কাগজের তুমি আমি পর্ব-১+২

0
3096

প্রেগ্ন্যান্সি কিট হাতে বসে আছে ধারা, কিটে দুটো দাগ স্পষ্ট। মাথাটা বেশি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আবেগের তাড়ণায় একটা ভুল করে ফেলেছে। ডান হাত দিয়ে মুখটি চেপে চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো ধারা। চোখ থেকে পানি যেনো থামতেই চাচ্ছে না। এতো বড় কিভাবে করে ফেললো। বাবা-মা জানলে জ্যন্ত কবর দিয়ে দিবে তাকে। একজন অবিবাহিত মেয়ে যদি হুট করেই প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে যায় ব্যপারটা সমাজ কিংবা ধর্ম কোনো কিছুই মেনে নিবে না। সে তখন হয়ে যাবে কলঙ্কিনী। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। কয়েকদিন থেকেই মাথা ঘুরাচ্ছিলো তার, বমি বমি ভাব হচ্ছিলো। পিরিয়ড মিস হলে সন্দেহ হতে থাকে। ধারার সবথেকে ভালো বান্ধবী সারাকে ব্যাপারটা জানালে সে প্রেগ্ন্যান্সি কিট কিনে দিয়ে বলে টেস্ট করে দেখতে। এখন সেটাই করছিলো ধারা। মনের ভয়টাই সত্য হলো, তার মাঝে একটা রক্ত মাংসের মানুষ বেড়ে উঠছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো ধারা, এখন কি করবে? হুট করেই মনে হলো তার, দিগন্তকে একবার বললে হয়তো মন্দ হবে না। আর এমনিতেও ওকে জানানোটা এখন খুব বেশি দরকার। তার একটি অংশ ধারার গর্ভে বেড়ে উঠছে। এটা তো তাদের ভালোবাসার প্রতীক, আবগের বশে হলেও তারা একে অপরকে ভালোবেসেই কাছে এসেছিলো। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো ধারা। বসে থাকলে হবে না, একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। এখন ভেঙ্গে পড়লে কিভাবে চলবে! এখনও তো অনেক পথ চলা বাকি, না জানি কত পরীক্ষা বাকি হয়েছে তার জন্য, আর তাকে তো লড়তে হবে তার ভালোবাসার জন্য, নিজের জন্য, নিজের অনাগত সন্তানের জন্য_______

সকাল ৯টা,
ভার্সিটির বটগাছের নিচে বসে আছে ধারা। বিগত আধা ঘটা ধরে অপেক্ষা করছে দিগন্তের জন্য। অপেক্ষার প্রহর যেনো পার ই হতে চাচ্ছে না। এটা যেনো তার জীবনের সবথেকে দীর্ঘ আধা ঘন্টা। মানুষ যখন নির্বিকার হয়ে বসে থাকে, তখন অতীত বারবার চোখের সামনে হানা দেয়। যেমনটা হচ্ছে ধারার ক্ষেত্রে। ধারা তখন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী। এমনই একটা কুয়াশা ঢাকা সকালে ভার্সিটির গেটে দেখা হয়েছিলো দিগন্তের সাথে। দিগন্ত তখন ভূগোলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ বাইকের ধাক্কায় অন্যমনস্ক ধারা খানিকটা ছিটকে পড়েছিলো। এটা অবশ্য, ধারার অন্যমনস্ক হয়ে চলার আর দিগন্তের বাইকের হাই স্পিডের কারণেই হয়েছিলো। অনুশোচনার বশে তাড়াতাড়ি হেলমেট খুলে ছুটে গিয়েছিলো দিগন্ত ধারার কাছে। ধারা তখন নিজের পায়ে ক্ষত সামলাতে ব্যাস্ত ছিলো। পায়ে কি ব্যাথাটাই না পেয়েছিলো। প্রথম দেখাতে সাদা কামিজ, গোলাপি ওড়না পরিহিত গোলগাল পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটিকে মনে ধরেছিলো দিগন্তের। কোমল গলায় তখন তাকে জিজ্ঞেস করে,
– বেশি ব্যাথা লেগেছে? আই এম সরি। তাড়াতে ছিলাম খেয়াল করি নি।

