আমার আসক্তি যে তুমি Part-52

0
3960

#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_52
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
আমি দরজার কাছে এসে দরজার লক খুলতেই যাব তখনই কেউ এসে আমার হাত খপ করে ধরে ফেলে। আমি এইবার ভয়ে একদম জমে যাই। তাও কিছুটা সাহস জুগিয়ে আস্তে আস্তে পাশে তাকাই। আমি পাশে তাকাতেই কেউ স্বজোরে আমার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আমি এইবার হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকি। চোখের কোনে পানি জমা হয়ে যায়।
আমি কোনমতে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি রিয়ান অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ভীষণ লাল। কপালের রগ ফুলে গিয়েছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে হিংস্রতার ছাপ। আমি রিয়ানকে এমন রুপে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। মনের মধ্যে কু ডাকতে শুরু করে। রিয়ান এইবার টান দিয়ে আমাকে তার সামনে নিয়ে যায়। তারপর আমার হাত শক্ত করে ছেপে ধরে টানতে টানতে রুমের মধ্যে নিয়ে যায় আর বিছানায় আমায় ছুঁড়ে ফেলে। হুট করে হুংকার দিয়ে উঠে,
.
— আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাবলিও কি করে তুই? এত সাহস হয় কিভাবে পাস তুই? স্পিক আপ ডেমিট!
তোকে একশ বার বলেছি আমার থেকে দূরের যাওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে দে। কিন্তু কি করলি তুই। আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যেতে নিলি। আমি যদি সঠিক সময়ে না পৌঁছাতাম তুই তো আমায় ছেঁড়ে চলেও যেতি। হ্যাহ!
.
রাগে রিয়ান হাতের পাশে থাকা সপিজটি ছুঁড়ে মারে। তারপর ফুসতে ফুসতে বলে,

— ওই তোর কি আমার ভালবাসা চোখে পড়ে না? তোকে যে পাগলের মত ভালবাসি আমি। না তা চোখে কেন পড়বে! শুধু আমার করা খুন গুলোই চোখের পড়ে তোর। কালকে থেকে একটা কথার সুর ধরে বসে আছিস যে আমি খুনি! আরেহ খুনও তো করেছি তোর জন্য। যাদের খুন করেছি ওদের প্রাপ্য ছিল মৃত্যু। কেন না ওরা তোর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তোকে অপবিত্র করার চেষ্টা করেছিল। তাই ওদের মত নরপশুদের মৃত্যু দিয়েছি। তো কি খারাপ করেছি শুনি আমি?
কখনো বুঝেছিস যে নিজের ভালবাসার প্রতি যখন কেউ বাজে নজর দেয়, তাকে অপবিত্র করার চেষ্টা করে তখন কেমন লাগে? আরে তুই কিভাবে বুঝবি! তুই তো আর ছেলে না। ছেলে হলে বুঝতি, একটা ছেলের মনে তার ভালবাসার মানুষটিকে নিয়ে কত শত চিন্তা। তাকে নিরাপদ রাখার কত পরিকল্পনা। তাকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য কত কারসাজি।
তোকে সকলের কুনজর থেকে বাজাতে তোর অগচোরে কি কি করেছি আমি তুই জানিস? না! তুই কিছুই জানিস না। একা একটা মেয়ে হয়ে এতদিন সকল নরপশুদের হাত থেকে কিভাবে বেঁচে ছিলি একবার ভেবেছিস?
এখন তো একটা ছোট বাচ্চা মেয়েও জানে যে সে এই দেশে নিরাপদ না। যখন তখন তাকে যেকোনো জায়গায় থেকে কুকুরের জাতরা এসে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে তার উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে দিবে। আর কেউ তাকে বাঁচাতেও পারবে না। যেখানে দিনের আলোয় একটা মেয়ে সুরক্ষিত না সেখানে তুই একা একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে ভালো আছিস এ কথা একবারও মাথায় আসলো না? আমেনা আন্টি যাওয়ার পর তুই কিভাবে এত সুরক্ষিত ছিলি একবার ভেবেছিলি?
