অবান্তর চিরকুট পর্ব-০৪

0
341

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-4)

♡আরশিয়া জান্নাত

“আস্সালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম, আরেহ রাফসান যে! কোথায় ছিলে এতোদিন? শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো?”

“জ্বি চাচা ভালো আছি। আপনি ঠিক আছেন তো? আমার খোঁজে কেউ এসেছিল?”

“এইতো রাখছে আল্লাহ কোনোরকম। বৌমা আসছিল এক সপ্তাহ আগে। তোমার খোঁজখবর নিলো, কি ব্যাপার ঝগড়াঝাটি হইছে নাকি?”

“না তেমন কিছুনা, কিছুদিন একা থাকার ইচ্ছে হইছিল, তাই আর কি। আচ্ছা চাচা যাই খুব ক্লান্ত লাগতেছে।”

“দেখো কান্ড সেইদিকে আমার খেয়াল ই নাই। যাও যাও বিশ্রাম নাও।”

রাফসান সিঁড়ি ধিঙ্গিয়ে তার ফ্লাটে ঢুকলো। দরজা খুলতেই মনে হলো সাফার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই চিরচেনা অস্তিত্বের উপলব্ধি। এখুনি বুঝি এসে বলবে, এই ফিরেছো তুমি! ঘড়িতে ক’টা বাজে দেখেছ? যাও চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নাও তোমার প্রিয় শুটকির ভর্তা করেছি।
বেডরুমে বড় করে বাঁধানো বিয়ের ছবিটাতে চোখ পড়তেই আনমনে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শাওয়ার নিয়ে বের হতে ডোরবেল বাজলো। কিছুটা অবাক হয়েই দরজা খুলতেই দেখে সাদেক চাচা তার ছোট ছেলেকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছেন। এই মানুষটা পারেন বটে!
খাবার খেয়ে রাফসান তাঁর কলিগ আফজাল ভাইকে কল করলো লয়্যারের সন্ধানে। সাফা যেহেতু মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইছে রাফসানের কিছুই বলার নেই। হয়তো এন্টিমনি চাইতেও এখন তার ইগোতে বাঁধে।

ইসমা– সত্যি করে বলোতো আপু তাহজীব ভাই সত্যিই অন্য কোথাও বিয়ে করছে!
সিতারা ছাদে কাপড় মেলতে মেলতে বললো, এখানে মিথ্যে বলার কি আছে? তাঁর বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে করছে। অবাক হবার কি আছে?
ইসমা সিতারার দুই কাঁধ ধরে থামিয়ে বললো, মানে কি এসবের তোমরা না দুজন দুজনকে ভালোবাসো? এখন অন্য কোথাও বিয়ে করবে কেন? তাহজীব ভাইয়া কিভাবে এটা হতে দিচ্ছে?
সিতারা শান্তস্বরে বললো, মেয়েটা তাহজীব নিজে পছন্দ করেছে ইসমা! শুধু তাই নয় ফুপ্পী যখন বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিল তখন সে-ই সকলের সামনে বলেছে আমাকে সে বোন ছাড়া কিছুই ভাবেনা। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করার ইচ্ছেই নেই তাঁর।
ইসমা রেগে বললো, প্রেম করার সময় এসব মনে ছিল না? বিয়ের কথা উঠতেই বোন হয়ে গেলে!! স্ট্রেইঞ্জ! তুমি কিছু বলোনি?

“আমি কি বলবো ইসমা? আমাদের রিলেশনটা তো ওপেন সিক্রেট ছিল। মা-বাবা, ফুপী সবাই ই তো গেস করে রেখেছিল আমরা একসঙ্গে আছি। তাই তো পারিবারিকভাবে সব হচ্ছিল কিন্তু ,,,,,,,”

“তুমি উনার নাক ফাটালে না কেন? আমি থাকলে নিশ্চিত রক্তারক্তি হয়ে যেত। তবে কি সে কেবল তোমার ইমোশন নিয়ে খেলা করছিল এতো বছর! কেউ প্রপোজ করলে তাঁকে মেরে হসপিটালে পাঠানো, কোনো ওকেশনে সেজেগুজে বের হতে না দেওয়া, কোনো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তো দূর ফেসবুকে পর্যন্ত এড করতে না দেওয়া। এতো এতো পজেজিবনেস এখন ফুড়ুৎ??”

