অবান্তর চিরকুট পর্ব-০৬

0
317

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-6)

♡আরশিয়া জান্নাত

স্বার্থপর কিংবা শাসক টাইপ মানুষদের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হলো এরা কখনো কারো বেড়ে উঠা মেনে নিতে পারেনা। যেই এদের মুখের উপর জবাব দিয়ে বিদ্রোহ প্রকাশ করবে তাকেই স্বভাবত দমিয়ে দিবে। এ তো প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তাহজীব সবসময় সিতারার অবনত মুখ দেখে অভ্যস্ত। যাই বলবে বিনাবাক্যে মেনে নিবে এমনটাই তো দেখে আসছে সে। সে যে তাঁকে ভালোবাসেনা এমন না। সেই বুঝের হবার পর থেকেই সিতারাকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। সিতারার চোখেও সেই অনুভূতির ঝলক দেখেছিল বলেই অল্প বয়সেই প্রেমনিবেদন করেছিল,তারপর দীর্ঘ সাতবছরের পথচলা। সেই নাইনে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে থেকে পরিপক্ক নারীতে পরিণত হওয়ার পথে চারদিকের লোভাতুর চোখ থেকে সামলে রাখা চাট্টিখানি কথা না। সিতারা আহামরি সুন্দরী নাহলেও পছন্দ হবার মতোই মানানসই মেয়ে। ওর সঙ্গে কথা বললে যে কেউ খুব সহজেই বিমোহিত হবে। তাই তো তাহজীব কারো সঙ্গেই কথা বলতে দিতোনা। যদিও সে নিজেও বুঝে অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না, কিন্তু রাগ দমানোর ক্ষমতা ওর খুব কম। অল্পতেই রেগে চেঁচামেচি করা ওর বদঅভ্যাস বটে! তাহজীব জানতো একদিন না একদিন সিতারা ঠিক উড়ে যাবে, বন্দিকারাগারে কেউই বেশিদিন টিকে না।
এই চরম সত্যিটা জানতো বলেই আরো বেশি আটকে রাখার মনোভাব এসেছিল। ফলাফল সম্পর্কে ফাটল,,,,
এক বছর যাবত নানা মতানৈক্য, তাহজীবের মুখের উপর জবাব দেওয়া কিংবা মতামত রাখার স্বাধীনতা চাওয়া। এসব নিয়েই শুরুতে টুকটাক কথা কাটাকাটি। তাহজীবের বদমেজাজি মস্তিষ্ক এইসব ছোটখাটো ব্যপার হজম করতে পারেনি। সে ধরেই নিয়েছে সিতারা তার কথামতো চলবেনা, তাকে এখনই ঠিক না করলে পরবর্তীতে কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে যাবে।
বহুদিন ধরেই সিতারার সব ফ্রেন্ডরা ঠিক করে রেখেছিল সবাই একসঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। এই বিষয়ে সিতারা আগেই কথা বলেছিল তাহজীবের সঙ্গে। তখন সে অবশ্য হ্যাঁ না কিছু বলেনি। তবু সিতারা ধরে নিয়েছিল নিষেধ করবেনা। এখন তো সে যথেষ্ট ম্যাচিওর। একা একা বন্ধুদের সাথে বেড়ানোর বয়স তো হয়েছেই, তাছাড়া বাসা থেকেও পারমিশন দিয়েছে।
এই প্রথম কক্সবাজার যাবে উত্তেজনাই ছিল অন্যরকম। কিন্তু বাঁধ সাধলো ঠিক যাওয়ার দিন সকালে। বাসস্ট্যান্ডে সব ফ্রেন্ডদের সামনে তাহজীবকে যখন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল রাগে অপমানে চোখ ফেটে কান্না আসছিল তাঁর, একপর্যায়ে রেগে হাত ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, কি সমস্যা আপনার? এখন শেষ মূহুর্তে এসে কেন যেতে দিচ্ছেন না?

তাহজীব রেগে বললো, তুই তো বলিস নি এখানে ছেলে ফ্রেন্ড ও আছে! তোর সাহস হয় কি করে এতো ছেলের সাথে ঘুরতে যাওয়ার?

