কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব-৩৫+৩৬

0
243

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩৫|

“কুঞ্জ ভাই! হলোটা কী!”

“কী হবে?”

“টিভিতে কী দেখছি এসব? আপনি না বললেন, এখনও সব কালেক্ট করা হয়নি!”

ওপাশে কুঞ্জ ভাই মিটমিটিয়ে হেসেই যাচ্ছেন। আমি নিউজ শুনেই রুমে এসে কল দিয়েছি। কুঞ্জ ভাইয়ের ফোনটা বোধহয় হাতেই ছিল। এজন্য সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলেন। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, “বলবেন কি?”

“কী বলব?”

“উফ!”

কুঞ্জ ভাই এবার সুর করে গেয়ে উঠলেন, “রাগ করে না। সুন্দরী লো! রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালোওও…”

“কুউউউউঞ্জ ভাইইইই! জ্বালাবেন না। বলে ফেলুন ফটাফট!”

উনি মিহি হেসে বললেন, “আমার প্রায় বছর খানেকের পরিশ্রম এবার সফল হলো!”

“তবে সকালে ওমন করলেন কেন?”

“যেই ছেলেটাকে নিয়ে গেলাম, দেখেছিলে?”

“হুঁ।”

“ওটা বেঈমানী করেছিল।”

“কী!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তবে…”

“তবে?”

“না, কিছু না।”

“বুঝেছি। তবুও আমি কীভাবে সাকসেস হলাম আমার মিশনে– তাই তো?”

“হঁ।”

“ও গাদ্দারি করেছিল শেষদিকে এসে। ওই চক্রের মাঝে একটা মহিলা কলেজের ছাত্রনেত্রীও ছিল। সে আবার ছেলেটার নিউ গার্লফ্রেন্ড। তারা কথায় কথায় একে অপরের ব্যাপারে জেনে নিয়েছে। মেয়েটা ভেবেছিল– এই ডিলটা হলেই সবাইকে জানিয়ে দেবে আমার ব্যাপারে। কিন্তু, সেটা করার আগেই আমি পুলিশে ইনফর্ম করে দিয়েছি। ছেলেটা আরও কাউকে বলেছে কি না, এটা শিওর হয়ে নিতে চাইছিলাম। নয়তো, বাইরে বের হওয়া তোমাদের জন্য রিস্কি হয়ে যেত।”

“কেন যেন এখানে কিছু লুকোনোর গন্ধ পাচ্ছি। লুকোচ্ছেন না তো কিছু!”

“উফ! পাক্কাগিন্নি!”

“মানে?”

“একটা কথা স্কিপ করে গিয়েছি।”

“কোনটা?”

“মেয়েটা আমাকে অনেক আগে একবার প্রপোজ করেছিল।”

প্রপোজালের কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। কুঞ্জ ভাই বলতে থাকলেন, “আমি শুরুতে ভেবেছিলাম, একে ঝুলিয়ে রেখে পেট থেকে অনেক কথাই বের করতে পারব। তাই রাজিও হইনি, আবার রিজেক্টও করিনি। কিন্তু মেয়েটা খুব ধুরন্ধর। তাই পরে কোনো আশা-ভরসা না রেখে রিজেক্ট করি। হয়তো ইগোতে লেগেছিল, তাই মেয়েটা আমার সামনে আসত না। মাঝে মাঝে কিছু সম্মেলনে দেখা হয়ে যেত। এই যা! এরপর যখন ও আমার ব্যাপারে এত কিছু জেনে যায়, এটা আমি জানতেই পারতাম না; যদি না ও নিজে এসে আমাকে জানাত!”

“নিজে এসে জানিয়েছে– মানে?”

“আমাকে বলে কি না তার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে, নয়তো এসব সে জানিয়ে দেবে। ভেবেছ, কী বোকা!”

“ছি! এসব মেয়ে এত খারাপ হয় কী করে!”

কুঞ্জ ভাই মিটমিটিয়ে হেসে বললেন, “এএএ নবু! জ্বলছে কি?”

আমি চিৎকার করে উঠলাম, “কুঞ্জ ভাই!”