মাথাতুলে সামনে হাটু গেড়ে থাকা শ্যামলা ছেলেটাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছিলো ধারা। এতো সুন্দর করেও কি কেউ কথা বলতে পারে? প্রথমে ভেবেছিলো বেশ কড়া করে কটা কথা শুনিয়ে দিবে ধারা। কিন্তু দিগন্তের চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেনো সব গবলেট হয়ে গেছিলো। বকা তো দূরে থাক একটা কড়া কথাও মুখ থেকে বের হয় নি ধারার। উলটো কোনো অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো, লোকটার মুখ থেকে চোখ ই সরছিলো না ধারার।
– এতো কিসের জরুরি তলব তোমার? এই সাতসকালে দৌড়াতে দৌড়েতে আসতে হলো। জানোই শীতের সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না।

দিগন্তের হিনহিনে গলার কাটকাট কথা শুনে কল্পনার থেকে বের হয় ধারা। হ্যা তার সামনে আড়াই বছর আগের দিগন্ত ই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আফসোস একটাই, এখনের দিগন্ত আর তখনের দিগন্তের মাঝে বেশ পার্থক্য। ধারা সেটা বুঝতে যে পারে না সেটা না, তবে এখনও সে দিগন্তকে পাগলের মতোই ভালোবাসে। ধারাক হা করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রুজোড়া একত্রিত করে টিটকারির স্বরেই বলে,
– আমাকে কি প্রথম দেখছো নাকি? এমন হা করে দেখার মতো রুপ গজিয়েছে নাকি?
– নিজের সন্তানের বাবাকে দেখছি, যে লোকটা কিনা নয় মাস পর একটা জ্বলজ্যান্ত বাচ্চার বাবা হবে তাকে হয়তো হা করে দেখাটা খারাপ কিছু না, তাই না?

ধারার নির্লিপ্ত কন্ঠের কথাটা শুনে দিগন্তের চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না দিগন্ত। অনেকটা ভুত দেখার মতো ঘাবড়ে যায় সে। অস্পষ্ট স্বরে ধারাকে বলে,
– সকাল সকাল কি ফাযলামি করছো তুমি? পাগল টাগল হয়ে গেছো নাকি?
– আমি ফাযলামি করছি না দিগন্ত। আজ সকালেই এক করেছি, আমার মাথায় কিছুই আসছে না। অনেক বড় ভুল অয়ে গেছে দিগন্ত। এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, তাই তোমাকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছি
– কি আর করবো, এবোর্শন ছাড়া আর কি উপায় আছে। আমরা কালকে ডাক্তারের কাছে যাবো

দিগন্তের নির্বিকার উত্তরে মাথায় বাজ পড়ে ধারার। কি বলবে কথা হারিয়ে ফেলেছে সে, যতই হোক বাচ্চাটা তাদের দুজনেরই অংশ। তাদের ভালোবাসার নিশানী। দিগন্ত কোনো চিন্তা না করেই কিভাবে বলে দিলো সে বাচ্চাটিকে নষ্ট করে দিবে। দিগন্তের কথাটি শুনে অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে আসে ধারার। যদিও কেবল একটি ভ্রুণ তার গর্ভে আছে কিন্তু সেত মা, কিভাবে নিজের জানা সত্ত্বে মেরে ফেলবে বাচ্চাটিকে, আর পাপ তো তারা করেছে; বাচ্চাটি তো নির্দোষ। অনেক কষ্টে ভাঙ্গা গলায় বলে,
– দিগন্ত, কি বলছো তুমি? বাচ্চা নষ্ট করার কথা আমি ভাবতেও পারি না। ও আমাদের
– ধারা বি প্রাকটিক্যাল, আমি তো জানতাম তুমি খুব প্রাকটিক্যাল একজন মানুষ। এখন এমোশোনাল ন্যাকামি করার সময় নয়। আমি এখন মাস্টার্স করছি, চাকরি পাই নি। এখন এই বাচ্চাটাকে রাখা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দেওয়া। বুঝতে পারছো তুমি? আমাকে এখনই তোমার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই ধারা। আমার ক্যারিয়ার আছে ভবিষ্যৎ আছে। আর তুমিও একটু ভেবে দেখো তুমি কি রেডি এই বাচ্চার জন্য?
– আসলেই আমার ভাবা উচিত ছিলো
– তাহলে কাল সকালে আমরা ডাক্তারের কাছে যাব, ওকে?

