আসক্তি২ পর্ব-০৯

0
2434

#আসক্তি২
পর্বঃ০৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে স্কুল খুলেছে ইনায়াহ্’র।সকাল বেলা শান নাস্তার এক ফাঁকে আব্দুল্লাহ্ ডেকে বলে, “চাচা ইনায়াহ’কে স্কুলে দিয়ে আসবেন।ওর স্কুল খুলেজে প্রিন্সিপালের কল এসেছিলো কাল রাতে”
“আচ্ছা বাবা”,শানের করা আদেশে সম্মতি জানায় আব্দুল্লাহ।
ইনায়াহ্ মলিন মুখে বলে,”আমি মুন সাইনের সাথে যাবো।”
শান ভ্রুকুচকে তাকায় ইনায়াহ্’র দিকে ।তাকিয়ে বলে,”তুমি না গুড গার্ল। আগের মতো স্কুলে যাবা, আবার রাফি চাচ্চুর সাথে বাড়ি চলে আসবা।ব্যাস!”
শানের কথায় ইনায়াহ্ একরোখা কন্ঠে জবাব দেয়,”না,মুন সাইন সাথে যাবে।”
গাল ফুলিয়ে ইনায়াহ্ অভিমানী সুরে বলে,”আমার সব ফ্রেন্ডসদের মা আসে তো।সারাক্ষন থাকে।ছুটির সময় আবার চলে যায়”

শানের ভিতর টা মোচর দিয়ে ওঠে ইনায়াহ্’র কথায়।শান্ত ভঙ্গিতে বলে,”মাম, এতো জিদ করতে নেই মাম।ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।প্লিইইজ!”
“নো “,ছলছলে চোখে বলে পাখির কোমড় জড়িয়ে কেঁদে ফেলে ইনায়াহ্।
এতোক্ষন পাখি চুপ থাকলেও আর নিজেকে চুপ রাখতে পারছে না।হাঁটু গেড়ে নিচে বসে দুহাতে ইনায়াহ্’র চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”এতোটুকুর জন্যে কেউ কাঁদে?যাব তো আমি”
খুশিতে গদগদ হয়ে ইনায়াহ্ পাখির গলা জড়িয়ে ধরে।পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে শানও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।নজর সরিয়ে পাখি বলে,”বেবি,এবার তাহলে কী করতে হবে আমাদের বলো তো?ঝটপট রেডি হতে হবে তো নাকি!”
ইনায়াহ্ খুশি খুশি বলে,”ওকে।চলো আমরা রেডি হই”

পাখি ইনায়াহ্’কে কোলে জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় উপরে।

🌸🌸

সকাল আট বাজতে এখনো পনের মিনিট বাকি আছে।এর মাঝেই পাখি ইনায়াহ্’কে নিয়ে পৌঁছে যায় তার স্কুলের গেইটে।রাফি তাদের গেইটে নামিয়ে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় বাড়িতে।কারণ শানকে হসপিটালে ড্রপ করতে হবে।রাফিকে বিদায় জানিয়ে পাখি স্কুলের ভিতরে ঢোকে।একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে।সব টিচার রা অনেক বেশি ফ্রেন্ডলি। কিন্ডারগার্টেনের টিচার বলে কথা।সবার ব্যবহারই অনেক মিষ্টি। পাখি ইনায়াহ্’কে তার ক্লাসে বসিয়ে প্যারেন্টস ওয়েটিং জোনে অপেক্ষা করে।সেখানে অনেক ছেলে মেয়েদের মায়েরা বসে বসে খোসগল্প করছে।মাঝে মাঝে দু একজন বাবাদেরও দেখা যাচ্ছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা অনেক আগে থেকেই পরস্পরের সাথে পরিচিত।সবার মাঝে পাখির নিজেকে একলা লাগে। কারণ আজ প্রথম দিন ;কাউকেই চিনছে না সে।

