আড়ালে কে পর্ব-০৯

0
126

. #গল্প – #আড়ালে_কে . [ #পর্ব – ০৯ ]
#লেখক — #সালাহউদ্দিন_তারিক

সাইফার পোস্ট*মর্টেম রিপোর্টে জঘন্য সব তথ্য উঠে এসেছে। ওর শরীরের প্রতিটি জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সুরতহালের সময় যখনই তার কাপড় কেটে পুরো বডিটা ন*গ্ন করা হয় তখনই দেখা যায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলচে / কালো দাগ হয়ে আছে। লম্বা সময় ধরে হওয়া অত্যাচারের সব আলামত পাওয়া যায় শরীরের বাইরেই। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব জায়গায় আঘাত করা হয়েছে, এমন কি স্ত’ন ও লজ্জাস্থান ও বাদ যায়নি। সুরতহাল বর্ণনা করা মহিলা দু’জন কি করবে বুঝতেই পারছিল না। কিভাবে এসব মুখে বলবে তারা! জীবনে কত বডির কথা বর্ণনা করেছে। কিন্তু একসাথে এতো স্পর্শকাতর কথা কোনো ক্ষেত্রেই বলতে হয়নি।

যারা সুরতহাল সম্পর্কে জানেন না তাদের বলি। সুরতহাল একটা আরবি শব্দ। সুরত মানে অবস্থা এবং হাল শব্দের অর্থ বর্তমান।

তথা একসাথে এর অর্থ হচ্ছে বর্তমান অবস্থা। যখন কারো মৃত্যু অস্বাভাবিক ভাবে হয়েছে বলে ধারণা করা হয় তখন ডে*ট বডির সকল জামা কাপড় খোলা হয়। অথবা যদি নির্দিষ্ট স্থানে আঘাত হয়েছে বলে জানা যায় তবে শুধু সেই স্থানের কাপড় খোলা হয়। তারপর চামড়ার উপরে যেসব অস্বাভাবিক অবস্থা লক্ষ্য করা যায় সেসব লিপিবদ্ধ করেন দ্বায়িত্বরত পুলিশ নিজে। তবে লা*শ মহিলা হলে মহিলা পুলিশ সব কিছু দেখেন আর সেসব বলেন অফিসারের কাছে।

কখনো কখনো লা*শ যদি মহিলা হয় এবং হাসপাতালে অবস্থান করে। তবে একজন কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসক ও একজন মহিলা পুলিশ লা*শের বডি খুঁটিয়ে দেখে। আর সেসব বলেন পুলিশ অফিসারের কাছে। তিনি সেসব লিখে নেন পর্দা/দেয়ালের আড়ালে থেকে। লা*শের এই যে বর্তমান বাহ্যিক অবস্থা, একেই বলে সুরতহাল।

সুরতহাল লেখা শেষে সাইফার লা*শ মর্গে পাঠানো হয়েছিল ময়না*তদন্তের জন্য। সেখান থেকে মৃত্যুুর কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়। শরীরে অনেক আ*ঘাত থাকলেও সেসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। বরং মাথার পিছনের আকস্মিক আ*ঘাতেই মৃত্যু হয়েছে সাইফার।

সাইফার ভাই বাদী হয়ে মামলা করেন সিয়ামের বিরুদ্ধে। পুলিশ প্রথম দিনেই কাজে লেগে পড়ে। সিয়ামের বাড়িতে যাওয়া হয় শুরুতেই। কিন্তু কোনো কাজ হয় না এতে। সিয়ামের বাবা জোর গলায় বলে দেন, “এই জানো*য়ারকে কবেই আমি আমার ছেলের খাতা থেকে বাদ দিয়েছি। এই বাড়ির কারো সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আপনাদের যদি তার সাথে কোনো সমস্যা হয় সেটা আপনারা তার সাথেই মিটিয়ে নিন। প্রয়োজনে ক্রস*ফা*য়ারে মে*রে ফেলুন। তার জন্য আমার কোনো আফসোস হবে না, শুধু দয়া করে আমাদের এসবের মাঝে টানবেন না।”

এতো জোর গলার কথার সামনে পুলিশ অসহায়। সিয়ামের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই এটাই বিশ্বাস করে সামনে এগুতে হবে তাদের। আশে পাশের কিছু থানাতে সিয়ামের ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীকে নৃ*শংস ভাবে খু*নের দ্বায়ে পুলিশ তাকে প্রতিটি জায়গায় খুঁজে চলেছে। দিনের পর দিন চলে যায় কিন্তু হদিস মিলে না সিয়ামের।

