আমি একা ৩য় এবং অন্তিমপর্ব

0
2333

#আমি_একা
#৩য়_এবং_অন্তিমপর্ব
#আরিয়া_সুলতানা

ছেলে সন্তান না হলে বাড়িতে জায়গা হবেনা। সন্তান লাভের আনন্দটা মুহূর্তেই ভয়ে পরিণত হলো কুহুর। যদি ছেলে নাহয় তবে কি হবে! কুহুর মাথায় তখন একটাই কথা ছিল, “আবারো কি আমার জন্য শ্রাবণকে ওর বাবা-মা থেকে দূরে থাকতে হবে? শ্রাবণ কি তখন আমাকে ঘৃণা করবে? আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি কি করবো?” কুহুর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে এ কদিনে। মুখ ফিঁকে হয়ে আছে। মন কু ডাক ডাকছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
“আচ্ছা এই বৃষ্টিতে যদি আমি ভেসে যেতে পারতাম ভালো হতো না খুব? অনেক দূরে চলে যেতে পারতাম তাইনা?”
“ওষুধ খেয়েছো?”
শ্রাবণ একগ্লাস স্যালাইন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। কুহু বাইরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বললো “হ্যা খেয়েছি।”
“কি দেখছো বাইরে?”
“আচ্ছা যদি আমার ছেলে না হয় তবে কি হবে? ছেড়ে চলে যাবে?”
“ছেলেই হোক কিংবা মেয়ে, তুমি পাশে থাকলেই হবে। এবার স্যালাইনটা খেয়ে নাও।”
চার মাস পর, সেদিন এমনই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে কাঁপড় উঠাতে যেয়ে স্লিপ করে পড়ে গেছে কুহু। গলা ফাঁটিয়ে চিল্লাচ্ছে কুহু।
বৃষ্টি এখন কিছুটা কমেছে। কোথাও একটা হুতুম পেঁচা ডাঁকছে কিছুক্ষণ পরপর। ব্যাঙেদের মেলা বসেছে। এরই মধ্যে একটা নবজাতক কন্যার কান্না শোনা যাচ্ছে। সাথেই শোনা যাচ্ছে একজন নব্য মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করা এক অসহায় নারীর কান্না। ভয় হচ্ছে, যদি ছেড়ে দেয়! যদি আবার শ্রাবণকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে আবার দূরে সরানোর জন্য ও দায়ী হয়! তারা কি ওকে অভিশাপ দেবে? নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে? এর কিছুই জানা নেই কুহুর। শ্রাবণ মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। কুহুর কান্না ধীরে ধীরে থেমে এসেছে। নার্স ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে।

