এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-০৭

0
220

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“ধূর! অনিক সিরিয়াস নাকি অয়ন্তীকে নিয়ে! অনিকের তো এক মেয়েতে হয়না! তার প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে চাই। কিছুদিন আগেও তো শুনলাম একটা মেয়েকে এবর্শন করানো হয়েছে। মেয়েটির নাম সম্ভবত প্রিয়া!”

অবিলম্বেই আরিফের শার্টের কলারটি ছেড়ে দিলো রাফায়াত। সিগারেটের জ্বলন্ত বাকী অংশটুকু নির্দ্বিধায় তার বাঁ হাতের তালুতে চেপে ধরল! মাথা নুইয়ে সে জংলী সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস শব্দে গোঙাতে লাগল। গাঁ থেকে দরদরিয়ে ঘাম ঝাড়তে লাগল তার। মুখের আদলে যদিও ব্যথার ছাপ গাঢ়ভাবে স্পষ্ট নয় তবে ভেতরের অকথিত যন্ত্রণা গুলো যেন প্রগাঢ়ভাবে স্পষ্ট হতে লাগল। এই যন্ত্রণা ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণা! এই যন্ত্রণা নিজের প্রতি নিজের জমতে থাকা ঘৃণার যন্ত্রণা! কাছের মানুষরা বেইমানি করলে তখন ম’রা আর বাঁচার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা! নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে যখন একটা সম্পর্কে যাওয়ার পর এভাবে ঠকে যেতে হয় তখন সেই ঠকে যাওয়াটা মানুষকে আর বাঁচতে দেয়না!

আরিফ তাজ্জব বনে গেল। আহত শরীর নিয়ে সে হকচকিয়ে রাফায়াতের দ্বিখণ্ডিত মুখের পানে তাকিয়ে রইল। ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্র থাবা থেকে ছাড়া পেয়ে এই মুহূর্তে তার তো এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু না। সে তো হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কেবল রাফায়াতকেই দেখছে! গোঙানির শব্দগুলো যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আরিফের কান দুটো সেই গভীর শব্দের আওয়াজ সইতে পারছেনা। ফেটেফুটে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ শরীরের অস্থিরতা চেপে রাখতে পারলনা আরিফ। কানে দু’হাত চেপে তাৎক্ষণিক সে মুখ খুলল। মৃদু আওয়াজে শুধালো,,

“কী হয়েছে ভাই? আপনি হঠাৎ এভাবে গোঙাচ্ছেন কেন?”

মুহূর্তের মধ্যেই মাথাটা ঝাঁকিয়ে তুলল রাফায়াত। ঘামে লেপ্টে থাকা মাথার চুলগুলো পোঁড়া হাতটি দ্বারা সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিলো। নাক টেনে শ্বাস -প্রশ্বাস ছাড়ল। রক্তিম চক্ষুজোড়া অচিরেই স্বাভাবিক করে তুলল। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে নিজেকে যতখানি শান্ত করা প্রয়োজন রাফায়াত নিজেকে ঠিক ততখানিই শান্ত করল। স্থির দৃষ্টিতে আরিফের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল৷ ভাবশূণ্য গলায় আরিফকে শুধালো,,

“আচ্ছা? তুই আমার একটা হেল্প করতে পারবি?”

“কী হেল্প?”

“অনিক সম্পর্কে সব ডিটেইলস আমাকে দিতে পারবি?”

“কিন্তু কেন? অনিক সম্পর্কে আমি কেন আপনাকে সব ডিটেইলস দিতে যাব? কে হন আপনি অনিকের?”

“কেউ নাহ্! জাস্ট আগ্রহ থেকে বললাম। যদি তুই আমার শর্ত মেনে নি তো আমিও এক্ষণি এই মুহূর্তে তোকে ছেড়ে দিব।”

“ধরলেন কই? ছেড়েই তো দিলেন। আমি এখন দৌঁড়ে এখান থেকে পালাব!”

চোখের পলকেই আরিফ যেইনা স্থান পরিত্যাগ করে দৌঁড়ে পালাতে যাবে অমনি রাফায়াত পেছন থেকে আরিফের কোমড় পেঁচিয়ে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে হুড়মুড়িয়ে বলল,,

“এবার পালিয়ে দেখা! রাফায়াত যাকে ধরে তাকে ছাড়তে জানেনা।”

রাফায়াতের দানবীয় শক্তির কাছে আরিফ অতি তুচ্ছ! খামোশ খেয়ে গেল আরিফ। প্রাণপনে যদিও চেষ্টা করছিল রাফায়াতের কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার তবে সেই সব চেষ্টা তার বৃথা ঠেকছিল। উপায় বুদ্ধি খুঁজে না পেয়ে আরিফ ভয়ার্ত গলায় হিংস্র রাফায়াতকে বলল,,

“ভাই ভাই। আমি আপনার শর্তে রাজি। প্লিজ বলুন অনিক সম্পর্কে আপনার কী কী ডিটেইলস চাই?”

