আসক্তি২ পর্ব-০৫

0
2385

#আসক্তি২ (আ জার্নি অব্ এডিকশান)
পর্বঃ০৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

দিন যতো পার হয় পাখির সাথে ইনায়াহ্’র সম্পর্কটা দিন দিন আরো বেশি গাঢ় হতে থাকে।একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন অচল প্রায়।রক্তের কোন সম্পর্ক নেই অথচ কতো আপন করে নিয়েছে দুজন দুজনকে।
ইনায়াহ্’র ঘুম এখন আর শানের চুমুতে ভাঙ্গে না ;পাখির চুমুতে ভাঙ্গে।সারাদিন খেলাধুলা, সময় মতো খাওয়াদাওয়া সাথে পড়তেও বসা সব যেন নিয়মমাফিক চলছে।শান দিনকে দিন অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ইনায়াহ্’র চেহারা আগের থেকে আরো বেশি সুন্দর হচ্ছে যেটা কারোরই নজর এড়াচ্ছে না।শানও এখন হসপিটালে এসে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।

গত কয়েকদিনে আব্দুল্লাহ্ আর রাহেলার সাথেও বেশ জমে উঠেছে পাখির। উঠবে না’ই বা কেন স্বাভাবে মিশুকে সে!তাঁদের দুজনেরই পাখিকে বেশ মনে ধরেছে।

কেবল ভাব জমে নি শান নামক মানুষটার সাথে।শান যতোক্ষন বাড়িতে থাকে এর মাঝে একটি বারও পাখি তার সামনে আসে না।কারো বাড়িতে অযাচিত হয়ে থাকা হয়ত পৃথিবীর সবথেকে নির্লজ্জ কাজগুলোর মাঝে একটি।তাই সবটা সময় শানের থেকে আড়ালে থাকে পাখি।
শান এতে অবাক হয় বেশ কিন্তু কিছু বলে না।কারন সে নিজেও চায় না কোন মেয়ে তার সামনে থাকুক।

🌸
সকাল বেলা শান নাস্তা করে চলে যায় হসপিটালে।আজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসার দিন। তাই আগেভাগেই চলে যায় সে।তার চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর পাখি ইনায়াহ্’র হাত ধরে নিচে নেমে আসে।রাহেলা বেগমের সাথে চোখাচোখি হতে দুজনে সহাস্যমুখে অভিবাদন জানায়।
রাহেলা হেসে ইনায়াহ্’কে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার মুন শাইনের ঘুম ভাঙ্গলো বুঝি দাদুভাই?”
ইনায়াহ্ পাখির হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে একসাথে দুই সিঁড়ি লাফিয়ে নামতে নামতে বলে,”উফফ দিদা, আর বলো না!মুন সাইন কিছুতেই নিচে আসতে চাইলো না।জানো তো!শুধু বলে সান সাইন আর মুন সাইন নাকি একসাথে কোনদিনও উঠে না।একজন গেলে আরেকজনের আসার সময় হয়”

ইনায়াহ্’র কথায় পাখি অস্বস্তিতে পরে যায়।চোখ এদিক সেদিক ফিরিয়ে পরিস্থিতি থেকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করে।রাহেলার দিকে তাকিয়ে দেখে সে পাখির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।পাখি প্রশ্ন করে,”কি দেখছো”
মাথা নাড়িয়ে হালকা শব্দে রাহেলা বলে, “কিছু না”
আব্দুল্লাহ্ তখনি বাহিরের কাজ সেড়ে বাড়িতে ঢোকে নাস্তার উদ্দেশ্যে।ওদের কথার মাঝে চেয়ার টেনে বসে পরে ডায়নিং এ।রাহেলা বাঁকা চোখে তাকিয়ে পাখিকে ইশারা করে।আব্দুল্লাহ্ কিছুই বুঝতে পারে না রাহেলার ইশারার মানে।আপন মনে নাস্তা শুরু করে।পাখি আর ইনায়াহ্ও বসে পরে নাস্তার জন্যে।