দিগন্তের কথা শুনে স্মিত হেসে ধারা বলে,
– আমার তোমাকে নিয়ে ভাবা উচিত ছিল দিগ, আবেগের বশে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে কি ভুলটাই না করে ফেলেছি। ইশ তখন যদি একটু ভাবতাম
– ধারা
– ব্যাপার না, তোমার এই বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আসি

বলেই ধারা সামনে পা বাড়ায়, পেছনে ফিরে দিগন্তের অনুতাপে ঘেরা মুখটা একবার দেখার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংযত করে। সামনে তার অনেক চলা বাকি, এখন পেছনে তাকালে হয়তো আবার দূর্বল হয়ে পড়বে। চোখের পানি অঝরেই পরছে, কি ভুলটাই না করেছে সে।

রাস্তায় হাটছে ধারা, শরীর যেনো চলতেই চাচ্ছে না ধারার। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, মাথাতা ঘুরোচ্ছে। বমিও পাচ্ছে। রোদটা বেশ চড়া হয়ে উঠেছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। শরীরটা গুলিয়ে আসছে। হঠাৎ বেশ বমি আসায় রাস্তার ধারেই গরগর করে বমি করলো ধারা। যাকে বিশ্বাস করেছিলো, সে আজ বিশ্বাসটাকে এতো নিষ্ঠুরের মতো ভেঙ্গে দিলো এটা যেনো মেতে নিতেই পারছে না ধারা। রাস্তার ধারে একটা পানির বোতল কিনে সেটা দিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো ধারা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটাকে নিয়ে রাস্তা পার হতে নিলে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়, সামনে যেনো অন্ধকার ছেয়ে আসে। গাড়ির হর্ণ কানে আসছে, পাশে তাকাতেই দেখে খুব স্পিডে একটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। ধারার পা থেমে গেলো, হয়তো এটাই তার পরিণতি। এই ভালো বাবা-মার মুখে কালি মাখার থেকে এই পরিণতিটাকে মাথা পেতে নেওয়াটা হয়তো ঢের ভালো। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো ধারার, তলিয়ে যাচ্ছে সে অন্ধকারের কোঠরে____

বিকেল ৫টা,
ধারার যখন চোখ খুলে তখন সে সাদা বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে। সে মরে নি, এখনো বেঁচে আছে। সমাজের নিম্মজীব হয়ে সারাটাজীবন অতিবাহিত করার জন্য সে বেঁচে আছে। পরমূহুর্তেই নিজের কাজে নিজের উপরেই রাগ উঠে ধারার। কি করছিলো সে। একে এক পাপ করেছে, এখন আরো বড় পাপ করতে যাচ্ছিলো। অজান্তেই পেটে হাত চলে গেলো তার।
– সমস্যা নেই, বেঁচে আছে। কোনো ক্ষতি হয় নি

কারোর কড়া কন্ঠ কানে এলে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে অটোমেটিক গলা শুকিয়ে যায় তার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। পাশে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে ধারার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই…………

[ আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের আগ্রহের জন্য আবারো অনল ধারাকে নিয়ে ফেরত এসেছে, গল্পটির কাহিনী প্রথম অধ্যায় থেকে আলাদা। কোনোই মিল নেই, সম্পূর্ণ নতুন কাহিনী। কেমন লেগেছে জানাতে ভূলবেন না।