“বাদ দে না। সে যা ইচ্ছে করুক গিয়ে হু কেয়ার্স?”

“ইউ কেয়ার্স আপু। এজন্য এমন শুকিয়েছ তাইনা? এতোদিন বুঝতেও দিলেনা। তাইতো বলি এবার আসার পর একবারো কেন ফোনে কথা বলতে দেখলাম না। আপু শোনো তুমি উনার বিয়ে এটেন্ড করবেনা। অযথা কষ্ট পাওয়ার কোনো দরকার নেই। তোমার এখন ঢাকা যাওয়ারও দরকার নেই এখানেই থাকো।”

সিতারা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বললো, তুই কি চাস তোর বোন কারো সামনে আজীবন দূর্বল হয়ে থাকুক? কেউ একজন এই ভেবে পৈশাচিক আনন্দ পাক যে তাঁকে অন্যের হতে দেখার ক্ষমতা আমার নেই? শোন ইসমা আমি উনার বিয়েতে যাবো, উনার প্রত্যেকটা আচার অনুষ্ঠানে আমি থাকবো। ইভেন তার বাসরঘরটা পর্যন্ত আমি সাজাবো। সে কি ভেবেছে সবসময়ের মতো এবারো আমি তার সামনে কান্নাকাটি করে আকুতিমিনতি করবো? একটা মানুষ সবসময় নত হয়ে থাকতে পারেনা, আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করতে করতে আজ আমার নিজেকে তুচ্ছ কীট মনে হয়।

“কিন্তু আপু তোমার কষ্ট হবে। আমিতো দেখেছি তুমি কতোটা ভালোবাসো উনাকে। মুখে যতোই বলো সামলাতে পারবেনা। অযথা সেখানে যাওয়ার দরকার নেই।”

সিতারা হাসতে হাসতে কান্না করে দিলো, চিৎকার করে বললো, তোরা সবাই আমাকে ননীর পুতুল ভাবিস। সবাই মানে সবাই, আমার মা-বাবা, তাহজীব, এমনকি তুই ও। সবাই ভাবিস আমি খুব উইক, আমি নিজেকে সামলাতে পারবোনা, আমার এখন নিজেকে অসহ্য লাগে। নিজেকে এমন দূর্বল ভাবতে ভালো লাগেনা ইসমা। এবার আমি দেখাবো আমি কতটা শক্ত তুই দেখিস।

ইসমা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো গলায় বললো, আপু তুই উইক না, তোর মনে ভালোবাসা বেশি। এমন নরম মনের অধিকারী সবাই হয়না। দেখিস তোর জীবনে এমন একজন আসবে যে তোকে এই দিকটার জন্যই অনেক অনেক ভালোবাসবে।
_____________

কোর্ট থেকে বের হয়ে রাফসান হাসিমুখে বললো, Congratulation Safa! এখন নিশ্চিন্তে প্রিয় মানুষের সঙ্গে সুখের সংসার বাঁধো। Wish u a very very happy married life.

সাফা হেসে বললো, Thank u .

