অবান্তর চিরকুট পর্ব-০৩

0
353

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-3)

♡আরশিয়া জান্নাত

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা কলোনী, রোজ বিকেলে এক ঝাঁক বাচ্চারা উঠোনে খেলাধুলা করে। এ সময়টায় রাফসান দোতলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে তাদের দেখে। কত দুষ্টুমি হৈ হুল্লোড়,কখনো বা ঝগড়া মারামারি এসব দেখে আনমনেই হেসে উঠে সে। জীবনটা তাদের কত সহজ হিসাবেই না চলছে! জীবনের বাস্তবতা আঁচ করার বয়স এখনো হয়নি বলেই হয়তো এমন প্রাণোবন্ত। অথচ এই বয়সেই রাফসান এতিম হয়েছিল। দস্যিপনার বয়সে অগ্নিকাণ্ডে বাবা-মাকে হারিয়ে একদম অনাথ হয়ে গিয়েছিল।
বারো বছর বয়সে বুঝেছিল এই পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। রাফসানের বাবা ছিল একজন মোদি ব্যবসায়ী। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে আত্মীয় বলতে তেমন কেউই ছিল না। মায়ের অবশ্য দুই ভাই ছিল সুদূর কুষ্টিয়ায়। সেখানেও তেমন যোগাযোগ নেই, এতিম ছেলেটার দায়িত্ব নেবে এমন কেউই ছিল না আশেপাশে। তার উপর ঘরের সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই, কারো সঙ্গে যোগাযোগ করবে তেমন কোনো মাধ্যমই পাওয়া গেল না। এলাকার মানুষ অনেক ভেবেচিন্তে তাকে এতিমখানায় রেখে আসে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন এক মহিলা তার সন্ধানে আসে, তাঁর সেই দূরসম্পর্কের ফুফু আফিয়া। এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে পরমাত্মীয় হয়ে। যদিও নিজের সংসারে নেওয়ার জো ছিল না তার, তবুও প্রায় এসে খোঁজখবর নিতেন এটাসেটা কিনে দিয়ে যেতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করে খরচ চালানো,অসুখে পড়লে একটা স্নেহের পরশের অভাব কত যন্ত্রণা দিয়েছে বলে শেষ করা যাবেনা। দিনশেষে ঘরে ফিরে যখন বাবা মায়ের অভাববোধ হতো রাফসান বেড়িয়ে পড়তো শহরের পথে। যেখানে একাকিত্ব নেই, ঘুমন্ত শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে বেড়ানোতে কিছু হারানোর ভয় নেই। কি হারাবে? জীবন ছাড়া আর কি ই বা আছে তার হারানোর জন্য? মানুষ না খেয়েও হয়তো কিছুদিন বাঁচতে পারে, কিন্তু একাকী জীবনে বাঁচতে পারেনা। রাফসান কিভাবে বেঁচে ছিল কে জানে!

বান্দরবান আসার আজ প্রায় তিনমাস হলো, তার বহু পুরোনো স্কুলফ্রেন্ড মংশানু এখানের স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে এসে অবশ্য বেকার বসে থাকেনি, পাশের স্কুলে অস্থায়ী টিচার হিসেবে ক্লাস নিচ্ছে।
পাহাড়ী অঞ্চলে খাপ খাওয়াতে প্রথম প্রথম তার খুব কষ্ট হয়েছিল। অসমতল রাস্তা,পাহাড়ের এলোপাথাড়ি পথ মারিয়ে চলাফেরা সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাহীন। এখন অবশ্য অনেকটা অভ্যাস হয়েছে। অনেক ভেবে ঠিক করলো ঢাকায় ব্যাক করবে, সাফা নিশ্চয়ই ডিভোর্সের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তাকে সে মুক্তি দেবে, আটকে রাখবেনা। এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে তার তিন মাস সময় লেগেছে, তাও মন এখনো পুরোপুরি শক্ত হতে পারেনি। সাফা তাকে ছেড়ে দিচ্ছে ভাবলেই চোখভরে আসে। কথায় বলে একা চলা মানুষ আজীবন একা চলতে পারে, তবে মাঝে কেউ সঙ্গী হলে বাকীপথ আর একা চলতে পারেনা। খুব কষ্ট হয়। রাফসানের জীবনের পাঁচটা বছর সে সাফার সঙ্গে কাটিয়েছে। এই পাঁচ বছরের স্মৃতি বুকে নিয়েই নাহয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
______________

