কল্পকুঞ্জ কঙ্কাবতী পর্ব-৪+৫

0
246

#কল্পকুঞ্জ_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৪|

মাঝরাতে বারান্দার রেলিং-এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন আমিটা ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠছি। এই হাসির নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। আমার ভাবনায় ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কুঞ্জ ভাই।
কুঞ্জ ভাই! নামটা দু’ঠোঁটে মিশিয়ে উচ্চারণ করলাম। ইশ! বড্ড প্রশান্তি পেলাম!
আবারও খানিকটা হেসে নিলাম। লোকটা ভারি অদ্ভুত! সবথেকে আলাদা। ওঁর ব্যক্তিত্ব আলাদা। বাকিদের সামনে যেমন-তেমন, কিন্তু আমার সামনে পুরোই উলটো। যেভাবে উনি আমার সাথে কথা বলেন, তার ৫%ও বাকিরা দেখেনি।
আমি জানি এটা, বুঝি সবটাই। আমাকে বিশ্বাস করেন উনি। নিজের সবটা ভেঙেচুরে উপস্থাপন করেন। কারণ আমি ওঁকে জাজ করব না।
আমাদের সবারই এমন একটা মানুষের ভীষণ প্রয়োজন, দিনশেষে যাকে আঁকড়ে ধরে মন খারাপের রেশটা কাটিয়ে নেওয়া যায়, যাকে সবটা বলা যায়, যাকে জ্বালিয়ে এক চিলতে হলেও সুখ পাওয়া যায়, যে কখনো কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না, যার কাছে আছে কেবল সুখ, সুখ ও সুখ!
আমি হয়তো কুঞ্জ ভাইয়ের তেমন একটা মানুষ। হয়তো? নাহ্! আমি আসলেই কুঞ্জ ভাইয়ের মন ভালো করার সঙ্গী। তাই তো ওঁর মান-অভিমান সব আমাকে ঘিরেই! তাঁর সবটা তো কেবল আমার সামনেই প্রকাশ্য!
ওঁর সামনে থাকলে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি; আমি একটু বোকা কি না! মাঝে মাঝে লজ্জায় গাল ও নাকের ডগা লাল হয়ে যায়, কিছু সময় রেগে গিয়েও লাল হয়ে যায়। মনে মনে হাজারও গালি দিই। কিন্তু… কিন্তু এই একাকী সময়ে ওঁর সেসব কথা মনে করেই লাজুক হাসি। লোকটা সাংঘাতিক!

ভাবতে ভাবতে আবারও হাসলাম। খোলা অন্তরীক্ষে স্থির দৃষ্টি মেলতেই আমার প্রাণবন্ত হাসি নিভে গেল, মলিন চাহনি যেন ঐ আকাশকে আঘাত হানল। না-পাওয়া একটা চাওয়া দীর্ঘশ্বাস রূপে বুক চিরে বেরিয়ে এলো।
ছলছল নেত্রযুগল শূন্যে স্থাপন করে ধীর কণ্ঠে বললাম, “আচ্ছা, কুঞ্জ ভাই! এই যে মজার ছলে এত কথা বলেন! ঐ নির্দিষ্ট কথাটা মন থেকে বলতে পারেন না?”

চোখ ছেড়ে এক বিন্দু অশ্রু বেদনামিশ্রিত কাহিনি নিয়ে ভূমি স্পর্শ করল। জোর করেই খানিকটা হাসলাম, “তখন বললেন না, আপনি আমার? কুঞ্জ ভাই! প্লিজ… প্লিজ একটাবার আমার হয়ে যান…”

মুহূর্তেই থমকে গেলাম আমি। মুখে তৎক্ষণাৎ লাগাম টানলাম। কীসব ভাবছি আমি! ছিঃ!, ছিঃ! উনি আমার ভাই লাগেন। আম্মু ওঁকে নিজের ছেলের মতোই ভাবে। উনি আমার ভাই। আল্লাহ! মাফ করো। এসব ভাবনা ঠিক না আমার। এগুলো হয় না। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।
বুক ফেটে বেরিয়ে আসা কান্না গিলে নিলাম আমি। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। কে বলেছিল? কে বলেছিল, ওঁকে আমার ভাই হতে?