সকালে…
শ্রাবণের বাবা-মা এসেছে হাসপাতালে। নাতনীকে কোলেও নিয়েছে। কুহু তাদের বলতে শুনেছে যে তাদের কুহুর জন্য খারাপ লাগছে। আজ ৩দিন পর কুহু আর মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে শ্রাবণ। কুহুর কন্ডিশন বেশি ভালো নয়। ডাক্তার বললো আর মাতৃত্বের স্বাদ তার পাওয়ার নয়। শ্রাবণ তার বাবা-মায়ের স্বভাব দেখে ধরেই নিয়েছে তারা মেনে নিয়েছে নাতনীকে। যদিও বা ধর্ম ভিন্ন। এরপর ২মাসের মতো বেশ শান্তিতেই ছিল সবাই শ্রাবণের মেয়েকে নিয়ে। কুহুর মেয়ে সুস্থ হলেও কুহু মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মধ্যরাতে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সারাদিন চিল্লাপাল্লা করে। ঘরকুনো হয়ে গিয়েছে কুহু। শ্রাবণ অনেকবার বলেছে যে তার কোনো দোষ নেই মেয়ে হয়েছে যে। আর তার বাবা-মাও নাতনীকে মেনে নিয়েছেন।
“আমি তাদের মুখ থেকে শুনতে চাই যে তারা ওকে মেনে নিয়েছেন।”
“আচ্ছা চলো তোমাকে তাদের মুখ থেকেই শোনাই।”
শ্রাবণ কুহুকে নিয়ে তার মা-বাবার ঘরে গেল। তারা নাতনীকে নিয়ে খেলছেন।
“আচ্ছা মা তোমাদের কি কোনো অভিযোগ আছে আমার মেয়ে হয়েছে বলে?”
“আরেহ নাহ নাহ। কোনো অভিযোগ নেই। আমরা খুশিই আছি আমাদের এই ফুটফুটে নাতনীকে নিয়ে।”
কুহুর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুঁটেছে সবে আর তখনই শাশুড়ি বললো,
“তবে নাতি কিন্তু আমাদের চাই-ই চাই। এরপরের বার যেনো ছেলে হয় বউমা!”
নিমিষেই সে হাসি অতীতে মিশে গেল। বর্তমানে বিষণ্ণতা ফুঁটে উঠেছে। কুহুর দ্বারা আবার মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব নয় তা জানে সে। কুহু চায় না কোনো মিথ্যা আশার স্বপ্নজাল বুনন হোক। একদিন না একদিন তো জানতেই হতো। সেদিনই বলার সিদ্ধান্তে পৌঁছালে হঠাত শ্রাবণ বলে ওঠে,
“আচ্ছা বাবা, নাতিই আসবে।”
কুহু শ্রাবণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ তো জানে সব। তাহলে মিথ্যা কেনো বলছে। কেনো যেনো কুহু শ্রাবণের মাঝে নিজের বাবার বৈশিষ্ট্য পাচ্ছে। বিষয়টা ভিন্ন হলেও মিথ্যা মিথ্যাই থাকে এর কোনো ভিন্নতা নেই। আগেও যেমন সুজিত স্যারকে নিজের বাবার বলা মিথ্যাগুলো বলে দিয়েছিল এবারো বলে দিল।
সব শুনে কুহুর শশুর-শাশুড়ি চুপচাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে পিন-পতন নীরবতা বিরাজমান আছে।
“আমাদের নাতি চাই। শ্রাবণ আমাদের একমাত্র ছেলে। বংশেরবাতি ও আমাদের। এখন যদি বংশ এগিয়ে নিয়ে যেতে শ্রাবণের দ্বিতীয় বিয়ে করা লাগে তবে করবে। দরকার হলে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে করবে আর এটাই আমার শেষ কথা।”
সেইদিন সেই অসাধারণ ছেলেটা আবারো কুহুর হাতই ধরে। কুহু অবাক হয়েছিল খুব, শ্রাবণ নিজের বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসে আর তার সাথেই সেদিন উঁচু স্বরে কথা বলে ত্যাজ্য উপাধি নিয়ে নিজের বউ আর মেয়েকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন সন্ধ্যায়। কুহু খুশি হলেও নিজের উপরই ক্ষেপে ছিল সে। চরম ক্রুদ্ধ হয়েছিল নিজের উপর আর নিজের মেয়ের উপর। বাবা-মা আর ছেলের বিচ্ছেদ সে চায়নি তবে কেনো হলো। কুহুকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তার শাশুড়ির বলা কথাগুলো।
“তুমি কোনোদিন সুখী হবানা। আমার পোলারে তুমি আমাগো থেইকা দূরে সরায়ে দিছো। তোমার কোনোদিন ভালা হইবো না।”
আজ প্রায় দু’দুটো বছর কেঁটে গেছে শ্রাবণ আর তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের। আজো কুহু নিজেকেই দোষী মানে। নিজের মেয়েকে দেখলে কেনো যেনো গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে তার। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেই মরে যাক বিষ খেয়ে। ইদানীং শ্রাবণ ও কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে আগে আদর করতো এখন আর তেমন একটা করেনা। শ্রাবণের চাকরি চলে গেছে। এদিকে ওর মা-ও মারা গেছে সবে ৩মাস। নিজের নাতিকে দেখতে চেয়েছিলেন। তবে আশা অপূর্ণই থেকে গেছে। এসব নিয়েই ভাবে আজকাল শ্রাবণ। বিষণ্ণতার গভীর ঘোরে ডুবে থাকে আজকাল। কোনোকিছুর প্রতিই আগ্রহ নেই তার। কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে কুহুর সাথে। এদিকে শ্রাবণের এই একদম চুপ হয়ে যাওয়া কুহুকে খুব পোড়াচ্ছে। মনে ভয় জাগছে কুহুর। কয়েকমাস ধরে কুহুর ওষুধ শেষ। ওষুধের অভাবে মাথায় ব্যাথা আর দুশ্চিন্তা ইদানীং খুব বেশি হারেই বেড়েছে। সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা হয় তার।
