কখনো হারিয়ে যেতে হয় পর্ব-০২

0
255

#কখনো_হারিয়ে_যেতে_হয়
পর্ব: ২

মীরার নতুন সংসার যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল ততটা কঠিন ভাবে শুরু হয়নি। রাকায়েত খুব চুপচাপ শান্ত স্বভাবের একজন মানুষ। খুব রুটিন মেনে চলে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার রুটিন ঠিক করা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে মেয়েদের খোঁজ খবর নেয়। ছোট মেয়েটা বাবার জন্য পাগল এবং রাকায়েত ও মেয়েদের জন্য। প্রতিদিন অফিস থেকে আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসবে মেয়েদের জন্য।
মেয়েরা মীরার সঙ্গে সহজ হয়ে গেছে ধীরে ধীরে।
রাকায়েত ওকে ডেকে একদিন বলল, ‘তোমাকে সারাদিন ঘরের রান্নাবান্না, ঘর গোছানোর কাজ না করলেও হবে কিন্তু মেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া এবং কোচিং এ নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা করতে হবে।’ ‘আমি আমার মেয়েদের এই নিরাপত্তার দায়িত্ব টুকু তোমাকে দিতে চাই।’
সেই থেকে মীরা দুই মেয়েকে সকালে স্কুলে দিয়ে আসে। বাসায় এসে রান্নাবান্না করে আবার দৌড়ে যায় আনতে। ভালোই লাগে তার বাচ্চাদের জন্য ছুটোছুটি করে সব কাজ করতে।
মেয়ে গুলো তাকে ছোটমা ডাকে। ওরা যখন ওকে ছোটমা ডাকে মীরার বুকটা ভরে যায়।
একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে রাকায়েত মেয়েদের সঙ্গে টিভি দেখতে দেখতে গল্প করছিল। মীরা খাবার টেবিলে কিছু একটা করছিল হঠাৎ শুনে রাকায়েত নিচু স্বরে মেয়েদের বলছে,’ মা মনিরা নতুন মা কে কেমন লাগছে?’
বড় মেয়ে ঐশী বলল, ‘ভালো! ঐশী কথা একটু কম বলে বাবার মতো হয়েছে।’
মৌশী বলল, ‘অনেক ভালো লাগছে বাবা। আমার সব কাজ করে দেয়। তুমি জানো বাবা আমার হোম‌ওয়ার্ক ও করিয়ে দেয়। তারপর ফিসফিস করে বলল, অনেক ভালো অংক পারে। ‘
‘তোমরা উনাকে কি ডাকো?’
‘কিছুই ডাকি না বাবা।’বলেই মৌশী ফিক করে হেসে দিল। ‘তবে নানু বলেছে খালা ডাকতে।’
‘উহু খালা আন্টি এসব ডাকলে কেমন শোনা যায় বলো তো মা? তারচেয়ে তোমরা ছোটমা ডাকতে পারো।’
মৌশী বলল,’ কিন্তু বাবা নানু ছোটমা ডাকলে যদি রাগ করে?’
‘রাগ করবে না আমি ডাকতে বলেছি বলবে নানুকে।’
মৌশী গলা আরো নামিয়ে বলল, ‘বাবা আমাদের ক্লাসের ইশা বলে সৎ মা রা অনেক অত্যাচার করে অনেক কষ্ট দেয় বাচ্চাদের!’
‘উহু এইটা ভুল কথা মা। তোমাদের ছোটমা কি সেরকম?’
‘না বাবা একদম না । আমার স্কুল ব্যাগ টাও গুছিয়ে দেয় আগে এইটা আমাকে করতে হতো। বলে হেসে দিল মৌশী’।
রাকায়েত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
সেই থেকে মেয়ে দুইটা মীরাকে ছোটমা ডাকে।
মীরাকে এখন কেউ জিজ্ঞেস করে যখন বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন?
মীরা মন ভরে বলে আমার দুই মেয়ে। কথাটা বলার সময় মীরার অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়। মনেই হয় না মেয়ে গুলোকে সে নিজে জন্ম দেয় নাই।
তবে যেদিন থেকে মেয়ে গুলো মীরাকে ছোটমা ডাকে সেদিন থেকে ওদের নানু মীরার উপর একটু বিরক্ত। সারাদিন কোন না কোন একটা কিছু নিয়ে খুঁত ধরবে তারপর বলবেই তার মেয়ে সাবিনা এই কাজ এভাবে করতো। ‘আসলে যার সংসার সে ছাড়া সব কি আর মানানসই হয়?’
শেষ কথাটা সারাদিনে না হলেও বিশ পঁচিশ বার বলবে। কখনো কখনো রাকায়েতের সামনে বলে ফেলেন তিনি।
রাকায়েত বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে না উনাকে। তবে মীরাকে একা করে বলবে, ‘তুমি আম্মার সব কথা মনে ধরো না। বয়স্ক মানুষ তো অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলেন। বোঝাতে গেলে আরো ভুল বুঝে।’
মীরা মৃদু হেসে বলেছে, ‘তুমি চিন্তা করো না আমার উনার কথায় কিছু মনে হয় না।’

