অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব-০১

0
350

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.

নিজের থেকে পাঁচ বছরের ছোট কোন ছেলের থেকে প্রেম প্রোপোজাল পেয়ে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। তার এখন ঠিক কি ধরনের রিয়্যাকশন দেওয়া উচিত তা সে খুজে পেলো না। তীক্ষ্ণ চোখে সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করলো। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট সাথে ঢোলাঢালা টি শার্ট। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ফর্সা মুখটা ফুলে আছে। চোখ দুটো টকটকে লাল। হয়তো ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে। এখন কেবল সকাল সাতটা। আশপাশে তেমন একটা লোকজন চোখে পড়ছে না। প্রিয়তা একটি প্রাইমারি স্কুলের টিচার। স্কুল শুরু হবে ঠিক নয়টায়। বাড়ি থেকে স্কুল অনেকটা দূরে হওয়ায় তাকে হাতে সময় নিয়ে বের হতে হয়।

‘আপনার দেরি হচ্ছে।’

ছেলেটার কন্ঠে প্রিয়তা নড়েচড়ে উঠলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখতেই তার চোখ কপালে। এই ছেলেটা অলরেডি আধঘন্টা সময় খেয়ে নিয়েছে। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে প্রিয়তা সামনের দিকে পা বাড়ালো।

‘উত্তরটা?

প্রিয়তার পা জোড়া থেমে গেলো। অতিরিক্ত রাগে তার মুখ লাল বর্ণ ধারন করেছে। সে যেন এই মুহূর্তে ছেলেটিকে পিষে ফেলতে চাইছে এমন ভাবেই সে পেছন ফিরে তাকালো। ছেলেটি নির্লিপ্ত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যা প্রিয়তাকে আরো রাগিয়ে দিলো।

‘তুমি সিক। তোমার উচিত ভালো কোনো মানসিক ডাক্তার দেখানো। ইডিয়েট।’

আর কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো প্রিয়তা। আজ পুরো দিনটা তার খারাপ কাটবে।
প্রিয়তা চলে গেলেও ছেলেটা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক ততসময় যতসময় প্রিয়তাকে যেতে দেখা যায়। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই সে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। আর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার।

_________

প্রিয়তা তার মামা মামির সাথে থাকে। খুব ছোট থাকতে মা কে হারিয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর বাবাও কেমন পর হয়ে গেলো। চল্লিশ দিন না হতেই নতুন বিয়ে করে আনলো। ছোট্ট প্রিয়তা যখন মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছিলো তখন তার বাবা তার সদ্য বিবাহিত বউকে দেখিয়ে বলেছিলো সে প্রিয়তার জন্য নতুন মা কিনে এনেছে। পুরোনো মা পঁচা। এই মা তাকে অনেক ভালোবাসবে। কিন্তু তার বাবার বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল মিথ্যা। তার এই মা কখনোই তাকে ভালোবাসেনি। ছয় বছর বয়সী ছোট্ট প্রিয়তাকে কোনো কারণ ছাড়াই খুব মারধর করতো। প্রিয়তার নানু প্রিয়তাকে তার কাছে নিয়ে এলো। এরপর তার দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু তার বয়স যখন ১১ তখন তার নানু ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। প্রিয়তা একা হয়ে পড়ল। নানু ছাড়া তাকে দেখার মতো আর কেউ ছিলো না। তার জায়গা হল মামা মামির সংসারে। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও প্রিয়তা আস্তে আস্তে বুঝতে পারল এ পরিবারেও সে বোঝা হয়ে উঠছে। কিন্তু ততদিনে প্রিয় তা বুঝতে শিখে গেছে। সে জানতো এর থেকে ভালো জায়গা তার আর কোথাও মিলবে না। তাই হাজার অবজ্ঞার শিকার হয়েও মাটি কামড়ে পড়ে রইলো মামা মামির সংসারে। আর কোথায় বা যাবে সে?

কাজ শেষ করে বের হতেই প্রিয়তার দেখা হলো নিখিলের সাথে। পাশের উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক নিখিল। নিখিলের সাথে প্রিয়তার পরিচয় খুব বেশি দিনের না। এক ট্রেনিং সেন্টারে তাদের পরিচয় হয়। এরপর থেকে দেখা হলেই নিখিল খুব নম্র ভাবে তার সাথে আলাপ করে। যদিও প্রিয়তা সবসময় নিখিলকে এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু লোকটা একটু বেশিই কথা বলে। তার কথাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া খুব কষ্টদায়ক। নিখিলের অনেক জোর করায় প্রিয়তা বাধ্য হয়েই পাশের এক কফি শপে বসে। হাত ঘড়িতে সময় দেখতেই দেখলো বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বাসায় ফিরে তাকে রাতের জন্য রান্না করতে হবে। কিছু পরিক্ষার খাতা দেখাও বাকি আছে। এই মুহূর্তে নিখিলকে তার বোঝা ছাড়া কিছুই মনে হলো না। প্রিয়তা ঠিক করে নিল এটাই শেষ। এরপর নিখিল কথা বলতে আসলে সে মুখের উপর বলে দিবে, দেখুন আপনি আমার সাথে এভাবে সেধে আলাপ করতে আসবেন না। আমার আপনার সঙ্গ একদমই পছন্দ নয়। আপনি যদি পরবর্তীতে আমাকে ইগনোর করে চলেন তাহলে খুবই আনন্দিত হইবো।

‘মিস কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!’