“এত রাতে ব্যালকনিতে কী করছিস?”

হঠাৎ আপির আওয়াজে আমি সংবিত ফিরে পেলাম। মুহূর্তেই আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। শীতল এক হাওয়া বেশে ভয়েরা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে গেল। আপি আমার কথা শুনে ফেলেছে কি? শুনে ফেললে কী হবে? ঠান্ডায় রমরমা এই পরিবেশে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব লক্ষণীয়।
বাড়তি সব ভাবনা-চিন্তা আপাতত বন্ধ করে চোখ-মুখ দু’হাতে ভালো করে মুছে আপির দিকে ফিরে তাকালাম। চোখে তার স্পষ্ট ঘুম। কীভাবে ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে! কপাল খানিকটা কুঁচকানো। হয়তো বিরক্ত।
আপির অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিলাম। অযথাই চিন্তা করছিলাম আমি! আপি আরও কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আমি বললাম, “ঘুম ভেঙে গেছে। আর ঘুম আসছিল না, তাই ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করি।”

“তুই হাঁটছিলি না-কি দাঁড়িয়ে ছিলি, সেটা আমি দেখতে পারিনি মনে করছিলি?”

“আসলে আপি হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছিল বলে একটু দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

আপি বারবার হাই তুলছে। পিছু মুড়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে আপি বলল, “ওভাবে থাকলে ঘুম আসবে না। ঘুম এসে থাকলেও চলে যাবে। তার চেয়ে রুমে আয়। পারলে পড়তে বোস।”

পড়া! মানে– কিছু হলেই পড়া! কিছু না হলেও তো পড়া! আপিকে বললাম, “না, না। ঘুম এসে গেছে। চলো, ঘুমোই।”

আপি বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আমিও ধীর পায়ে আপির পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশ করেছি। কিন্তু হঠাৎ এই সময়ে আপির ঘুম ভাঙার কারণ বুঝতে না পেরে আপিকে জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ তোমার ঘুম ভাঙল কী করে?”

আপি বলল, “আসিফ কল দিয়েছিল। তার নাকি আমার ভয়েস শুনতে ইচ্ছে করছিল। ন্যাকা! ছাতার মাথা আমার ঘুমটাই নষ্ট করে দিল!”

আমি এর প্রত্যুত্তর না করে মুচকি হেসে আপির পাশে শুয়ে পড়লাম। আপি মুখে যত যাই বলুক, মনে মনে যে আসিফ ভাইয়ার কলে কতটা খুশি হয়েছে; তা আমার জানা আছে। চোখ দু’টো বন্ধ করে ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম।

অনেকটা সময় পরও দু’চোখের অতলে ঘুমের বসত হলো না। এর কারণ হিসেবে কী দায়ী করব? আজ বিশেষ কী হলো, যে আমার মতো ঘুমপোকা একটা মেয়ের ঘুম হারাম হলো? বিশেষ বলতে শুধু একটাই ঘটনা আছে, তা হচ্ছে কুঞ্জ ভাই; কুঞ্জ ভাইয়ের এই মুহূর্তে, এই বাড়িতে অবস্থান। ধুর! ভাল্লাগে না! এপাশ-ওপাশ করতে করতে ক্লান্ত আমি। এদিকে আমার বোন! শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সে!
বড়ো বোনের ঘুম হারাম করতে না পারলে আমি কোন খেতের ছোটো বোন? শয়তানি হাসি আমার ওষ্ঠ দখল করে নিল।
মিটমিটিয়ে হেসে আমি আপিকে সুর করে ডাকলাম, “আপিইই! ওওও আআপিইই!”

আপি ঘুমুঘুমু কণ্ঠে শুধাল, “কী?”

আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “আজ কী বার?”