রাকায়েতের শ্বাশুড়ির বয়স প্রায় সত্তর এর উপর। তার আরও চার ছেলে মেয়ে আছে। ছেলেরা মীরা আসার পর নিয়ে যেতে এসেছিল কিন্তু তিনি বকাঝকা করে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। নাতনিদের রেখে তিনি কোন ভাবেই যাবেন না। এমনকি তার বড় মেয়ে বলেছিল,’ আম্মা এখন আপনার এখানে থাকাটা ভালো দেখায় না যার সংসার তাকে সামলাতে দেন। তারপর দেখা যাবে আপনি উল্টাপাল্টা কিছু বলবেন সবাই আপনার উপর মনক্ষুণ্ণ হবে।’
তিনি মেয়ের এই কথায় চিৎকার, চেঁচামেচি অতঃপর কান্নাকাটি করে বাসা মাথায় তুলেছিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন এটা আমার সাবিনার সংসার। সাবিনা থাকতে এমন কথা তোরা বলতে পারতি?
‘আম্মা সাবিনা নাই বলেই আমরা বলছি বোঝার চেষ্টা করেন। সব কিছুর একটা দেখার সৌন্দর্য আছে বুঝেন না কেন?’
‘ও আচ্ছা আমি এখন বেমানান খারাপ হয়ে গেছি সব জায়গায়?’
তিনি এত সীন ক্রিয়েট করলেন রাকায়েত আর মীরা ছুটে এসে তাকে শান্ত করার জন্য বলল, ‘আম্মা আপনি কোথাও যাবেন না।’
মীরা বলতে বাধ্য হল, ‘এইটা আপনার মেয়ের সংসার আপনি যতদিন খুশি থাকবেন।’
তিনি তবুও থামলেন না ঐশী মৌশীকে বুকে জড়িয়ে আহাজারি শুরু করলেন।
এবং একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন কান্নাকাটি করতে করতে।
এই কাজ টা তিনি প্রায় রেগুলার করেন। কিছু একটা তার মনের বিরুদ্ধে হলেই মেয়ে দুইটাকে ধরে আহাজারি শুরু করেন।
একদিন বাসার পুরনো ফ্রীজটা নষ্ট হয়ে গেল। মীরা রাকায়েতকে বলল ফ্রীজটা ঠিক করাতে হবে।
রাকায়েত বলল, ‘অনেকবার ঠিক করিয়েছি এবার এটা বদলে নতুন একটা বড় ফ্রীজ কিনব।’
পরদিন অফিসে গিয়ে রাকায়েত নতুন ফ্রিজ কিনে পিয়নকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
ঐশীর নানু সেই নতুন ফ্রীজ দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। তার মেয়ে কত শখ করে আগের ফ্রীজটা কিনেছিল আজকে তার মেয়ে নেই বলে সেই ফ্রীজটা বদলে ফেলতে হলো। তার মেয়ের স্মৃতি এভাবেই এই সংসার থেকে বিদায় নিবে। তিনি পুরাতন ফ্রীজটা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
মীরা যত বোঝায় আম্মা ফ্রীজটা নষ্ট হয়ে গেছে বলেই ঐশীর বাবা নতুন ফ্রীজ কিনেছে। তিনি কোন কথাই শুনেন না।
একপর্যায়ে বলে উঠলেন তুমি কি বুঝবে এই জিনিসটা, যার সংসারের জিনিস সে থাকলে এইটা করতে পারতে না।
মীরা চুপ হয়ে গেল।
বাধ্য হয়ে রাকায়েত পুরনো নষ্ট ফ্রিজ টা বারান্দায় রেখে দিল। তারপর গিয়ে তিনি ঠান্ডা হলেন।
এরকম অনেক জিনিস নিয়ে তিনি এমন কান্নাকাটি করেন।
সবচেয়ে বিরক্ত হয় মীরা , যখন‌‌ই আত্মীয়-স্বজন কিংবা পাড়া প্রতিবেশী আসে তাদের তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলবেন, ‘বাচ্চা হবে না কখনো তাই রাকায়েত বিয়ে করেছে একটা বাচ্চা হলে কি আর আমার নাতনিদের কোন যত্ন করবে? ‘
‘এরকম সৎমা জীবনে অনেক দেখছি গো নিজের একটা বাচ্চা হলেই আগের ঘরের বাচ্চাদের সুখ শান্তি শেষ করে দেয়। ‘
মীরা এসব কথা ইগনোর করে।
কিন্তু একদিন যখন বলে ফেলল মহিলা, ‘বাজা মেয়ে দেখেই বিয়ে করে এই সংসারে আসতে পেরেছে। ‘
সেদিন মীরা চোখ মুছতে মুছতে বলেই ফেলল, ‘বাজা বলেই তো আম্মা আগের সংসার ছেড়ে আসতে হলো নয়তো সেই সংসার ছাড়ার তো কোন কারন ছিল না আমার। ‘
তিনি মীরার কথায় আবার যথারীতি কান্নাকাটি করলেন।
রাতে রাকায়েত বাসায় আসার পর কথাটা তাকেও বললেন।
রাকায়েত চুপ করে শুনলো তারপর বলল, ‘আপনি এভাবে কথাটা না বললেও পারতেন আর আমি মীরাকে বলছি আপনার সঙ্গে এভাবে কথা না বলতে!’
‘থাক কিছু বলার দরকার নেই বাবা। আমার জন্য নিজেদের মধ্যে অশান্তি করবা আমি চাই না।’
রাকায়েত সেই রাতে চুপচাপ শুয়ে পড়লো ঘরে এসে কোন কথা বলল না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মীরা একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। ওর কাছে কখনো কখনো মনে হয় তার জীবন টা এভাবে আর কতকাল কাটবে?

