আড়ালে কে পর্ব-০৬

0
119

#গল্প – #আড়ালে_কে [ পর্ব- ০৬ ]
লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক

রাতে ঘরে ফিরতেই নাকে বোটকা একটা গন্ধ পান শফিক সাহেব। র*ক্ত পঁচা এই গন্ধ সাধারণত কোরবানি ঈদের দিন বিকালে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন এই সময়ে এমন পঁচা গন্ধ কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারেন না তিনি। পাশের, বিল্ডিংয়ের কাছে যেতেই গন্ধটা আরো বেড়ে যায়। কৌতূহল নিয়ে সেই বাড়ির উঠোনে হাজির হোন। দেখেন বাড়ির সদর দরজা খোলা অবস্থায় আছে। উনি আগে থেকেই জানেন এই বাড়ির মালিক এখানে থাকেন না। ছোট্ট ২ রুমের এই বাড়িটা কেবল বিশাল জায়গাটা পাহারা দেওয়ার জন্য যেন একটা পরিবার থাকতে পারে সেজন্য তৈরি করা হয়েছে। কয় মাস আগেই এটিতে আসে এক নবদম্পতি। অল্প বয়সের নতুন দম্পতিটি পালিয়ে বিয়ে করছে বলেই ধারণা করেন শফিক সাহেব ওনার মাথায় দুঃশ্চিন্তা ঢুকে যায়। মোবাইলের লাইট জালিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখেন মেঝেতে র*ক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাতাসের ধাক্কায় তীব্র গন্ধ এসে ঠেকে ওনার নাকে। পকেটে কিছু না পেয়ে পাঞ্জাবির হাতে দিয়েই নাক চেপে ধরেন তিনি।

আর ভিতরে যাওয়ার সাহস করেননি তিনি, সেখান থেকেই ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। পুলিশে কল করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান এবং রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ডেকে এনে পরিস্থিতি দেখান তাদের। সবাই অপেক্ষা করে পুলিশ আসার জন্য। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে ৪ জন পুরুষ ও একজন মহিলা পুলিশ এসে উপস্থিত হলেন। তাদের নেতৃত্বে আছেন এস আই আজিজুর রহমান।

চল্লিশ উর্ধ্ব বয়সের এস আই আজিজুর রহমান দেখতে এতোটাও বৃদ্ধ নন। কিন্তু মেদ অনেকটা বেড়ে গেছে। দাঁড়ি সেভ করে রাখাতে এখনো বয়স ৩৫ এর বেশি মনে হয় না ওনাকে। ভাড়া করা সিএনজি নিয়েই এসেছেন ওনারা। থানার নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করেননি। একটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে একজন সহকারী কর্মকর্তা উপস্থিত লোকজনের ভিড় সরিয়ে ভিতরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেন।

এসআই আজিজ সাহেব ভিতরে ঢুকেন। মেঝেতে অল্প জায়গাও বাকি নেই যেখানে পা ফেললে র*ক্ত লাগবে না জুতায়। বাধ্য হয়ে র*ক্তের উপর দিয়ে হেঁটেই ঘরে ঢুকেন তিনি। বেশিক্ষণ আর খোলা নাকে থাকতে পারলেন না। পকেট থেকে কারুকাজ করা রুমালটা বের করে নাকে চেপে ধরেন। ফ্লোরে একটা যুবতী মেয়ের লাশ পরে আছে। তার মাথা থেকে বের হওয়া র*ক্তের ফোয়ারা গড়িয়ে গড়িয়ে বারান্দায় গিয়েছে। বিষয়টা বুঝতে পারার পরে
মহিলা সহকর্মীকে ডাকালেন উচ্চ স্বরে ‘ এই সালমা ভিতরে আসো তাড়াতাড়ি।’

মিস সালমা র*ক্ত দেখেই ভয়ে আছেন। কিন্তু ভিতরে না গিয়েও কোনো উপায় নেই। মূূল দরজা পাড় হওয়ার আগেই নাকে মুখে রুমাল চেপে নিলেন। অতঃপর র*ক্তের উপর দিয়ে পা টিপে টিপে কোনো রকমে লাশের সামনে গেলেন তিনি। আজিজ সাহেব অন্য সব পুলিশ অফিসারদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে নিজেও বের হয়ে গেলেন। বারান্দায় এসে বললেন, ‘সালমা এবার বডি উল্টে পাল্টে দেখ অস্বাভাবিক কি দেখা যায়।’

মিস সালমা ডেট বডিটা উল্টে পাল্টে দেখে আজিজ সাহেবকে জানান, “স্যার তেমন কিছুই তো নাই। মাথার পিছনে খালি র*ক্ত।’

আজিজ স্যার আবারও জিজ্ঞেস করে, ” কেমন ক্ষত? ‘

‘ স্যার বুঝা যায় না তো রক্তের জন্য। ছোটই মনে হচ্ছে।’

‘ শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে?’