আপি বিরক্ত হলো। জবাব দেওয়ায় আলস্য বোধ করে আবারও ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। আমি বেশি না, আর একটু জ্বালাব।

আবারও আপিকে ডাকলাম। আপি এবার ছোটো ছোটো করে চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মেকি হেসে বললাম, “একটা কথা ছিল।”

আপি জিজ্ঞেস করল, “কী?”

বড্ড গম্ভীর মুখ করে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, এই যে দেশে দিনদিন দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। আমাদের কি এজন্য কিছু করা উচিত না?”

“ঘুমা। এগুলো পরে ভাবিস।”

“আপি! তুমি কিন্তু নিজের দেশের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। প্লিইইজ! লেট’স টক অ্যাবাউট ইট!”

“ঘুম পাচ্ছে, সোনা।”

“আপি! ইট’স সিরিয়াস!”

আপি আমার চরম স্তরের গম্ভীর মুখভঙ্গী দেখে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, ”ওকে, কী করতে চাস?”

“আমার মনে হয়, এজন্য দায়ী ঐ স্লোগানটা।”

“কোনটা?”

“ঐ যে! ‘দু’টি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’—এটা।”

“কীভাবে?”

“আরে! এই যে! ধরো, পাশের বাসার ঐ নতুন দম্পতি…. ঐ যে, মাস দুয়েক আগেই এলো না? তারা এই স্লোগানটাকে অনুসরণ করে দু’টি সন্তান নিল।”

“ঐ দম্পতি কয়টা সন্তান নেবে, এটা তুই কী করে জানবি?”

“আরে! ধরতে বলেছি তো!”

“আচ্ছা, ধরলাম।”

“হ্যাঁ। কিন্তু এই দম্পতির তিন নম্বর সন্তানটা একজন সচেতন দেশ প্রেমিক। তো দুই সন্তান নিলে এই দেশ একজন দেশ প্রেমিক মিস করে গেল না? দেশের কত বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল, ভেবে দেখেছ?”

“এত সব কী করে বলছিস? এও তো হতে পারে, ঐ তিন নম্বর সন্তানটা একটা বখাটে।”

“ছিঃ! একটা না হাওয়া বাচ্চার ব্যাপারে এই ধারণা তোমার? হাও ক্যান ইউ বি সো নেগেটিভ? যা বুঝতে পারছি, আসিফ ভাইয়ার ভবিষ্যতে প্রচুর নেগিটিভিটি।”

আপি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে উলটো দিকে ফিরে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ল। এতে যা বুঝলাম আমি, কয়েক ঘণ্টা কুঞ্জ ভাইয়ের সংস্পর্শে থাকতেই আমি তাঁর গুণগুলো আয়ত্তে এনে ফেলেছি! প্রচুর হাসি পাচ্ছে। শেষে কি না আমিও!

আচ্ছা! এখন কী করব আমি? আপিকে একটুখানি শান্তির ঘুম উপহারস্বরূপ দান করে রুমের বাইরে চলে গেলাম। সমগ্র ফ্ল্যাটের অন্ধকারত্ব ফিচলে হয়েছে কোথা থেকে আগত এক আলোক-রশ্মির দরুন। লক্ষ করলাম, এই আলোক-রশ্মি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দিক থেকে এসেছে; দরজার ফাঁক থেকে আলতো আলো এই অন্ধকারে প্রবলভাবে বিরাজ করছে।
কী করব, কী করব –ভেবেই আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের নিকটে চলে এলাম। না বুঝে, না জেনে, অকারণে, অনিচ্ছায়, অনেকটা মোহাচ্ছন্ন ভঙ্গিতেই আমি পরপর তিনবার কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দরজায় নক করে বসলাম।
হঠাৎ আমার এই ধ্যান কেটে গেল। তৎক্ষনাৎ আমি সরে গিয়ে রান্নাঘরের দেয়ালের পাশে লুকালাম। আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে কেন গেছি, বুঝতে পারলাম না। বারবার মনে হলো কোনো এক অদৃশ্য সুতো আমাকে সেদিকে টেনে নিচ্ছিল, দু’চোখ কোনো সুউচ্চ বেষ্টনী দ্বারা আবৃত ছিল, হাত দু’টো বাঁধা ছিল; সুতো যেদিকে টানছিল, আমি নির্বিকার হয়ে ঠিক সেদিকেই চলছিলাম। কিন্তু, কেন?

