আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-০৮

0
1528

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৮]

আচমকা কেউ হাত ধরায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। ভরকে গিয়ে নুরা ও রিমির দিকে তাকালো। অবাক হয়ে অসহায় চোখেমুখে বললো, ‘তোরা যাস নি?’

রিমি মাথা এপাশ থেকে ওপাশ দুলিয়ে বললো, ‘নাহ্। তুই নাস্তা করবি না; তোর ঘাড় করবে। আয় তাড়াতাড়ি।’

অসহায় হলো দীবা। কাদুকাদু গলায় বলে উঠলো, ‘আমি নিচে যাবো না।’

রিমি নুরা কেউ তার কথার গুরুত্ব দিলো না। জোরপূর্বক দীবার হাত ধরে নিচে নিয়ে আসলো। দীবা প্রথমে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু নিচে আসায় হাত মোচড়ামুচড়ি করা থামিয়ে দিলো। দীবার এক হাত ধরে নুরা ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলে রাইমা বলে উঠলো, ‘কিরে? এতো লেইট করে আসলি কেন তোরা?’

রাইমার কথা শুনে টেবিলে থাকা সবাই তাদের দিকে তাকালো। আবরার তাকাতেই দীবার দিকে চোখ আটকে গেলো তার। তখন দূর থেকে দেখেছিলো। কিন্তু এখন কাছ থেকে দেখলো। ইউনিফর্মে মেয়েটাকে প্রচুর কিউট লাগছে। তার উপর আবার এখন মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সামনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না আবরার। চোখ ফিরিয়ে নিলো। তবে চোরা চোখে তাকাতে ভুললো না একদম।

দীবা মুখ কালো করে নুরার হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো। ক্ষুব্ধ চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হা’রা’মি দুইটা।’

টেবিলের এক পাশে সে চুপচাপ বসে পরলো। তার ঠিক সামনের চেয়ারে আবরার। চেয়ারে বসার পর আবরারকে দেখে অসাড় হলো দীবা। ইশ! কি ভুলটা করলো সে। ভালো করে দেখে পাশের চেয়ারটায় বসতে পারতো। মনে মনে নিজের বোকামোতে শখানেক গালি দিলো। নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করলো সে। কিছুক্ষণ পর আবরার চোখ তুলে দীবার দিকে তাকালো। পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো দীবাকে। গোলগাল চেহারা! ঠোঁট একদম পাতলা গোলাপি আস্তরণ! সিল্কি কালো চুল! গায়ের রঙ উজ্জ্বল! সব চেয়ে সুন্দর টানা টানা চোখ দুটো আর গোল গোল গাল দুটো। মিষ্টি লাগছে একদম। খাবার চিবুতে চিবুতে দীবার দিকে তাকিয়ে আছে আবরার। দীবা খাওয়ার ফাঁকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই আবরারের চোখে চোখ পরলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো দীবা। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। কিন্তু আবরার চোখ ফিরালো না। তাকিয়ে রইলো একমনে। অস্বস্তিতে মিহিয়ে এলো দীবা। আবরারের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলো তারই দিকে তাকিয়ে আছে আবরার। জড়তা এসে গ্রাস করলো দীবাকে। দ্রুত খাবার খেতে লাগলো। এখান থেকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে পারলেই বাঁচে!

দীবাকে এতো তাড়াতাড়ি খেতে দেখে সাবিত বললো, ‘কিরে পাকনি। এতো তাড়াতাড়ি খাইতাছোস ক্যান? তোর খাবার কি কেউ নিয়া যাইতেছে? আস্তে খা!’

সবাই দীবার দিকে ফিরে তাকালো। তাদের চাহনীতে দীবা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। দ্রুত চালিত হাত ধীর হলো। আস্তে আস্তে কোনো মতে অর্ধেক খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়াল। এতো তাড়াতাড়ি উঠতে দেখে রাইমা অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘উঠলি কেন? কিছুই তো খেলি না।’

দীবা ঠোঁট টেনে হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, ‘আপু আমার ক্ষিদে নেই। আর খাবো না। রিমি আমি গাড়িতে যাচ্ছি। তোদের শেষ হলে চলে আসিস।’

কারোর প্রতিত্তুরের অপেক্ষা করলো না দীবা। দ্রুততার সাথে টেবিল থেকে চলে আসলো। রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে বাগানে গেলো। এবার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দীবা।