ঐশী চুপচাপ থাকলেও অনেক মজার মজার কথা বলতে পারে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মীরাকে বলল, ‘ছোটমা আজ স্কুলে নতুন এক মিস এসেছে বয়স খুব কম। দেখতেও ছোটখাটো আমাদের বিজ্ঞান স্যার মিস কে আমাদের মতো ছাত্রী ভেবেছে। টিচার্স রুমের সামনে কি করছিস বলেই মিস কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খুব ঝাড়ি দিয়েছেন।
মিস যা লজ্জা পেয়েছেন।’ কথাটা বলেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল ঐশী।
মীরা ঐশীর কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে। টিন‌এজ বয়সী একটা মেয়ে। মা ছাড়া দুটো বছর নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়েছে। মীরা মেয়েদের বন্ধু হবার চেষ্টা করে।
তবে ঐশীর চেয়ে মৌশির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মীরার।
সারাদিন স্কুলে, বান্ধবী দের সঙ্গে কি কি করে সব মীরাকে বলবে। এমনকি ওর নানু সারাক্ষণ মীরাকে নিয়ে কি বলে কখনো কখনো সে গুলোও বলবে।
মীরা হাসতে হাসতে শুনে আবার কখনো কখনো কিছু কথায় মন খারাপ হয় ওর ।
ওর নানুর কান্নাকাটি ওর মোটেও ভালো লাগে না এটাও মৌশি বলবে।
মীরা আজকাল একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ঐশীর নানুর সঙ্গে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু মহিলার বয়স বেশি হলেও কুটবুদ্ধি অনেক।
বড় মেয়ের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাকে নিতে এসেছে বড় মেয়ে। এবার তিনি কোন ভাবেই ফিরাতে পারছেন না মেয়েকে কিন্তু যাওয়ার সময় ঐশী মৌশীকে সঙ্গে নিয়ে র‌ওনা হলেন।
তারপর যথারীতি আবার রাতে ওদের সঙ্গে বাসায় চলে এলেন।
এসে মীরাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি ভাবছিলে আমি আর আসব না?’
মীরা বলল, ‘তা ভাবতে যাব কেন?’
‘আমার দুই নাতনি আমাকে রেখে আসবে না, কি আর করা তাই সঙ্গে আসলাম। আমার থাকার জায়গার অভাব নেই মনে রাখবা। সব জায়গায় সবাই আমাকে মাথায় করে রাখে।’
মীরা হাসলো।
রাতে ঘুম পারানোর সময় মৌশী বলল, ‘নানু আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না তাই খালাম্মা অনেক বার বলল থাকতে কিন্তু থাকেনি।’
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!