রান্নাঘর থেকে সোজা দিকেই কুঞ্জ ভাইয়ের রুম। সরাসরি তাকালে, দেখা যায়। কিছুক্ষণ যেতেই কুঞ্জ ভাই দরজা খুলে ফেললেন। সে শব্দ কর্নকূহরে আসতেই খানিকটা কেঁপে উঠলাম।
উনি ঘুমোননি কেন এখনও? ওঁর প্রেমিকার সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত নাকি? নিজেকে তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললাম। সে ভাবনায় নিজেকে হারাতে দেওয়া চলবে না। এখন নিজের মনকে একটু শান্তি দিতে হবে। আর তার অন্যতম উপায় হচ্ছে, কুঞ্জ ভাইকে জ্বালানো! ঠোঁট এলিয়ে হাসলাম।

কিছুক্ষণ পর দরজা লাগানোর আওয়াজ পেয়ে আমি পুনরায় সেদিকে তাকালাম। হ্যাঁ! দরজা লাগিয়ে দিয়েছেন। পা টিপে টিপে আবারও গেলাম। এবার হয়তো উনি সজাগ, দরজা নক করার সঙ্গে সঙ্গেই খুলবেন। তাই, তিনবার না; একবার নক করেই কেটে পড়ব।
নক করার জন্য যেই না হাত এগোলাম, ওমনিই দরজা খুলে গেল আর আমার হাত গিয়ে আটকাল কুঞ্জ ভাইয়ের সুপ্রশস্ত বুকে। ধুকপুক! ধুকপুক! ধুকপুক! আওয়াজেরা যেন মিশে যাচ্ছে; আমার সাথে, ওঁর সাথে। নাহ্! কেমন যেন খেই হারা নৌকোর মতো লাগছে নিজেকে। কিন্তু, আমি এতটা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারি না।
তড়িঘড়ি করে নিজের হাত সরিয়ে ফেললাম। সামনে কুঞ্জ ভাই ভ্রু- কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। মাতাল করা চোখ দু’টো খেলে বেড়াচ্ছে আমার মুখশ্রীতে। উষ্ণ ওষ্ঠ যেন হালকা বেঁকে আছে। না তো হাসছেন, না গম্ভীর হয়ে আছেন। এত শান্ত! আমার সামনে! চাহনিতে যে কী খেলছে, বোঝা দায়! ওঁর গায়ে থেকে ভেসে আসছে একটা তীব্র ম্যানলি স্মেল। এটার প্রতি ভীষণ দুর্বল আমি। ভীষণ, ভীষণ! মুহূর্তেই আমার চোখ গিয়ে আটকাল কুঞ্জ ভাইয়ের গলায়! আর তাকালাম না। অন্য নারীর নিজস্ব পুরুষকে এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছি! কুঞ্জ ভাই ঠিকই বলেন, ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ।
চোখ সরিয়ে মেঝেতে স্থির করলাম। নাহ! আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না। নয়তো সেলফ কন্ট্রোলের রফাদফা হয়ে যাবে। শেষে কি না কুঞ্জ ভাইয়ের ‘লুচু মহিলা’ ট্যাগটি সত্যিতে প্রমাণিত হবে। এটা হতে দেওয়া যায় না!
কিন্তু…! আবারও কুঞ্জ ভাইয়ের গলার দিকে তাকালাম। একটা ছেলের গলার মধ্যে কী এমন আছে? শুকনো ঢোক গিলে দু- কদম পিছিয়ে গেলাম। এই লোকটা আমাকে পাগল করেই ছাড়বেন! ধুর!

কুঞ্জ ভাই এবার মুখ খুললেন, “কী?”

