সুন্দর অফার মিস করতে চাইল না। মাথা ঝাঁকাতেই আয়াজ তার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। প্রিয়তা আবারো মুগ্ধ হয়ে তাকালো আয়াজের পানে। কত যত্নশীল ছেলেটা। তার মনের মাঝে প্রেমের হাওয়া বইতে লাগলো। এই ছেলের প্রেমেতো সে বহু আগেই পড়েছে। তবুও নতুন ভাবে যেন সে প্রেমে পড়ছে। প্রিয়তা বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করলেও আয়াজের জন্য তা পারল না। আয়াজের চোখ রাঙানিতে ভদ্র মেয়ের মতো অল্প ঝালে এক প্লেট ফুচকা নিলো। আয়াজ খেল না।

‘তুমি কেন খাচ্ছ না?’

‘এসব আনহাইজেনিক ফুড আমি পছন্দ করি না।’

প্রিয়তা মুখ বাঁকাল। ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে খোঁচা দিল।

‘নিজে খাওনা কিন্তু বউকে তো বেশ খাওয়াচ্ছ। তাড়াতাড়ি মেরে অন্য একটা বিয়ে করার ধান্দা। বেশ বুঝেছি আমি!’

আয়াজ শীতল চোখে তাকালো। কোনো কথা না বলে প্রিয়তার হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিল। প্রিয়তা সবে তিনটা ফুচকা খেয়েছে। বাকি ফুচকা প্লেট কাত করে ময়লার বালতিতে ফেলে দিল আয়াজ। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো।

‘এই কি করছ! খাবো তো!’

আয়াজ বাঁকা হাসলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,

‘যদি মরে যান? দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আমার।’

প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারেনি। খুব আফসোস হলো। ওমন কথাটা বলা কি খুব জরুরী ছিল? গাল ফুলিয়ে আয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। দ্বিতীয়বার আর সে এই ছেলের পেছনে লাগবে না।
____________

পেপার হাতে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তরিকুল সাহেব। শাকিলা উশখুশ ভাবে পায়চারি করছে। এতবছরের সংসারে এখনো তিনি স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। তার উৎকণ্ঠা চোখের আড়াল হলো না তরিকুল সাহেবের। তিনি আড় চোখে অবলোকন করে বললেন,

‘কিছু বলবে?’

শাকিলা সাহস পেল। এগিয়ে এসে পাশে বসলো। ধরে আসা গলায় বললো,

‘ছেলেটার খোঁজ নিয়েছেন?’

আয়াজের কথা স্মরণ হতেই চোয়াল শক্ত হলো তরিকুল সাহেবের। হাতের পেপারটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে জ্বলন্ত চোখে চাইলেন। তীব্র রাগ নিয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন।

‘তোমার ঐ অভদ্র বেয়াদপ ছেলের কথা আমায় বলবেনা। কতটা অবাধ্য হলে এভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়! আমার সম্মানের কথা একবারও ভাবলো না।’

শাকিলা বেগম অসহায় মুখে তাকালেন। অনুনয় করে বললেন,

‘ছোট ও। না বুঝে ভুল করে ফেলেছে। আপনি এভাবে রাগলে মানায়?’

তরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন,

‘তোমার ছেলে যে ছোট বিয়ে করার সময় মাথায় ছিল না তার? তুমি বা কোন আক্কেলে ছোট ছেলের বউকে ধেই ধেই করে বরণ করতে গেলে! বোঝাতে পারলেনা সে ছোট বিয়ে করার বয়স হয়নি!’

শাকিলা হতাশ হলেন। বাপ-ছেলে কেউ কারো থেকে কম না। এভাবে চললে এর শেষটা কিভাবে হবে! সে তো মা! সন্তান বাড়ির বাহিরে আছে। কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুদন্ড স্থির থাকতে পারছেন না তিনি। একটা মাত্র ছেলে একটুনাহয় অবাধ্য হয়েছে। তাই বলে এভাবে বের করে দিতে হবে কেন? চোখ জ্বলে উঠলো তার। ভিষণ অভিমান হচ্ছে তার। ছেলেটাও বা কম কিসে? বাপ বলল অমনি সুরসুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের কথা একবার ও ভাবল না। শাকিলা শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করলেন। ছেলে বাড়ি ফিরলে তবেই এই দরজা খুলবে। অন্যথায় সে রুমের বাহিরে এক পা ও ফেলবে না। আর নাইবা খাবে। দেখা যাক পানি কতদূর গড়ায়।
___________

রোদ ঝলমলে সকাল। প্রিয়তার অফ পিরিয়ড চলছে। আয়াজকে কয়েকবার কল করেও পেল না। প্রিয়তা ওদিকে তেমন পাত্তা দিল না। হয়তো ব্যস্ত আছে।

‘প্রিয়তার মুখ উজ্জ্বল লাগছে খুব। কারণ কি?’