‘ এমনিতে তো বুঝা যাচ্ছে না কিছুই। আরো ভালো করে দেখতে হলে সব খুলতে হবে।’

‘ আচ্ছা তাইলে আর কিছু করতে হবে না এখন। আপাতত এতোটুকুতেই হবে। তুমি বডি বাইরে নেওয়ার উপযোগী কর।”

মিস সালমা ছোট্ট করে উত্তর দেয়, ” আচ্ছা স্যার”।

অতঃপর কাজে লেগে পরেন তিনি। মাথার পিছন থেকে র*ক্ত গুলো পরিষ্কার করে নেন বাতির আলোতে। তারপর চুলে খোঁপার মতো বেঁধে দেন। ওরনাটা গলাতে পেঁচিয়ে অল্প একটু ছড়িয়ে দেন বুকের উপরে। তারপর বাইরে থেকে আরেকজন সহকর্মী এসে ডেট বডিটা ধরা-ধরি করে বাইরে নিয়ে আসে। বাড়ি ওয়ালাকে আগেই কল করে জানানো হয়েছিল। উনি নিজের প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে আরো ২০ মিনিট সময় লাগবে বলে জানান। পুলিশকে অনুরোধ করেন ততক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য। পুলিশের পক্ষ থেকে ওনার অনুরোধ রাখা হয়।

উনি আসার আগে বাকি ২০ মিনিটে ডেট বডি থাকা ঘর পুরোটা তল্লাশি করা হয়। জরুরি কাগজ পত্রের সাথে সাথে ফ্রিজ ও অন্যসব জিনিসও খুঁটিয়ে দেখেন ওনারা। সাধারণত বাংলাদেশ পুলিশরা ঘটনাস্থল তেমন পরীক্ষাই করে না। আসে, লোকজনের সাথে কথা বলে, এলাকার মেম্বার ও অন্যসব সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে। তারপর লাশ নিয়ে চলে যায় পোস্টমর্টেম করার জন্য। তবে এদিকে একটু আলাদা আজিজুর রহমান স্যার। এই ঘটনা ওনার হৃদয়েও একটুখানি আঘাত করেছে। তাই সবাইকে তাগাদা দিল ভালো করে সব পরীক্ষা করার জন্য।

সহকর্মীরা সব দেখা শেষ করলেন ১০ মিনিটের মধ্যে। তারপর বাইরে উঠোনে চলে আসলেন সবাই। বাইরে কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। তবে পুরো উঠোন আলোকিত করার জন্য বাইরের সল্প আলোর বাতিটিও জ্বালানো হয়েছে।
এলাকার বেশকিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছেন, উপস্থিত হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাহেবও। সবার একটাই মতামত, এই নবদম্পতি সম্পর্কে তারা কেউই তেমন অবগত নন। তারা এই এলাকার না, কেবল ভাড়া থাকে হিসেবেই জানেন। তাদের বাড়ির পরিবার পরিজনের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় পেলেন না এস আই আজিজ সাহেব।

ততক্ষণে বাড়িওয়ালা এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। ঘেমে একাকারা হয়ে আছে বয়ঃজ্যোষ্ঠ এই ব্যক্তিটির চেহারা। ওনার ভিতরে কি অবস্থা হচ্ছে তা ওনার চেহারা দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হলো না ওনাকে। এলাকার প্রায় সবাই ই ওনাকে চিনেন। তাই দেখা মাত্রই সবাই জায়গা করে দিলেন ভিতরে যাওয়ার জন্য। উনি ভিতরে গিয়ে দাঁড়াতেই মেম্বার সাহেব ওনাকে এস আই আজিজ স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনি হচ্ছেন লোকমান হোসেন সাহেব, এই বাড়ির মালিক উনিই। এখানে যে বিশাল জমি দেখছেন সামনে এটাতে বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবেন উনি। এজন্য এসব দেখাশোনা করার জন্যই ছোট এই ঘরটি বানিয়ে ছিলেন।”

এস আই আজিজ সাহেব ওনাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন। লম্বা পাঞ্জাবি পরিহিত ধবধবে ফর্সা পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক। সহকর্মীকে নির্দেশ দিলেন হিস্ট্রি লেখার জন্য। নাম, বয়স, ঠিকানা এসব কিছু নেওয়ার পরে ডেট বডি সম্পর্কে ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন আজিজ স্যার।

