আমার আসক্তি যে তুমি Part-49

0
3348

#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_49
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
‘৫০৫’ নাম্বার ফ্ল্যাটের সামনে দাড়িয়ে আছি। মনের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে। বুকের বা পাশটাও বার বার ধুকধুক করে উঠছে। হুট করেই এমন কেন হচ্ছে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি এইসব উপেক্ষা করে উৎসুক চোখে দরজার লকের মধ্যে চাবিটা ঘুরাই সাথে সাথে ঘ্যাঁচ করে দরজাটা খুলে যায়। আমি এইবার ভিতরের দিকে অগ্রসর হই।
ভিতরটা বেশ অন্ধকার। সকল জানালায় কালো পর্দা জরানো এমনকি বারান্দার দরজায়ও। যার ফলস্বরূপ বাইরের তীক্ষ্ণ রশ্মি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারছে না। নাকে কেমন এক আবছা গন্ধ আসছে। আমি এইবার জানালার কাছে গিয়ে পর্দাগুলো মেলে দেই। সাথে সাথে পুরো ঘরের কোনে কোনে তীক্ষ্ণ রশ্মিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আমি এইবার চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকি৷ আর যা দেখি তাতে আমি অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাই।
ডাইনিং এর পুরো কালো দেয়াল জুড়ে শুধু আমারই ছবি। এমন কোন ফাঁকা জায়গা নেই যেখানে আমার ছবিটি ঘাপটি মেরে বসে নেই।ডাইনিং এ কোন আসবাবপত্র না থাকায় ছবিগুলো খুব সহজেই আমার চোখের সামনে ভাসছে। এইখানে সবচেয়ে বেশি অবাক করার বিষয়টি হচ্ছে যে এইখানে থাকা সকল ছবি এই আমার অজানতে তুলা হয়ে।
আমি এইবার ছবিগুলো কাছে গিয়ে ছবিগুলো ছুঁয়ে দেই। ছবিগুলো যে বেশ যত্ন করে লাগানো হয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। ছবিগুলোর দিকে চোখ বুলাছি ঠিক তখনই ছবির এক কিনারে থাকা কালো কালি দিয়ে লিখা তারিখটির উপর আমার নজর পড়ে। আমি তারিখটা দেখতেই শিউরে উঠি। তারিখটা হচ্ছে “২০.০২.২০১৬”। আমি এইবার ভ্রু দুটো কুচকিয়ে সকল ছবিগুলোতে চোখ বুলাতে থাকি। সকল ছবির নিচে ডান দিকে তারিখ লিখা আছে। আমি এইবার উপর থেকে তারিখ গুলো দেখতে থাকি। “১২.০৮.২০১৫” থেকে ছবির তারিখ গুলো শুরু হয়েছে। এই দিন থেকে শুরু করে প্রত্যেকদিনেরই ছবি আছে আমার।আমি এইবার আস্তে আস্তে সামনে যেতে থাকি। তিনটি দেয়ালে পড়ে ছবির ধারা শেষ হয় এবং শেষ তারিখটি হচ্ছে “৯.০৫.২০১৭”।
আমি এইবার বিরবির করে বলি,
.
— এইটা কিভাবে সম্ভব! রিয়ান আর আমার পরিচয়ই হয়েছে ৪-৫ মাস আগে। আর এইখানে আমার ছবি লাগানো আরিও ৩-৪ বছর আগের। ছবিগুলো যে মিথ্যা তাও না। এইগুলা বেশ পুরানো ছবি এই।
তার মানে কি রিয়ান আমাকে আরও ৩-৪ বছর আগে থেকেই চিনে। উফফ কিছু বুঝতে পারছি না।
.