হঠাৎ কারো কথায় পিছু ফিরে তাকায় পাখি।
“এক্সকিউজ মি!”
“জ্বি,আমাকে!”,হেসে জবাব দেয় পাখি
মিষ্টি চেহারার সুমধুর কন্ঠের অধিকারী একজন মেয়ে বলে,”হুমম হুমম আপনি”
পাখি উঠে যায় সেদিকে।মেয়েটা তাকে হাত টেনে নিয়ে যায় বেশ নিরিবিলি একটা জায়গায়।
” ইনায়াহ্’র কি হোন আপনি?”
“জ্বি আমি ওর গভারনেস”
“ওহহ আচ্ছা আচ্ছা।ও খুব মিষ্টি মেয়ে আর অনেক সুইট একটা বাচ্চা”
পাখি ঠোঁটের হাসি এলিয়ে রাখে।
“সবার মাঝে আপনাকে দেখলাম একা একা বসে আছেন।আমি রাখি ;ইনায়াহ্’র টিচার”
পাখি মুচকি হেসে বলে,”আমি পাখি”
“ওয়াও আমাদের নামে কতো মিল বলেন!আপনি কি করেন;আই মিন এমপ্লোয়ি নাকি হাউজ ওয়াইফ?”
পাখি মূহূর্তে ভাবনায় পরে যায়।তার কি বলা উচিত?
“আমি অনার্স কমপ্লিট করেছি এই বছরই।আর ….”
“ওহহহ বুঝেছি, অনার্স করলেন ভেবেছেন মাস্টার্সের আগে কয়েকমাস জব করবেন, তাই তো?আরে আমিও তো এবার অনার্স করলাম।তারমানে আমরা ফ্রেন্ড!”
পাখি হাসি হাসি ভাব ধরে রেখে ক্ষীণস্বরে বলে,”হুমম, তাই তো”
মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,”একদম।তাহলে তোমায় তুমি করেই বলি।বিশ্বাস করবা না,বাড়িতে একা একা কি বোরটাই না হচ্ছিলাম পরে স্কুলে জয়েন করলাম।ছোট বাচ্চা আমার ভীষণ ভালো লাগে।ভাবলাম সময়টা কাটবে সাথে আম্মুরও একটু হেল্প হবে।ওহহহ তোমায় তো জানানোই হলো না,আমি স্কুলের প্রিন্সিপালের মেয়ে।আমাদেরই স্কুল এটা।আব্বু গত হবার পর আম্মুই দেখাশোনা করছে”
“ওহহহ আচ্ছা”,শুকনো জবাব দেয় পাখি।

পাখির সবটা বুঝতে সময় লাগলো না।সাথে এটাও বোঝার বাকি রইল না রাখি কি পরিমানে বেশি কথা বলে।তবুও কোথাও যেন ভালো লাগা কাজ করলো এটা ভেবে যে, যাক কেউ তো একজন বন্ধু টাইপ হলো।

“এই তোমার ফোন নম্বর দাও,ফেসবুক আইডি দাও,ইমো,হোয়াটস’এপ,টুইটার,ইন্সটা সব দাও”,বলতে বলতে রাখি ফোন বের করে।
পাখি আমতা আমতা করে বলে,”আমার কিছুই নেই”
“হোয়াটট?লাইক সিরিয়াসলি?এটা একবিংশ শতাব্দী ম্যাম!আর তুমি বলছ কিনা! হ্যাহহ”,হাফ ছেড়ে রাখি আবার সন্দিহান চোখে পাখির দিকে চেয়ে বলে,”ওয়েট ওয়েট, বাই এ্যানি চাঞ্ছ কোন ভাবে তুমি আমার উপর বিরক্ত হলে না তো গত চার ঘন্টায়!তাই নম্বর দিচ্ছো না। বা একাউন্ট?”
“সেরকম টা একদমই নয়।আর আপনার কথা গুলো আমার খুব ভালো লেগেছে”,প্রসস্ত ঠোঁটে জবাব দেয় পাখি।
“আপনি!”
“সরি,তুমি”
রাখি হেসে বলে,”তাহলে দিবা না?”
“আমি সত্যিই ফোন ব্যবহার করি না। ওসব একাউন্ট তো দূরের কথা ”
“তোমার বাড়ি কোথায়?মনে হচ্ছে না তুমি ঢাকার বা তার আশেপাশের,”চোখ ছোট ছোট করে বলে রাখি।
পাখি শুকনো মুখে জবাব দেয়,”সিলেট”
“সিলেট!এখানে কিভাবে?”
রাখির প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই স্কুলের বেল পরে যায়।বাচ্চারা ছুটে মায়েদের কাছে যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার লোভে।
পাখি হেসে বলে,”সব কথা একদিনে শেষ করলে বাকিদিন কী বলব?”
“আমার কথা আজীবনেও ফুরাবে না”,হেসে জবাব দেয় রাখি।
এরপর রাখিকে বিদায় জানিয়ে গেইটে পা রাখতেই রাফি গাড়ি নিয়ে চলে আসে।পাখি ইনায়াহ্’কে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসায়।পনের বিশ মিনিট পরে গাড়ি পৌঁছে যায় আহমেদ ম্যানশনের সামনে।