একবারও কি ভেবেছিলি যে, যারা আজ তোর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা হয়তো বা পরবর্তীতে অন্য কোন মেয়েকে এমন বাজে দৃষ্টি না দিয়ে একবারে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে? দিতে পারবি গেরান্টি? না পারবি না।
কেন না আজ যদি ওই নরপশুদের আমি না মারতাম তাহলে ঠিক একদিন না একদিন ওরা এমনটাই করতো। আর তখন আফসোস ছাড়া করার মত কিছুই থাকতো না। এখন বল তাদের খুন করে কি ভুল করেছি আমি। বল! শেষের কথাটা হুংকার দিয়ে বললো।
.
এতক্ষণ আমি রিয়ানের কথাগুলো মনোযোগসহ কারে শুনছিলাম। কিন্তু শেষে রিয়ানের হুংকারে আমি কেঁপে উঠি।
রিয়ান আমার কাছে এসে আমার বাহুদ্বয় চেঁপে ধরে বলে,
.
— ৫ টা বছর! ৫ বছর ধরে আমি তোর অগচোরে তোকে পাগলের মত ভালবেসে এসেছি। দূর থেকেই ভালবেসে যেতাম। প্রতিদিন তোর এক ঝলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতাম। প্রতিদিন তোর ছবি তুলে নিয়ে যেতাম আর দিন গুনতাম।
জানিস যখন জেনেছিলাম তুই ভালবাসায় বিশ্বাস করিস না। ভালবাসাকে ঘৃণা করিস।ভালবাসা নামকেই অবজ্ঞা করিস। তখন আমি আহত হয়ে পড়েছিলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম কিভাবে তোর সামনে কিভাবে ভালবাসার অনুভূতিগুলো নিয়ে সামনে যাব। কিন্তু ভালবাসতাম তাই হাল ছেড়ে দেই নি।
তাই প্রথমে তোর ভালবাসার প্রতি অনিহার কারণ খুঁজতে শুরু করি তখন জানতে পারি তোর জীবনে এক কালো অধ্যায় আছে। তোকে নাকি কেউ একজন ভালবাসি বলে আর তারপর যখন তুই মানা করে দিস তখন সে তোকে মলেস্ট করার ট্রাই করে। তখন থেকেই তোর মনে ভালবাসার জন্য এত ঘৃণা জন্ম নেয়। তখন জানতাম না যে সেই কালো অধ্যায় আরিয়ান। যদি জানতাম না ঠিক তখনই আরিয়ানকে মেরে ফেলতাম। কিন্তু দেরিতে হলেও আমি ওই জা***টাকে মেরে ফেলিছিলাম।
এতটুকু বলে রিয়ান দম নেয়। তারপর আমায় আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
.