আমি এইবার কৌতূহল বসতো অন্যসব রুম দেখতে যাই। রুমের সামনে যেতেই অবাক হয়ে যাই, একেকটা রুমে ১,২,৩ নাম্বার দেওয়া। আমি এইবার নাম্বার অনুযায়ী সব রুম দেখতে থাকি।সকল রুমেই আমার ছবি লাগানো। শেষের একটি ছবিতে “২৪.০২.২০২০” লিখা। এইটি সেইদিন যেইদিন রিয়ানের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। এর পরে আর ছবি নেই।
আমি এইবার এর পরের রুমটিতে যাই। রুমের গায়ে ৪ নাম্বার লিখা। আমি এইবার আস্তে দরজাটা খুলি।
দরজা খুলতেই আবছা শুকনো ফুলের ঘ্রাণ নাকে আসে। আমি এইবার রুমের মধ্যে প্রবেশ করি। রুমটির দেয়ালের মধ্যে কস্টিপ দিয়ে অজস্র শুকনো ফুলের লাগানো। আর তার নিচেই একটা ছোট কাগজ লাগানো আর তাতে কিছু একটা লিখা। আমি এইবার কাছে গিয়ে সেটি পড়তে শুরু করি। আর পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। এইগুলো সেই ছন্দগুলো যেগুলো আমাকে সেই অচেনা ফুল পেরকটি পাঠাতো। আমি এইবার একে একে সকল ছন্দগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। সকল ছন্দ একই। আমাকে যে ফুলের সাথে যে ছন্দটি দেওয়া হয়েছিল ঠিক সেই ফুলের একটু টুকরো দেয়ালের সাথে লাগানো আর তার উপরে সেই ছন্দটি লাগানো। এইসব দেখে এইবার আমার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। রিয়ানই যে সেই ফুল পেরক ছিল তা বুঝতে আমার আর বেশি বেগ পেতে হয় নি।
কিন্তু তাও আমার মনের মধ্যে চলছিল হাজারো প্রশ্ন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন এখন বার বার উঁকি দিচ্ছে আর তা হলো,
” রিয়ানই যদি সেই ফুল পেরক হয় তাহলে কেন আমাকে এই ব্যাপারে জানালো না? কেন আমাকে ভালবাসার পরও ভালবাসার দাবী নিয়ে সামনে আসে নি? কেন সে আমার হতে আড়াল ছিল। ”
কিন্তু উত্তরে আমি কিছুই পাই না। তখনই আমার নজর যায় পাশে থাকা টেবিলের দিকে। সেখানে মোটা একটা ডাইরি রাখা সাথে আরও কিছু ফাইলের মত কাগজ। আমি সেইগুলা হাতে নিয়ে নেরে চেড়ে দেখতে থাকি। তখনই আরও একটি চিকন ডাইরি চোখে পড়ে। এতকিছু একসাথে এখন দেখা সম্ভব নয় বলে আমি দুইটো ডাইরি এই আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে নেই। পরবর্তী সময়ে যাতে ধীরে সুস্থে পড়তে পারি তার জন্য।

এইবার আমি একদম কিনারের রুমটিতে যাই। রুমটিতে ৫ নাম্বার লিখা।
আমি এইবার সেই রুমে প্রবেশ করি। সেই রুমটি ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না তাই আমি হাতরে হাতরে লাইট সুইচটি খুঁজে বের করি। সুইচটি অন করতেই সামনের দেওয়ালে আমার অনেক বড় একটি হাসউজ্জ্বল ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমি খিলখিলিয়ে হাসছি আর বাতাসে আমার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছুটে চলেছে। ছবিটি আরও ৩ বছর আগের। সেইদিন আমার জন্মদিন ছিল। সেইদিন আরিশা আর রিংকি মিলে আমায় ওদের বাসার ছাদে সাপ্রাইস দিয়েছিল। সেখানেই ওদের সাথে খুনসুটি করার সময় আমি এইভাবে খিলখিল করে হাসছিল। ঠিক তখনই এই ছবিটি তুলা হয়েছে। বেশ শভ্রময়ই লাগছে এই ছবিটিতে। আমি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
আমি এইবার সেখান থেকে চোখ সরিয়ে চারদিকে চোখ বুলাতে থাকি। রুমের এক পাশে একটা টেবিল রাখা। তার উপরে একটি বোর্ড আর তার মধ্যে কতকিছু পয়েন্ট করে রাখা। তারই অন্য পাশে একটি টিভি। আমি এইবার ধীর পায়ে আমার ছবিটির দিকে তাকিয়ে রুমে প্রবেশ করি। হাটতে গিয়ে পায়ের মধ্যে কিছু বাজে। নিজে তাকাতেই দেখি রক্ত মাখা এক ছুড়ি।
সাথে সাথে আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠি। একটুপর কিছুটা শান্ত হয়ে চোখ খুলি আর নিচে তাকাই। তাকাতেই আমি শিউরে উঠি। ছোপা ছোপা রক্তের ছাপ। তা দেখে আমি কয়েক কদম পিছে চলে যাই। পিছে যেতেই আমি পাশে রাখা টেবিলের সাথে বারি খাই। তাল সামলানোর জন্য আমি টেবিলে হাত রেখে ভর দেই। তখনই হাতের নিচে একটি রিমোট এসে পড়ে। আমি এইবার পাশে তাকিয়ে রিমোটটা হাতে নেই। হাতে নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে থাকি। হঠাৎ অন করা বাটনে আমি চাপ দিয়ে বসি। আর সাথে সাথে টিভি অন হয়ে যায়। আর টিভিতে ভেসে উঠে আমার বাসার কোনার কোনার চিত্র। আমি সেই দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না যে আমার বাসায় সিসিসিটিভি লাগানো। আমার ডাইনিং থেকে শুরু করে সকল জায়গায় সিসিটিভি লাগানো। ওয়াশরুম বাদে।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনের মধ্যে ক্ষপ সৃষ্টি হতে থাকে। বার বার মাথায় শুধু এই প্রশ্নটা ঘুরঘুর করতে থাকে যে,
“রিয়ান এইটা কিভাবে পারলো? কিভাবে?”