আপনাকে সাবধান করতে এসেছি, কুঞ্জ ভাই। এই বাসা থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো এই লুচু মহিলার হাতে নিজের সম্ভ্রম হারাতে পারেন। আপনাকে দেখে আমার কেমন কেমন লাগছে! বরাবরের মতোই আপনার গার্লফ্রেন্ডের উপর হিংসে হচ্ছে।
এগুলো গলায় অবধি এসেও কণ্ঠনালিতে আটকে গেল। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললাম, “কুঞ্জ ভাই! আই থিঙ্ক…”

থেমে গেলাম। কী ভেবেছি? কুঞ্জ ভাই তাগিদ না দিয়ে নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইলেন। যেন ওঁর তরফ থেকে কোনো অশ্রবণীয় সুর আমার কানে ভরাট ও গম্ভীর, সাথে খানিকটা নেশালো গলায় বলে গেল, “এই সময় তোমার নামে, নবনী। টেইক ইউর টাইম।”

আমি থামা থামা গলায় পুনরায় বললাম, “আই থিঙ্ক, আই শ্যুড টেল ইউ।”

কুঞ্জ ভাই বুকে হাত গুঁজে বললেন, “হোয়াট?”

“প্রতি গ্লাসে সাত রাত করে পানি খাওয়া উচিত।”

কথাটা বলেই জিভ কাটলাম। নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য উদ্যত হলাম। মুহূর্তেই আমার ভেতরকার সত্তা আমাকে বলল, “থাম, নবনী। থাম। তুই সমীকরণ জটিলের চেয়েও জটিল করে দিবি অ্যান্ড ফাইনালি, জিরো পাবি। তার চেয়ে মুখ বন্ধ রেখে হাত-পা চালিয়ে বিদেয় হ।”

সেই উদ্দেশ্যেই পিছু মুড়ে চলে যাব। তৎক্ষনাৎ আমার ডান হাতের কব্জি কোনো শক্ত বন্ধনীর মুঠোতে আবদ্ধ হয়ে গেছে! আমি জানি, চিনি এই স্পর্শ। নাহ্! নবনী, নাহ্! এই লোকটার তোকে পাগল করে দেবে! তুই মরবি এই লোকটার মাঝে!

চলবে…?

#কল্পকুঞ্জ_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৫|

সকাল আটটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ দু’টো আলতো ভঙ্গিতে খুলে সিলিংয়ে স্থির করলাম। ঘুম ভেঙে গেছে বললে ভুল হবে; তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি ছিল আমার অবস্থান। সবকিছু অনুভব করতে পারছি; কখন কে কী বলল, সব শুনতে পারছি। এই যে মিনিট বিশেক আগে আপি তৈরি হয়ে বেরোল, এটাও আমার সুপ্ত মস্তিষ্ক টের পেয়েছে। আধ জাগরণের মাঝে অবস্থান করছিলাম। তবে আজ কোনো তড়িঘড়ি নেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাগিদ নেই। মায়ের এত বকা শুনেও সকালের ঘুম ভাঙার মানে নেই। কেননা, আজ কলেজে অফ। কিছু বিশেষ কারণবশত আজ কলেজ অফ।

সিলিংয়ে স্থির রাখা দৃষ্টি নিজের মন-মতলবি কাহিনি গড়া শুরু করল। আজ কী কী করব, মুহূর্তেই তার একটা ছোটো-খাটো হিসেব কষে ফেলল। চোখের পাতা খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ করতেই কাল রাতেই সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। কুঞ্জ ভাই যখন আমার হাত ধরেছিলেন!

