এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব-০৮

0
215

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আমি অনেককিছু হই নাক গলানোর! অনেক কিছুই হই। অনিক আমাকে বলেছিল সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তার চোখে-মুখে আমি সেই ভালোবাসা দেখেছিলাম। ট্রাস্ট করেছিলাম আমি তাকে। নিজের থেকেও বেশী। আজ সবকিছু জানতে পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে অয়ন্তী! খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে!”

নির্লিপ্ত নির্বিকার দৃষ্টিতে অয়ন্তী তাকিয়ে রইল কঠোর ভাবাপন্ন রাফায়াতের দিকে। হঠকারিতায় তার মুখের জবান রুদ্ধ প্রায়। কৌতূহল, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা যেন বেগতিক গাঢ় হতে লাগল। বিক্ষুদ্ধ রাফায়াতের দিকে একনিষ্ঠ মনোযোগ তার। এই মুহূর্তে পৃথিবী ধ্বসে গেলেও বোধ হয় তার মনোযোগ একচুল এদিক থেকে ওদিক হবেনা! আচমকাই এভাবে অপরিচিত একটা লোককে এতটা পরিচিত বলে মনে হবে তা যেন অয়ন্তী তার দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এক অদ্ভুত মনঃসংযোগ অনুভব করছে অয়ন্তীর ভেতর। মনে হচ্ছে যেন একটা সময় এই মানুষটাকে ছাড়া তার চলত না!

রাফায়াতের অগ্নিঝড়া চাহনি রীতিমত বেদনায় পরিণত হলো। অন্তঃকরণে জমে থাকা ব্যথারা, আঘাতেরা, অপ্রকাশিতব্য যন্ত্রনারা নির্দ্বিধায় মুখশ্রীতে বিচরণ করতে লাগল। অয়ন্তীর চোখে যখন টলমল জল তখন-ই রাফায়াতের অবাধ প্রস্থান! বুকে ভারী এক পাথর চেপে যেন রাফায়াত সাইক্লোনের বেগে অয়ন্তীর সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। ঘর পরিত্যাগ করে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। অয়ন্তী একই জায়গায় থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। রাফায়াতের হঠাৎ প্রস্থান তাকে একচুলও ভাবালো না! কল্পনা তাকে তার বাস্তব থেকে টলাতে পারল না। কেবল নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল,,

“কে সে? কী তার পরিচয়? সে কি আমার পূর্ব পরিচিত? একটা সময় কী তাকে ছাড়া আমার চলত-ই না?

পেছন থেকে তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে থাকা আলিজা পিলপিলিয়ে হেঁটে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। দু’হাত দ্বারা স্তব্ধ অয়ন্তীকে ঈষৎ ঝাঁকিয়ে বলল,,

“কী রে অয়ন্তী? রাফায়াত ভাইকে তুই চিনতিস নাকি আগে থেকে? কীসব বলে গেল রাফায়াত ভাই? তাছাড়া অনিক ভাইকেও কি রাফায়াত ভাই আগে থেকে চিনে?”

তব্ধতা কাটিয়ে উঠল অয়ন্তী। আকস্মিক দৃষ্টি ফেলল প্রশ্নবিদ্ধ আলিজার দিকে। তৎক্ষণাৎ পেছনের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো অয়ন্তী। চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে দু’কানে হাত চেপে বলল,,

“আমি চিনিনা কাউকে। জানিনা তোর রাফায়াত ভাই এসব কী বলছে! আমার মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরছে আলিজা। আই নিড টু রেস্ট।”

অয়ন্তীর মানসিক অবস্থা বিপর্যের পথে। তা আলিজা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে! অনিক অয়ন্তীর গাঁয়ে হাত তুলেছিল তাও আলিজা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে৷ অনিক মাঝেমধ্যেই অয়ন্তীর গাঁয়ে হাত তুলে। তা আলিজার অজানা কিছু নয়! অয়ন্তীকে শান্ত করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলিজা। ধীর পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রাফায়াতের নাম্বারে অনেকবার ট্রাই করার পরেও রাফায়াতের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারল না সে। এতো রাতে আলিজাকে একা ছাড়তেও সাহস পাচ্ছিলেন না অয়ন্তীর মা। তাই তিনি আলিজাকে তাদের প্রাইভেট কারে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

,
,

মধ্যরাত তখন তিনটা প্রায়। বেঘোরে ঘুমের মধ্যেই অয়ন্তী হঠাৎ অনুভব করল কেউ তার চোখে-মুখে বেসামালভাবে আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে! শিরশিরিয়ে উঠছে তার সমস্ত শরীর! উন্মাদনা কাজ করছে প্রতিটা অঙ্গে-প্রতঙ্গে। উত্তেজিত হয়ে উঠছে দেহ। দম আটকে আসার মত অনুভূতি তার। আচমকাই আঁতকে উঠল অয়ন্তী। লাফ দিয়ে উঠল ঘুম থেকে। চোখ বুজেই চিৎকার করে বলল,,

“রাদিফ ভাভাভাভাই!”

