আড়ালে কে পর্ব-০৭

0
115

. #গল্প — #আড়ালে_কে – [ #পর্ব – ০৭ ]
#লেখক : #সালাহউদ্দিন_তারিক

ফোনে প্রেমিকের সাথে কথা বলছে সোহানা। এমন সময়ই বারান্দায় উঠে নাদিয়া। ভাবীর প্রতি আগে থেকেই তার সন্দেহের দৃষ্টি আছে, এজন্য ফোনে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনতেই পা টিপে টিপে ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায়। বেশিক্ষণ লাগে না মামলা বিষয়ক গোপন কথাটা শুনতে। রাগে তার মাথা গরম হয়ে যায়। এতো বড় সাহস কি করে হয় যে তার ভাইয়ের নামে মামলা করে! নাদিয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ভাবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সবগুলো কথা শোনার জন্য। সোহানা কল কাটতেই আবারও পা টিপে টিপে বারান্দা বারান্দা পেঁড়িয়ে সিঁড়িতে চলে যায় সে। জোরে জোরে শব্দ করে হাঁটে সিঁড়ির উপরে। ইচ্ছে করেই এমন করে যেন তার ভাবীর কান অবধি এই শব্দ যায়, আর সে বুঝে নাদিয়া এই মাত্রই আসতেছে।

বারান্দায় উঠে জুতা দু’টো পরিষ্কার করার ভঙ্গিতে একে অপরের সাথে বাড়ি দেয় যেন এই শব্দটাও তার ভাবীর কানে যায়। নাদিয়া এসে পরেছে বুঝতে পেরে মোবাইল ফোন রেখে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নেয় সোহানা। নাদিয়াকে সে জমের মতো ভয় পায়। তার কারণ একটাই, নাদিয়া হচ্ছে তার ভাইয়ের তথা নাজমুল সাহেবের কলিজার টুকরো থেকেও বেশি কিছু। নাজমুল সাহেবের জন্মের অনেক বছর পরে জন্ম হয় নাদিয়ার। ছোট থেকেই তাকে অনেক আদর করেন নাজমুল সাহেব। আর নাদিয়াও ভাইয়ের জন্য জান প্রাণ। তার এমন কোনো কথা নেই যা সে ভাইয়ের সাথে শেয়ার করে না। এজন্য নাদিয়ার থেকে পুরোপুরি লুকিয়ে কথা বলতে হয় সোহানাকে।

নাদিয়া নিজের রাগান্বিত চেহারাটা প্রকাশ করে না সোহানার সামনে। মনে মনে শুধু ভাবে, আরেকটু অপেক্ষা কর কালসা*প, ভাইয়া বাসায় এসে নিক। এতো ধুমধাম করে ৩ লাখ টাকা কাবিন দিয়ে তোকে বিয়ে করে আনছে। আর তুই আরেক পোলার লগে ফস্টি*নস্টি করে এখন ভাইয়ার নামে মামলা করিস। তোর তো দুই পা দু’দিকে টে*নে ছিঁ*ড়ে ফেলা উচিত।
এমন হাজারো কথা চিন্তা করতে করতেই হাত-মুখ ধুয়ে নেয় নাদিয়া। পরনের ইউনিফর্ম পাল্টে বাড়ির সাধারণ পোশাক পরে নেয়।

বিকালের সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। নাদিয়ার কিছুই ভালো লাগছে না। ভাইয়া কখন বাড়িতে আসবে, আর কখন সোহানাকে শাস্তি সেই অপেক্ষায় সময় গুনছে সে।
সন্ধ্যার পরেও পড়াতে মন বসে না তার, বারবার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরে। বিয়ের আগে তার মা’কে সে-ই সবার আগে বলছিল যে সোহানা কে তার পছন্দ হয়েছে। তার পছন্দের কারণেই সবাই এতো গুরুত্ব দিয়েছে তাকে। নাদিয়ার এখন নিজেকে দোষী মনে হতে থাকে। ভাবে তার জন্য ই তো ভাইয়ার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। রাগে তার মনে চায় যে সবকিছু ভেঙে ফেলতে চায়। মাথার যন্ত্রণায় পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। নিজের মা কে বলে রাখে তার ভাইয়া আসলেই যেন ডেকে দেওয়া হয় তাকে।

রাত ৯:৩০ এর দিকে ঘুৃম ভাঙে নাদিয়ার। চোখ খুলতেই দেখতে পায় নাজমুল সাহেব তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে উঠে বসে দ্রুত, ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, ‘তুমি কখন আসছ ভাইয়া?’