তিরতির করে কাঁপছিল আমার পাতলা ওষ্ঠদ্বয়। চাহনি অস্থির; কখনো নিচে, কখনও ডানে, কখনও বামে। আবার কিছু সময় অবাধ্য মনটা নিষেধ এড়িয়ে তাকিয়েছিল আমার ঠিক সামনে দণ্ডায়মান সেই পুরুষটির দিকে। কিছু বলতে পারছিলাম না। অথচ সেই লোকটা! সেই লোকটা দিব্যি নির্বিকার ছিল। থাকতে পারছিলাম না কেবল আমিই। অশান্ত, অবাধ্য, ছটফট করতে থাকা হৃদয়টা চাচ্ছিল এক্ষুনি বেরিয়ে আসতে।
অন্যদিকে সেই স্পর্শ! কেন এভাবে ছুঁলেন আমায়, আমার মনকে? কেন বুকের ভেতরে বিষাদের এক জ্বালা ধরিয়ে দিলেন? আমি শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর ঐ ভয়ঙ্কর সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেই তাকানোতে প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কেন আমার কাছে অন্য রকম? সব পুরুষের চেয়ে অন্যরকম?’
তবে উনি বুঝতে পারেননি এই প্রশ্ন। হয়তো ভেবেছিলেন, আমার চোখে জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রশ্নটা এই ছিল, ‘কী জন্য হাত ধরলেন? আটকালেন কী জন্য?’

তাই তো তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে থাকা হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিয়েছিলেন। আর কয়েক পলকের মাঝেই তা ছেড়েও দিয়েছিলেন। তারপর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, “আর ইউ ড্রাংক?”

প্রশ্নের মানে বুঝেছিলাম আমি। মাঝরাতে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের ঘরে একটা যুবতী মেয়ে কেন এলো! এই সমাজ এসব অন্য নজরে দেখে, সে নজর যে বড্ড বিচ্ছিরি! তবে কিশোরী হৃদয় থোড়াই না সমাজের তোয়াক্কা করে!
সেই সময় হয়তো বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘হ্যাঁ! আপনার মাতাল করা সেই চাহনিতে আমি মাদকাচ্ছন্ন। ইয়াপ্… আ’ম ড্রাংক।’
কিন্তু সে কি আর বলতে পারি? বলিনি। নিশ্চুপ, স্থির, অবিস্তৃত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জবাব দিতে পারিনি।
কুঞ্জ ভাই কী ভাবছিলেন, তা আমার অজানা ছিল। কেননা ওঁকে আমি দেখতেই পারিনি। তবে ক্ষণিক সময়ের মধ্যেই কুঞ্জ ভাই ভরাট গলায় বলে ওঠেন, “সোজা রুমে গিয়ে ঘুমা।”

ব্যাস! সেই এক কথা। অনুমতি পেয়েই আমি ছুটে চলে এসেছিলাম নিজের রুমে। গা এলিয়ে দিয়েছিলাম নিজের প্রিয় জায়গায়, সুপরিচিত বিছানায়। ঘুম কি আর চোখে ধরা দেয়?
সেই যে রাত বেজেছিল তিনটে। এরপর এখন আটটে! মুচকি হাসলাম আমি। লোকটার সামনে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তাঁর শান্ত স্বভাব অন্যদের জন্য। আমার সামনে তো উনি একটা বজ্জাত লোক! সেভাবেই থাকুক না!
কেন যে পালটে যায়! ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললাম। অদ্ভুত! কুঞ্জ ভাই ভারি অদ্ভুত একটা লোক!

আমার ভাবনার মাঝেই ফোন রিং হলো। শব্দ পেয়ে ফোন খোঁজা শুরু করলাম। কাল রাতে কোথায় রেখেছি, মনে পড়ছে না। শব্দ অনুসরণ করে দেখলাম ফোনটা বেডসাইড টেবিলের ফ্লাওয়ার্ভাসের পেছনে। হাতে নিয়ে দেখলাম কল এসেছে। উজ্জ্বল স্ক্রীনে ভেসে আসছে একটা নাম, ‘নীতি’!

মুহূর্তেই মুচকি হাসি আমার ওষ্ঠ দখল করে নিল। রিসিভ করে কানে তুলে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

ওপাশ থেকে নীতি বলল, “বুবু! কেমন আছো?”

আমি মিষ্টি হেসে বললাম, “ভালো আছি, জান। তুমি কেমন আছো? খালামণি কেমন আছে?”