🌸
“তোমারে একখান কতা কই রানুর বাপ?”
“কও”,আব্দুল্লাহ্ পিছনে দুইহাত দিয়ে বাগানের মাঝখানে হাঁটছে আর জবাব দিচ্ছে।রাহেলাও তার সাথে সাথে হাঁটার চেষ্টা করে বলতে থাকে,”পাখি মাইয়াডা ক্যামুন লাগে তোমার কাছে?”
আব্দুল্লাহ্ আগের ভঙ্গিমায় জবাব দেয়,”ক্যান বালাই তো”
“হ, আমারও বালাই লাগে।মায়া মুখের মিষ্টি একখান মাইয়া।তয় আমি কি ভাবতাছি জানো?”,হেসে হেসে বলে রাহেলা।
“না কইলে জানুম ক্যামনে?কইয়া ফালাও তো।”
“আমাগের শান বাবার সাথে যদি মাইয়াডার….”
“তোমার মাতা খারাপ অইছে রানুর মা।হেইডা কি কও তুমি।শান বাবা শুনলে আমাগেরও এই বাড়িত থাইক্কা বাইর কইরা দিবে।”,চাপা চাপা স্বরে বলে আব্দুল্লাহ্ এদিক সেদিক তাকায়।
কাপড়ের আঁচল টা আঙ্গুলে মুচড়িয়ে বলে রাহেলা ,”তোমার কি মনে অয়, আমি পাগলি?আরে বুইড়া ভাবো, যদি তাগোর মাঝে পেরেম অয়। তহন?”

আব্দুল্লাহ্ এবার হা হয়ে যায়।কারণ সে জানে এই কাজ কোনদিনও সম্ভব না।শানের মনে মেয়েদের ব্যপারে যে বিরূপ মনোভাব তা একদিনে তৈরী হয় নি ধীরেধীরে হয়েছে।যা একবারে কোনদিনও দূর হবে না।
“তুমি গেছো রাহেলা। সাতে আমারেও নেওয়ার পায়তারা করতাছো।মনে নাই ম্যাডাম কি কইছে?”,দাঁতে দাঁত চেপে বলে আব্দুল্লাহ্।

রাহেলা মুচকি হেসে বলে,”তোমারে কিছুই করতে হইবে না।আমি যা যা করব একটু সাতে থাইক্কো তাইলেই অইছে”
“আমি তোর আগেও নাই তোর সাথেও নাই।যা করার কর।আমি যে কামের লাইগ্গা এইহানে পইরা আছি তা আমারে করবার দে”,বলেই আব্দুল্লাহ্ সামনে হাঁটা ধরে।

🌸
দুপুরের খাবারের পর পাখি ইনায়াহ্’কে নিয়ে ঘুমিয়েছিলো।ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
“এতো সময় ধরে ঘুমাইলাম “,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয় পাখি।দড়বড় করে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরমের দিকে।ইনায়াহ্ তখনো শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।

পাখি ফ্রেশ হয়ে ইনায়াহ্কে ডাক দেয়।এরপর দুজন নিচে নেমে আসে।রান্নাঘরে খুঁটখাট আওয়াজে পাখির পা থেমে যায়।
“কি হলো মুন সাইন, যাবা না?”
“উনি এতো তাড়াতাড়ি এসে গেছেন!”,ভাবতেই সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে যায় পাখি।
“চলো নাআআ”,পাখির হাত টেনে নিয়ে যায় ইনায়াহ্।
গিয়ে বুঝতে পারে রাহেলা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে।পাখি হাফ ছেড়ে বাঁচে

“উঠলে তবে।চা খাবে মা?”,পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে রাহেলা।পাখি মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
“দাদু ভাই তুমি তোমার দাদুর কাছে যাও তো,”আব্দুল্লাহ্কে দেখিয়ে দিয়ে বলে রাহেলা।ইনায়াহ্ পাখির দিকে চেয়ে থাকে।পাখি মুচকি হেসে বলে,”যাও”
ইনায়াহ্ চলে যায় সেদিকে।

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে মা”,চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে রাহেলা
পাখি সবেমাত্র চা এ চুমুক দেবে তার আগে রাহেলার কথায় থেমে গিয়ে বলে,”বলো না চাচি কি কথা?”
রাহেলা আমতা আমতা করে বলে,”তোমার বাড়ি কোথায় মা?”
পাখি বুঝতে পারে রাহেলা কি কি জানতে চাইবেন এখন।তাই নিজেকে প্রস্তুত করে রাহেলাকে সবটা বলার জন্যে।
রাহেলা চায়ের কাপ টা দেখিয়ে বলে,”খাও মা ঠান্ডা হয়ে যাবে নয়ত”