দিনে দিনে রাখির সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে পাখির।পাখি স্কুলে পা রাখার পরপরই শুরু হয় রাখির ননস্টপ বকবক।এরপর ছুটির ঘন্টার সাথে সাথে ইনায়াহ্’কে নিয়ে আসা পর্যন্ত চলতে থাকে সে বকবকানির রেশ।পাখির অবশ্য মন্দ লাগে না।এ কথায়,ও কথায় সময় গুলো পার হয় বেশ ভালোভাবেই।

🌸🌸

প্রতিদিনের মতো পাখি আজও ইনায়াহ্’কে সাথে নিয়ে যায় স্কুলে।ক্লাসে বসিয়ে দিতেই রাখি এসে হাত টেনে নিয়ে যায়।একটা ফাঁকা রুমে নিয়ে বলে,”সত্যি করে একটা কথা বলবে?”
পাখি হকচকিয়ে বলে,”কি কথা?”
“ডক্টর শান কী হয় তোমার?”
পাখি বুঝতে পারে আজ রাখিকে সবটা বলতে হবে।এরপর অনেক ভেবে নিজের জীবনের সাথে হওয়া সমস্ত ঘটনা রাখিকে খুলে বলে।
হা করে চেয়ে থাকে রাখি।ছলছলে চোখে বলে,”তুমি এতোটা সয়েছো জীবনে?অথচ আমরা সামান্য কিছুতেই হাফিয়ে গিয়ে মৃত্যু কামনা করি; ইভেন সুইসাইড এটেম করি।”
পাখি অপলক চেয়ে শুনে যায় রাখির কথা।
রাখি ঝনঝনে গলায় বলে,”আজ থেকে ধরে নাও তোমার একটা পার্মানেন্ট ঠিকানা তুমি পেয়ে গেছো।নেক্সট টাইম যখনি ঐ ডাক্তার সাহেব বকে দেবে তুমি আমার কাছে চলে আসবে। ইনায়াহ্’কে নিয়েই এসো; চুরি করে।”,বলেই ফিক করে হেসে দেয় রাখি।দুজনেই হেসে কুটিকুটি হয়।

🌸🌸
বিকেল বেলা ইনায়াহ্’কে সাথে নিয়ে বাড়ির পাশে রাস্তার দিকে হাঁটতে বের হয় পাখি।শহর থেকে কিছুটা দূরে আহমেদ ম্যানশন।বেশ নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন একটা এলাকা।রাস্তার পাশে কয়েকটা খাবারের ছোট ছোট দোকান।সেগুলো দেখিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”মুন সাইন চলো ঝালমুড়ি খাবো”
পাখি ইনায়াহ্’র দিকে চেয়ে বলে,”খাবা?ওকে চলো”
বলেই দোকানের দিকে হাঁটা ধরে।কিছুদূর যেতে থমকে যায় পাখি।
“কি হলো চলো না, থামলে কেন?”
“বেবি,টাকা তো নাই আমার কাছে”,মুখটা মলিন করে বলে পাখি।
“তুমি আসো তো”,বলে পাখির হাত টানতে টানতে নিয়ে যায় ইনায়াহ্।সাথে সাথেই একজন লোক পাখির একদম গা ঘেঁষে ফোনে কথা বলতে বলতে চলে যায়।পাখি রাগি চোখে তাকিয়ে পিছন ফিরে দেখে লোকটা অনেকটা দূর চলে গেছে মূহূর্তেই।পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না লোকটা কোন ব্যস্ততার মাঝে আছে।তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে ইনায়াহ্’র সাথে দোকানে চলে যায়।