২ দিন কেটে যায়, এরমধ্যে পুলিশ সিয়ামের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না। সিয়াম ও সাইফা দু’জনের মোবাইল ট্রেকিং করা হয়। আলাদা আলাদা স্থানে খুঁজে পাওয়া যায় সে দু’টো। ঘটনাস্থলে পৌঁছে জানতে পারেন উভয় ক্রেতাই আলাদা আলাদা বিক্রেতার কাছ থেকে কিনেছে মোবাইল দু’টো। পুলিশ চাইলেই ঐ মোবাইল ব্যবহারকারীদের বিশেষ নজরদারিতে নিতে পারত। পুলিশের এমন হয়*রানির নজির অনেক রয়েছে। চুরি যাওয়া সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন অথবা পলাতক কারো সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনে অনেক ব্যবহারকারীই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে ইতিপূর্বে। কেউ কেউ তো কেবলই তাদের টাকা গুলো হারিয়েছে মানে মোবাইলটা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেছে। আর কেউ কেউ আরো অনেক দূর্ভোগে পতিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে উভয় ক্রেতাই যেহেতু মোবাইলের সাথে সেগুলোর কাগজ দেখিয়েছে সেজন্য পুলিশ কিছুই করতে পারে না তাদের। শুধু মাত্র সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল কেনার দ্বায়ে তো আর কাউকে জেলে নেওয়া যায় না ।

পুলিশ বুঝতে পারে সিয়াম অনেক ধুরন্ধর। যখন তার ঘরে এক পোয়া চাউল এবং কোনো তরকারি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তখনই তাদের বুঝে আসে যে অত্যন্ত অভাবে দিন কাটছিল তাদের। আর সে অভাব থেকেই হয়তো ঝগড়া ও মারামারির শুরু। সেখান থেকে সাইফাকে চাপ প্রয়োগ করা হয় বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য। কিন্তু ইতিপূর্বেই যেহেতু সাইফার সাথে তার পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেহেতু সিয়ামের সামনে খু*ন করা ব্যতীত আর কিছুই করার ছিল না বলে ধারণা পুলিশের। অভাব তার মস্তিষ্ক বিকৃত করেছে, অস্থির করে তুলেছে তার র*ক্তকে। আর সে অস্থিরতা জন্ম দিয়েছে এই ভয়াবহ খুু*নের।

সিয়ামের পকেটে টাকা না থাকার কারণেই পালিয়ে সবার আগে নিজেদের মোবাইল সাথে নেয়। তারপর সুযোগ খুঁজে বিক্রি করার। তারপর যেই লোকের কাছে বিক্রি করে, সে লোক আবার অন্য কারো কাছে বিক্রি করে সেগুলো। এই মোবাইল দু’টো বিক্রির টাকা দিয়েই হয়তো যেকোনো ভাবে চলছে সে।

পুলিশ ৩ দিন তাদের কাজে তৎপর থাকে। তারপর পুরোদমে ঝিমিয়ে পড়ে। খোজাখুজি বাদ দিয়ে কেবল অপেক্ষায় থাকে কোনো একটা সংবাদের। যার ভিত্তিতে সিয়ামকে ধরতে সক্ষম হবে তারা….।

সাত….

সোহানা বেশ কয়েকদিন ধরেই অস্বাভাবিক ভাবে নাজমুল সাহেবের কেয়ার লক্ষ্য করছে। অফিস থেকে ফেরার সময়ে একটা চকলেট নিয়ে আসছে। কখনোবা আইসক্রিম নিয়ে আসছে। তার পছন্দের নানান জিনিস কিনে আনছে তার অজান্তেই। মাঝরাতে হুট করেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি কথাটা বলে। সকাল বেলাতে ঘুম থেকে উঠার আগে জড়িয়ে ধরে রাখে। সহজে উঠতে দেয় না তাকে। বেশি জোড়াজুড়ি করলে পরে কপালে বা গালে একটা চুমু দিয়ে তারপর উঠার সুযোগ দেয়।

সোহানা একবারের জন্যও চায় না নাজমুল সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরুক। বারবার বাঁধা দেয় সে। কিন্তু একেবারে ওনার বুক ছেড়ে সরে যাওয়ার মতো ক্ষমতা হয় না তার। আজ সোহানার জন্মদিন, এদিনে ছোট বেলা থেকে নিয়ম করে কিছুই করে আসেনি সে। কিন্তু মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে অথবা ঘরেই ছোট পিচ্চিদের সাথে অল্প পরিসরে আনন্দ অনুষ্ঠান করছে। আজ সন্ধ্যা থেকেই জন্মদিন ঘিরে যত স্মৃতি ছিল, সব কিছু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছে সে। নাদিয়া ঘরেই আছে, এজন্য প্রেমিককে কল দিয়ে কথা বলারও সুযোগ নেই তার। কযেকবার মেসেজে কথা বলেছিল অবশ্য। কিন্তু চ্যাটিং করে কোনো ভাবেই মন ভরছিল না তার।

কি করা যায় আজকে! এই নিয়ে অনেক চিন্তা করেছে সে। কিন্তু কোনো কিছুই করার কথা নিশ্চিত কর বলতে পারছে না। নাজমুল সাহেবের সাথে যদি ভালো সম্পর্ক থাকতো তবে অবশ্য ঘুরতে যেতে পারত। কিন্তু এখন তো তার নাজমুল সাহেবের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা অবদি নেই। দিনেও বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আজকে। নাদিয়া ইদানীং কেমন যেন একটু চোখে চোখে রাখে তাকে। তাই কোনো রিস্ক নিতে চায়নি সে।

