অবান্তর চিরকুট পর্ব-০৮

0
320

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব:৮)

♡আরশিয়া জান্নাত

বহুক্ষণ এ পাশ ওপাশ করেও দুচোখের পাতা এক করা গেল না। অবশেষে রাত তিনটায় দুটো ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমাতে গেল সিতারা। চোখ বন্ধ করেও শান্তি পাচ্ছেনা পুরনো সব স্মৃতি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আজ রাতে সে কি করে ঘুমাবে? পৃথিবীতে এমন কিছু কি আছে যা এই যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্ত ভুলিয়ে দিতে পারবে?
গান শোনার জন্য ফোন হাতড়ে নিলো। সুইচডঅন করতেই দেখে রাফসানের টেক্সট। না চাইতেও বিষাদতা ছড়িয়ে দিলো কিবোর্ডে,

“ঠিক থাকার মতো কিছু কি আছে জনাব?”

মেসেজ সেন্ড হবার সাথে সাথেই রিপ্লাই এলো,

” যাক আপনি বেঁচে আছেন তাহলে! আমিতো ভেবেছি,,,,”

সিতারা কিছুটা অবাক হয়েই বললো,

“আপনি এখনো ঘুমান নি? ইনসোমনিয়া আছে নাকি?”

“না আসলে আপনার টেনশনে ছিলাম,,
ব্যাকস্পেসে ক্লিক করে সবটা মুছে লিখলো,

“এমনি ঘুম আসছে না”

সিতারা টেক্সট না করে সরাসরি কল করলো,

“হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম।”

“পারমিশন ছাড়া কল করার জন্য দুঃখিত।”

“ইটস ওকে। মুড অফ?”

“মিথ্যে বলি?”

“না। সত্যি বলতে না চাইলেও মিথ্যা বলতে হবেনা।”

“জানেন আজ তাঁর বিয়ে ছিল!”

“কষ্ট পাচ্ছেন?”

” পাওয়াটা অস্বাভাবিক?”

“নাহ। তবে পেয়ে কি হবে! দুঃখ উড়িয়ে দিন বুকে পুষে রেখে নিজেকে কষ্ট দেবেন না।”

“এতো সহজ?”

“কঠিন না কিন্তু!”

“বেশ। তা আপনি এই রোগে আক্রান্ত হবার কারণ কি? ক্যারিয়ার নিয়ে ডিপ্রেশন নাকি অন্য কিছু?”

” সে গল্প অন্য কোনোদিন শুনবেন। তবে একটা কথা বলতে পারি আমাদের গল্পের পটভূমি আলাদা হলেও শেষটা প্রায় একই রকম।”

“আমি কিন্তু খুব ভালো শ্রোতা। একদিন সুযোগ করে শোনাবেন কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম।”

“আচ্ছা!”

“আমাকে ছ্যাঁচড়া মনে হচ্ছে তাইনা? কেমন আগ বাড়িয়ে কথা বলছি,,,”

“নাহ। আপনার ব্যাপারটা আমি খুব ভালো করেই বুঝেছি। আসলে আমরা যখন খুব কষ্ট পাই বা কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে থাকি তখন আশেপাশের মানুষদের থেকে পালিয়ে বেড়াই। চেনাজানা লোকদের করুণ চাহনী কিংবা টিপ্পনি আমাদের মন সহ্য করতে পারেনা। তাই এই সময়টায় অচেনা কিংবা দূরের মানুষদের সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে। সো ডোন্ট ওরি আমি আপনাকে একটুও ছ্যাঁচড়া ভাবছিনা।”

“আপনি খুব বিচক্ষণ মানুষ। আর বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। ধন্যবাদ আমার মনের অবস্থা বোঝার জন্য।”

“স্বাগতম। তবে প্রশংসা করে লজ্জায় ফেলছেন।”

“কি যে বলেন!”

“অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

“আপনিও। শুভ রাত্রি”

“শুভ রাত্রি”

ফোন রেখে রাফসান ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সাফাকে সারাদিন ভুলে থাকলেও রাতে ঠিকই সে মিস করে। অথচ আজ পুরো সন্ধ্যা থেকে এই পর্যন্ত সিতারার টেনশনেই মত্ত ছিল। মেয়েটাও তাঁর মতো খারাপ সময় পার করছে। প্রিয় মানুষকে অন্যের পাশে দেখা কতটা যন্ত্রণার তা রাফসানের চেয়ে ভালো কে বুঝবে?
___________

রিসিপশনে আফসানার পাশে তাহজীবকে দেখে হাসিমুখেই শুভেচ্ছা জানালো সিতারা। বিয়েতে তার অনুপস্থিতি সকলের নজর এড়ালেও তাহজীবের মায়ের নজর এড়ায়নি। তিনি সুযোগে সিতারাকে টেনে রুমে বসিয়ে বললেন, পালিয়ে বাঁচলি তাইনা? আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা রেখেছিলাম তুই ই আমার পুত্রবধূ হবি। কিন্তু তুই সেই সুযোগ রাখিস নি। তোকে কি বলবো আর আমার হারামজাদা ছেলেটাই সব নষ্ট করেছে এখন আর আফসোস করে কি লাভ!

“এসব ছাড়োনা ফুপ্পী। এখন এসব ভেবে অযথাই কষ্ট পাচ্ছো। তাকদিরে যা ছিল তাই ঘটেছে।”

“আমার ছেলে কাল সারারাত পায়ের কাছে বসে কেঁদেছে। কিছু বলেনাই মুখে,,, ”

“আপা কেন এসব কথা বলছো এখন? এখন এসব বলে লাভ আছে? এখন ওর জীবনে অন্য কেউ চলে এসেছে, পিছুটান রেখে কষ্ট বাড়িও না”

(জহির সাহেব রুমে ঢুকে সবটা শুনে এসব বললেন)

সিতারা কিছু না বলেই চলে গেল।

“তুমি কেন ওকে এসব বলছো? ও তো কম চেষ্টা করেনি। এখন যখন সামলে উঠছে এসব বলে কেন দূর্বল বানাচ্ছো?”

“আমি কি করবো তুই বল? ছেলের কষ্ট যে সহ্য হচ্ছেনা।”

“সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমরা তো সুযোগ দিয়েছিলাম সে যখন নিজেই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখন আমাদের কি বলার আছে?”

“জহির আমার ছেলের সংসার যদি ভেঙে যায় তুই সিতারার সঙ্গে ওর,,,”

কথা শেষ হবার আগেই জহির সাহেব থামিয়ে বললেন, আপা আজ তোমার মেয়ের সাথে যদি এমন ঘটতো তুমি কি দিতে? এখনই এতোকিছু ভেবোনা আল্লাহ চাইলে ওদের সংসার ভালোভাবেই চলবে। নিয়্যত ভালো রাখো।

তাহজীবের মা আর কিছুই বললেন না।

দার্জিলিং যাওয়ার আগে তাহজীব সিতারাকে টেক্সট করে বললো, যদিও আমি বিশ্বাস করিনা তোর জীবনে কেউ আছে। তাও বলে রাখলাম যদি কেউ থাকে তবে আমি সরে যাবো, আর যদি না থাকে তবে এই সংসার বেশিদিন টিকবেনা। যেভাবেই হোক আমি তোকে বিয়ে করেই ছাড়বো।

রাগে গা ঘিনঘিন করতে লাগলো সিতারার। কি ভাবে তাহজীব নিজেকে! হানিমুনে যাওয়ার আগে এমন কথাবার্তা। তাহজীবকে আজকাল অসহ্যকর লাগে, বেপরোয়া ভাবটাই আগে টানতো অনেক। অথচ এখন মনে হয় বড্ড বাড়াবাড়ি। তাঁর চোখে কেবল জয় করার লোভ, হারতে না চাওয়ার হিংস্রতা। এমন লোককেই সে অন্ধের মতো ভালোবেসেছে? আংটি বদলের পরও তো কম কান্নাকাটি করেনি সে। কতবার ক্ষমা চেয়েছিল, খুব কষ্ট হচ্ছে বলে বলে কত টেক্সট করেছিল। অথচ তাহজীব তখন আফসানাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোতে বিজি ছিল। সেই নিষ্ঠুর লোকের বিয়ের দিনই কেন সব ভালোবাসা উৎড়ে পড়লো? এটাকে প্রতিহিংসা ছাড়া আর যাইহোক ভালোবাসা তো বলা যায়না,,,
দার্জিলিং থেকে ফেরার আগেই সে এমন কাউকে ম্যানেজ করবে যাকে দেখে তাহজীবের ভুল ভাঙে। তাকে দেখিয়ে ছাড়বে সে অনেক আগেই মুভ অন করেছে। এখন তাঁর মনে তাহজীবের জন্য কিচ্ছু নেই।
কিন্তু সিতারার চেনাজানা ছেলে নেই বললেই চলে। সবসময় সে তাহজীবের জন্য ছেলেদের এড়িয়ে এসেছে। এখন হুট করে কোত্থেকে ছেলে যোগাড় করবে? আর তাহজীবের যে নেটওয়ার্ক ফ্রেন্ডদের সাহায্যে কিছু করলে ঠিক খবর পেয়ে যাবে। তাই যা করার ওকেই করতে হবে। দুঃখদূর্দশা ভুলে এখন সে টেনশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কোথায় পাবে সে তাহজীবকে টক্কর দেওয়ার মতো ছেলে???