🌸
“হ্যা, হ্যা প্লিজ এ্যারেইঞ্জ দ্য মিটিং । আ’ম কামিং”,ফোনে বলতে বলতে শান বাড়িতে ঢোকে।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ বাসায় নেই।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে সন্ধ্যা হচ্ছে ধীরেধীরে।
ক্ষীণস্বরে ইনায়াহ্’কে ডাকে,”মাম্মাম কোথায় তুমি?,মাম?”
কিন্তু কোন সাড়া পায় না।পুরো বাড়ি, ছাদ সবখানে খোঁজে শান বাধ্য হয়ে দারোয়ানকে ডেকে বলে,”ইনায়াহ্ কোথায় সালাম ভাই?”
“ইনায়াহ্ বেবি তো পাখি ম্যাডামের লগে বাহিরে গেছে অনেকক্ষণ আগে।সেই বিকেল বেলা।এক ঘন্টা অইব”,জবাব দেয় দারোয়ান সালাম।
শানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে যায়,কারণ পাখি এই এলাকায় নতুন।তেমন কিছু চেনে না।তারউপর ইনায়াহ্’র ব্যপারে সে কারোর উপর অন্ধবিশ্বাস করতে চায় না।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছয়টা বিশ বাজে।সাতটায় মিটিং আছে হোটেল জিহায়।শান আগপিছ ভেবে গোসল সেড়ে রেডি হয়ে নেয় মিটিং এর উদ্দেশ্যে।সদর দরজায় পা রাখতেই পাখি ইনায়াহ্ সমেত বাড়িতে হুরমুর করে ঢুকে পরে।ধাক্কা লেগে যায় শানের বুকের সাথে।হকচকিয়ে ওঠে শান।এদিকে মুখের সামনে কাউকে বুঝতে পেরে একটু সাহস সঞ্চার হয় পাখির মনে।ইনায়াহ্’র হাত চেপে রেখেই সামনে তাকাতে বুঝতে পারে শানকে।কিছুক্ষন নিষ্পলক চাহনীতে চেয়ে থাকে। শান রেগে গিয়ে বলে,”কোথায় ছিলে এতো সময়?”
পাখি পূর্বের ন্যায় চাহনীরত অবস্থাতেই গোটা শরীরের ভার ছেড়ে দেয় শানের বুকের উপর।সবটাই যেন চোখের পলকে ঘটে যায়।ঘটনার আকষ্মিকতায় শান ভরকে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই পাখি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

এভাবে নারী স্পর্শ এই প্রথম না। অনেক সময় কলিগ,মেয়ে ফ্রেন্ডসদের সাথেও হাগ করেছে শান।কিন্তু ইতোপূর্বে আজকের মতো কোন অনুভূতির সন্ধান শান পায় নি।শিড়দাড়া দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেলো।পুরো শরীর যেন জমে বরফে হয়ে গেলো মূহূর্তেই।রাগের অন্তরালে মনের মাঝে লুকানো অনুভূতিগুলো আজ একসাথে দলবেঁধে বের হতে চাইছে।এই মূহূর্তে লাগামহীন সে অনুভূতির রাশ কেন জানে না শানের ধরতে ইচ্ছে করছে না।অচেতন পাখির গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে শানের শার্টের ঠিক উপরের দুটো বোতামের নিচের ফাঁকা জায়গাটায়।সে নিঃশ্বাস কাউকে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার বানাবার ক্ষমতা রাখে।

