আড়ালে কে পর্ব-০৪

0
153

#আড়ালে_কে [ #পর্ব – ০৪ ] [ ভায়োলেন্স এলার্ট ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক

স্ত্রী সাইফার পিঠে একের পর এক লা*থি দিয়ে চলেছে সিয়াম। একবারের জন্যও তার নজরে আসেনি র*ক্তের ফোয়ারা। সাইফার মাথা থেকে র*ক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে যখন মেঝের মাঝখানে চলে এসেছে তখন তা নজরে আসে তার। র*ক্ত দেখে ভয়ে কলিজা শুঁকিয়ে আসে সিয়ামের। পা দু’টো আর তার ভর রাখতে পারে না। ধপাস করে পরে যায় সে। সাইফার মাথাটা দ্রুত তার পায়ের উপরে উঠিয়ে আনে। তারে পুরো হাত র*ক্তে ভরে যায়। সিয়ামের মুখ থেকে একের পর এক অর্থহীন শব্দ বেরিয়ে আসে। কিংকর্তব্য বিমুখ হয়ে যায় সে। অনেকক্ষন ধরে সাইফার মাথাটা পায়ের উপরে নিয়ে বসে থাকে।

সাইফার মাথায় এক টুকরো কাপড় চেপে ধরার কথাও মনে হয় না সিয়ামের। র*ক্ত বেরুতে বেরুতে দরজার নিচে দিয়ে বাইরে চলে যায়। সাইফার শরীরটা আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করে। একে ঠিক নড়াচড়া বললে ভুল হবে। কয়েকটা কাঁপুনি দিয়েই নিস্তেজ হয়ে যায় তার শরীর। ঠান্ডা হতে শুরু করে সাইফার মৃতদেহ।

হুঁশ ফিরে সিয়ামের, স্ত্রী মাথাটা পা থেকে নামিয়ে দৌড়ে গোসল খানায় যায় সে। তাড়াতাড়ি পুরো শরীরের রক্ত ধুয়ে ফেলে। পরনের লুঙ্গিটা র*ক্তে লাল হয়ে গেছে। তাই সেটা পাল্টে পেন্ট পরে নেয়। পরনের টি-শার্ট ও পাল্টে নেয়। হন্য হয়ে কতক্ষণ দৌড়াতে থাকে পুরো ঘরে। কি রেখে কি নিবে বুঝতে পারে না। পুরো ঘর খুঁজে কোথাও দশটা টাকাও পায় না। নিজের পকেটে আগের মাত্র পঞ্চাশ টাকা ছিল। এই টাকা আর সাইফার বাটন ফোন ও নিজের মোবাইল সহ দরকারি সব কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বারান্দায় এসে দেখে র*ক্ত বারান্দাতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে পায়ে অল্প র*ক্ত লেগে গিয়েছিল। সেগুলো বাইরের একটা টিপকল থেকে ধুয়ে বেরিয়ে গেল সে। কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই জানা নেই তার। সে কেবল একটি কথাই জানে, যেভাবেই হোক তাকে পালাতে হবে। অনেক দুরে পালিয়ে যেতে হবে ।
..
..
নাজমুল সাহেবের বুক থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে সোহানা। বারবার মোচড়াচ্ছে নিজের শরীর। এটা মোটেও পছন্দ হয় না নাজমুল সাহেবের। তাই সোহানার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘চুপচাপ শুয়ে থাক, বেশি মোচড়ামুচড়ি করলে হাত ঠ্যাং মুচড়ে ড্রামের ভিতরে ঢুকিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিব।’

ভয়ে সোহানায় কান ঠান্ডা হয়ে আসে। একেবারে জড় পদার্থের মতো চুপ হয়ে যায় সে। প্রথমবারের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় এই নবদম্পতি।
.
.
ফজরের আজানের পরপরই দেশি মোরগের ডাক শোনা যায়। ঘুম ভাঙে নাজমুল সাহেবের। ডিম লাইটের আলোতে দেখতে পায় সোহানা একটা বাচ্চা মেয়ের মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। কানের উপরের ছোট চুল গুলো মুখের উপরে ঝুলে আছে। সোহানাকে দেখে কেমন যেন মায়া লাগতে থাকে ওনার। নিজের মুখটা সোহানার খুব কাছে নিয়ে যান উনি। ডিম লাইটের সল্প আলোতে অতোটা বুঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তবুও স্ত্রীর গলাতে নিজের আঙুলের ছাপ দেখতে পান নাজমুল সাহেব। সোহানার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেন। খুব আস্তে আস্তে বলেন, ‘তোমাকে খুব আঘাত করে ফেলেছি! তাই না সোহানা?’