নাজমুল সাহেব তখনও ছোট বোনের মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো বলে, ‘তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ! বইখাতা কিভাবে ফেলে রাখছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আবার শুনলাম সন্ধ্যার সময়েই ঘুমিয়ে গেছিস আমি আসলে ডেকে দেওয়ার কথা বলে।”

নাদিয়া হাত মাথা থেকে ভাইয়ের হাতটা নিজের মুঠের মধ্যে নেয়। তারপর কাচুমাচু করে বলে, “স্যরি ভাইয়া তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।”

নাজমুল সাহেব অবাক হয়ে যায় নাদিয়ার কথা শুনে। আবারও প্রশ্ন করে, ‘কি হয়েছে তোর আমাকে বলতো?’

‘ ভাইয়া, কিভাবে কি বলব বুঝতে পারছি না। আব্বু আম্মু জানলে কি যে হবে আমি কল্পনা করতে পারছি না। তুমি জানো ঐ কালসা*প কি করেছে?’

‘ কালসা*প আবার কে! ‘

‘ যেই কালনা*গিনী কে আমি ভাবী হিসেবে পছন্দ করছিলাম। ঐ ডাই*নির কথা বলতেছি।’

‘ মানে! কি করছে তোর ভাবী?’

নাদিয়া একটু উঁকি দিয়ে দেখে নেয় আর কেউ তাদের ঘরের দরজার কাছে আছে কি-না। তারপর ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘তুমি অফিসে যাওয়ার পরে এই মেয়ে তোমার নামে মামলা করে আসছে থানায় গিয়ে।’

‘ মামলা! কিসের মামলা! ‘ চমকে উঠেন নাজমুল সাহেব।

‘ হুম মামলা, নারী নির্যাতনের মামলা করে আসছে।’

‘ কি বলিস এসব! তুই কোথায় শুনছিস। ‘

‘ নিজের কানে তাকে বলতে শুনছি তার কোন প্রেমিকের সাথে। ‘

‘ কখন শুনছিস? ‘

‘ স্কুল থেকে ঘরে ঢুকেই। আমি আসার শব্দ পায়নি, ভাবছিল আব্বু আম্মু তো ঘুমাচ্ছেই। মনের সুখে কথা বলতেছিল নিশ্চিন্তে, আমি চুপি চুপি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছি। কি মিষ্টি করে কথা বলতেছিল, আমার মন চাইছিল তখনই মাথাটা ফা*টিয়ে দেই ওই ডাই*নির।”

নাদিয়ার মুখে সব শুনে রাগে দাঁত কিরকির করতে থাকেন নাজমুল সাহেব। তবুও ছোট বোনের সামনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই কিছু চিন্তা করিস না লক্ষীটি। আর মন খারাপ করিস না, ওর একটা ব্যবস্থা করব আমি। ‘

নাদিয়ার মন শান্ত হতে চায় না। উল্টো ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে সে। সারাদিনের আটকে রাখা কষ্ট সব লোনা জল হয়ে নাজমুল সাহেবের টি-শার্টে মিশে যেতে থাকে। অঝোরে কাঁদতে থাকে নাদিয়া, আর নাক টেনে টেনে বলতে থাকে, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ভাইয়া।’

নাদিয়ার কান্না কখনোই সহ্য হয় না নাজমুল সাহেবের। পরম আদরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওনার নিজের চোখেও পানি চলে আসতে চায়। কোনো রকমে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে বোনের কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে আসেন সেখান থেকে। নিজের রুমে না ঢুকে সোজা ছাদে চলে যান তিনি। নিরবে কতক্ষণ কাঁদতে মনে চায় ওনার। কিন্তু এখন কেন জানি আর কান্না আসে না ওনার। কেবল রাগে শরীর জ্বলতে থাকে। মনে মনে স্বীদ্ধান্ত নেয়, ডাই*নি হ্যাঁ! আমার নামে মামলা করা হয়েছে! তোর যে কি দশা করব তুই নিজেও বুঝতে পারবি না।’
.

অনেকক্ষণ ছাঁদে থাকার পর নিচে আসেন নাজমুল সাহেব। সোহানা তখন টেবিলে খাবার সাজায়। সবাই খেতে বসে কিন্তু নাদিয়া আসে না। নাজমুল সাহেব নিজে উঠে গিয়ে ডেকে আনেন তাকে। নিজের পাশের চেয়ারে বসান খাওয়ার জন্য। অল্প কয়টা খেয়েই উঠে পরে নাদিয়া। এতে করে নাজমুল সাহেব বাঁকা চোখে তাকাতেই বলে, ‘পেট ভরে গেছে ভাইয়া, আর খাব না। ‘

আর কিছু বলেন না তিনি। ঘাড় নেড়ে বুঝান, ‘আচ্ছা যা তবে।’