“এখানে ছেলে আছে কেবল তিনজন বাকিসব তো মেয়ে। আর আমি তো পারমিশন নিয়েই রেখেছিলাম। আপনি সবার সামনে আমাকে এভাবে ছোট করছেন কেন? এমনিতেই সবাই বলে আমার নিজস্ব সত্ত্বা বলে কিছু নেই। আপনি আজ এমনটা করে আমাকে আরো বেশি অপমানিত করছেন!”

“এতো কথা আমে শুনতে চাইছিনা তাঁরা। তুই যাবিনা ব্যস যাবিনা। আমি যা বলবো তাই হবে।”

“সবসময় গোড়ামী ভালো লাগেনা তাহজীব! আমি সেখানে যাবো, আমার মন পড়ে আছে সেখানে যেতে। প্লিজ আপনি আমায় ছাড়ুন।”

” ভেবে বলছিস তো? এল ফল কিন্তু ভালো হবেনা তাঁরা!”

“এখানে ফল খারাপ হবার কি আছে? আপনি যে এখানে সেখানে চলে যান কখনো আমার পারমিশন নিয়েছেন? না আগে একবার বলার প্রয়োজনবোধ করেছেন? আপনার যে এতো মেয়ে ফ্রেন্ড আমি আজ পর্যন্ত কাউকে নিয়ে প্রশ্ন করেছি? আপনার লিস্টে আপনার সিনিয়র জুনিয়র হতে শুরু করে কতশত চেনা অচেনা মেয়ে ,আমি কী বলেছি তাদের লিস্টে রাখেন কেন? গতবার যে কুয়াকাটা গেলেন কতমেয়ের সঙ্গে গ্রুপ ফটো আপলোড করেছেন আমি একবারও প্রশ্ন করেছি মেয়েগুলো কে? কেন তাঁদের পাশে নিয়ে ছবি তুলেছেন? অথচ এই কাজগুলো আমি করা তো দূর স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। সবসময় একতরফা স্যাক্রিফাইজ তো চলেনা তাহজীব! আমি যেমন সবকিছু থেকে দূরে থাকি আপনাকেও তো থাকতে হবে। আপনি যদি এমন আটকে রাখাকে ভালোবাসা বলে আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারেন তবে আমিও তো বলতে পারি আমায় ভালোবেসে আপনিও সেসব বাদ দিন! আমিই কেন সবসময় ছাড় দিবো, যেখানে আপনি আমাকে এক বিন্দু ছাড় দিতে ইচ্ছুক না??”

তাহজীব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, তুই তাহলে সমান সমান চাইছিস সব? আমি ছেলে আমি অনেককিছুই করার ক্ষমতা রাখি, আমাকে কেউ ধরে নিয়ে রেপ করবেনা। কিন্তু তুই মেয়ে! তোর সেইফটি নিয়ে আমি ভাববো না? বেশ তবে যা যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে। আমি তোকে কিছু বলবোনা। বায়”

তাহজীব একবারো পিছু ফিরে চাইলোনা। সিতারাও কক্সবাজার যাওয়ার সাহস দেখালোনা। রাগের মাথায় এতোদিনের জমানো কথা এভাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে সে কখনো কল্পনা করেনি। সেই রাস্তায় বসে কারো তোয়াক্কা না করেই কাঁদতে শুরু করেছিল সে।
তারপর কতদিন তাহজীবের মান ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। প্রতিবার সে বকাঝকা দিয়ে বিদায় করেছে। শুধু যে বকাঝকা করেই ঝাঁজ মিটিয়েছে তা নয় এমনসব কথা বলে অপমান করেছে যা হয়তো কারোই সহ্য হতোনা। সোফিয়া মেয়ের চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করেছিলেন বলেই সিতারার বাবা আর ফুফুর সাথে কথা বলে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে বসেছিলেন। সিতারা ভেবেছিল রাগ অভিমান যাই হোক বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু তাহজীব যে এমন রিয়েক্ট করবে তা সে কখনোই ভাবেনি।
শুধু যে সিতারা কে রিজেক্ট করেছে তা নয়, সে আফসানা নামক মেয়ের সঙ্গে আংটিবদল করে ছিল তার পরের দিনই।