“মা ভালো আছে। আমিও খুউব ভালো আছি।”

“খেয়েছ সকালে?”

“হ্যাঁ, বুবু। তুমি?”

“উঠিনি এখনও। তো! কী মনে করে এত সকালে কল দিলে?”

ওপাশ থেকে নীতির মিটিমিটি হাসির আওয়াজ এলো। আমার কপাল কুঁচকে গেল, তবে অধরে এখনও খেলা করছে সেই হাসি।

নীতি বলল, “সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

“কী সারপ্রাইজ?”

“সেটা বলে দিলে সারপ্রাইজ হলো নাকি!”

নিজের বোকামি ক্যাটাগরির প্রশ্নের জন্য হেসে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ নীতি আর খালামণির সাথে কথা বলে কল কেটে দিলাম। আর মিনিট দশেক ওভাবেই শুয়ে থেকে উঠে পড়লাম। অস্বস্তি লাগছে। ছুটির দিনে বেলা করে ঘুমোতে ইচ্ছে করলেও আর হয়ে ওঠে না।

__________
শাওয়ার নিয়ে গুনগুন করতে করতে ডাইনিংয়ে চলে এলাম আমি। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছি আমি আর আম্মু। এটা নতুন না। গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। তারপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে ডাক দিলাম আম্মুকে।

আম্মু তাকাতেই হেসে দিলাম। আমার এই স্বভাব তার চেনা, খুব ভালো করেই জানে। তাই আর কিছু না বলে পরোটা ছিঁড়ে খাইয়ে দিতে লাগল। আমিও আরামসে মায়ের হাতে খেতে লাগলাম! আহা! এই চেয়ে শান্তি নেই। মনে হচ্ছে যেন অমৃত খাচ্ছি।

তবে হুট করেই আমার মনের মাঝে কিছু একটার অভাব অনুভব করলাম। সাথে বুঝলাম, আমার চোখ এদিক-সেদিক কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কী?
সময়ের তালে এটাও বুঝলাম, আমি কুঞ্জ ভাইকে খুঁজছি। খেতে খেতেই আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কুঞ্জ ভাই কোথায়?”

আম্মু নিজেও খাচ্ছে আর বলছে, “সকালে সবার সাথেই খেয়েছে। এখন রুমেই আছে।”

আমি আর কিছু বললাম না। আম্মু আবারও বলল, “তোর কোনো কাজ আছে আজ?”

আমি কিছু একটা ভেবে বললাম, “না।”

আম্মু যেন হালকা হাসল, “ভালোই হলো। একটু বড়ো ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে তোকে। ভাবি যেতে বলেছিল।”

“ঠিক আছে। খেয়েই যাব।”

“আচ্ছা। কুঞ্জর সাথেই যাস।”

মুহূর্তেই যেন ডাইনিংয়ে ছোটো-খাটো বিস্ফোরণ হলো। ওঁর সাথেই কেন যেতে হবে? এখান থেকে এখানে, আমি একাই তো যেতে পারব!
এই কথাগুলো অগোছালো ভাবে আম্মুকে বললাম। কিন্তু আম্মু বুঝল না। তার একটাই কথা, আলাদা যাওয়ার কী আছে? একই বাসা থেকে বেরোবে, একই বাসায় যাবে, সেখানে আলাদা আলাদা কেন?
আর কী বলব আম্মুকে? খাওয়া শেষ করে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম। আমি ভাবিইনি, কাল যা কাহিনি করলাম, তার পরও ওঁর সামনে কী করে যাব!