পাখি কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলে,”আমার বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজারে চাচি”
“ওহহহ আচ্ছা আচ্ছা। তা তুমি সিলেট থেকে ঢাকা এতোদূরে কেমনে আসলা মা?পত্রিকায় গভারনেসের নিয়োগ দেখে?”
রাহেলার প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কাপটা টেবিলের উপর রেখে হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বলে, “আসলে চাচি…”
বাকিটা শেষ না করেই দুটো শুকনো ঢোক গিলে চেয়ে থাকে রাহেলার দিকে।রাহেলা কাপে চুমু দিতে দিতে সরুচোখে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে ইশারা করে বলে,”বলো তারপর।কোন সমস্যা নেই। আমি তোমার মায়ের মতো কারণ তোমার বয়সি আমার একটা মেয়ে আছে।”

আড়চোখে তাকিয়ে আবার বলে, “কেন জানি না তোমার ব্যপারে জানতে খুব ইচ্ছে করছে”
পাখি পর পর দুটো ঢোক গিলে বলে,”আমার বাবারা দুই ভাই ছিলেন।সিলেট মৌলভীবাজারে শান্তিনগর গ্রামে(ছদ্ম নাম) আমাদের বাড়ি।আমার দাদু ভাই মারা যাওয়ার আগে দুই ভাইকে সম্পত্তি সমান অংশে ভাগ করে দেন।আমার বাবার আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম।আর আমার বড় বাবার দুইজন ছেলে আরেক জন মেয়ে ছিলো ইরা।বড় ছেলে বিদেশে পড়াশুনা করত।ছোটজন বাড়িতেই থাকত। আর ইরা আমার এক বছরের ছোট ছিলো।

দাদু মারা যাবার পর বড় বাবা আর তার ছেলে আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় আমরা যেন ঐ সম্পত্তি ওদের নামে লিখে দেই।দাদিমা বেঁচে ছিলেন বলে ওরা তেমন মাথাচাড়া দিতে পারত না।আমার বাবা সেটা কিছুতেই করতে নারাজ।বাবা একদিন স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেয়।তখন আমি অনেক ছোট।

একদিন বাবা মা সহ আমি ঘুরতে গেছিলাম।আমাদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করে ঘটনাস্থলেই বাবা মা আমায় একা রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। আমি হয়ে গেলাম একা”,এটুকু বলতেই পাখির চোখের কোণ ভরে আসে।
আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”এরপর এসে জুটলাম বড়মা’র সংসারে।বড় মা কাজের দুটো মেয়েকে ভাগিয়ে আমায় বানালেন বাড়ির কাজের লোক।সকালকার এঁটো বাসন থেকে শুরু করে রাত্রে বেলা বড় মার পা টিপে দেয়া পর্যন্ত সংসারের খুঁটিনাটি আমাকে দিয়েই করাতেন।অথচ আমি কিছুদিন আগেও বাবার রাজকন্যা ছিলাম।কখনো রান্নাঘরের ধারে কাছেও যেতে দিতো না বাবা।মা বললে বলত’বিয়ের সময় আমার মেয়ের সাথে দরকার পরলে কাজের লোক পাঠাব। তবুও মেয়েকে কাজে দিবো না’
এমন ছিলো আমার বাবা”

রাহেলা অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।কিছু একটা পোড়ার গন্ধ পেতেই বলে,”একটু থামো মা,আমি তরকারিটা নামিয়ে রেখে আসি”

রাহেলা যাওয়ার পর পাখি হাতের কাপটা রেখে ওড়নার আঁচলে চোখের কোণা দুটো মুছে নেয়।ইতোমধ্যে আবার রাহেলা এসে এবার পাখির পাশে বসে বলে, “তারপর?”
“জানো চাচি আমাকে একটু আদোর করবার মতো কেউ ছিলো না।ধীরেধীরে বড় হচ্ছিলাম আর বড় মা”র নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলছিলো।ইরা একটু ভালোবাসত তবে ওর মাকে ও প্রচন্ড ভয় পেত।বড় মা সবটা সময় তার ছেলে মেয়েদের ভালো ভালো খাওয়াতো।আর আমার জন্যে বরাদ্দ ছিলো সবজি।খুব কষ্ট করে বড় মা’র সংসারে সবজি খাওয়া শিখেছিলাম।
বড় মা খোঁটা দিয়ে দিয়ে বলত আমি নাকি তার অন্ন ধ্বংস করছি।তার স্বামীর পয়সায় চলছি।অথচ বাবা মা মারা যাবার পর সমস্ত সম্পত্তির ভোগ তারা করত।এভাবে সারাটাদিন খেটে রাত্রে একটু সময় পেতাম বইটা ধরার।সেই চেষ্টায় মাধ্যমিকটা দিলাম।রেজাল্ট এসেছিলো এ+

