আড়ালে কে পর্ব-০৮

0
120

#গল্প — #আড়ালে_কে [ #পর্ব – ০৮ ]
#লেখা – #সালাহউদ্দিন_তারিক

গোসলখানায় লুকিয়ে প্রেমিকের সাথে কথা বলেছে সোহনা। কথা শেষে মোবাইল ও ইয়ারফোন লুকিয়ে বাইরে আসতেই দেখে তার স্বামী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার হাটুু কাঁপতে শুরু করে। নাজমুল সাহেব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, একবারের জন্যও পলক ফেলতে চাইছেন না। সোহানা কি বলবে কিছু বুঝতে পারে না। মনে মনে ভয় পায় কোথাও উনি বুঝে যায়নি তো যে সে গোসলখানায় ফোন নিয়ে ঢুকেছে। কথা বলছে অন্য কোনো এক ছেলের সাথে! তার বুকের ভিতরে ধুকধুক করে, কিন্তু চেহারায় কিছুতেই তা প্রকাশ করতে চায় না সে। মাথাটা একটু নিচু করে নাজমুল সাহেবকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে চায়।

নাজমুল সাহেব পিছন থেকে তার হাত ধরে ফেলে। ভয়ে ভয়ে আস্তে করে হাত ছুটাবার চেষ্টা করে সোহানা। কিন্তু নাজমুল সাহেব আরো শক্ত করে ধরেন। আস্তে করে টেনে আনেন নিজের দিকে। সোহানা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু নাজমুল সাহেব কিছুতেই ছাড়েন না। সোহানাকে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বলেন, ‘ঘুমানোর সময় অনেক সুন্দর লাগে তোমাকে।’

সোহানা চমকে উঠে এমন কথায়। সে মোটেও এমন কিছু আশা করেনি। নাজমুল সাহেব আচরণ দিয়ে বারবার চমকে দিচ্ছেন সোহানাকে। সোহানা এতোক্ষণ যে ভয়ে ছিল তা এবার মূহুর্তেই কেটে যায়। নিজের কর্মে একটু ভিন্নতা আনে সে-ও। মাথাটা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে একটা মন ভোলানো হাসি দেয়। নাজমুল সাহেবের চোখ আঁটকে যায় সে হাসির দিকে, হাতের বাঁধন নরম হয়ে আসে সোহানার কাছে। সে সুযোগে এক টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানার কাছে চলে যায়। বিছানায় উঠে তাড়াতাড়ি নাজমুল সাহেবের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখা মোবাইল ও ইয়ারফোনটা বের করে নেয়। তারপর বালিশের নিচে এক পাশে দিয়ে অল্প করে ভিতরে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মনে মনে চিন্তা করে,’ বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি আজ।’

নাজমুল সাহেবও একটু পরেই বিছানায় উঠে। নিজের বালিশটা আরেকটু চাপিয়ে আনে সোহানার বালিশের দিকে। সোহানা রাগে ফুঁসতে থাকে ওনার এমন কাজে। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো কোনো সাহসই নেই তার মাঝে। উল্টো দিকে ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে সে। নাজমুল সাহেব তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, সোহানা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না এতে। নাজমুল সাহেব তার কানে কানে বলে, “এতো নড়াচড়া করছ কেন! চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।’

সোহানা কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু চিন্তা করতে থাকে হঠাৎ করেই ওনার কি হলো আবার, এতো ভদ্র হয়ে গেছেন। কি সুন্দর রোমান্টিক-রোমান্টিক কথা বলতেছেন। সোহানার মনে নতুন চিন্তার উদয় হয়, কিন্তু ভয় দূর হয়ে যায়। এভাবেই কখন ঘুমিয়ে যায় বুঝতেও পারে না সে।

সকালে ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে নাজমুল সাহেব এখনও তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঠিক রাতে যেভাবে ধরেছিল সেভাবেই আছেন তিনি। এক ইঞ্চিও যেন নড়চড় হয়নি ওনার অবস্থানের। স্বামীর হাতটা নিজের পেটের উপর থেকে সরিয়ে উঠার চেষ্টা করে সে। কিন্তু হাত দু’টো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। কানের কাছে কিছু শব্দ ভেসে আসে, ‘আর কতক্ষণ থাকো না এভাবে। ভালো লাগছে অনেক।’