প্রিয়তা তাকালো। তার সামনের ডেস্ক থেকে শর্মিলা ম্যাম হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তিনি এই স্কুলে সবথেকে সিনিয়র। বয়স চাকরি দুদিক থেকেই। তাছাড়া ভিষণ মিশুক। কেমন হেসে হেসে কথা বলে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। বিয়ের কথা বলেকি সে সবাইকে একটু চমকে দিবে? কিন্তু হাতে টাকা নেই। এভাবেতো বলা যায় না। তাই সে চেপে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,

‘আমার হাসতে মানা?’

‘তা নয়। তবে তোমার হাসি তো ধুমকেতুর মতো। বহু অপেক্ষার পর দেখা মেলে। তাই কিউরিয়াস!’

প্রিয়তা মুচকি হাসলো। কোনো জবাব দিলো না। কি বা জবাব দিবে?
আজ বহুদিন পর নিখিলের সাথে দেখা। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়ে গেল।

‘কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তো খোঁজ পাওয়া যায় না।’

অনেকটা টিটকারী করেই বলল নিখিল। প্রিয়তার মন আজ ভীষণ রকম ভালো। মন ভালো উপলক্ষে নিখিলের এই সামান্য কথাকে গায়ে মাখাল না সে। সৌযন্যমূলক হেসে বলল,

‘এই একটু ব্যস্ত ছিলাম মাত্র।’

‘এতটাই ব্যস্ত যে সামান্য ম্যাসেজ ওপেন করার সময়টাও হয়নি!’

নিখিলের কন্ঠ জুড়ে হতাশা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট গুলো অভিমাণ হয়ে বের হতে চাইল। নিখিল রুখল। তার সামনের এই রূপবতী রমনীর কৃষমতা নেই তার হৃদয়ের ব্যাথা অনুভব করার। তার অভিমান গুলোকেও হয়তো সে অবহেলায় উড়িয়ে দিবে ঠিক যেভাবে মেয়টার মোবাইলে এক অংশে তার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো পড়ে রয়েছে নিদারুণ অবহেলায়। নিখিল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুখে মিথ্যা একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে ব্যাথিতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘এক কাপ কফি একসাথে বসে খাওয়ার মতো বন্ধুত্বটুকু আছে নিশ্চয়ই!’

প্রিয়তা নিখিলের আকুতি ভরা দৃষ্টি দেখলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মতী জানালো। প্রিয়তার বলতে ইচ্ছা হলো,’আমার যদি আরো একটা হৃদয় থাকতো সেখানেও হয়তো আপনাকে দেওয়ার মতো বিন্দু জায়গা অবশিষ্ট থাকতো না। আমার পিচ্চি বরটা জানেন তো ভিষণ হিংসুটে। দুটো হৃদয়েই থাকতো তার রাজত্ব। আপনি তখনো কষ্ট পেতেন। এখনো পাচ্ছেন। এটা আপনার ডেস্টিনি। যা হয়তো আপনিই চেয়ে এনেছেন!’

মানুষের ডেস্টিনি সত্যিই অদ্ভুত। কেউ জানে না তার ভাগ্যে কি আছে। কি হবে বা হতে চলেছে। প্রিয়তাও কি জানত সে তার অতি বরক্তিকর এক পিচ্চিকে এতটা ভালবেসে ফেলবে। কিংবা তার সাথেই ঘর বাঁধবে! কিন্তু সেটাই হয়েছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে মানুষের জীবনে। কিছু ঘটনা খুব নাটকিয় ভাবে ঘটে যা নিঃসন্দেহে কোনো অস্কার প্রাপ্ত সিনেমাকে হার মানাবে। ঠিক প্রিয়তার জীবনের গল্পের মতো করে।

এই রেস্টুরেন্টে প্রিয়তা আগেও এসেছে। নিখিলের সাথেই। এখানের কফিটা ভালো। পরিবেশটাও ভিষণ সুন্দর। এমন নিরব পরিবেশ আয়াজের ভিষণ পছন্দ। প্রীয়তা চট করে ভাবল আয়াজকে সাথে নিয়ে এখানে একদিন আসবে। দুজন এই নিরব পরিবেশে কিছুটা সময় পার করবে।
কফি এসেছে। প্রিয়তা তৃপ্তি নিয়ে কফিতে চুমুক বসালো। উদাস গলায় বলল,

‘আপনার বোধহয় একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত নিখিল। এভাবে অন্যের বউয়ের পেছনে ছোটা মোটেই শোভনীয় নয়।’

নিখিল প্রিয়তার কথা বুঝলো না। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো। প্রিয়তার মায়া হলো। মানুষের হৃদয় ভাঙতে ভিষণ রকম দুঃখ দুঃখ অনুভব হয়। তার ও হচ্ছে। প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল। কিন্তু বলার সময় এলোমেলো অগুছালো হয়ে গেল।

‘রিসেন্টলি একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

নিখিল আগ্রহ নিয়ে চাইল। ভ্রুদয়ের মাঝে সামান্য ভাঁজের সৃষ্টি হলো। নিখিলের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েই প্রিয়তা ঝটপট বলল,

‘বিয়ের মতো অত্যন্ত চমৎকার কাজটা আমি করে ফেলেছি।’

চলবে……..