কথাগুলো এতোটাই তীক্ষ্ণ শব্দের ছিল যে তা সোহানার কান অবধিও পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। নাজমুল সাহেব অনেকক্ষণ বসে থাকেন সোহানার মাথার পাশে। তার লাবণ্যময়ী চেহারাটা ডিম লাইটের নীলচে আলোতে চকচক করছে। কি ভেবে যেন আবারও স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে গেলেন নাজমুল সাহেব, কতক্ষণ খুব কাছ থেকে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অতঃপর তার চুলের মন মাতানো সুগন্ধ নিলেন নিঃশ্বাসের সাথে। সোহানা একটু নড়েচড়ে উঠল, পার্শ পরিবর্তন করে অন্য দিকে ফিরল। নাজমুল সাহেব নিজেকে একটু সামলে নিলেন, পরীক্ষা করে দেখলেন সোহানা তখনও গভীর ঘুমেই তলিয়ে আছে। নিশ্চিত হতেই চোখ বন্ধ করে সোহানার কপালে একটা চুৃমু খেয়েই দ্রুত সরে গেলেন সেখান থেকে। সোহানা একটু নড়ে উঠে বাম হাতের পিঠ দিয়ে কপাল মুছল। নাজমুল সাহেবের বুুক যেন ধুকধুক করে উঠল, কোথাও সোহানা জেগে ছিল না তো!
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে আবার নিজেই উত্তর দিলেন মনে মনে, ‘যা, উঠলে কি হয়েছে। আমার বউরে আমি চুমু দিছি তাতে সমস্যা কি!”

অতঃপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ নিজেকে দেখলেন নাজমুল সাহেব। চুলগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন ভালো করে, ‘কই একটা চুলও তো পাকেনি!’

খোচা খোচা দাঁড়ি গুলোও খুঁটিয়ে দেখলেন, ‘সব কালো চকচকে।’

বিভিন্ন পোজ দিয়ে নিজেকে ভালো করে দেখলেন তিনি, সব দিক দিয়েই তো সুপুরুষ মনে হচ্ছে! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলেন একেকপর এক। পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা, কোনো মেদ নেই, চুলে পাক ধরেনি। তবুও কি সমস্যা আমাকে পছন্দ করতে! বয়স কি খুব বেশি হয়ে গেছে! সবে মাত্র ৩০ বছর। ওর থেকে মাত্র আট বছরের বড়। তাতে কি হয়েছে, কেন অপছন্দ হবে আমাকে!

ভাবনায় কোনো কুল কিনারা পেলেন না তিনি। পরনের টি-শার্ট টা খুুলে অন্য একটা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। বাবা-মার ঘরের দরজাতে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন কেউ উঠেছে কি-না। ভিতরে একটা ইঁদুর দৌড়ানোর শব্দও ওনার কানে আসল না। কালকে রাতের কথা মনে পরতেই ওনার বুক কেঁপে উঠল। মায়ের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন, এই ভেবে কাউকে আর ডাকলেন না তিনি।

আস্তে আস্তে সিঁড়ি ঘরের দরজাটা খুলে ছাদে উঠে গেলেন। মুক্ত বাতাসে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে হিসাব করতে লাগলেন জীবনের পাওয়া না পাওয়াগুলো। কলেজ জীবনে অন্য দশ জনের মতো ওনার জীবনেও প্রেম এসেছিল। ভালো লাগত, সব লজ্জা ঝেড়ে মুছে প্রিয়জনকে জানিয়েছিলেন ভালোলাগার কথাটুকু। কিন্তু প্রেমের সুযোগ হয়ে উঠেনি। মেয়েটা পূর্ব থেকেই অন্য জনের প্রেমে মজেছিল। নাজমুল সাহেব তখন দ্বিতীয়বার আর ঘাঁটেননি সেই মেয়েকে। কলেজ জীবন ছেড়ে ভার্সিটিতে উঠার পরে আর এসব নিয়ে ভাবারই সময় পাননি। বাবার অসুস্থতা ওনাকে একের পর এক টিউশনি করতে বাধ্য করেছে। মাস্টার্স শেষ করে আর পড়াশোনাতে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগও করতে পারেননি। যোগ দিতে হয়েছিল চাকরিতে।