আবরারের কি হলো কে জানে! দীবার এমন কান্ডে সকলের অগোচরে আলতো ভাবে হাসলো। মেয়েটিকে কিউটের অতিরিক্ত মাত্রায় ফেলে দিলো সে। আর ক্যারিয়ারে অনেক তারকাদের সাথে দেখা হয়েছে। তারা সবাই যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু কাউকে দিকে অন্য নজরে দেখেনি আবরার। তবে দীবাকে এক পলক দেখার পর থেকেই অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করতে মনে। ভীষণ ভাবে দীবার মায়ায় আটকে পরেছে সে। তবে এটাই কি পবিত্র বন্ধনের শক্তি? মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতেই খাবার শেষ করলো আবরার।

সকালের নাস্তা শেষে রিমি ও নুরা বেরিয়ে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে। অন্যসময় রাইমাকে ভার্সিটিতে আরিয়ান নামিয়ে দিতো। কিন্তু আজ রাইমা একা ভার্সিটি গেছে। আরিয়ান, সাবিত মিলে আবরার ও অভ্রকে নিয়ে বের হবে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
___________________

আকাশটা মেঘলা। থোকায় থোকায় কালো মেঘ ভাসছে। প্রবল বাতাস প্রভাহমান। চারপাশ নিঝুম নিস্তর থাকলেও কলেজ ছুটি শেষে শিক্ষার্থীদের কোলাহলে জমজমাট হয়ে গেছে। বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি ফিরার তাড়া শিক্ষার্থীদের। সকলের মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে দীবা। দুই হাতে ব্যাগের ফিটা টেনে ধরে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।তার সামনেই নুরা রিমি কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। দীবা আস্তে আস্তে হাঁটার কারণে পিছিয়ে পরেছে তাদের থেকে। সে দিকে ধ্যান নেই তার। অন্যমনস্ক হয়ে আছে মন। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। দ্বিতীয়বার লোকটার সামনে পরতে চায় না সে। ভয়, জড়তা, অস্বস্তি লাগে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ-ই কারোর সুঠাম দেহের সাথে ধাক্কা লাগায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। ধ্যান ভাঙ্গলো তার। বাহুতে হাত রেখে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো, ‘স্যরি স্যার। আই’ম রিয়েলি স্যরি। আসলে আমি..!’

দীবার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয়নি রাজ। তার আগেই কথার পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ইট’স ওকে। ব্যাথা পেয়েছো?’

ডান হাতের কব্জি বরাবর ব্যাথা পেয়েছে দীবা। কিন্তু স্বীকার করলো না। মাথা নাড়িয়ে মুখে বলে উঠলো, ‘না স্যার।’

‘ঠিক আছে। সাবধানে যাও।’

দীবা মাথা হালকা কাত করে সম্মতি দিলো। তারপর রাজকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। স্থির দাঁড়িয়ে রইলো রাজ। এক দৃষ্টিতে দীবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সবসময় হাস্যউজ্জ্বল থাকা মেয়েটি হঠাৎ এতো অন্যমনস্ক হলো কেন? দীবা কলেজ আসা থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্লাস ও এখন অব্ধি রাজ নোটিস করেছে। মেয়েটার মন আজ অন্যমনস্ক। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু ভার মন। কিন্তু কেন? কিছু হয়েছে কি? চিন্তিত হলো রাজ। তারপর হঠাৎ-ই মনে পরলো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনার কথা। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মেয়েটির স্পর্শ পেয়েছে সে। প্রথম স্পর্শ ছিলো মেলাতে। আর আজ! দীবার শরিরের মিষ্টি ঘ্রাণে আবারো নতুন করে প্রেমে পরতে বাধ্য হলো রাজ। আনমনে আলতো ভাবে বাঁকা হাসি দিলো একটা।

দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো দীবা। কিছুসময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য এখনো হতভম্ব সে। ধা’ক্কা লাগার জন্য আর কেউ ছিলো না? স্যারের সাথেই ধা’ক্কা লাগতে হলো। ব্যাপারটা লজ্জাজনক লাগলো দীবার কাছে। নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগছে। কলেজ থেকে নেমে সামনে খোলা মাঠে আসার পর নুরা ও রিমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো দীবা। তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই নুরা তাৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করে উঠলো, ‘স্যারের সাথে কি কথা বলছিলি এতোক্ষণ?’