কিন্তু আমায় মিষ্টি খাওয়ানোর মতো কেউ ছিলো না।বড় মা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলত ‘ওতো পড়ে কি করবি?হবি তো আমার রায়ানেরই বউ’
রায়ান ছিলো আমার বড় বাবার ছোট ছেলে।পৃথিবীর এমন কোন খারাপ কাজ নেই যেটা সে করত না।নেশা করা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি। সব করত সে।বড় মা, বড় বাবা বলতো’ছেলেরা এমন একটু আকটু করে’

ততোদিনে দাদিমাও আমায় ছেড়ে চলে গেলেন।একদিন আমি রান্নাঘরে ঘুমিয়ে আছি। রাতের বেলা হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার পায়জামায় হাত দিয়েছে।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বুঝতে পারি সেটা রায়ান ভাই ছিলো।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছিলো।কারণ ভাই তখন নেশা অবস্থায় ছিলো।আমি না পারছিলাম চিৎকার করতে, না পারছিলাম চুপ থাকতে।হঠাৎ ইরা পানি নেয়ার জন্যে নিচে নেমে এসে রায়ান ভাইকে আর আমায় দেখে। আমি দৌড়ে ইরার কাছে চলে যাই।
পরদিন ইরা বাড়িতে সবটা বলে সবাইকে।কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।সবার মাঝখান থেকে বড় বাবা বলেছিলো’এরকমই যদি হয় তবে বিয়ে দিয়ে দিই ওদের দুজনের’
কারণ আমার বড় মা, বড় বাবার আসল উদ্দেশ্যই ছিলো আমার নামে দেয়া সম্পত্তি গুলো।রায়ানের সাথে বিয়ে হলে তখন যেভাবেই হোক সম্পত্তি গুলো তারা পেয়ে যেত।আমি আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে বিয়েটা সে বার আটকে দেই।অনেক বার অনেক টর্চার করে আমার উপর আমি আইনের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে কিছুদিন দমিয়ে রাখতে পারতাম।

সেদিনের পর থেকে আমি ইরার সাথে ঘুমাতাম।দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো দুইটা বছর।তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের পরিক্ষা দিই।তখন আয়ান ভাইয়া বিদেশ থেকে চলে আসে।দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার যোগ্যতা।যেকোন মেয়েই ওর জন্যে পাগল ছিলো।
আমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো সেদিন আমি পরিক্ষা দিয়ে বাড়ি আসি।আমায় দেখে ভাইয়া সেদিন মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলো।কিছুদিন যেতে না যেতে আমার প্রতি ভাইয়ার অন্যরকম যত্ন বুঝতে পারলাম।মনে মনে খুব শান্তি পেতাম এই বুঝি একটু সুখের সন্ধান পেলাম।

একদিন ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে ইরাকে দিয়ে প্রেম পত্র দিলো।আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না। কারণ ভাইকে কোনদিন অন্য নজরে দেখিই নি আমি।ভাইয়ার আসার পর রায়ান আমায় দেখলে মাথা নিচু করে হাঁটত।আয়ান ভাই সবসময় সব বিপদ থেকে আমায় বাঁচাত।এমনকি বড় মাও ভাইয়ার ভয়ে আমায় কোন কাজ করতে দিতো না।আমার জীবনে সবটাই যেন আগের মতো হতে থাকলো।”

পাখি থেমে গিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, “জানো চাচি ঘুটঘুটে আঁধারে সামান্য একটু আলো দেখলেই সেটা ধরে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করে!”
“তুমি জীবনে এতো কষ্ট সহ্য করেছো মা?”,বলতে বলতে রাহেলা হাত বুলিয়ে দেয় পাখির মাথায়।আবার প্রশ্ন করে, “তারপর কি হলো?”