কেঁটে গেছে প্রায় ৫বছর। এ কয়েক বছরে বেড়ে গেছে দূরত্ব। বেড়েছে দুশ্চিন্তা, অবহেলা। মেয়েটা বেড়ে উঠেছে অবহেলায়। কারোই ভালোবাসা পায়নি মেয়েটা। অভাবের সংসার, বোধহীন সংসার, বিষণ্ণতার অতলে ডুবে যাওয়া সংসার। একটা ছোট-খাটো চাকরি পেয়েছে শ্রাবণ। সেখানেই থাকতে হয় দিনের এক তৃতীয়াংশ। বাড়িতে কুহু আর ওর মেয়ে। কুহুর মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবসময় রেগে থাকে। মেয়েটার সাথে বাজে ব্যবহার করে। তবে রাতে ডুঁকরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। রাতের গভীরতা মানুষের হিংস্রতা বাড়ায়। রাতের গভীরতা মানুষকে উপলব্ধি করায়। তবে সকাল হতেই কুহুর বাজে ব্যবহার আবার শুরু হয়ে যায়। শ্রাবণকে সে খুশি রাখতে চায়। মেয়েটাই শ্রাবণের দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে এমনই ধারণা। ইদানীং টের পাচ্ছে শ্রাবণ আর আগের মতো নেই। অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণের ফোন চেক করেই সে বুঝতে পেরেছিল শ্রাবণ আর ওর নেই। সে আর কুহুর সেই অসাধারণ মানুষটা নেই। অন্যকারো হয়ে গেছে। আজ একটা ছেলে থাকলে বোধহয় শ্রাবণ ওরই থাকতো। মেয়েটার উপর খুব রাগ হচ্ছে কুহুর। সাথে নিজের উপরও। কুহুর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, কিভাবে শ্রাবণকে ধরে রাখবে নিজের কাছে। তবে এই ধরে রাখতে যেয়েই ঝগড়াগুলো আরো দূরে সরিয়ে নিয়েছে ওদের। কুহুর সেই অসাধারণ মানুষটা যে একসময় কুহুর জন্য সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছিল, কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি। সেই অসাধারণ মানুষটাই আজ হাত টা সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিল। তবে কুহু ঠিকই সামলে উঠবে। মেয়েকে একটু সময় দিবে। শ্রাবণকেও দোষ দেওয়া যায় না। মনুষ্য জাতটাই এমন, সুখ পাওয়ার কাঙাল। সুখের সন্ধানে সারাটা জীবন কাঁটিয়ে দিতে পারে। সুখ পেলেই সে সেই অনন্তে পারি জমাবে যেথায় তার সুখ আছে। ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
“না মা। ঘুম আসছেনা। গল্পটা খুব মনোযোগ কাড়া। ঘুমটাও কেড়ে নিয়েছে।”
“রাত অনেক হয়েছে। আমি তোর মাথায় তেল দিয়ে দি। ভালো একটা ঘুম হবে।”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নাহ, কুহেলিকা জমাদ্দার ওরফে কুহু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মোঃ সামিউল ইসলাম নামটা শুনেই বুঝেছি মা কাদের গল্প বলছে। আস্তে আস্তে ঘুমে ঢুলে পড়লাম আমি। সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ক্যালেন্ডার টার দিকে তাকালাম। আজ ৩তারিখ। আর মাত্র ২৬দিনের মতো।
জানিনা মা কি করবে একা একা। তবে ঠিক থাকবে আশাকরি। রান্নাঘরে যেয়ে দেখলাম মা রান্না করছে। অথচ মা ৫টা মিনিট ও ঠিক হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা তবুও কষ্ট করে রান্না করছে। অনেক ভালবাসি তোমায়।

আজ ৭ম দিন মেয়েটা ছেড়ে চলে যাওয়ার। দূর অনন্তে মিশে গেছে আমার মেয়েটা অবহেলা পেতে পেতে। খুব খারাপ মা ছিলাম আমি। শেষ কয়েকদিনেও ঠিকমত খেয়াল রাখতে পারলাম না তোর। অসুস্থতার দোহায় দেখিয়ে লাভ নেই। দোষী তো আমি প্রথম থেকেই। যখন ছিলি তখন দেখে রাখিনি যে।
“আজ একলা এই বারান্দায়
সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁপোকার ভিঁড়ে
পাখিদের মতোই নীরে ফিরে
সবার ছেড়ে যাওয়া পরিত্যক্তা
আমি একা।”

(সমাপ্ত)