.
আমি এইবার রাগে ক্ষোপে পিছে ঘুরে দাড়াতেই চমকে উঠি। একটা বোর্ডে রকি, আবির, আরিয়ানের ছবি লাগানো। তার সাথেই আছে আরও অসংখ্য জনের ছবি। যাদের মুখ মন্ডল কিছুটা হলেও আমার চিনা। এরা এক সময় আমাকে ডিস্টার্ব করেছিল এবং আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
সকলের ছবিতেই লাল কালি দিয়ে আড়া-আড়িভাবে দাগ কেটে রাখা হয়েছে। এই ছবিগুলোর পাশেই তাদের লাশের ছবি দেওয়া। আর তাতে সেই একই লাল কালি দিয়ে টিক চিহ্ন দেওয়া।
এইসব এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। এইসবের মানে কি তা যে আমার অজানা। আর এই অজানাকে জানার আগ্রহ আমার বেরেই চলেছে। তাই আমি একটু খুঁজাখুঁজি শুরু করি। তখন হাতের ধাক্কার ফলে রিমোটটা পড়ে যায়। আর সাথে সাথে টিভিতে একটা ভিডিও শুরু হয়ে যায়। ভিডিওতে কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই চলে। আমি এইবার পিছে তাকিয়ে চমকে যাই। কেন না টিভির স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে রকির চেহেরাটি। আর তার সামনেই আছে রিয়ান। রিয়ান চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে,
.
— হাও ডেয়ার ইউ! আমার জান আমার রিয়ুপাখি র দিকে নজর দেওয়ার সাহস পায় কিভাবে হয় তোর? বড্ড ভুল করেছিস আমার জানের দিকে কুনজর দিয়ে। তার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কিভাবে হয় তোর? তাকে কাঁদিয়ে ঠিক করিস নি তুই! এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। তাও খুব ভয়ংকর শাস্তি।
.
এই বলে রিয়ান রকির এক হাত কেটে দেয়। আর রকি চিল্লিয়ে উঠে। রিয়ান এইবার ওর জিহ্বা কেটে দেয়।
এইসব দেখে আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে চেঁচাতে থাকি। এইসব যে আমার সহ্য হচ্ছে না। ভয় যেন এইবার আমায় ঘিরে ধরে ফেলে। মাথা একদম ফাঁকা হতে শুরু করে। বার বার চোখের সামনেই সেই ভয়াবহ দৃশ্য ভেসে আসতে থাকে। আমি এইবার ভয়ে কাঁপতে থাকি। সেখানে দাড়িয়ে থাকাটাও আমার জন্য দায়ভার হয়ে উঠছিল।এরই মধ্যে মস্তিষ্ক বার বার একটা সতর্কবার্তা দিতে শুরু করে দেয় যে,
” রিয়ান খুনি! সে একজন খুনি। সে সবাইকে খুন করেছে। সে একজন নরপশু।”
.
আমি এইবার ফ্লোরে বসে পড়ি। ভয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকি। রিয়ানের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে খুব। কানে এখনো ভিডিওতে চলা রকির আর্তনাদের ধ্বনিগুলো এসে বারি খাচ্ছে। সহ্য হচ্ছে না আমার এইসব কিছু। আমি এইবার সহ্য করতে না পেরে রিমোটটা টিভি মধ্যে ছুড়ে মারি। টিভিতে আঘাত লাগতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাও বার বার সেই আর্তনাদটি আমার কানে ভাসছে এবং সেই দৃশ্যটি চোখে। আমি কোন কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারছি না। আমি আমার কান দুটো চেপে ধরে কান্না করতে থাকি। তখনই কেউ আতঙ্ক মাখা কণ্ঠে আমার নাম ধরে ডেকে উঠে,
.
— রিয়ুপাখি!!
.
.
.
#চলবে