সাফার চোখেমুখে উচ্ছাস দেখে যদিও রাফসানের বুক ভেঙে আসছিল, সোহেলের সঙ্গে কি সুন্দর হাত জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সে! এই দৃশ্যও দেখতে হলো তাকে?
ইপ্সিতা রাফসানের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবেনা দেখবেন। ও যে মোহে হারিয়েছে খুব শীঘ্রই তা কেটে যাবে। তখন আপনার কাছেই ফেরত আসবে।

“না না ইপ্সিতা এমন কিছু বলোনা। আমি চাই আমার কাছে আর ফিরে না আসুক। ও যেন সুখী হয় সেই কামনা করি। আমি অন্তত ওর খারাপ চাইবোনা।”

“ভাইয়া আপনি কি একবার আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করবেন? তিনি বারবার আপনার খোঁজ নিচ্ছিল। লজ্জায় আসতে পারছেন না। সাফাতো সেখানে ভুলেও যায় না। বাবা-মাকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছে।”

“যাবো সুযোগ করে। আপাতত কিছুদিন ব্যস্ত আছি। আচ্ছা যাই ভালো থেকো।”

হাঁটতে হাঁটতে কতোটা দূর চলে এসেছে হুশ নেই রাফসানের।

“ওহ হ্যালো মিস্টার একটু হেল্প প্লিজ।”

রাফসান চারদিকে তাকাতেই সে বললো, আরেহ আপনাকেই বলছি। উপরের বক্সটা একটু ধরেন প্লিজ আমি ব্যালেন্স করতে পারছিনা।

রাফসান বোকার মতো উপরের বক্স দুটো নিলো।
কিছুটা বিরক্তস্বরে বললো, এমন ভারী বাক্স হাতে নিয়ে একা ঘুরছেন কেন? সঙ্গে কাউকে আনতে পারেননি? এই হলো আপনাদের মেয়েদের সমস্যা সবকিছুতে একাই একশো মনোভাব!

সিতারা একগাদা বক্সের ডানপাশে মাথা হেলিয়ে তাকাতেই রাফসান থমকে গেল। মেয়েটার কপালজুড়ে এলোমেলো সিল্কি চুলগুলো মৃদুবাতাসে উড়ছে, চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, চেহারায় রাজ্যের ব্যস্ততা। ইষৎ হলদে বর্ণের এমন সুন্দর মেয়ে সে আগে দেখেছে কি না কে জানে!

“শুনুন জনাব সবকিছুতে নারীবাদী টপিক তুলে আনেন কেন হু? কে বলেছে আমরা সবাই একাই একশো ভাবি নিজেকে? নারীবাদী যেমন ভালোনা নারীবিদ্বেষীও কিন্তু ভালোনা। হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে আমার সাথে ভাই এসেছিল, হঠাৎ সে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর বক্সগুলো এলোপাথাড়ি হয়ে গেছে বলেই হেল্প চেয়েছি ,কাউকে ফোন পর্যন্ত করতে পারছিলাম না। কিন্তু কে জানতো হেল্প চাইলে আপনি এতো কথা শুনিয়ে দেবেন?”

রাফসান দৃষ্টি এড়িয়ে বললো, দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি। আর শুনুন বুদ্ধি থাকলে খেটে মরতে হয় না। আপনার পেছনের বেঞ্চিতে সব রাখলেই পারতেন।

সিতারা জিভ কামড়ে হেসে বললো, দেখেছেন এই সিম্পল বুদ্ধিটা মাথায়ই আসেনি,হিহিহি। থ্যাঙ্কস মি. ?

“রাফসান”

“ওহ। আমি সিতারা”

“আচ্ছা”

“শুধু আচ্ছা! নামটা সুন্দর না?”

রাফসান অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সিতারা ইতস্ততবোধ করে বললো, আসলে একটা প্রাইভেট বিপদে পড়েছি। তাই আর কি,,,,,

“কি বিপদ?”

সিতারা চোখ বুজে কাঁচুমাচু হয়ে বললো,
“I’ve to go to washroom. প্লিজ এগুলো একটু পাহারা দিন। আমি পাঁচ মিনিটে যাবো আর আসবো।”

রাফসানের জবাবের অপেক্ষা না করেই সিতারা দৌড়ে কোথায় যেন চলে গেল।
এরকম অচেনা লোকের দায়িত্বে কেউ এতোগুলো জিনিস ফেলে যায়? তাও এই জাদুর শহরে! মেয়েটা অদ্ভুত তো!!!

চলবে,,,,