সোহানার ভ্রু কুঁচকে যায়, এ কি শুনছে সে! কি হয়েছে নাজমুল সাহেবের। এতো রোমান্টিক হয়ে গেছে হঠাৎ। কিন্তু তার এতে দূর্বল হওয়া চলবে না এটা ভালো করেই জানে সে। জোর করেই হাত দু’টো ছাড়ানোর চেষ্টা করে যায় সে। হঠাৎই নাজমুল সাহেবের ঠোঁট দু’টো তার গাল ছুঁয়ে দেয়। আকষ্মিক চুমুতে আবারও চমকে যায় সোহানা। তার হাত দু’টো ও থেমে যায়, বন্ধ হয়ে যায় জোড়াজুড়ি। নাজমুল সাহেব এবার নিজে থেকেই ছেড়ে দেয় তাকে। বিছানা ছেড়ে উঠার আগে কেবল বলে দেন, ” কত তাড়াহুড়ো উঠার জন্য। যাও তবে এক কাপ চা করে দিও প্লিজ।’

সোহানা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওনার দিকে। কি বলবে কিছু মাথায় আসে না ওর, নাজমুল সাহেব ওকে প্লিজ বলতেছে। অবশেষে ঘাড় কাত করে মুচকি হেসে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। নাজমুল সাহেব আরো কতক্ষণ শুয়ে থাকেন উল্টো হয়ে কিছুক্ষন পরে শব্দ পান দরজা খোলার। মাথাটা তুলে একটু দেখেন কি হচ্ছে। সোহানার হাতে চা বানানোর ছোট পাতিলটা দেখে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলেন তিনি। মনে মনে খুশি হন। ভাবেন ‘যাক একটা কথা শুনছে আমার।’

কতক্ষণ পরে চা এনে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে রাখে সোহানা। নাজমুল সাহেব উঠে বসেন শব্দ পেতেই। সোহানাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি খাবে না?’

সে না সূচক মাথা নাড়ে। নাজমুল সাহেব নিজের ভ্রু কুঁচকায়। আবার পরক্ষনেই মুচকি হেসে বলেন, “অল্প নিও। আমার কাপ থেকেই না হয়।’

সোহানা চোখ বড়বড় করে তাকায় নাজমুল সাহেবের দিকে। নাজমুল সাহেব বাচ্চাদের মতো হেসে উঠে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে, ‘ চোখ ছোট করো ভয় পাবো আমি। পা*গলি আমি আমার খাওয়া কাপ থেকে খেতে বলিনি। বলেছি এখান থেকেই না হয় অল্প নাও। এতে চোখ বড় করার কি আছে।’

সোহানা নিজেও হেসে ফেলে নাজমুল সাহেবের কথায়। বুঝে পায় না কি হচ্ছে তার সাথে। নাজমুল সাহেব এভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল কেন কিছুই বুঝে আসছে না তার। সাত পাঁচ ভেবে অবশেষে অল্প একটু চা আলাদা একটা কাপে নিয়ে নেয় সে। যদিও তার চা পছন্দ না, তবুও একটু নিল নাজমুল সাহেবের এভাবে বলার কারনে। নাজমুল সাহেব ও ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্রাশ শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে আসলেন। সোহানা তখন চায়ের কাপে একের পর এক ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি কি ভেবে যেন সোহানার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ” তুমি কি ভেবেছ চায়ে কিছু মিশিয়েছ কি-না এটা পরীক্ষা করার জন্য তোমাকেও আমার কাপ থেকে একটু নিতে বলেছি!”

উষ্ণ বাতাস কানে লাগতেই সোহানার শরীরে যে শিহরণ জাগে তা কয়েক গুণ হয়ে যায় এই কথা শুনে। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়, “মোটেই না, এমনটা কেন ভাবতে যাব আমি।’

নাজমুল সাহেব আর কিছু বলেন না। শুধু মাথা নাড়াতে থাকেন রহস্যময় ভঙ্গিতে। সোহানা ওনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়। বুঝানোর চেষ্টা করে, ‘কি হচ্ছে এসব!’

নাজমুল সাহেব কিছু না বলে চায়ের কাপ হাতে নেন। একটা চুমুক দিয়ে তারপর বলেন, ‘চা অসাধারণ হয়েছে। এই না হলে আমার বউ!’