বিয়ের একটা বছর চোখের পলকে চলে গেল। এর মাঝে শীতের সময় মেয়েদের পরীক্ষা শেষ হতেই রাকায়েত ওদের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে বেড়িয়ে এলো।
কক্সবাজার গিয়ে মীরার খুব মুহিবের কথা মনে হচ্ছিল। সে আর মুহিব প্রতি বছর কক্সবাজার আসতো। শেষ কয়েক বছর অবশ্য যায় নাই। তখন মনে শান্তি ছিল না।
মুহিবের নতুন ব‌উয়ের ও এখনো কোন বাচ্চা হয়নি। শুনেছে মুহিবের আব্বা কিছুদিন আগে মারা গেছে। খবর টা শুনে একবার মীরার ইচ্ছা হয়েছিল মুহিবকে ফোন দিবে কিন্তু পরে আর দেয়া হয়নি।

রাকায়েত মানুষটা একেবারেই শান্তশিষ্ট।
বাসায় যখন থাকে বোঝা‌ই যায় না যে বাসায় একজন পুরুষ মানুষ আছে।
কক্সবাজার গিয়ে প্রথম মীরা দেখলো রাকায়েতের উত্তেজিত রূপ।
একটা ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছিল সেখানে।
মৌশীকে হোটেলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
রাকায়েত খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মীরাও যে ভয় পায়নি তা নয় কিন্তু ওর মন বলছিল মৌশীর কিছুই হয়নি ও ভালো আছে আশেপাশেই আছে।
তাই হয়েছিল। মৌশী রাস্তার ওপাশে বার্মিজ মার্কেটে আচার কিনতে গিয়েছিল।
মীরাই গিয়ে খুঁজে পায়।
রাকায়েত মীরা আর ঐশীকে বকা দিল। ‘বাচ্চা একটা মেয়ের খেয়াল তোমরা রাখতে পারলে না!’

শীতের শেষ দিকে মীরা একবার বাপের বাড়ি এসেছিল ওর বড় ভাইজান খুব অসুস্থ শুনে। বিয়ের পর সে আর আসেনি বাপের বাড়ি। ইচ্ছাই করে না তার। কিন্তু ভাইজান অসুস্থ না আসলে কেমন দেখায় তাই আসতে বাধ্য হলো।
পরদিনই রাকায়েত কে বলল এসে নিয়ে যেতে। বিকেলে রাকায়েত অফিস থেকে যাবার সময় ওদের বাসায় এলো।
মীরার ছোট ভাবি বললো,’ থাকবে না কিছুদিন?’
‘না ভাবি মেয়ে দুইটার স্কুল খোলা। আমি না থাকলে অনেক অসুবিধা হবে।’
‘বাহ্ মীরা খুব ব্যস্ত হয়ে গেছো সতিনের বাচ্চাদের নিয়ে!’
খোঁচাটা হজম করে মীরা বলল, ‘কি করব বলো ওদের মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আমি তো আর অবহেলা করতে পারি না।’
‘ভালো ভালো তাও আবার তোমার একটা নিজের সংসার হয়েছে। মেয়েদের নিজের সংসারে থাকাই ভালো।’

বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই মীরার শরীর টা ভালো না। কয়েক দিন জ্বর ঠান্ডা ছিল। জ্বর ঠান্ডা দুই মেয়ের ও হলো।
মেয়েরা ভালো হয়ে গেলেও মীরার শরীর খুব খারাপ। মাথা নিয়ে বেশিক্ষণ উঠে বসে থাকতে পারছে না। খুবই দূর্বল শরীর। কাজের বুয়াটা বলল, ‘আজকাল জ্বর হ‌ইলে শরীর একেবারে শেষ হ‌ইয়া যায়। আপনি একটা ডাক্তার দেখান।’
তিনদিন বিছানায় পড়ে রইলো। রাকায়েত জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল একদিন।
বিভিন্ন টেস্ট করে দেখা গেল মীরার অসুস্থতা টা শুধু জ্বরের জন্য দূর্বলতা তা নয়।
তার জীবনে একটা মীরাকেল ঘটে গেছে। খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে র‌ইলো মীরা!
সে আনন্দ পাবে নাকি দুঃখবোধ করবে বুঝতে পারছে না!
সে মা হতে যাচ্ছে।
তার গর্ভে কেউ একজন আছে! যার অস্তিত্বের জন্য এত গুলো বছর মীরার জীবনে কত কি ঘটে গেল! আজ সে আসছে। কিন্তু তার আগমনী খবরে ওর অনুভূতি কেমন সে বুঝতে পারছে না!
কেন জানি আনন্দে ভেসে যেতে পারছে না আবার দুঃখবোধ ও হচ্ছে না।
ও আরো বেশি কনফিউজড হয়ে গেল রাকায়েতের অনুভূতি দেখে। খবরটা শুনে রাকায়েত খুব অবাক হলো !
ওকে বলল, ‘কি বলছো এসব মীরা?’
‘ডাক্তার তো তাই বলল আমাকে।’
‘কিভাবে সম্ভব মানে তোমার তো কখনো বাচ্চা হবে না জানতাম!’
মীরা চোখর পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘আমার কোন সমস্যা ছিল না কিন্তু ,তাই বলে কখনো হবে না সেই কথাও বলেনি কোন ডাক্তার!’
‘তাহলে এখন কিভাবে কি হলো?’
‘আগে আল্লাহ দেয় নাই এখন আল্লাহ বাচ্চা দিয়েছেন! মীরা করা গলায় বলল!’
‘হুম বুঝতে পেরেছি।’ রাকায়েত আরো গম্ভীর হয়ে গেল।