অবিলম্বেই ঘুমন্ত চোখজোড়া খুলে নিলো অয়ন্তী। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে বিকট চাহনিতে তার আশেপাশে চোখ বুলালো। তবে কাউকে কোথাও দেখতে পেলনা! কোথাও কেউ নেই। ড্রিমলাইটের আলোতে সমস্ত ঘর আলোময়। এই আলোতে কাউকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। হয়রান হয়ে উঠল অয়ন্তী। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে লাগল। অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল। শীঘ্রই বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। ডেস্কের উপরে রাখা গ্লাস ভর্তি পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে সামনের চুলগুলো টেনে ধরে বলল,,

“তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম?”

নিজেকে স্থির করে তোলার প্রয়াসে লিপ্ত হলো অয়ন্তী। শেষবারের মত একদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে তুলল। মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ধীর পায়ে হেঁটে আলমারির কাছে গেল। আলমারির দরজা খুলে ড্রয়ার থেকে একটি আধপুরোনো ডায়েরী বের করল! নীল মলাটে মোড়ানো সেই ডায়েরীটি যদিও খুব দামী ডায়েরীর পর্যায়ে পড়েনা, তবে অতি সাধারণ একটি ডায়েরী হিসেবে এই ডায়েরীটিই তার খুব প্রিয়। সাধারণ যেকোনো জিনিসই যদি অসাধারণ মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া যায় তবে সেই সাধারণ জিনিসটিই অতি অসাধারণ হয়ে ওঠে। এরমধ্যে নতুন বিশেষত্ব যোগ হয়। তেমনি এই ডায়েরীটিও তার অন্যথায় নয়!

হাঁটতে হাঁটতে ডায়েরীটি নিয়ে অয়ন্তী বিছানার উপর এসে বসল। ভারী নীল মলাটটিতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। অমনি তার বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল! দীর্ঘ দু’বছর পর ডায়েরীটিতে হাত পড়ল তার। ফেলে আসা সেই দু’বছর আগের আবেগ, অনুভূতি, পাওয়া, না পাওয়ার যন্ত্রণা গুলো অচিরেই ধরা দিলো তার মনে। সেইসব অনুভূতি আঁকড়ে ধরে অয়ন্তী মলাট উল্টে ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় গেল। সঙ্গে সঙ্গেই একটি রঙিন ছবি তার চোখের আলিজে ঠায় পেল! এবার আর নিজের দমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলোকে সন্তপর্ণে ধরে রাখতে পারলনা অয়ন্তী। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল! ছবি টিকে তার বুকের মাঝে চেপে ধরল। দুঃসহ বেদনায় আর্ত গলায় বলল,,

“কেন আমার অনুভূতিগুলোকে আপনি বুঝতে পারলেন না রাদিফ ভাই? কেন আপনি প্রিয়াকে ভালোবাসলেন? আমাকে কেন নয়? কেন আমাকে এতটা কষ্ট দিলেন বলুন? কেন সবসময় আমাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝাতেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন? যখন আমি আপনাকে আমার মনের কথা বলতে গেলাম, তখনই কেন বললেন আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? বলুন কেন? জানিনা দু’বছর পর আজ কেন হঠাৎ আপনার কথা খু্ব মনে পড়ছে আমার! আপনার প্রতিচ্ছবিই যেন আজ অন্য একজন মানুষের মাঝে আমি আবিষ্কার করলাম!”

,
,

ব্রীজের উপর মাথা নুইয়ে বসে আছে রাফায়াত। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বার থেকে মাত্রই ড্রিংকস করে ফিরেছে সে! শরীরের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। কিয়ৎক্ষণ পর পর বেসামালভাবে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। যেকোনো সময় সে ব্রীজ থেকে পড়ে অঘটন ঘটাতে পারে! জীবনের এত বড়ো ঝুঁকি নিয়েও তার মুখে শুধু একটাই অস্ফুটে বুলি,,

“কেন আমাকে ঠকালি অনিক? বল কেন?”