ফোন হাতে নিয়েই বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সিতারা। তাহজীব তাকে ফোন করেছে, কেন করেছে! এখন তো সব শেষ তবে কিসের জন্য কল করলো?
ফোনের রিংটোনে চমকে উঠলো সিতারা। নামটা এখনো জ্বলজ্বল করছে, কলটা রিসিভ করে কানে তুলতেই তাহজীব ঝরঝরে গলায় বললো, যাক বাবা কলটা ধরলে অবশেষে। আমি তো ভেবেছি এখনো রিসিভ হবেনা।
সিতারা স্বাভাবিক গলায় বললো, কেন ফোন করেছেন?
— স্ট্রেট ফরওয়ার্ড বলতে হবে দেখছি! একটু ফর্মালিটি মেইনটেইন করে কেমন আছ জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিলেনা। এনিওয়ে কল করেছি ইনভাইট করতে, আফটার অল তুমি আমার একমাত্র মামাতো বোন। তোমাকে ইনভাইট না করলে চলে? শোনো যেখানে গিয়েই লুকিয়ে থাকোনা কেন আমার বিয়েতে তোমায় প্রেজেন্ট থাকতেই হবে।
— অবশ্যই থাকবো ভাইয়া। আপনার বিয়েতে আমি থাকবো না এ হতে পারে নাকি? ভাইয়ের প্রতি তার একমাত্র বোনের দায়িত্ব আপনাকে শেখাতে হবেনা, আমি খুব ভালো করেই জানি। আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। বোঝেন ই তো আমি মহাব্যস্ত মানুষ। এসব ছোটখাটো ইভেন্টের কথা মাথায় থাকেনা।
— তাঁরা তুই সত্যিই আসবি?
তাহজীবের কথা শুনে সিতারার চোখের পানি আটকানো গেল না, গলা সমান কান্না আটকে স্বাভাবিক গলায় কথা বলার ক্ষমতা তার যে অনেক বেশি সে আজ আবারো প্রমাণ করলো। অকপট গলায় বললো, অবশ্যই আসবো। শুধু যে আসবো তা নয় অনেক হৈ হুল্লোড় করবো, সবাই চেয়ে দেখবে ভাইয়ের বিয়েতে কিভাবে আনন্দ করতে হয়। আমি এখন খুব ব্যস্ত আছি আর কিছু বলার আছে আপনার?
তাহজীব রাগের চোটে ফোন ছুড়ে মারলো ফ্লোরে।
মুহুর্তেই চোখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো, রাগে চিৎকার করে বললো, এতো শক্ত কেন তুই তাঁরা! তোকে আমার পাথুরেমূর্তি মনে হয়। তোর মনে আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর একটু করুণাও নেই। I hate you so much Tara…

কল কেটে যেতেই বুঝতে বাকি রইলোনা এই ফোনটাও গেছে। এতো রাগ এই মানুষটার, মাঝেমধ্যে সামলানো যায়না। সিতারা হাঁটু ভাঁজ করে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। কি দরকার ছিল কল করার। সে তো ভালোই ছিল এতোদিন, কেন অযথা ফোন করে দূর্বল করতে আসে? বোন লাগি আমি তার! একমাত্র মামাতো বোন। হাহাহা
এবার আপনাকে আমি বোঝাবো মিস্টার তাহজীব সিতারার মন কতোটা শক্ত। আপনি যেই সিতারাকে ইচ্ছেমতো কাঁদিয়েছেন তাকে আর সেই রূপে কখনোই ফেরত পাবেন না।

রৌদ্রোজ্জল সকালে সকলকে বিদায় জানিয়ে ঢাকায় ফিরছে রাফসান। অল্প ক’দিনে অনেকের সঙ্গেই বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে তার। এদের ছেড়ে যেতে কিছুটা মন খারাপ লাগছে বটে। সাফার ব্যাপারটা মিটমাট করে ভবঘুরে হয়ে যাবে, একেকবার একেক শহরে বসবাস করে কাটিয়ে দেবে এমনটাই পরিকল্পনা তার। পিছুটানহীন মানুষের কোনো সমস্যা নেই, এই বিশাল পৃথিবীর প্রকৃতিই তার জন্য অনাবিল সুখ নিয়ে বসে আছে। যা ঘুরে দেখার মাঝেও আনন্দ আছে। এই আনন্দের সন্ধান সে পেয়েছে বান্দরবান এসে। “যাঁর কেউ নেই তার আল্লাহ আছে” এই কথাটা সবসময় আফিয়া ফুফু বলতো। এটা রাফসান মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও করে। আসলেই তো ঐটুকু বয়সে যে ছেলেটা স্ট্র্যাগল করে আল্লাহর রহমতে বেঁচে থাকতে পেরেছে, সে এখন স্বাবলম্বী হয়ে একা বেঁচে থাকতে ভয় পাবে? মোটেও না। জীবন নামক এই যুদ্ধটা সে আবারো একাই লড়বে।
মনে মনে নিজেকে হাজারটা অনুপ্রেরণা দিলেও ঘুরেফিরে সাফার স্মৃতিই ভেসে উঠে মানসপটে।
এই যেন সেদিনকার গল্প, প্রথমবার ভাত রাঁধতে গিয়ে কিভাবে হাত পুড়িয়েছিল সাফা। রাফসান নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছিল আর আবেগে চোখের পানিতে ভেসে হাসিমুখে খাচ্ছিলো সাফা।
রাতে নাকি তাঁর বুকে মাথা না রাখলে ঘুমই আসতোনা। অথচ সে এখন দিব্যি আছে তাকে ছাড়া। কত রাত বুক খাঁ খাঁ করতো সাফার অভাবে, পাশের বালিশে বেঘোরে ঘুমানো মেয়েটাকে মনে হতো দূরের নীল নক্ষত্র। যাকে দেখা যায় ছোঁয়া যায়না। একই ছাদের নীচে থেকেও তাদের মাঝে সহস্র মাইলের দূরত্ব। কেন এলো এই পরিবর্তন? তবে কি ভালোবাসার কমতি ছিল? নাকি অন্য কিছু!
যে মেয়েটা দিনে কয়েকবার ফোন করে খোঁজ নিতো সে দিনশেষে ভুলেও জিজ্ঞাসা করেনা, দুপুরে খেয়েছিলে তো?
আগের মতো টিফিন প্যাক করার সময় কই? সেও যে নামী কর্পোরেট অফিসের মেম্বার। তার ব্যস্ততা রাফসানের চেয়ে হাজারগুণ বেশি। অবশ্য বিকেল পাঁচটায় ছুটির পর সে কার সঙ্গে কফিশপে যায় তা তার অজানা ছিল না। কতদিন অফিস শেষে সাফাকে রিসিভ করতে গিয়েছে সে খবর সাফা জানেনি কখনো। রাফসান শুধু নিরবে দেখছিল রংধনুর সাতটি রঙে রাঙিয়ে কেমন ডানা জাপটে উড়ছিল তার সাধের ময়নাপাখিটা,,,,

চলবে,