সোহানা একটু লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিচু করে নেয়। আর নাজমুল সাহেব শব্দ করে করে চুমুক দিতে থাকেন চায়ের কাপে। সোহানা তার কাপের অল্প চা টুকু ঠান্ডা শরবত বানিয়ে মুখে চালান করে। তারপর দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। তরকারি কাটে আর মনে মনে চিন্তা করে, ‘উনি কি হঠাৎ করে আমার প্রেমে পড়ে গেল না কি একদম…..।’

ছয়….

পুলিশ পোস্টমর্টেম শেষ করে সাইফার লা*শ হস্তান্তর করে তার পরিবারের কাছে। তাদের বাড়িতে শত শত মানুষের ভীর জমে কা*টা লা*শ দেখার জন্য। সাদা প্লাস্টিক ব্যাগে করে পরিবহন করা হয়েছে তার ডেট বডিটা। একদম স্বচ্ছ সাদা ব্যাগের ভেতরে থাকা র*ক্তাক্ত চেহারাটা সবারই নজরে আসে খুব সহজে। মসজিদ থেকে আনা স্টিলের খাটে রাখা হয় পলিথিন ব্যাগে প্যাকেট করা লা*শটি। পুরুষের সাথে সাথে কিছু নারীও ধাক্কাধাক্কি করে দেখার চেষ্টা করে কা*টা লা*শটি।

সাইফার বাবা একবার কেবল দেখে তার চেহারাটা। তারপর নির্বাক হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকে। ওনার চোখে এক ফোঁটা পানিও কেউ দেখতে পায় না। সাইফার মা একবারও সাহস করে না লা*শটা দেখার। বিলাপ করে কাঁদতে থাকে বারান্দার এক কোণে বসে। সাইফার দুই ভাই কেবল লা*শের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বোনের কা*টা চেহারার দিকে। কপালের উপরে বড়বড় সেলাই স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। চোখ দু’টো গর্তে ঢুকে আছে, মুখ শুঁকিয়ে আছে। বেশিক্ষণ লা*শের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না তারা। চোখ মুছে লেগে যেতে হয় কাজে। গোসল করানোর জন্য জায়গা ঠিক করতে হয়। বাড়ির উঠোনের এক পাশে একটা পুরাতন খাট বসিয়ে সেটার চারপাশে পর্দা টানিয়ে দেওয়া হয়। এলাকার ৩ জন সাহসী মহিলাকে গোসল করানোর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়।

লা*শের গোসল শেষে জানাজার নামাজ পড়া হয় মাগরিবের নামাজের পরপর। অন্ধকার হওয়া স্বত্বেও কবরে মাটি দেওয়ার জন্য যায় প্রায় শ’খানেক মানুষ। সাইফার বড় ভাই কবরে মাটি দেয় আর ভাবে, “তোকে হলুদ তো দিতে পারিনি বোন। কিন্তু মাটি ঠিকই দিতে পারছি। বিয়েতে যে মানুষ খাওয়ার জন্য আসত তারাও আজকে মাটি দিতে এসেছে।”

সব কাজ শেষ করে সবাই আস্তে আস্তে কবরস্থান থেকে চলে আসতে শুরু করে। সাইফার বড় ভাইয়ের বুক ফেটে যেতে চায়। হৃদপিণ্ড কেঁপে কেঁপে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। দীর্ঘশ্বাসের সাথে কিছু হতাশার বাক্য বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, “আহ্ আমার কলিজার টুকরা সাইফা। তোর সাথে এতোকিছু হয়ে গেল অথচ আমাকে বললি না। একটা ছোট্ট ক্লিপ কিনতে হলেই যে আমাকে বলত, সে এ-তো কিছু হওয়ার পরও আমাকে বলল না।’

বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কবরস্থানে তো আর থেকে যাওয়া যায় না। তাই ফিরে আসতে হয় তাকেও। রাতে সবার পেটে খাবার ঢুকলেও তার পেটে এক টুকরা রুটিও ঢুকে না। বসে বসে চিন্তা করতে থাকে, ” যেভাবেই হোক সিয়ামকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েই ছাড়বে সে। সকাল হলে সবার আগেই থানায় যাবে, যত টাকাই খরচ হোক নিজের সামর্থ অনুযায়ী খরচ করবে। এই মামলা তাকে চালিয়ে নিতেই হবে…..।

( চলবে ইন শা আল্লাহ…)