পৈশাচিক হাসল রাফায়াত! আরিফকে টানতে টানতে গ্যারেজের একটি কোণায় এনে বসালো। রাফায়াত নিজেও আরিফের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে আরিফের পাশে আরামচে বসল। শান্ত স্বরে বলল,,

“সব বল। অনিক সম্পর্কে যা যা জানিস সব বল। আর শুন? রাস্তাঘাটে এসব সস্তা ইভটিজিং করা বন্ধ কর। তোর মত হ্যান্ডসাম একটা ছেলেকে এসব করা মানায় না!”

নিশ্চল দৃষ্টিতে আরিফ শান্ত রাফায়াতের দিকে তাকালো। এই প্রথম কারো উপদেশ আরিফের কাছে এতটা ভালো লাগল! রাফায়াতকে তার আপন মনে হতে লাগল। এই বুঝি তার আপন কেউ তার পাশে বসে রইল!

,
,

বাড়ি ফিরেই অনিক প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগল অয়ন্তীকে। মাথা নুইয়ে অয়ন্তী কেবল হু হা করতে লাগল। অনিকের এসব কড়া কড়া প্রশ্নের ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে অনিক বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে অয়ন্তীর প্রতি! তাই চুপচাপ বসে এখন হ্যাঁ বা না তেই প্রশ্নের উত্তর সীমাবদ্ধ রাখা শ্রেয়। শেষবারের মত অনিক অয়ন্তীর দিকে কঠিন এক প্রশ্ন ছুড়ল। ঠাণ্ডা মাথায় শুধালো,,

“কাল রাতে স্টোর রুমে তোমার সাথে কে ছিল?”

ভড়কে উঠল অয়ন্তী। ওড়নার আঁচল পেঁচানো বন্ধ করে সে বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলল অনিকের আগ্রাসী চোখের দিকে। শুকনো ঢোঁক গিলে জবাবে বলল,,

“মামানে?”

“হোয়াটস ইউর প্রবলেম হ্যাঁ? এভাবে সাডেন আঁতকে উঠলে কেন? স্টোররুমে তো তোমার একা থাকার কথা নয়। তাও আবার একটি অপরিত্যক্ত, অপরিচ্ছন্ন, অন্ধকার রুমে। সাথে কে ছিল বলো?”

রাগে গাঁ রি রি করে উঠল অয়ন্তীর। তৎক্ষনাৎ সে জায়গা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। অনিকের প্রশ্নবিদ্ধ চোখে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গলা উঁচিয়ে বলল,,

“শাট ইউর মাউথ অনিক ভাই। তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বলে যে তুমি যখন তখন আমার চরিত্র সস্পর্কে যা তা বলবে তা কিন্তু হবেনা! সিরিয়াসলি আমি মানব না এসব। স্টোর রুমে আমি কোনো কারণে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই তবে আমার ন্যাচার এতটাও খারাপ নয় যে আমি অন্য কারো সাথে একা একটা রুমে রাত কাটাব! নেক্সট টাইম তুমি আমার সম্পর্কে এসব ফাউল কথা তুলেছ তো এর ফল কিন্তু খারাপ হবেনা এই বলে দিলাম!”

হনহনিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো অয়ন্তী। অনিক চোঁয়াল উঁচিয়ে অয়ন্তীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সামনে থাকা টি-টেবিলটিতে সজোরে এক লাথ মারল! দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,,

“এর অহংকার ভাঙতে হবে আমার! ডে বাই ডে মুখের উপর কথা বলা শিখে যাচ্ছে। যত আর্লি পসিবল এর দফারফা করতে হবে।!”