— জানিস তোরর মনের মধ্যে ভালবাসা অনুভূতি গুলো তৈরি করতেই আমার এই ৫ টি বছর লেগে যায়। তোকে ভালবাসার আগে তোর মনে আগে ভাললাগার অনুভূতি গুলো সৃষ্টি করতে হয়েছিল আমার।
প্রথম ২ টা বছর আমি তোকে জেনেছি বুঝেছি। তোকে আপাদমস্তক মুখস্ত করেছি। তোকে ফলো করেছি। পাগলের মত করে চেয়েছি তোকে। তোকে নিজের চোখে চোখে রাখার জন্য তোর বাসার পাশের ২ টা ফ্ল্যাটই আমি কিনে নেই। যাতে আমি বাদে তোর আশে পাশে আর কেউ না থাকতে পারে। কিছু কাজের বাহানায় লোক পাঠিয়ে তোর সিসিটিভি লাগাই। যাতে তোকে আমি প্রতিটা মুহূর্ত চোখের সামনে দেখতে পাই। তোর কোন বিপদ হলেই ছুটে চলে যেতে পারি। তোর জন্য সবসময় আড়াল থেকে কিছু না কিছু করেই যেতাম। তোকে সকল বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখতাম।
মাঝে মধ্যে তোকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু পারতাম না। তাই রাতের আধারের সুযোগটা নেই আমি। তোকে কাছ থেকে ছুঁয়ার ইচ্ছাটা ধরে রাখতে না পেরে তকর বাসার ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে তোর বাসায় ঢুকতাম তোকে কাছ থেকে একটু ছুঁয়ে দিব বলে। এতে কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না আমার। শুধু তোকে একদম কাছ থেকে দেখবো বলে এমন করতাম। তোকে হাল্কা ছুঁয়ে দিব বলে এমন করতাম। খারাপ কিছু করার ভাবনা আমার মাথায় কখনোই আসে নি। কেন না যাকে সত্যিজারে ভালবাসা হয় তাকে সে কখনো অপবিত্র করতে পারে না। কিন্তু একদিন নিজেকে সামলিয়ে রাখতে না পেরে তোকে ঘুমের ঘরে কিস করে বসি। আর এর জন্য আমি সত্যি লজ্জিত ছিলাম। আর এর জন্য নিজেকে শাস্তিও দিয়েছিলাম। এই কাজটি বাদে আর কখনো তোর সাথে কিছু করি নি। এমনকি তোর কাছেও সহজে আসতাম না। এইভাবেই আমি পুরো ১ বছর কাটাই।
এরই মধ্যে আমেনা আন্টি মারা যায়। আর তুই একদম ভেঙে পরিস। তখন দূর থেকেই তোকে সকল কষ্ট থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তোর মুখে হাসি ফুটাতে কি না করেছি। তোকে ভুলাতে চেষ্টা করতাম।
তারপর তোকে ফুল দিয়ে স্পেশাল ফিল করাতাম। তোর মনের মধ্যে ভাললাগার অনুভূতি গুলো জাগ্রত করার চেষ্টা করতাম। চিঠির মাধ্যমে আমার অনুভূতি গুলো তোর কাছে প্রকাশ করতাম। এইভাবে ২ টা বছর পার করি আমি। শুধু মাত্র তোর মনে ভাললাগার অনুভূতি গুলো সৃষ্টি করতেই।
তারপর অবশেষে তোর সামনে আসি তোকে ভালবাসার আসল মানে বুঝাতে। তোর মনে ভালবাসার মিষ্টি অনুভূতি অনুভব করাতে। নিজেকে তোর অভ্যাসে পরিনত করতে। আর দেখ আজ তুই আমার। আমার ৫ বছরের সাধনার বিনিময়ে আজ তুই আমার কাছে, আমার পাশে।
কিন্তু আজ তুই আমার সকল ভালবাসা প্রত্যাখ্যাত করে শুধু আমার হিংস্রতাই দেখলি। কেন রিয়ানা কেন!!
.
রিয়ানের মুখে “রিয়ানা” নামটা শুনার সাথে সাথে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। যেদিন থেকে রিয়ান আমায় “রিয়ুপাখি” ডাকা শুরু করেছিল এর পড়ে ১-২ বার বাদে কখনো আমার “রিয়ানা” বলে ডাকি নি।
যখন কেউ দীর্ঘদিন “আপনি” থেকে “তুমি” হয় তখন সে হয়ে উঠে সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ। আর সেই মানুষটি যখন “তুমি” থেকে “আপনি” তে চলে আসে তখন সে হয়ে যায় সবচেয়ে পর। ঠিক নামের বেলাও একই।
এর মানে কি রিয়ান এখন আর আমায় আপন ভাবতে পারছে না?
আমি এইবার ছলছল চোখে রিয়ানের দিকে তাকাই। আর মনে মনে বলতে থাকি।
— রিয়ান যে আমার অগচোরে আমায় এতটা ভালবেসে এসেছে তা আমি কোনদিন উপলব্ধিই করতে পারি নি। জানতাম রিয়ান আমায় অনেক বেশি ভালবাসে কিন্তু এতটা তা আমার জানা ছিল না। সত্যিই রিয়ান ঠিক বলতো রিয়ানের ভালবাসা সকলের হতে ভিন্ন। রিয়ান যা করেছে আমার জন্য আর আমি কিনা তাকে ভুল বুঝলাম। তার ভালবাসাকে উপেক্ষা করে শুধু তার হিংস্রতাই দেখলাম। কি করলাম আমি এইটা!