“ভাইয়ার ব্যবহার আচার আচরনে দিনদিন আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।বলতে গেলে একটু একটু দূর্বল হয়ে পরেছিলাম।আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ভাইয়া আবারও তখন ইরাকে দিয়ে প্রেম পত্র দেয়।আমি আর না করি নি।শর্ত দিয়েছিলাম আমার অনার্স কমপ্লিট হবে তারপর বিয়ে।ভাইয়া আমার শর্তে রাজি হয়েছিলো।কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলো।বই কিনে দিলো।আমার সারাদিনের এ টু জেড সবটাই আয়ান ভাইয়া খেয়াল রাখত।একই বাড়িতে থাকতাম অথচ এর মাঝে একদিনও ভাইয়ার কোন অশোভন আচরন আমি পাই নি।এইটা আমায় তার প্রতি বেশি দূর্বল করে তুলত।

তিনটা বছরে আমি ভাইয়ার প্রতি এতো বেশি দূর্বল হয়ে পরেছিলাম কি বলব তোমায়!
আমার নিঃশ্বাস নেয়াও যেন আয়ান ভাইয়ের অনুমতিতে চলত।এতো ভালোবেসে ফেললাম।বড় মা দুটো মেয়েকে আবার কাজে দিলো।কারণ আয়ান ভাই আমায় কোন কাজে হাত দিতে দিতোই না।আয়ান ভাইয়ের মতো একজনকে জীবনে পাবো ভাবিও নি কখনো।এমনি এক সন্ধ্যেবেলা আমি নিজেই আয়ান ভাইকে বলি ‘বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়’
ভাই সেদিন বলেছিলো ‘মাস্টার্স পড়বি না?’
আমি হেসে বলেছিলাম’তোমার মতো কেউ জীবনে থাকলে কোন মেয়েরই চাকরির দরকার পরবে না’
কি জানো তো চাচি, বড্ডো বোকা ছিলাম আমি

তার তিনদিন পরই খুব ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করে আয়ান।আমায় পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে দিয়ে গেছে।বাহিরে আয়োজন চলছে।এরমাঝে আমার রানি মাসি।ওহহ রানি মাসির কথা তো বলাই হলো না তোমায়।
আমার বাড়িতে কাজ করত সনাতনধর্মের একজন মহিলা।নাম রানি। আমি ছোটবেলা থেকে রানি মাসি বলে ডাকি।বলতে গেলে তিনিই আমায় ছোটবেলা থেকে বড় করেছেন।মাকে কোন কাজ করতে দিতো না।আমাদের বাড়ির সব কাজ তিনি করতেন।

তো রানি মাসি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে এসে বললাম, “মাসি তুমি! এই সময়!কি হয়েছে?”
তারপর রানি মাসি যা বলল তা আমি জীবনে কোনদিনই ভাবতে পারি নি চাচি।
আয়ান নাকি সবটাই করেছে শুধুমাত্র আমার সম্পত্তির লোভে।সে বিদেশে বিয়ে করেছে ওর একটা বাচ্চাও আছে।বড় বাবা, বড় মা ওকে যখন সব কথা বলে তখন সে কৌশলে দেশে চলে আসে আমার সাথে ভালোমানুষির নাটক করে আমায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে। তারপর বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সাইনের বদলে জমির দলিলে সাইন করিয়ে নিতো।তাদের প্ল্যান ছিলো কৌশলে জমি হাতিয়ে নিয়ে রায়ানের সাথে বিয়ে দেয়া আর তারপর আয়ান পূনারায় বিদেশ চলে যেত।

আমি রানি মাসির কোন কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আবার রানি মাসি এমন একজন মানুষ যাকে অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না।রানি মাসি বুঝতে পেরে আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় যেখানে স্পষ্ট লেখা ‘আমি আমার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি আমার স্বামী রায়ানের নামে লিখে দিলাম’
আমার গা হাত পা কাপা শুরু করেছে ভীষণভাবে।আমি ভাবতেও পারি নি এরা আমায় এভাবে ধোকা দেবে!