বাসায় ফিরে মীরা নিজের ঘরেই শুয়ে রইলো। রাকায়েত রাতের বেলা নিজে থেকে বলা শুরু করলো। ‘আসলে দোষটা আমার ই। আমার সতর্ক থাকার দরকার ছিল। আমি তো জানতাম তোমার বাচ্চা হবে না কখনো, কিন্তু এখন কি হবে? আমি আমার মেয়েদের কি বলবো?’
মীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রাকায়েতের কথা গুলো শুনছে !
‘তুমি কি বুঝতে পারছো ঐশী মৌশী এই খবর শুনে কতটা কষ্ট পাবে?’
‘ওরা কষ্ট পাবে?’ মীরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল!
‘নয়তো কি? ওরা ওদের আদরের ভাগ আর কেউ নিতে আসছে শুনলে কষ্ট পাবে না ?’
‘মীরা আমি আমার মেয়েদের কষ্ট দিতে পারব না।’
মীরা কি বলবে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না! কি বলছে লোকটা তার সামনে। যে আসছে সে তার নিজের সন্তান তাকে নিয়ে এত দ্বিধা!
মীরা অন্ধকারে চোখের পানি মুছে বলল, ‘তাহলে কি চাও তুমি?’
‘কি চাই? আমি বুঝতে পারছি না মীরা আমার চিন্তা শক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে।’
‘আম্মা শুনলে তো মহা কেলেংকারি শুরু করবে!’ ‘কান্নাকাটি করে বাসা মাথায় তুলবে।’
মীরার এখন খুব রাগ হচ্ছে।
‘উনি কেন রাগ হবেন? আর উনি রাগ হবেন বলে যে আসছে তুমি তাকে চাও না? সে ও কিন্তু তোমার সন্তান।’
‘হ্যা ঠিক আছে কিন্তু বাস্তবতা তোমাকে বুঝতে হবে মীরা। তোমার আমার বিয়েটা হয়েছিল আমার দুটো মেয়ের জীবন সুন্দর করার জন্য। ওদের মায়ের আদরে বড় করার জন্য।’
‘আমি কি আমার দ্বায়িত্ব পালন করিনি এই এক বছরে?’
‘অবশ্যই তুমি শত ভাগ পালন করেছো আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তুমি কাউকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে তুমি কি পারবে ঐশী মৌশী কে সময় দিতে?’
‘আশ্চর্য পারব না কেন! মৌশী যখন হলো ওদের মা কি ঐশী কে অবহেলা করেছিল নাকি তখনও তোমার মনে হয়েছে আদরের ভাগ হয়ে গেছে?’
‘তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারছো না মীরা নিজের সন্তান পেলে কেউ কি’….
রাকায়েত চুপ করে গেল।
‘আটকে গেলে কেন শেষ করো কথাটা ?’ মীরা দৃঢ় গলায় বলল।
‘এত কথার কিছু নেই এই বাচ্চা আমি চাই না।’ ‘তুমিও বাচ্চা বাচ্চা করে আমাকে আর ইমোশনাল করার চেষ্টা করবে না প্লিজ মীরা।’
মীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আছে নিজের সন্তানের জন্য কোন দয়া মায়া হচ্ছে না লোকটার!
রাকায়েত পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
মীরা চোখের পানি মুছে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
কার্তিক মাসের মাঝামাঝি এই মাঝরাতে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। ‘মীরার খুব ইচ্ছে ছিল রাকায়েত কে বলতে তোমাকে ছোট্ট একটা ছেলে বাবা বলে ডাকবে।’ আল্ট্রাসাউন্ড করলো যেখানে ,সেখানের আয়াটা মীরার কানে কানে এসে বলেছিল, ‘আফা আপনের ছেলে বাবু হ‌ইব বকশিশ না নিয়ে ছাড়তাছি না।’
মীরা রাকায়েত কে এত খুশির কথাটা বলতেই পারলো না।

( চলবে )