.
রিয়ান এইবার ছেড়ে দিয়ে জোরে দেয়ালে ঘুষি মারে। নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু আজ যেন তার রাগ কমছেই না। রিয়ান এইবার পাগলের মত হয়ে উঠে। হাতের সামনে যা পেতে থাকে তাই ছুঁড়ে মারতে থাকে। মুহূর্তেই সে রুমটির অবস্থা নাজেহাল করে ফেলে। রিয়ানের এমন পাগলামো দেখে আমি আতকে উঠি। আমি ভালো ভাবে রিয়ানের দিকে তাকাই।রিয়ানের চোখ একদম রক্তিম লাল হয়ে আছে। কপালে নার্ভগুলো ফুলে উঠেছে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। কেন যেন আজ রিয়ানকে বেশ অচেনা লাগছে। নিজেকে বুঝিয়েও সাহস জুগাতে পারছি না রিয়ানের সামনে যাওয়ার।
রিয়ান আস্তে আস্তে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। রিয়ান এখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। রিয়ান কিছুক্ষণ নিজের চুল চেপে ধরে বলে,
.
— আমার থেকে দূরে যাওয়া কখনো সম্ভব না। এক আমার মৃত্যু ব্যতীত তোমায় আমার কাছ থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে। তুমি মারো কাটো আর যাই করো না কেন আমার থেকে তুমি নিস্তার পাবে না।
কিন্তু তুমি তো আমার সাথে থাকতে চাও না তাই না। তো আল্লাহ এর কাছে দোয়া করো যেন আমি বেশি দিন না বাঁচি। যত দ্রুত সম্ভব মরে যাই আর তুমি আমার পিঞ্জারা হতে বহু দূর চলে যাও। যেখান রিয়ান নামক কোন হিংস্র জীব থাকবে না।
.
এই বলে রিয়ান টলমল চোখে রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। আর খুব জোরে দরজাটা বারি মেরে লাগিয়ে চলে যায়। আর এইখানে আমি নির্বাকের মত তাকিয়ে থাকি। মন ও মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা হয়ে যায়। কানে শুধু রিয়ানের একটি কথা কানে ভেসে আসছে, ” দোয়া করো আমি যাতে দ্রুত মারা যাই।”
হুট করেই আমার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়তে থাকে। রিয়ানকে আজ হয়তো আমি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। সবসময় আমি এমনটাই করি। না বুঝে উল্টাপাল্টা করে বসে থাকি। তখন অন্যের নুন্যতম বাক্য আমি শুনতে নারাজ। আর এর জন্যই রিয়ানকে আমি ভুল বুঝলাম।
আমি এইবার কান্নায় ভেঙে পড়ি৷ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে দাড়িয়ে যাই। রিয়ানের কাছে আমার ক্ষমা চেতেই হবে। আমি বাইরের দিকে অগ্রসর হতে নিলে কিছু একটাতে বেজে পড়ে যাই। আর হাতের কুনোইতে সামান্য ব্যথা পাই। আমি এইবার কোনো মতে উঠে বসি। আর এক হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরি।
নিজের ব্যথাটাকে নিবারন করার চেষ্টাই করছিলাম ঠিক তখনই আমার চোখ পাশে পড়ে থাকা ডাইরির উপরে পরে। এইটা সেই ডাইরি যেটা আমি “৫০৫” নাম্বার ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে এসেছিলাম।
কি যেন ভেবে আমি দ্রুত ডাইরিটা হাতে নিয়ে নেই এবং প্রথম পৃষ্ঠা বের করে পড়তে শুরু করি৷
.
.
.
#চলবে