রানি মাসি সেদিন আমায় বলেছিলো আমি যদি কোনভাবে সবটা জেনে যাই, বিয়েতে মত না দিই তাহলে নাকি আয়ান নিজে হাতে আমায় খুন করত।সেটাও বিশ্বাস করি নি আমি।তখন রানি মাসি একটা ভিডিও আমার সামনে এগিয়ে দেয়।সত্যিই সেখানে বড় বাবাদের পরিবারের সবাই আমায় মারার প্লানটাই করছিলো।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।এদিকে আমাকে বিয়ের আসরে নেয়ার জন্যে মেয়েরা দরজা ধাক্কাচ্ছিলো।রানি মাসি আমায় তখন হাতে একটা ফোন আর একটা ছোট্ট কাগজ হাতে দিয়ে বলেছিলো,”এটা আমার বোনের ঠিকানা।আর এই ফোনটা সাথে রাখবি ”
বলেই পিছন দরজা দিয়ে আমায় বের করে দিয়ে নিজেও ঐ দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে।বুঝতেছিলাম না আমি কি করব!দিগ্বিদিক না ভেবে শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।আমাদের এলাকা থেকে মেইন সরক বেশটা দূরে।দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে মেইন সরকে এসেছি বুঝতে পারি না।ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রাস্তায় কোথাও কোন গাড়ি নেই।অনেকটা দূরে দুইটা আলো দেখা যাচ্ছে।ভয় ভীতি একপাশ করে দৌড়ে ছুটে এসে দেখি একটা কার।আর একটা ছেলে গাড়ির বনেট তুলে ইঞ্জিন দেখছে।আমি অনেক অনুরোধ করি আমায় সাহায্য করার কিন্তু করে নি।”

বলতে বলতে থেমে যায় পাখি।শানের সেদিনের ব্যবহারের কথা মনে উঠতেই খুব রাগ হয় সাথে কষ্টও হয়।রাহেলা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না মানুষ সম্পদের লোভে কতোটা জঘন্য হতে পারে!

“তারপর কিভাবে এলে? ”
পাখি রাহেলার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,”যাকে অনুরোধ করি তিনি ছিলেন গাড়ির ড্রাইভার।উনার হয়ত একটু মায়া হয়েছিলো পরে আমাকে গাড়িতে বসা তার মালিকের কাছে পাঠায়।আমি এগিয়ে এসে তাকেও অনুরোধ করি কিন্তু তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় ‘নো’।মানে তিনি সাহায্য করতে পারবেন না।পরে উপায়ান্তর না পেয়ে আমি তার গাড়ির ডিকিতে উঠে পরি।আর তারপর তো এখানে….”
বলতে বলতে গলার স্বর নিচু হয়ে আসে পাখির।
রাহেলা অবাক হয়ে বলে, “তারমানে সেদিনের ঐ লোক শান বাবা তাই না?”
ক্ষীণস্বরে পাখি জবাব দেয়,”হু”
“তারমানে ড্রাইভার ছিলো রাফি”,আনমনে ভাবে রাহেলা।

রাহেলা বুঝতে পারে না এই মূহূর্তে কি বলা উচিত তার।পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”একটা কথা বলি আজ।শান বাবা খুবই ভালো মানুষ।তবে মেয়েদেরকে তিনি দুই চোক্ষে দেখতে পারে না।ওটা ব্যপার না।দেখবে ও তোমার অবস্থাটা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে”
পাখি ছলছলে তাকিয়ে বলে,”উনার জীবনে কি আছে আমি জানি না চাচি। জানতে চাইও না।আমার জীবনেও তো এতোবড় একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি তাই বলি আমি কি দুনিয়ার সব ছেলেকে এক মনে করব?সবাই তো আর খারাপ হয় না।”

রাহেলা পাখির তিলটা দেখে মনে মনে ভাবে,”কেমনে কই তোমারে গো মা। এমনিই মেয়েদের পছন্দ করে না।তারউপর তোমারও ঐ একই জায়গায় তিল এটা যে ওর জন্যে কতোটা কষ্টদায়ক সেটা আমি জানি”

ওদের কথার মাঝখানে শান দুইবার গলা ঝেড়ে কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।পাখি সেদিকে না তাকিয়েই সোজা উপরে ইনায়াহ্’র ঘরে চলে যায়।শান হতভম্বের মতো পাখির যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে।রাহেলা শানের দিকে চেয়ে ভাবে,”জীবনে যা কিছু হয় সবটার পিছনে কিছু না কিছু ভালো কারণ থাকে”

চলবে….