কুঞ্জ ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। এরপর বললেন, “আমার থেকে রিজেকশন পাওয়ার পর, আমাকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেইলিং করা হচ্ছিল। তারপর মেয়েটাকে হালকার উপর ঝাপসা সরিয়ে দিয়েছি।”

“মানেহ!”

“ওসব বাদ দাও। এরপর জানতে পারলাম, ওই তিনজন আবার আসবে। এই ডিলটা অনেক বড়ো। সাথে স্মাগলিংও হবে। ততদিনে আমার কাছে লিস্ট এসে গিয়েছিল। আমি সন্ধ্যাতেই লিস্টটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিই। আর রাতের রেডকিন পয়েন্টে অর্ধেক এবং বাকিদেরকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করা হয়। ক’জন অবশ্য পালিয়েছে। তবে তাদেরও ধরে ফেলা হবে খুব জলদি।”

“বাপ্রেহ! কত্ত কাহিনি! এখন আমরা সেফ তো?”

“বলতে পারো। তবে বিপদ তো বলে-কয়ে আসে না। উই হ্যাভ টু বি কেয়ারফুল।”

“আচ্ছা, তারপর ছেলেটির সাথে কী করলেন?”

“সে অনেক কাহিনি। জেনে কাজ নেই তোমার।”

“হ্যাঁ, তা-ও ঠিক।”

“জি, ম্যাডাম!”

“শুনুন। আপনাকে দেখতে খুউউউউব ইচ্ছে করছে।”

“তবে, তোমার বাসার ছাদে।”

“কখন?”

“অ্যাট টুয়েলভ এ.এম…”

_______
রাতে কুঞ্জ ভাই ছাদে আসার আগেই আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিয়ে বললেন, “হাঁটতে বেরোবে?”

আমি এক বাক্যে রাজি। ঢাকার রাস্তাগুলো বরাবরই আমার ভারি পছন্দের। রাত হলে তো এর রূপই পালটে যায়। আমি জলদি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একজোড়া স্বর্ণের চুড়ি আর একটা নাকফুল পরে নিলাম। নারী-অঙ্গেতে স্বর্ণ ভারি সাজে! রাতে যখন চাঁদের আলো পড়বে, তখন এটা নারীর সৌন্দর্য কয়েক লক্ষ গুন বাড়িয়ে দেবে। তাছাড়া যদি পুলিশের হাতে পড়ি, তো ফ্যামিলি পিকচার্সের সাথে এগুলো দেখিয়ে বলতে পারব– আমরা ম্যারিড। সো, ইটস মাল্টিপার্পাজ।

যেহেতু বাসার ছাদেই দেখা করার কথা ছিল, তাই আর চেঞ্জ করিনি। পরনের সাদা শিফনের কুর্তি আর একটা ঢোলা-ঢালা পায়জামা। চুলগুলো বিনুনি করা। এভাবেই ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার বারান্দা থেকে যেই রাস্তাটি দেখা যায়, সেখানে কুঞ্জ ভাইকে পেলাম।

আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, “আয় হায়, নবু! তোকে তো আজ একদম বউ বউ লাগছে!”

“ও-বাবা! তাই নাকি? তা কার বউ?”

“কার আবার? অবশ্যই মি. ফাহিম কুঞ্জের।”

আমি হেসে দিলাম। বললাম, “তো, মি. ফাহিম কুঞ্জ! বাইক আনেননি?”

“অরুণকে নিয়ে এসেছিলাম। ও আমাকে ড্রপ করেই চলে গেছে। তাছাড়া, আজ আমরা হাঁটব।”

“কোন রাস্তায়?”

“রোড এইটে হাঁটবি না কি রোড ইলেভেনে?”

“আটে তো আমরাই থাকি। এখানে হাঁটব? পাগল!”

“কেন?”

“ইশ! বাবা মাঝে মাঝেই রাতে ওঠেন, ব্যালকনিতে এসে যদি খেয়াল করেন! তার চেয়ে ভালো হবে, আমরা ইলেভেনেই যাই।”

“অ্যাজ ইওর কমান্ড, ম্যাম!”

আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন কথা বলতে লাগলাম। পাগলামো করলাম। এখনও এই রাস্তায় মাঝে মাঝে রিকশা চলছে। যখনই ফাঁকা রাস্তা পাই, মাঝে এসে দু’হাত ছড়িয়ে ঘুরতে থাকি। কুঞ্জ ভাই তখন হাসেন। ইশ! এভাবে হেসেই বোধহয় জান নিয়ে নেবেন!

এরই মাঝে সেখান দিয়ে পুলিশের জিপ অতিক্রম করার সময় আমাদের দেখে থেমে গেল। আমি শুকনো ঢোক গিলে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি নির্বিকার হয়ে আছেন। জিপ থেকে একজন পুলিশ নেমেই আমাদের দিকে এগোল। কাছে এসেই কুঞ্জ ভাইকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, এখানে তুই!”

কুঞ্জ ভাই সোজাসাপটা বললেন, “বউ নিয়ে ঘুরছি রে।”

“বাব্বা! বিয়ে কবে করলি?”

“করব, সামনে। তুই করিসনি?”

“কেয়া গ্র‍্যাজুয়েশন অবধি অপেক্ষা করতে বলেছে রে।”

“আচ্ছা, যা তবে। কাল ক্যাম্পাসের সামনে একটু চক্কর দিস। দেখা হবে।”

“আচ্ছা, খোদা হাফেজ।”

“খোদা হাফেজ।”

এরপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল। পুলিশটা চলে যেতেই বললাম, “এটা কী হলো?”

“কোনটা?”

“এই যে, পুলিশটাকে আপনি চেনেন। আমি তো বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”

কুঞ্জ ভাই হেসে বললেন, “কেন?”

“কেন আবার! মাঝরাতে একজোড়া যুবক-যুবতী এভাবে ঘুরছে। উচিত ছিল, হাজতে ঢোকানো।”

“এত শখ তোমার? তাহলে একদিন থাকার ব্যবস্থা করি? কী বলো?”

আমি বিরক্ত হয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম, “আপনি একটা খারাপ লোক।”

উনি হাসতে লাগলেন। নিস্তব্ধ সড়কে এই হাসি কেমন যেন মোহনীয় শোনাল। খুব খুব মাতাল করা শব্দ হচ্ছিল। পাশে থেকেও তাঁর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আকাশে গুমোট ভাব। মাঝে মাঝে মেঘেরা শব্দ করে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবে বোধহয়!

কিছুক্ষণ বাদে কুঞ্জ ভাইকে বললাম, “আচ্ছা, এখন আমাকে প্রসন্ন করুন।”

উনি হেসে শুধালেন, “তো কীভাবে মহারানী প্রসন্ন হবেন?”

“আপাতত চা খেতে চাই।”

“চলো। করিম চাচার দোকান ১টা অবধি খোলা থাকে।”

কথাটা বলেই উনি ঘড়ি দেখলেন। সময় দেখেই বলে উঠলেন, “ওহ্ শিট!”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী হলো?”

“১টা ৮ বাজে।”

তারপরই আমার হাত ধরে দৌড় লাগালেন। আমরা তখন রোড টুয়েলভের সামনে ছিলাম। পিছে ঘুরে রোড টেন-এ তে গেলাম। করিম চাচা সবেই দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে থামলেন। কুঞ্জ ভাই বললেন, “চাচা! আর একটু থাকো। দুই কাপ চা দাও না আমাদের।”

করিম চাচা হেসে বললেন, “দিতাছি। বসো তোমরা। এনে কী করতাছ এত রাইতে?”

আমি সামনে ফেলে রাখা বেঞ্চে বসলাম। কুঞ্জ ভাইও বসতে বসতে বললেন, “আর বোলো না, চাচা! নবু বলল, ঘুরবে এখন। তাই আর কী!”

আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলাম, “কী মিথ্যুক!”