তারপর কবে যে সংসারের ঘানি টানতে শুরু করলেন আর বিয়ের বয়স পেরিয়ে যেতে থাকল তা বুঝতেই পারেননি। হাত দু’টো দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে একটু ব্যায়াম করার চেষ্টা করলেন। কতদিন শরীরের যত্ন নেওয়া হয় না। ভুঁড়িটা অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছে। ছাদের মেঝেতে ভর দিয়ে কয়েকটা বুক ডাউন চেষ্টা করলেন। পাঁচটা নিয়েই হাঁপিয়ে উঠলেন। মসৃণ পরিষ্কার ছাদেই শুয়ে পরলেন ক্লান্ত হয়ে। নিজেকে নিজেই বলতে থাকলেন, ‘তুই তো বুড়া হয়ে যাচ্ছিস নাজমুল। তুই বুড়া হয়ে যাচ্ছিস।’

বেশিক্ষণ আর একা থাকা হলো না নাজমুল সাহেবের। ছোট বোন মোবাইল হাতে দৌড়ে ছাদে আসল, ‘ভাইয়া ভাইয়া, তোমার ফোন আসছে।’

বোনের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলেন অফিসের কল। রিসিভ করে কানে দিতেই বস একটার পর একটা দ্বায়িত্ব দিতে থাকলেন ওনাকে। নাজমুল সাহেব রোবটের মতো কেবল ‘ জি স্যার, জি স্যার’ করে গেলেন।

কথা শেষ করে কল কাটতেই খেয়াল করলেন ছোট বোন মাথার পিছনে এসে দাড়িয়েছে। নাজমুল সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আচ্ছা নাদিয়া আমাকে দেখে তোর বুড়া মনে হয়?’

নাদিয়া কতক্ষণ ঠোঁট উল্টে ভাবল। তারপর ভাইয়ের মাথার চুল গুলো টানতে টানতে বলল, ‘আমার কাছে তো মনে হয়। কিন্তু ভাবী কি তোমাকে বুড়া বলল না-কি?’

নাজমুল সাহেব ঘাড় নাড়লেন, না সূচক জবাব দিলেন নাদিয়াকে।

নাদিয়া আরো কতক্ষণ ভাইয়ের চুল টেনে দিল। তারপর আমতা আমতা করে বলল, ‘ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলি?’

নাজমুল সাহেব হেসে বললেন, ‘তুই আমার একটা মাত্র বোন। তুই একটা কেন একশোটা বলবি। তবে শর্ত আছে একটা।’

নাদিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কি শর্ত? ‘

নাজমুল সাহেব হেসে বললেন, ‘খালি চুলগুলো আরেকটু ভালো করে টেনে দিতে হবে। সেই কখন থেকে খালি হাত বুলিয়ে যাচ্ছিস।’

নাদিয়া উচ্চস্বরে হাসল আর ভালো করে চুল গুলো টানতে লাগল।
আরামে চোখ দু’টো বন্ধ করলেন নাজমুল সাহেব। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন কিছুক্ষণ। তারপর নাদিয়াকে তাগাদা দিলেন তার কথাটা বলার জন্য।

নাদিয়া আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার না খুব ভয় করছে ভাইয়া। তুমি আবার বকা দিবে না তো আমাকে?’

নাজমুল সাহেব তাকে আশ্বাস দিলেন। নাদিয়া কতক্ষণ ভেবে চিন্তেে বুকে সাহস নিয়ে বলল, “আমি না ভাবীকে একটা ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে দেখেছি।’

নাজমুল সাহেব দ্রুত বেগে ঘাড় ঘুরালেন নাদিয়ার দিকে। নাজমুল সাহেবের লালচে চোখ দু’টো দেখেই ভয় পেয়ে গেল নাদিয়া। ভয়ে তার বুক দ্রুত বেগে উঠানামা করতে লাগল। ভাইয়ের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না নাদিয়ার। সিঁড়ি দিয়ে একপ্রকার দৌড়ে ঘরে চলে গেল সে।

( চলবে ইন শা আল্লাহ )