হঠাৎ মনে পড়লো সেদিন রাফসান কেমন সাবলীল গলায় কথা শুনিয়েছিল তাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ সে ই পারে ঠান্ডা গলায় কঠিন কথা বলে রাফসানকে চুপ করাতে। কিন্তু রাফসানের সম্পর্কে তো কিছুই জানেনা, তাঁকে বললে সে কিভাবে নিবে তাও ভাবনার বিষয়। না উনার সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরি। তাছাড়া হাতেও মোটামুটি সময় আছে। যা করার এরমধ্যেই করতে হবে।


“দেখো বাবা, মেয়েকে ভালো পাত্র দেখে পাত্রস্থ করা সকল বাবার গুরুদায়িত্ব। আমি আমার ফরজ কাজ আদায় করেছিলাম। তুমি আমার চোখে আদর্শ মেয়ের জামাই। কিন্তু আমার নসীব খারাপ, মেয়ে আমার কোন মোহে হারিয়েছে আল্লাহ ভালো জানেন। তবে তোমার অভিশাপে ও কোনোদিন সুখী হবেনা। রুহের হায় বড় খারাপ জিনিস।”

“এসব বলবেন না আব্বা। আমি ওকে অভিশাপ দেইনা। আমি আপনার মেয়েকে সুখে রাখতে পারিনাই এটা আমার ব্যর্থতা। আপনি দোআ করেন ও যেই সুখের আশায় গেছে তাই যেন পায়।”

“কষ্টে বলি এসব। সে আমারে ফোন করে বলে আমি তাঁর বোঝা কমাতে অল্প বয়সে বিয়ে দিছি, যে বয়সে পড়াশোনা করে স্টাবলিশ হওয়ার কথা সে বয়সে ও সংসারের ঘানি টানছে। মেয়ে আমার এতোই বড় হয়েছে সে এখন বাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিয়েও করছে নিজে নিজে। আমিও বলে দিয়েছি আমার বাড়িতে ওর জায়গা নেই। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে।”

রাফসান মাথা নীচু করে সব শুনলো কিছু বললোনা। তখন সাফার বাবা সাদেক আহমেদ বললেন, বাবা একটা কথা বলি, আমার ছোট মেয়ে রুবিকে তো দেখছোই। তুমি চাইলেই আমি ওরে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই। তোমার ফুফু আমার বড় সম্মানের বোন হয়। তার ভাতিজাকে এমন কষ্ট দেওয়ার যন্ত্রণা আমার কমতেছেনা। বড় মেয়ের ভুল তো শোধরাতে পারবোনা তাই,,,,

রাফসান শান্তস্বরে বললো, আব্বা আপনাকে আমি অনেক সম্মান করি। আমার বাবা-মা নেই আপনাদের নিজের বাবা-মায়ের মতোই সম্মান করি। আর রুবি- সাফিন কে ছোটভাইবোনের মতো স্নেহ করি। সাফার সাথে আমার সম্পর্ক না থাকলেও আপনাদের সঙ্গে ছেলের মতোই সম্পর্ক বজায় রাখবো। আপনি এসব বলে আমায় লজ্জিত করবেন না। ওরা আমার ভাইবোন এর বাইরে অন্য কিছু করার দরকার নেই।

“কিন্তু তুমি একা চলবা কিভাবে? এখানে না হোক অন্য কোথাও সমন্ধ দেখি? আমার ছেলে পরিচয়ে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো”

“আপনি এখন এসব ভাববেন না। আমার সেরকম মনে হলে আমি অবশ্যই জানাবো।”

সাদেক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

চলবে,,,