রাত ৯টার দিকেই বাড়ি ফিরে আসেন নাজমুল সাহেব। এক আকাশ বিরক্ত নিয়ে দরজা খুলে দেয় সোহানা। ওনার মুখের দিকে তাকানোরও যেন ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু যখনই বড়সড় একটা গিফট বক্স ওর চোখের সামনে ধরা হয় তখন আর না তাকিয়ে পারে না সে। একবার গিফট বক্সের দিকে তাকায় আবার নাজমুল সাহেবের মুখের দিকে তাকায়। ওনার মুখে কি এক অনন্য হাসি লেগে আছে। সোহানা অনিচ্ছা স্বত্বেও যেন তাকিয়ে থাকে সেই হাসির দিকে। ঠোঁট চেপে কি সুন্দর হাসছে টিনএজার ছেলের মতো।

সোহানা একদম চুপ করে আছে দেখে নাজমুল সাহেবই প্রথম মুখ খুলেন, “শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা আমার।”

কথাটা সোহানার বুকের ভিতরে হ্যামারের মতো আঘাত করে। গলা শুঁকিয়ে আসে একদম। এই প্রথম ওনার মুখে প্রিয়গমা শব্দটা শুনেছে সে। কিছু না বলে শুধু ওনার হাত থেকে গিফট বক্সটা নেয় সোহানা। নাজমুল সাহেব তাগাদা দেয়, “খুলে দেখো না কি আছে। ”

সোহানার ইচ্ছে ছিল না এখন এটা খোলার। কেমন যেন লাগছে তার বুকে। কিন্তু নাজমুল সাহেব যেহেতু বলেছেন, সেহেতু খুলতেই হবে। নীল রঙের গিফট পেপারটা আস্তে আস্তে টেনে ছিঁড়ে খুলে সে। ভিতরে দুইটা শক্ত চ্যাপটা বক্স। উপরের ছোট বক্সটার ভিতরে অনেক সুন্দর কারুকাজ করা একটা কেক। সোহানার প্রিয় চকলেট কেক। নিজের অজান্তেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে সোহানা। বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে ধন্যবাদ জানায় নাজমুল সাহেবকে।

বক্সটা আবার আগের মতো লাগিয়ে রেখে টেবিলের এক পাশে রেখে দেয় সোহানা। তারপর অপর বাক্সটা হাতে তুলে নেয়। তুলনামূলক পাতলা কিন্তু বড় চ্যাপটা একটা বক্স। উপরের ঢাকনাটা একদম পাতলা। সেটা খুলতেই একটা নীল শাড়ি চকচক করে উঠে। শাড়ির কাপড়ের উপরে ছোট ছোট কি যেন লাগানো আছে সেলাই করে। সেগুলো থেকেই আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে, চিকচিক করছে রূপার পাতের মতো।

সোহানা মাত্রাতিরিক্ত খুশি হয়েছে। নাজমুল সাহেবকে যদিও পছন্দ হয় না তার। কিন্তু এই উপহার তাকে অনন্য খুশি এনে দিয়েছে। এতো খুশিতে উচ্ছাস করতে পারে না আর। কেমন স্তব্ধ হয়ে যায় সে। নাজমুল সাহেব তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে আস্তে আস্তে ঘুরে ওনার দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে জ্বলজ্বল চোখে। চোখের পাতাটা একবার ফেললেই হয়তো টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করবে। নাজমুল সাহেব একবার ঘরের দরজাটা দেখে নেন। ভিতর থেকে লাগানো আছে নিশ্চিত হয়ে, নিজের দুই হাতে সোহানার মুখটা দুইপাশ থেকে চেপে ধরে আলতো করে উপরের দিকে তোলে। অতঃপর সোহানার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কতোক্ষণ। সোহানা জোর করে নিজের মাথাটা নিচু করে নিতে চায়। কিন্তু সে সুযোগ দেয় না নাজমুল সাহেব। আরেকটু শক্ত করে ধরে তার মুখটা। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা গাঢ় চুমু খায় সোহানার কপালে।

সোহানা নিজের দাঁতে দাঁত চেপে ধরে শক্ত করে। সাথে চোখ দু’টোও বন্ধ করে নেয়। টপটপ করে তার চোখের পানি গুলো গাল বেয়ে পড়তে শুরু করে। নাজমুল সাহেব কতক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে সোহানার কান্না দেখেন। তারপর চোখের পানি মুছে দিয়ে কানে কানে বলে, ‘আজকের রাতটার জন্য অন্তত শাড়ি পরে সাজবে আমার জন্য?’

সোহানা স্তব্ধ হয়ে যায়, বারবার ঢোকর গিলতে থাকে। কি উত্তর দিবে তার স্বামীকে! কিছুই মাথায় আসে না তার…..।

( চলবে ইন শা আল্লাহ )