করিম চাচা হা হা করে হেসে উঠলেন। আমাদের কাণ্ড দেখে উনি ভারি মজা পান। চা খেতে খেতে আরও অনেকটা সময় পেরোল। করিম চাচা আমাদের সাথে আড়াইটা অবধি ছিলেন। এই দেড় ঘণ্টায় আমি ছয় কাপ আর কুঞ্জ ভাই চার কাপ চা খেয়েছেন। তারপর আবার হাঁটলাম। হাঁটা শুরু করতেই দারুণ ভাবে বৃষ্টি নেমেছিল। সেই বৃষ্টিতে দুজন একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে ভিজলাম। আহা! দিনগুলো তো এই সময়েই সুন্দর! বয়স বাড়তেই, এসব আমাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, নতুবা ব্যস্ততায় আর হয়ে উঠবে না।

তবে একটা কথা মানতেই হয়। যেদিন থেকে কুঞ্জ ভাই আর আমার সম্পর্ক দু’জনের সামনেই প্রকাশ্যে এসেছে, সেদিন থেকেই ওঁর সাথে আমি সত্যিকার অর্থে জীবন উপভোগ করে চলেছি। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি ক্ষণ, উনি আমাকে সুখে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। এত এত সুখে, আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম— সুখ ক্ষণস্থায়ী।

চলবে…

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩৬|

সুখ সাময়িক। প্রেমে সফল ব্যক্তিই যে সর্বোচ্চ সুখী, ব্যাপারটা এমন নয়। প্রেমের চেয়েও আগে কিছু আছে। সেটা হলো বন্ধুত্ব। আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব বড্ড প্রগাঢ় ছিল। পড়াশোনায় যে আমরা চারজনই খুব ভালো ছিলাম, তা না। রাহী টপার ছিল, আর চিত্রা-নৌশি-আমি মোটামুটি পর্যায়ের স্টুডেন্ট ছিলাম। তবুও পড়ালেখার পেছনে শ্রম দিয়েছি অফুরন্ত। রিজন একটাই। চারজনকেই একই সাথে থাকতে হবে। যেহেতু চারজনেরই স্বপ্ন মেডিকেল ছিল, তাই টার্গেটে রেখেছিলাম ডিএমসি। এজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু হলো না। পাবলিকে চান্স পাওয়াটা আমাদের চারজনের কাছেই বড্ড আনন্দের বিষয় ছিল, কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে শোকে পরিণত হতে লাগল তখন, যখন জানতে পারলাম– চারজন চার জায়গায়।
আমার ডিএমসিতে হয়েছে। রাহীর মেডিকেলে একটুর জন্য আসেনি, তবে ইঞ্জিয়ারিংয়ে হয়েছে; চুয়েটে। নৌশির সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল আর চিত্রার জাবিতে। এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমরা কল্পনাতেও আনিনি।
প্রথম প্রথম মন খারাপ হলেও, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কেটে গেল দুটো বছর। তবে ভুলতে পারিনি সেই দিনগুলো। রাহীর অভিমান, চিত্রার অবুঝ স্বভাব, নৌশির গুন্ডামী! কিচ্ছুটি ভুলিনি। মাঝে মাঝে সেসব মনে হতেই, বুকের ভেতরটায় চিড়িক দিয়ে ওঠে। বড্ড অস্থির লাগে।

সেদিন আমার বিশতম জন্মদিনে, আমি মামার কাছে এক অদ্ভুত আবদার করে বসি। মামা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “যা লাগবে, আমাকে বলবি, আমি এনে দেব।”

আমি হেসে শুধাই, “সত্যিই তো?”

মামা কথা দেন, “আমার মা যা বলবে, তাই তাকে দেব।”

আমি তখন সোজাসুজি চেয়ে বসি তারই ছেলেকে, “তবে সামাজিকভাবেও আপনার মেয়ে হতে চাই।”

মামা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, “তা কীভাবে?”

লাজ-লজ্জা খেয়ে বলি, “আপনার ছেলের বউ হয়ে।”

মামার হাসি মিইয়ে যায়। পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ– কোনো টাইপেরই অ্যান্সার পাই না। আমার মন বিষিয়ে যায়। তবুও আশা ছাড়ি না। এতে অবশ্য লাভ বৈ ক্ষতি হলো না। একদিন এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন মামা, “ভেবে চাইছ তো?”