_____________
বাসা থেকে বেরিয়েছি। ঢাকার ব্যস্ত সড়কে হেঁটে চলছি। আমার ঠিক পাশেই, একটু সামনে দিয়ে হাঁটছেন কুঞ্জ ভাই। সেই যে রাতে কথা হয়েছিল, এরপর আর দু’জনের একজনও কোনো কথা বলিনি। আচ্ছা! আমি না হয় লজ্জা পাচ্ছি, তবে উনি কেন কথা বলছেন না! বাচাল লোক একটা! এভাবে তো সারাদিন বকবক করতেই থাকেন! আর এখন যখন চাচ্ছি, তখন কথাই বলছেন না!
সে যাক গিয়ে! আমি এক দৃষ্টিতে ওঁকে পেছন থেকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। কুঞ্জ ভাই হোয়াইট টিশার্ট পরে আছেন। মাঝে মাঝে হালকা বড়ো হওয়া চুলগুলো এক হাতে ছুঁয়ে যাচ্ছেন।
আমি ওঁর পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছি। তিন মিনিটের এই রাস্তা। প্রথমে একসাথে আসা নিয়ে ঘোর আপত্তি করলেও এখন বলতে ইচ্ছে করছে, “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”

আমার অজান্তেই গানটা মুখে এনেছি। গুনগুনিয়ে গেয়েই যাচ্ছি। হঠাৎ কুঞ্জ ভাই পা দুটো থামিয়ে দিলেন। হতবিহ্বল নেত্রে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।

উনি দু’কদম পিছে এসে আমার পাশাপাশি দাঁড়ালেন। ওঁর চাহনি আমার চোখের মাঝেই সীমাবদ্ধ। এক, দুই, তিন! তিন সেকেন্ড ছিল। দ্রুত অন্যদিকে সরিয়ে দিলেন। যেন আমার চোখে আর কিছুক্ষণ তাকালেই ওঁর মন ভস্ম যাবে! কুঞ্জ ভাইয়ের অকস্মাৎ পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারছি না।

“ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ। শেষে কি না এই অবস্থা!”

হ্যাঁহ! এখন কী করলাম? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাতেই উনি বললেন, “তুই এত সাংঘাতিক কী করে হতে পারলি, নবু? এই ভরা রাস্তায় আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লজ্জা লাগে না?”

খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। তবুও নিজের হয়ে বললাম, “আমার বয়েই গেছে!”

“হুম, হুম, হুম। তা তো দেখতেই পাচ্ছি! তুই বরং একটা কাজ কর, চোখ দুটো ঐ যে রিকশা দেখছিস, ওর চাকার নিচে ফেলে দিয়ে আয়। এই চোখ বড়োই সর্বনাশা।”

কথাটা বলেই আবারও বললেন, “কীভাবে দেখছিলি আমায়। বাসায় ফিরেই শাওয়ার নিতে হবে। উফফ! কোথায় কোথায় যে এই লুচু মহিলা চোখ দিয়ে ছুঁয়েছে!”

“দেখুন, কুঞ্জ ভাই! আপনি এভাবে বলতে পারেন না। আমি মোটেও আপনাকে ওভাবে দেখিনি। কখনো দেখিও না।”

“তো! দেখিস না কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?”

এখন এটার কী জবাব দেব? ধুর! উনি আগেই ভালো ছিলেন। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেছি। ঠিক তখনই আমার ভেতরের সত্তা আমাকে বলল, “নে! চেয়েছিলি না এটাই? বজ্জাতটা চুপ ছিল, তখন তো তোর সহ্য হয়নি। নে এখন। খুশি হ! এই খুশিতে গিয়ে মাঝরাস্তায় লুঙ্গি ড্যান্স দে।”

কুঞ্জ ভাই আবারও বললেন, “হুঁ?”

মনের অগোচরে লুকায়িত, অবাধ্য, অকথ্য কিছু কথা বেরিয়ে এলো, “না! ভয়ংকর। ভীষণ ভয়ংকর। তাই তো ঘুমোতে যাওয়ার আগে আপনাকে ভেবে ঘুমোনো হয় এবং দিনের শুরুটা আপনাকে দেখেই হয়!”

বড্ড ফিসফিসিয়েই বললাম। বাসায় চলে এসেছি। কুঞ্জ ভাইকে এক প্রকার এড়িয়েই বাসার ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু এরপর কী হবে? ধীরে ধীরে এভাবে কীভাবে এতটা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারি আমি?

চলবে…?