“মুন সাইন, এই মুন সাইন কি হলো তোমার?”,পাখির জামার কোণ ঝাকিয়ে বার বার বলছে ইনায়াহ্।
শানের ধ্যান ফিরে আসে পরোক্ষণে।ভাবনার বেরাজাল থেকে বেরিয়ে এসে হন্তদন্ত হয়ে শান বলে
“হে হোয়াট হ্যাপেন্ড?হে?”
পরপর কয়েকবার ডেকেও কোন সাড়া পায় না শান।উপায়ন্তর না পেয়ে চট করে কোলে তুলে নেয়।নেতিয়ে পরা পাখির আরেকটা হাত তখনো ইনায়াহ্’র হাতকে শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে।সেদিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায় শান।আনমনে ভাবতে থাকে,”পুরোপুরি অবচেতন অথচ হাতটা কিভাবেই না শক্ত করে রেখেছে”
হাত ছড়িয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় শুইয়ে দেয় পাখিকে।

কিছুক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারে হার্ট অনেক দ্রুত বিট করছে।হয়ত কোন ব্যপারে আতঙ্কিত থেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।চট করে ইনায়াহ্’কে কাছে টেনে বলে,”মাম্মাম কি হয়েছিলো?”
“আমরা ঝালমুড়ি খেতে যাব আমাদের কাছে কোন টাকা ছিলো না বলে দাঁড়িয়ে যাই।তখন একটা পচা লোক মুন সাইকে ধাক্কা মেরে চলে যায়।তারপর যখন আমরা আবার দোকানে গেছি তখন লোকটা আমাদের পিছুপিছু দোকানে চলে যায়।বার বার দূর থেকে ঘুরে ঘুরে মুন সাইনকে দেখছিলো।লোকটাকে দেখে মুন সাইন যেন কেমন করছিলো।ঝালমুড়ি ওয়ালা মামা আমায় দেখে বলল’টাকা লাগবে না’
আমি বলেছি সান সাইন দেবে।তখন ঐ লোকটা এসে বলল’আমি দেব’।তারপর যে কি হলো!মুন সাইন লোকটাকে দেখে আমায় কোলে তুলে নিলো আর তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।আমরা হাঁটি লোকটাও হাঁটে।আমরা দৌঁড়ালে লোকটাও দৌঁড়ায়।এরপর আমরা দৌড়ে যখন বাড়ির সামনে আসি তখন মুন সাইন আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বাড়ির ভিতরে দৌঁড়াতে থাকে।আর দারোয়ান আঙ্কেল লোকটাকে আটকে দেয়। মুন সাইন তবুও দৌড়াচ্ছিলো।”

ইনায়াহ্’র কথায় শান ভাবনায় পরে যায়।
“এলাকায় মোটামুটি সবাই মাম্মাম কে চেনে তাহলে এমন কে? যে ওদের এভাবে তাড়া করবে?আর পাখিই বা কেন এতো ভয় পেলো?”,ভাবতে ভাবতে পাখির অবচেতন মলিন মুখটার দিকে তাকায় শান।কেমন যেন বুকের ভেতরে অজানা আকুতি জেগে ওঠে।মায়াভরা মিষ্টি মুখটা নিজের চিন্তা চেতনাকে আরো বেশি অবাধ্য করে তোলে।
“এক গ্লাস পানি আনো তো মা”,ইনায়াহ্’কে পানি আনতে পাঠিয়ে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে পাখিকে।
কিছুক্ষন পর ইনায়াহ্ পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।শান গ্লাস থেকে পানি নিয়ে পাখির চোখে মুখে ছিটাতেই ভ্রুকুচকে আসে পাখির।ধীরেধীরে চোখ পিটপিট করে খোলার চেষ্টা করে।খানিক সময় পর পুরোপুরি চোখ খুলে উঠে বসে পাখি।আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে সে এখন বাড়িতে আছে।ভয়ে যেন গলা কাঠ হয়ে গেছে তার।