,
,

সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতেই অনিক আবারও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। মূলত এক লক্ষ টাকার একটি চেক সাইন করাতেই অনিক ঢাকায় এসেছিল! তার স্বার্থ হাসিলের জন্যই অয়ন্তীর কাছে এসেছিল। অয়ন্তীও কিছু না বুঝে শুনেই সেই চেকে নির্বোধের মত সাইন করে দিয়েছিল। অতিরিক্ত বিশ্বাসের ফল এসব! যা এখনও অবধি অয়ন্তী এবং তার পরিবার টের পায়নি! অনিকের বের হওয়ার পর পরই আলিজা এবং রাফায়াত অপ্রত্যাশিতভাবেই অয়ন্তীদের বাড়িতে ঢুকে! মূলত আলিজার জোরাজুরিতেই রাফায়াতের এই বাড়িতে আসা। যদিও রাফায়াত সুযোগ খুঁজছিল কখন এই বাড়িতে আসবে! পুরোনো কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে তার! সন্ধ্যার পর আলিজা একা বাড়ি থেকে তেমন বের হয়না। যেহেতু রাফায়াত আছে তাই এই ভর সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে বের হওয়া।

ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই অয়ন্তীর মা আলিজা এবং রাফায়াতকে দেখে বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ট্রে ভর্তি চা নাশতা সাজিয়ে দিলেন। আলিজা এবং রাফায়াতের সাথে বসে জমিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। আলিজার এবং রাফায়াতের আসার খবরটা অয়ন্তী এখনো পায়নি! অতিরিক্ত ঘুমে বুদ হয়ে আছে সে! কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর অয়ন্তীর মা অয়ন্তীকে ঘুম থেকে ডেকে দিলেন। আলিজা এবং রাফায়াতকে দেখে যেন অয়ন্তী আকাশ থেকে পড়ল! খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে উঠল।

অয়ন্তীর রুমে ঢুকেই রাফায়াত প্রথমে পুরো রুমটিতে শকুনের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার সর্তক দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তীর দিকে। হুট করেই অয়ন্তীর বাঁ গালের দিকে নজর পড়ল তার। কেমন যেন কালসিটে দাগ পড়ে গেছে তার বাঁ গালটিতে! ব্যস্ত হয়ে উঠল রাফায়াত। বুকের ভেতর প্রলয়ঙ্করী ঝড় বইতে লাগল! আলিজার কাছ থেকে রাফায়াত অয়ন্তীকে টেনে আনল। স্বচ্ছ দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তীর সমস্ত মুখমণ্ডলে। ধক করে উঠল বুকটা তার। পুরোনো ক্ষত জমাট বাঁধতে লাগল। বাঁ গালের কাছটিতে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হয়েছে তোমার গালে হ্যাঁ? কালসিটে দাগ কেন?”

বিষয়টিকে খুব নিঁখুতভাবে এড়িয়ে যেতে চাইল অয়ন্তী। উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। মাথা নুইয়ে স্তব্ধ গলায় বলল,,

“কোথায় কীসের দাগ? কী যা তা বলছেন আপনি? তাছাড়া আমার দিকে এভাবে ঘুরে তাকানোর অধিকার নেই আপনার। এমন হুটহাট হাত ধরে টানাটানিরও অধিকার নেই।”

অয়ন্তীর নিষেধ শুনলনা রাফায়াত! পুনরায় অয়ন্তীকে হেঁচকা টানে তার দিকে ঘুরিয়ে নিলো। চোখের গরম যেন কমছিলই না তার! বেগতিক বাড়ছিল। ভেতরটাও কেমন নিগূঢ়ভাবে খাঁ খাঁ করছিল। বিষাদে আর্বতিত হয়ে উঠছিল মনের শহর। দু’বছর আগের জমানো গভীর অনুভূতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল! উত্তেজিত গলায় অয়ন্তীকে শুধালো,,

“অনিক তোমার গাঁয়ে হাত তুলেছে?”

অতিমাত্রায় অবাক হলো অয়ন্তী। কেন যেন রাফায়াতকে তার পূর্ব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল! এই যে চোখে-মুখে আকাশ সমান অস্থিরতা তা যেন তার অনেক আগে থেকেই চেনা! তৎক্ষণাৎ মাথাটা ঝাঁকালো অয়ন্তী। শুষ্ক গলায় বলল,,

“এটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার। আপনি কে হ্যাঁ নাক গলানোর?”

“আমি অনেককিছু হই নাক গলানোর! অনেক কিছুই হই। অনিক আমাকে বলেছিল সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তার চোখে-মুখে আমি সেই ভালোবাসা দেখেছিলাম। ট্রাস্ট করেছিলাম আমি তাকে। নিজের থেকেও বেশী। আজ সবকিছু জানতে পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে অয়ন্তী! খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে!”

#চলবে…?