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো দীবা। তার থেকেও বেশি বিরক্ত হলো এতোক্ষণ কথাটা শুনে। নুরার দিকে অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে ত্যাঁছড়া গলায় বলে উঠলো, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচছিলাম। দেখিস নি?’

রিমি হেসে উঠলো। নুরা কলেজের দ্বিতীয় তলায় তাকিয়ে দুইজন কে ইশারা করে বললো, ‘বোইন দেখ, স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় আমাকে দেখছে।’ চোখেমুখে মুগ্ধতা এনে বললো।

নুরার কথা অনুসরণ করে দ্বিতীয় তলার বারান্দার দিকে তাকালো রিমি দীবা। রাজকে পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দৃষ্টি তাদের দিকে। কিন্তু আদৌ কি তাদের দেখছে? আশেপাশে তো কতো শিক্ষার্থী আছে। নুরা সবসময় একটু বেশি নেগেটিভ ভাবে। তাই রিমি বললো, ‘তোর চিন্তাভাবনা ফেনার লগে ভাইসা গেছে। পাগল মাইয়া। স্যারের আর কাম কাইজ নাই? তোরে দেখতে যাইবো কোন দুঃখে?’

নুরা বললো, ‘কারণ স্যারের চোখে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমি। সুতরাং আমাকেই দেখবে। এটা স্যারের সিক্রেট তাই কেউ জানে না। শুধু আমি জানি।’

রিমি নুরার মাথায় গাট্টা মেরে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘তোর ছাগলামি বাদ দে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ। বৃষ্টি নেমে যাবে।’

নুরা ও রিমি বকবক করতে করতে গেইটের দিকে এগিয়ে গেলো। দীবাও তাদের পিছু হাঁটতে লাগলো। কি মনে হতে যেন পিছু ফিরে একবার দ্বিতীয় তলায় তাকালো। দেখলো রাজ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপার টা কেমন অদ্ভুত লাগলো দীবার কাছে। অপ্রীতিজনক! চোখ দিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। দ্রুত পা চালিয়ে গেইটের বাহিরে চলে আসলো। দীবা বেড়িয়ে যেতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো রাজ। চলে যাওয়ার আগে দীবা পিছু ফিরে তার দিকে তাকিয়েছে। এই চাহনীটা রাজের বুকে গিয়ে বাধলো। মনে ভালো লাগা কাজ করতেই এক হাতে মাথা চুলকে মৃদু হাসলো।
___________________

আষাঢ়মাসের অম্বর কালো কাদম্বরীতে ঢেকে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ আর আড়ম্বর জানান দিচ্ছে কিয়ৎক্ষণ পর চট্টগ্রাম শহর বর্ষণমুখর হবে। পিচ ঢালা রাস্তা ভিজে একাকার। বর্ষণের ভাড়ি ফোটাতে কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুলো নুইয়ে পরেছে। কদমফুল ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। ক্ষীণ সময় পরপর আকাশ আলোকিত করে গর্জে উঠছে চারপাশ। ঘুরাঘুরি শেষে বিকেলের শেষাংশে বাড়ি ফিরলো চারজন। আবরার, অভ্র, আরিয়ান ও সাবিত। বাহিরে ঝিরঝির বৃষ্টি ছিলো। তাই আবরারের শার্টের কাধের অংশবিশেষ ভিজে আছে। বর্ষণে মুখরিত চট্টগ্রামের পরিবেশ দেখার মতো। বেশ উপলব্ধি করেছে সে। এক হাতে ভিজে যাওয়া চুল গুলোতে আঙুল চালিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো আবরার। দরজা খুলে রুমে পা রাখবে এমন সময় দীবা কে তার রুম থেকে বের হতে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো সে। দীবা আবরার কে দেখেই তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। বুকে হাত রেখে জুড়ে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। দীবার এহেন কান্ডে আবরার অবাকের শেষ প্রান্তে। ভয়াংকর রকমের রাগ হলো তার। সে কি বাঘ নালি ভাল্লুক যে তাকে দেখে দরজা লাগিয়ে ফেলবে? নাকি সে দেখতে খারাপ? আবরার এবার এক প্রকার জগন্য প্রতিজ্ঞা করে ফেললো। সে ভুলেও আর দীবার দিকে তাকাবে না। তাকানোর দরকারও পরে না। মনে মনে ক্রোধ দমিয়ে রেখে রুমে প্রবেশ করলো। দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাঁড়াল আবরার। এই মুহূর্তে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর প্রয়োজন তার।

চলমান..