হঠাৎ কথাটা শুনে সম্বিত ফেরে প্রিয়তার। প্রিয়তা একটু লজ্জা পায়। কারো সম্মুখে এভাবে অন্যমনষ্ক হওয়া ভিষণ লজ্জাজনক। প্রিয়তার সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল,

‘সরি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।’

নিখিল কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে অল্প হাসলো। সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রিয় তাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। সুযোগ পেতেই সে বলল,

‘মিস যদি সময় হয় সানডে একটু বের হওয়ার টাইম হবে?’

প্রিয়তা চোখ তুলে তাকাতেই নিখিল আমতা আমতা করে বলল,

‘আসলে আমার বোন ফ্রান্স থেকে ফিরছে। ওর জন্য একটু কেনাকাটা করা দরকার ছিলো। মেয়েদের জিনিস কেনার অভ্যাস নেই আমার। তাই আর কি! আপনার আপত্তি থাকলে ইটস্ ওকে।’

প্রিয়তা চেয়েও না করতে পারলো না।

‘আমি পরে জানাবো।’

প্রিয়তার কথায় নিখিল দম ছেড়ে হাসলো। এক মুহুর্তে সে ভেবেছিল প্রিয়তা হয়তো না করে দিবে। এই রমনীর মুখে না শোনাটা তার জন্য খুবই বেদনাদায়ক।

প্রিয়তা যখন‌ ফিরলো তখন সন্ধ্যা সাতটা। স্কুল শেষে টিউশন করিয়ে একবারে বাসায় আসে সে। বাসায় আসতেই সে শুনতে পেলো তার মামি সুজলা মামাতো বোনটার সাথে চিল্লাপাল্লা করছে। গায়েও হয়তো হাত তুলছে। প্রিয়তা হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে দৌড়ে গেলো রুমে। তুলি মেঝেতে বসে কাঁদছে। মামির হাতে লাঠি। প্রিরতা দৌড়ে যেয়ে তুলিকে আগলে ধরলো।

‘কিছু হয়েছে মামি?’

অমনি সুজলা খেকিয়ে উঠলো।

‘কিছু হওয়ার বাদ আছে? কালে ধরেছে আমার সংসার। খাইয়ে দাইয়ে ঘরে কাল পুষছি কিনা! কাল আমার সব শেষ করে দিলো। আমার ছেলে মেয়েগুলোর মাথাও খেয়েছে কালে।’

সুজলা প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে আরো কিছু কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। প্রিয়তার বাড়িতে দেরিতে ফেরার ব্যাপারে কথা বলতেও ছাড় দেননি তিনি। প্রিয়তা মাথা নিচু করে সব শুনল কেবল। তুলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আপু তুমি কেন এগুলো সহ্য কর বলোতো? তুমিকি ফ্রি ফ্রি থাকো? মাস শেষে বেতনের সব টাকা তাদের দিয়ে দাও। তাও তারা এত কথা শোনায় তোমাকে। এই টাকা দিয়ে তো তুমি বাইরে কোথাও বাসা নিয়ে থাকতে পার। তুমি একটা বাসা নিলে আমিও তোমার সাথে চলে যাব। ভালো লাগে না আমার এখানে।’

‘হূস পাগল। এসব বলতে নেই। গুরুজনরা একটু আধটু অমন বকে। তাই বলে রাগ করতে নেই।’

কিন্তু তুলি তার কথায় কান দিল না। সে একে একে নানা অভিযোগ করতে লাগলো। প্রিয়তাও সুন্দর করে তাকে বোঝাতে লাগলো। যদিও মাঝে মধ্যে প্রিয়তার নিজেরই ইচ্ছে হয় এ বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতে। কিন্তু এতগুলো বছর যারা তাকে বড় করলো তাদের সাথে এমনটা করতে তার বিবেক বাঁধা দেয়।

__________

ঘড়িতে রাত দশটা। প্লেটে খাবার নিয়ে ছেলের জন্য বসে আছেন শাকিলা। এ বাড়িতে নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়ার নিয়ম। তরিকুল সাহেব এ ব্যাপারে ভিষণ কঠোর। কিন্তু তার কথা সকলে মান্য করলেও তার একমাত্র ছেলেই তার কথার অমান্য করে। বাড়ির খুব কঠোর নিয়মের মাঝেও ছেলেটা কিভাবে এত বেপরোয়া হলো সেটা সে খুঁজে পায় না। শাকিলা ভিতু নয়নে বারবার সদর দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করছে। ছেলেটা এখনো ফেরেনি। আজ তরিকুল সাহেব মোটেই ছেলেকে ছেড়ে কথা বলবেন না। সে তার রুমেই অতি আদরে বাঁদর হওয়া ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ এক চরম শিক্ষা দিবেন তিনি ছেলেকে।

চলবে……