“কি ব্যপার, কি হয়েছিলো তোমার?”,একটু এগিয়ে এসে শান্ত স্বরে জানতে চায় শান।চোখের সামনে চেনা অবয়ব দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না পাখি। ভয়ে সিধিয়ে গিয়ে শানের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ।তখন তড়তড় করে কাঁপছিলো পাখির চোখের পাতা।কোণভরা জল যেন পলক ফেললেই টপকে পরে যাবে দু’গন্ড বেয়ে।শান পাখির কাজে অবাক হয়ে যায়।চট করে নিজের হাতের দিকে তাকায়।
“আ আ আয়ান,আয়ান ভাই এখানে”,বলতে বলতে চোখের জল ছেড়ে দেয় পাখি।
শানের কথার অপেক্ষা না করে পাখি ভয়ার্ত চোখে বলে,”আমি জানি ও এবার আমায় বাঁচিয়ে রাখবে না।জানি তো।”
“আমার জীবনটা এমন ছিলো না ডাক্তার সাহেব।কেন এমন হলো?কেন সবাই শুধু আমাকেই কষ্ট দেয়”,পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে শানের হাতজোড়ার সাথে কপাল ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলে পাখি।যে কান্নার স্বর বড্ডো করূন থেকে করূনতর হচ্ছে সময়ের স্রোতে। বুকের বাঁ পাশের কোথাও যেন সে কান্নার শব্দটা বন্ধ দরজায় জোড়ে জোড়ে করাঘাতের মতো আঘাত করছে।কোন মেয়ের কান্নাই আজ পর্যন্ত এতোটা নাড়া দিতে পারে নি শানের মরিচা পরা সে দরজায়।

শান বুঝতে পারে না এই মূহূর্তে কি করে পাখিকে শান্তনা দেবে।ডান হাতটা উঠিয়ে পাখির মাথায় রাখতে যাবে এমন সময় ইনায়াহ্ এসে পাখির মাথায় হাত রেখে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”ও মুন সাইন, এমন করে কেঁদো না প্লিজ।ওই পচা লোককে তো সান সাইন এক ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবে।তাই না বলো?”,শানকে ইশারা করে বলে ইনায়াহ্।
শান শুকনো মুখে চেয়ে থাকে ইনায়াহ্’র দিকে।পাখি হঠাৎ মাথা তুলে দুহাত সিটকে সরে যায়।
“কি করছিলাম আমি একটু আগে?”,ভাবতেই কেমন বিব্রত লাগে পাখির।নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে হাঁটু জড়িয়ে নেয়।ইনায়াহ্ এগিয়ে এসে পাখির চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”ঐ পচা লোক কিচ্ছু করবে না মুন সাইন।আমি আছি তো”

পাখি ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।শান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”দেখছি ”
পাখির দিকে তাকিয়ে আবার বলে,”বাড়িতে সাবধানে থেকো।একটুপর তো রাহেলা চাচি চলে আসবে।আমি না আসা পর্যন্ত চাচিকে যেতে দেবে না”
পাখির কোন উত্তর না পেয়ে শান জড়িয়ে আসা গলায় বলে,”আমার জরুরী মিটিং আছে, আসছি”
বলে শান দ্রুত বাড়ির বাহিরে চলে আসে।এসে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে।বুকের ভিতরের আটকে রাখা ল্যাবডাব যেন বাহিরে থেকে শোনা যাচ্ছে।হাঁফরের মতো বুকের ছাতি উঠানামা করছে শানের।দুহাতের দিকে তাকিয়ে পাখির স্পর্শটা অনুভব করার চেষ্টা করে বার বার।

দ্রুত মাইন্ড ডাইভার্ট করে গাড়ির কাছে ছুটে যায়। গাড়ি চালিয়ে গেইটে পৌঁছে থেমে সালামকে ঐ লোকের ব্যপারে জিজ্ঞেসা করে।সালাম বিনয়ীভাবে জানায়,”স্যার,পাখি ম্যাডাম বাড়িতে ঢোকার পরপর ছেলেডা আমারে ধাক্কা মাইরে চলে যায়”

কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে শান গেইট খুলে দিতে বলে সালামকে।

চলবে….