বাড়িওয়ালা লোকমান সাহেব এমনিতেই ঘেমে আছেন। পকেট থেকে একটা টিস্যু নিয়ে আগে নিজের চেহারা মুছে নিলেন। তারপর শুরু করলেন সব বর্ণনা দেওয়া, “প্রায় ৩ মাস আগে একটা ছেলে আমার কাছে আসে বাড়ি ভাড়ার জন্য। সে না-কি তার এক বন্ধুর কাছে আমার এই বাড়ির কথা শুনেছিল। এখানে ভাড়া কম দিতে হবে আর তার-ও ইনকাম কম। এজন্য অনুরোধ করল যেন তাকে ভাড়া দেই। ছেলেটাকে দেখে ভালোই মনে হল। সিগারেট ছাড়া অন্য কোনো নেশার প্রতি তার ঝোঁক আছে মনে হয়নি। আমিও এমন লোকই খুজছিলাম। তাই ওকে জিজ্ঞেস করি কাকে নিয়ে থাকবে। সে বলেছিল যে নতুন বিয়ে করেছে আর এখন যে কোম্পানিতে কাজ করে সেটা এখান থেকে কাছে হবে বিধায় বউ নিয়ে চলে আসবে। আমি বিয়ের কাবিননামা দেখি। ওই ছেলের ও তার বাড়ির লোকের আইডি কার্ডের ফটোকপি এমনকি তার বউয়ের আইডি কার্ডের ফটোকপি ও নিই। এই যে এগুলোই।”

এক নিঃশ্বাসে এই সবগুলো কথা শেষ করে মানিব্যাগ থেকে ৩ টা কাগজ বের করে দেন তিনি। আজিজ সাহেব কাগজগুলো ভালো করে দেখে সেগুলোর ঠিকানাও নোট করে নেন।

তারপর কাগজ গুলো সহকর্মীর হাতে দিয়ে দেন বিবরনের কাগজের সাথে রেখে দেওয়ার জন্য। কাগজ গুলো যত্নের সাথে রেখে বাড়ি ওয়ালার আছে ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু বলতে বলেন।

লোকমান সাহেব আবারও একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে থাকেন, ‘ভাড়া দেওয়ার পরে মাত্র ৩-৪ বার আসছিলাম এখানে। সর্বশেষ এসেছিলাম মনে হয় ২২ দিন আগে। তখন ছেলেটার চেহারাটা আগের মতো ছিল না। দাঁত, ঠোঁট দু’টোরই রং কালচে হয়ে গেছে। গাল ভেঙে ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে। আমার মনে হলো সে সিগারেটের বাইরে অন্য নেশাও শুরু করেছে। কিন্তু তার বউটা খুব ভালো মেয়ে ছিল। আমাকে অনেক সুন্দর করে রান্না করে খাইয়েছিল। সাংসারিক ভাবে ওদের মধ্যে তেমন কোনো ঝগড়াঝাটি আমার নজরে আসেনি, আর আসার কথাও না যেহেতু মাসে ১বার দেখি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।”

আজিজ সাহেব প্রয়োজনীয় কথা গুলো সহকর্মীকে দিয়ে নোট করিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। বাড়িওয়ালার সাথে হ্যান্ডসেক করে বললেন, ‘আপনার সোজা সাপটা কথাগুলো ভালো লেগেছে। কিন্তু প্রথমে আপনার ঘাম দেখে তো ভাবলাম আপনিও হয়তো কোনো অঘটন ঘটিয়েছেন।”

লোকমান সাহেব কষ্ট করে একটু হেসে বললেন, “স্যার কি যে বলেন। এতো বড় কান্ড হয়ে গেছে আমি যে স্ট্রোক করিনি এটাই আল্লাহর হাজার দয়া।”

আজিজ সাহেব ওনার কাঁধে হাত রাখলেন। দুইবার চাপড় মেরে বললেন, “চিন্তা করবেন না। ঠিকানা যেহেতু পেয়ে গেছি এবার এর একটা রফাদফা করে ফেলব খুব তাড়াতাড়িই। আপনার ভয়ের কিছু নেই।”
লোকমান সাহেব কেবল লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন।

আজিজ সাহেব তার সহকর্মীদের হাতে ইশারা করলেন লাশ গাড়িতে তোলার জন্য। সিএনজির পিছন থেকে একটা বড় বস্তা এনে লাশটা উঠিয়ে সেটার উপরে রাখল ২ জন মিলে। তারপর আবারও একসাথে দু’জনে ধরে লাশটা টেনে হিঁচড়ে তুলতে লাগলেন সিএনজির পিছনে।

জমাট বেঁধে যাওয়া র*ক্তের এক ফোঁটাও বের হলো না বস্তার নিচে দিয়ে। বস্তায় উপরেই লেপ্টে গেল সেসব।

লাশ নিয়ে চলে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আইডি কার্ডে থাকা ঠিকানা অনুযায়ী মেয়ে ও ছেলে উভয়ের বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হলো খু*নের খবর।

নিজের একমাত্র বোনের খু*ন হয়েছে শুনে ভাইয়েরা চিৎকার জুড়ে দিল। মা গানের সুরে সুরে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তার বাবা তখনও শক্ত হয়ে বসে রইল কাঠের চেয়ারটাতে। ওনার চোখে কোনো পানি নেই, মুখে শব্দ নেই, চেহারায় নেই কোনো শোকাবহ বেদনাদায়ক ছাপ…..।

( চলবে…)