বেলকনীতে দাঁড়িয়ে সেইসব কথাই ভাবছিল সিতারা। হলুদ ফাংশন শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ হলো, কাল তাহজীবের বিয়ে। এই কথাটা ভাবতেই তাঁর কলিজা ছিড়ে আসছে। এই দিনটার জন্য কত বছর অপেক্ষা করেছিল সে। বিয়ের লেহেঙ্গাটা পর্যন্ত সিতারার পছন্দসই। বিয়ে নিয়ে তারা যা যা পরিকল্পনা করেছিল সবটা সেরকমই হচ্ছে কেবল পাত্রী অন্য কেউ! তাহজীব ওর পোড়ামনের ক্ষত বাড়াতে দার্জিলিং এ হানিমুনের টিকিটটা পর্যন্ত কেটে রেখেছে।
“এতো রাগ তার, এতো ক্ষোভ মনে! এ কেমন নিষ্ঠুরতা!”
তবে সিতারার মনে একটা শঙ্কা জাগছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বিয়ের সময় তাহজীব ঠিক মত বদলে ফেলবে। হয়তো রাগ দেখাতেই সিতারাকেই বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু সিতারা আর ফিরবেনা তাঁর কাছে। বরযাত্রী বের হবার আগেই নিখোঁজ হবে সে। যেন কেউ টের না পায় এমনভাবে কাজটা করতে হবে।
__________________

পৃথিবীর সবকিছু বদলে গেলেও আকাশটা বদলায়নি। সে ঠিক আগের মতোই বিশালতার উপমা হয়ে রয়ে গেছে। ঢাকা শহরটার প্রতি অদ্ভুত মায়া কাজ করে রাফসানের। এখানেই যেন তার কেন্দ্রস্থল। যেখানেই যাক না কেন দিন শেষে তাকে এই শহরেই ফিরতে হয়। এই শহরের অলিগলি কত মিস করছিল তা কেবল সে-ই জানে। ব্যস্ত শহরের যানজটেও যেন সে মায়া খুঁজে পায়। ছোটবেলায় তাঁর মা বলতো, রাফুরে ছেলেদের মনে এতো মায়া থাকলে চলেনা বাবা। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে
মন করতে হবে পাথরের মতো শক্ত, শত দুঃখ; শত আঘাতেও যেন না ভাঙে।
তুই তো আমার সোনা ছেলে মায়ের আঙুলে রক্ত দেখেই চোখের পানিতে ভাসছিস। এমন কাঁদুনে হলে লোকে যে মেয়ে মানুষ বলবে!
রাফসানের মনে হয় তার মা ঠিকই বলেছে, ছেলেদের মন নরম হলে চলেনা। হতে হয় কঠিন শক্ত, যেন কেউ চাইলেও ভাঙতে না পারে।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে পথে পথে ঘুরছিল তখন ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। দুইবার রিং হতেই সে রিসিভ করলো।

“হ্যালো রাফসান সাহেব? আস্সালামু আলাইকুম ভালো আছেন?”

“জ্বি ওয়ালাইকুম আস্সালাম। কে বলছেন?”

“আরেহ আমি সিতারা। ঐ যে বোকা মেয়েটা যার হেল্প করেছিলেন আপনি?”

“ওহ হ্যাঁ আপনি! ভালো আছেন?”

“জ্বি ভালো আছি। আচ্ছা আপনি কি এখন ফ্রি আছেন?”

“হুম কেন?”

“কেন! আসলেই তো কেন? আচ্ছা শুনুন আমি তিন ঘন্টার জন্য নিখোঁজ হবো। আপনি কি আমাকে হেল্প করতে পারবেন?”

“একটা অচেনা ছেলেকে এই কথা বলছেন আপনার সাহস আছে বটে!”

“আমি কিন্তু ক্যারাটে জানি।”

“হাহাহাহা। এটা কি ভয় দেখানোর জন্য বলছেন নাকি সত্যিই?”

“আপনি চাইলে ডেমো দেখাবো।”

“না থাক। আমি এমনিতেও অসহায় মানুষ হসপিটালাইজ করানোর কেউ নেই। অযথা আমাকে ডেমো দেখাতে হবেনা।”

“না থাক আমি বরং অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ”

রাফসান আনমনেই হাসতে লাগলো। মেয়েটা কি তবে তাকে ভড়কে দিতেই কল করেছিল?

চলবে,,,,