খাওয়া শেষে সেখানে বসেই নাজমুল সাহেব জানান, ওনার অফিসে নতুন কাজের চাপ পড়েছে। তিনি এখন এতো দূর থেকে এসে গিয়ে অফিস করাটা কষ্ট হয়ে যাবে। বাড়তি আরো দু’ঘন্টা অফিস করতে হবে ওনাকে। এজন্য ঠিক করেছেন যে অফিসের কাছেই কোথাও একটা বাসা ঠিক করে চলে যাবেন।

ওনার বাবা-মা প্রথমে অনুমতি দিতে না চাইলেও পরে বাধ্য হোন অনুমতি দিতে। চিন্তা করেন দৈনিক ৪ ঘন্টা রোড জার্নি করা, আবার অফিসের এতো কাজের চাপ। ওনার আসলেই অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যান তারা। সোহানার এটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। সে অনেক ভয় পেয়ে যায় যে ওখানে একা বাসাতে ওর সাথে কি কি হতে পারে তা কেউ জানে না। কিন্তু যেখানে তার শশুর শাশুড়ী রাজী হয়ে গেছে সেখানে তার আর কিছুই করার নেই। সে যথেষ্ট বুঝানোর চেষ্টা করে যে, সে চলে গেলে ওনাদের দেখাশোনা কে করবে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয় না, ওনারা উল্টো বুঝান যে ওনাদের ছেলের কতটা কষ্ট হচ্ছে। সোহানা বাধ্য হয়ে হার মেনে নেয়। চুপচাপ উঠে ঘরে চলে যায়। নাজমুল সাহেব বাবা-মার সাথে কথা বলা শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখেন সোহানা বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পরেছে। গত রাতের ঘটনার পরে ভয়ে আজ আর বিছানার মাঝখানে বালিশ দেওয়ারও সাহস করেনি সে। নাজমুল সাহেব কতক্ষণ একটা উপন্যাসের বই পড়েন বিছানার এক কোণে বসে। টানা আধা ঘন্টা বই পড়া শেষে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় উঠেন। সাদা আলোর বাতিটা নিভিয়ে নীলচে আলোর ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দেন। নীলচে আলোতে সব কিছু কেমন যেন রোমান্টিক আর চোখ ধাধালো মনে হয়। সোহানার চেহারাটা নীল আলোতে অনেক লাবন্যময়ী লাগে ওনার কাছে। একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। কেমন যেন একটা অজানা মায়া অনুভব করেন তার প্রতি। নিজের মাথাটা অনেকটা ঝুকিয়ে আনেন সোহানার চেহারার কাছে।

তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রেমিকের মতো মায়াবী স্বরে বলেন, ” তোমাকে ভালোবাসি সোহানা। অনেক ভালোবাসি।’

সোহানা তখনও ঘুমায়নি। অপেক্ষা করছিল নাজমুল সাহেব আগে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য। কানের কাছ থেকে মায়াবী স্বরে ভালোবাসার কথাগুলো তার শরীরের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়। এক অজানা শিহরণ জাগে তার মধ্যে। তবুও একদম স্থির হয়ে শুয়ে থাকে সে। নাজমুল সাহেবকে বুঝতে দেয় যে, সে এখন ঘুমাচ্ছে।

নাজমুল সাহেব আরো কতক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থাকেন সোহানার দিকে। তারপর উল্টো দিকে ফিরে ঘুমিয়ে যান। সোহানা এজন্যই অপেক্ষা করছিল। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরে খুব আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যায় সে। মোবাইল আর ইয়ারফোনটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে পা বাড়ায় গোসলখানার দিকে।

গোসল খানায় মোবাইল নিয়ে ঢুকার পিছনে একটা উদ্দেশ্যই ছিল তার। সকালে প্রেমিককে কথা দিয়েছিল রাতে তার অনেক কাছে যাবে। সেই কাছে যাওয়া মানে যে গভীর রাতে গোসলখানায় গিয়ে ভিডিও কল দেওয়া সেটা খুব কম মানুষই বুঝতে পারবে। নাজমুল সাহেবের প্রতি ভয় থাকা স্বত্তেও প্রায় ২০ মিনিট গোসলখানায় থেকে ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ অবস্থা কাটায় সোহানা। তারপর খুব সাবধানতার সাথে ইয়ারফোনটা লুকিয়ে নেয় কাপড়ের ভিতরে। মোবাইল ফোনটাও একটা সুরক্ষিত জায়গায় লুুকায় নিজের শরীরেই। এরপর আস্তে করে গোসলখানার প্লাস্টিকের দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখে। দ্বিতীয় পা টা বাইরে রাখতেই সে দেখতে পায় নাজমুল সাহেব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে কটমট করে।

আত্মা শুকিয়ে যায় সোহানার। তার বুক ধুর ধুর করতে থাকে। বুুকের ভিতরে কেবল একটা কথাই বাজছে। ”কি হবে এবার!’

[ চলবে ইন শা আল্লাহ ]