নে’শা’খো’রদের মত অবস্থা তার। বিবর্ণ মুখমণ্ডলে চোখদুটো হায়েনাদের মত জ্বলছে। শত্রুকে সামনে পেলে খাবলে খুবলে খাবে দেখে এতটাই হিংস্র মনে হচ্ছে! বারংবার সিগারেটটিতে ফুঁক দিচ্ছে সে। মিনমিনে গলায় বলছে,,

“আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি অয়ন্তী! বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। আমি অনিককে বিশ্বাস করেছিলাম। অন্ধের মত বিশ্বাস করেছিলাম। যার ফলস্বরূপ আমাদের দুজনকেই এত বাজেভাবে ঠকে যেতে হলো।”

ইতোমধ্যেই পেছন থেকে দৌঁড়ে এলো আরিফ। রাফায়াতকে শক্ত হাতে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরল। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“আরে ভাই করছেনটা কী আপনি? পড়ে যাবেন তো। ওঠে আসুন এখান থেকে।”

রাফায়াত মা’তাল’লদের মত আলুথালু গলায় কিছু বলার পূর্বেই আরিফের হাতে থাকা রাফায়াতের সেলফোনটি পুনরায় বেজে উঠল! ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে আরিফ মৃদু আওয়াজ করে রাফায়াতকে বলল,,

“ভাই? আপনার আব্বা অনেকক্ষণ যাবত কল করছে। আপনার সাথে নাকি কী ইমার্জেন্সি কথা আছে।”

চোখ মেলে তাকালো রাফায়াত। কম্পিত দৃষ্টিতে অস্থির আরিফের দিকে তাকালো। সিগারেটটিতে শেষবারের মত ফুঁক দিয়ে টিমটিমে স্বরে বলল,,

“ফোনটা স্পিকারে রাখ।”

রাফায়াতের কথা মত আরিফ ফোনটা স্পিকারে রাখল। অমনি ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে আফজাল শেখ বিস্ফোরিত গলায় বললেন,,

“এই কোথায় তুই? ফোনে তোকে কানেক্ট করা যাচ্ছিলনা কেন? কেন বউমার খালা-খালুরা তোর প্রতি এত বিরক্ত হ্যাঁ? ওখানে গিয়েও তুই আমাদের শান্তি দিবিনা বল? সারাটা জীবন তো জ্বালিয়ে এলি আমাকে। তোর মা-কে, ভাইকে, ভাবিকেও। আর কী জ্বালানোর বাকি আছে? লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি তোর পেছনে! এখনো অবধি করে আসছি। তুই কী জীবনেও মানুষ হবিনা? আর তুই জানিস না? প্রিয়া সু’ই’সা’ই’ড করতে গিয়েছিল কয়েকবার? প্রিয়ার সাথে কথা বলছিস না কেন?”

“শুনো বাবা। প্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো কথা থাকলে বলো।”

“কেন? প্রিয়া সম্পর্কে কেন কোনো কথা বলবনা? বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তোর প্রিয়ার সাথে। ভুলে গেছিস তুই?”

“আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে পারব না বাবা! প্রিয়া সম্পর্কে তুমি কিছুই জানোনা। আর এই মুহূর্তে আমি তোমাকে কিছু জানাতেও চাইনা। মোট কথা আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে চাইনা। ফোনটা রাখো তুমি প্লিজ। এই বিষয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছেনা!”

আরিফের থেকে ছোঁ মেরে ফোনটি কেড়ে নিলো রাফায়াত। ঠাস করে কলটি কেটে দিলো। ফোনের পাওয়ার অফ করে আরিফের হাতে ফোনটি ধরিয়ে দিলো। আরিফের থেকে মুখ ফিরিয়ে আক্রোশিত গলায় বলল,,

“অয়ন্তীর সাথে আমাকে একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবি?”

“কী বলেন ভাই? এত রাতে?”

“পারবি কিনা বল?”

“ট্রাই করে দেখতে পারি।”

“ট্রাই না। আমি এক্ষণি, এই মুহূর্তে অয়ন্তীকে দেখতে চাই। ম’রে যাওয়ার মত ফিলিংস হচ্ছে আমার। তাকে দেখে যেন এতদিনের জমানো শরীরের ব্যথাগুলো অনুভব হচ্ছে! তার যত্ন পেতে চাইছে।”

বিগলিত হয়ে উঠল আরিফের মন! কথা না বাড়িয়ে সে নে’শা’গ্রস্থ রাফায়াতকে টেনেটুনে ব্রীজের উপর থেকে উঠালো। রাস্তার পাড় ধরে যেইনা সামনে অগ্রসর হতে গেল অমনি দুজন কনস্টেবলের সম্মুখস্থ হয়ে গেল দুজন!

#চলবে….?