এই এক প্রশ্নে অনেক কিছু বুঝে যাই। খুশির আর সীমা থাকে না। কোনোমতে উত্তরে বলি, “জি, মামা।”

তারপর একদিন আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটল। আমি তখন মামার সাথে বসে গাল-গল্প করছিলাম। আজ-কাল আর বাসায় মন টেকে না। গত বছর আপিরও বিয়ে হয়ে গেছে আসিফ ভাইয়ের সাথে। সে-অনেক কাহিনি। সবটা লিখতে গেলে, বাকি কথা লিখতে ভুলে যাব। তাই ওই ঘটনা স্কিপ করলাম। তো, ও-বাসায় মন টেকেই না। আগে যেমন হুট-হাট মামার বাসায় চলে আসতাম, এখন আর তারও ইচ্ছে হয় না; রাহী নেই যে! মাঝে মাঝে অবশ্য ছুটিতে আসে, তবে তাতে কী আর সাধ মেটে? নৌশির সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়, তবে চিত্রার সাথে আর এই দুই বছরে দেখা হয়নি। আঙ্কেল-আন্টি গ্রামে চলে গিয়েছেন যে।
ইদানিং কিছুটা মন খারাপ নিয়ে ঘুরছি। খানিকটা উদাস মনে আকাশ দেখছি। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে পড়াশোনায়। রাতটা আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমেই কাটাই। এই নিয়ে কেউ কখনই কিছু বলেনি।
তখন, দুপুরে খাওয়া শেষে, মামার সাথে বিভিন্ন কথা বলছিলাম। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।

মণি কিচেনে ছিল, তাই আমিই গিয়ে দরজা খুলি। খুলতেই, সামনে কুঞ্জ ভাইকে দেখে আমি বিস্ময়ে রা করতে পারি না। কথা বন্ধ হয়ে যায় আমার। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হলেও, কখনও বাসায় আসেননি উনি। আজ এলেন! তাও আবার মামা থাকতেই! মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগল সেই আবদারটি। বিগত দুই বছরে বোধহয় এত খুশি আমি হইনি।

আমাকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি মুচকি হেসে বললেন, “প্ল্যানিং তো মাশাআল্লাহ।”

ভ্রু কুঁচকালাম। নিচু স্বরে শুধালাম, “কীসের প্ল্যানিং?”

“দুই কাপ চা নিয়ে রুমে আয়, বলছি।”

আমি চা বানাতে কিচেনে গেলাম। গিয়ে নিয়ে ফ্রিজ খুললাম। শব্দ হতেই, মণি আমার দিকে তাকাল। এরপর আবার রান্নায় মনোযোগ দিয়ে শুধাল, “কে আসছে?”

আমি ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে ধুচ্ছিলাম। মণির কথা শুনে, ও-তে কামড় বসিয়ে বললাম, “তোমার আদরের ছানাটা এসছে, যাও যাও।”

“রাহী আসছে?”

“না না, বড়োটা।”

মণির হাত থেকে খুন্তিটি পড়ে গেল। বিকট একটা শব্দ হলো। সেদিকে মণি পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ইশ! এজন্যই বোধহয় মায়েরা মমতাময়ী।
এদিকে, তরকারি পুড়ছিল বলে। আমি খুন্তিটি ধুয়ে নিয়ে তরকারি নেড়ে দিলাম। অন্য চুলোতে চায়ের পানি বসালাম।

________
মিনিট বিশেক পর, চা নিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের সামনে গেলাম। দরজায় নক করতে গিয়েই, একটা দুষ্টুমি খেলল মাথায়। তাই, দরজা নক না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মণি কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে। কুঞ্জ ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিলেন। আমি চায়ের ট্রে-টা বেড সাইড টেবিলে রেখে, ধীর পায়ে কুঞ্জ ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত বাড়ালাম, শক্ত করে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে। এগোতেই, কুঞ্জ ভাই সরে গেলেন।
গ্রিলের সাথে বাড়ি খেয়ে, অস্ফুট স্বরে ‘উফফ!’ বলে উঠলাম। বেদ্দপ্টার এখনই সরতে হলো? তাকিয়ে দেখলাম, উনি ফোন ছেড়ে এতক্ষণে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। খানিকটা আগ অবধিও যেই ভালো মুড নিয়ে আমি ছিলাম, তার সামান্যও অবশিষ্ট নেই।
আমাকে এভাবে থাকতে দেখে উনি বললেন, “কী? কী হয়েছে?”

আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “আপনার ১২টা মেয়ে হয়েছে। কান্না করছে ননস্টপ। থামান গিয়ে।”

“নবু, একটু মেপে কথা বল! আমার ১২টা মেয়ে হলে কি তুই এখনও সারাদিন ল্যাদ খেতে পারতিস? তোর তো নাওয়া-খাওয়াই হারাম হয়ে যেত রে!”

“উফ! বাজে কথা! এখনই সরতে হলো আপনার? দু‘মিনিট পরে সরলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?”

“কেন? তুই কি দোয়া করছিলি নাকি? যে, আর দুই মিনিট পর আমার মাথার উপর সিলিং ভেঙে পড়বে!”

“ওটা সিলিং নয়, আকাশ হবে।”

“আপাতত মাথার উপর আকাশ দেখতে পারছি না। ওহহ! তোর চশমায় তো আবার বেশি দেখায়।”

“কুঞ্জ ভাই, আপনি আমার চশমার পেছনে কী পেয়েছেন? যবে থেকে চশমা নিয়েছি, তবে থেকেই এ-নিয়ে খোঁচাচ্ছেন!”

“যা-ই বলিস! তোকে চশমায় পার্ফেক্টলি ডাক্তারনি লাগে!”

“এতক্ষণে ভালো কথায় এলেন। সবসময় এরকম করে আমার প্রশংসা করবেন। বুঝেছেন? এবার ভালোয় ভালোয় বলে ফেলুন— মামা করেছেটা কী?”

“শুনবি?”

“অবশ্যই। আপনি তো সোজা কথার জাত না। মামা সব ভুলে আপনাকে আসতে বললেও, কুঞ্জ দ্যা ঘাড়ত্যাড়া জীব্বনেও আসবে না— এই গ্যারান্টি আমি নিজে দিতে পারি। তো এখন, লাইনে আসসো, মাম্মা!”

“তোর মুখের ভাষা অনেক খারাপ হয়ে গেছে, নবু। ফ্রেন্ড চেঞ্জ কর।”

নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলি, “এগুলো তো আপনার সাথে থাকার সাইডিফেক্ট।”

“কী বললি?”

ইশ! জোরে বলে ফেলেছি কি? উনি শুনে ফেলেছেন? শুনুক গিয়ে! আমার কী! মিথ্যে বলিনি তো। সাহস করে এবার ওঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, “নিজের মুখের ভাষা আগে ঠিক করুন। ছোটোরা বড়োদের থেকেই শেখে।”

কুঞ্জ ভাই কিছু না বলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার কপালে টোকা দিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলেন। উফ! জঘন্য! আমিও পিছু পিছু গেলাম।

কুঞ্জ ভাই চায়ের কাপ নিজেরটা নিয়ে, আমারটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কাপ হাতে নিয়ে শুধালাম, “এরপর?”

“তোর মামা আমাকে সেদিন কল দিয়েছিল। ভারি অবাক হই আমি। রিসিভ করলাম। অথচ, স্যার কোনো কথাই বললেন না! তারপর কল কেটে দিলেন।”

“এটুকুই?”

কুঞ্জ ভাই কিছু না বলে, চোখে হাসলেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এরপর বলুন।”

“এরপর, তোর মামা আমার ফ্ল্যাটে চলে আসে। হাজার হোক, জন্মদাতা পিতা তো! বের করে দিতে পারিনি। বাসায় এসেই আমার সামনে শর্ত রাখল, পলিটিক্স ছেড়ে দিতে।”

“আপনি মেনে নিলেন?”

“ ‘ন’-আকার না।”

“তো?”

“তো, আমিও তাকে এভাবেই রিফিউজ করলাম। উনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বাসা থেকে চলে গেলেন।”

“এটা কবের ঘটনা?”

“উম.. মাস দুয়েক আগের।”

“আমাকে বলেননি কেন?”

“স্পেশ্যাল কিছু না তো!”

“আমি আপনার সবকিছুতে থাকতে চাই, কুঞ্জ ভাই। সবকিছুতেই…”

চলবে..