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

__________________________________________

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#২য়_পর্ব

কারোর কড়া কন্ঠ কানে এলে পাশে ফিরে তাকায় ধারা। পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে অটোমেটিক গলা শুকিয়ে যায় তার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। পাশে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে ধারার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
– অকাম কুকাম করে পেট ফু্লিয়ে রাস্তায় মরতে যাওয়াটা কি এখন তোদের ট্রেন্ড হয়ে গেছে? ভাগ্যিস কাকতালীয়ভাবে গাড়িটা আমার ছিলো। তুই ও বেছে বেছে আমার গাড়ির সামনেই মরতে গিয়েছিলি। তা মরার সিদ্ধান্ত কি জন্য নিয়েছিস? এর বাবা অস্বীকার করেছে নাকি জানিস ই না এই জিনিসের বাবা কে? সমস্যা নেই একটু পর মামা-মামী এসে নিজের হাতেই তোকে মেরে ফেলবে।

লোকটার কথার ছিরি যে কোনো মানুষের মানুষের মেজাজ খারাপ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। রাগে, লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করতে হবে ধারার। লোকটি আর কেউ নয় তার ফুফাতো ভাই অনল। অনলকে কখনোই ধারার খুব একটা ভালো লাগে না। লোকটাকে নিতান্তই খচ্চর লাগে, এই লোকটা নাকি পেশায় ডাক্তার। কিন্তু ধারার মাথায় একটা কথা আসেই না। এতো করোলা মিশ্রিত কথা শোনার পর কোন প্যাশেন্ট আসে তার কাছে। অনলের দোষ অনেক; তার মধ্যে অন্যতম হলো লাগাম ছাড়া কথা বলে, এমন এমন কথা বলবে যেটা একই সাথে কাউকে রাগ এবং লজ্জা দুটো জিনিসের অনুভব করাতে সক্ষম। কিন্তু ধারা তাকে পালটা উত্তর দিতে পারবে না। কারণ প্রথমত অনল তার থেকে বয়সে অনেক বড়, দ্বিতীয়ত ধারা সত্যি মস্ত বড় ভূল করেছে যার জন্য তাকে সমাজের কাছে এর চেয়েও ঘৃণ্য কথা শুনতে হবে। আর যদি একবার তার বাবা জানতে পারে তাহলে তো তার নিস্তার নেই। কাঁপা কাঁপা স্বরে ধারা অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছো?
– না জানানোর কোনো কারণ তো আমি খুজে পাই নি। তারা অন দ্যা অয়ে, তবে তোমার কুকর্মের কথা আমি জানাই নি। মামা শুনলে আবার আই.সি.উ তে এডমিট হবেন। তাই ফোনে এতো বড় শকিং নিউজ টা দেই নি

নির্বিকার ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলে দিলো অনল। মোট কথা তার কিছুই যায় আসে না, মামাতো বোন বলে যেটুকু না করলেই নয় সেটুকুই করেছে সে। ধারার বুকটা রীতিমতো ধুকপুক করছে। ব্যাপারটা চাইলেও সে লুকাতে পারবে না মা-বাবার কাছ থেকে। অনল না হয় এখন কিছু বলে নি, কিন্তু তারা হাসপাতালে আসলেই তো সব জেনে যাবে। উফফ মাথাটায় কিছুই ঢুকছে না, বাবার রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে ধারার। ধারার বাবা, সেলিম সাহেব খুব কড়া একজন মানুষ। তার কাছে নিজের আত্নসম্মানের চেয়ে বড় কিছুই নয়। আজ পর্যন্ত সম্মানহানির ভয়ে একটা টাকা ঘুষ খাননি তিনি। ছাব্বিশ বছরের চাকরি জীবনে তার প্রোফাইল একেবারেই নীট এন্ড ক্লিন। আর আট মাস পর রিটায়ার্ড করবেন তিনি। দুই মেয়ে তার অহংকার। সারাজীবন বেশ ছা পোষা জীবন অতিবাহিত করার উদ্দেশ্য একটাই যাতে তার দুই মেয়েকে সব ধরণের ভালো শিক্ষা দিতে পারেন, কোনো কুপ্রবৃত্তি মেয়েদের ছুতেও না পারে। অথচ আজ ধারার একটা ভূল তাকে সারাজীবনের জন্য লজ্জায় মাথা নিচু করে বাঁচতে বাধ্য করবে। কথাটা ভাবতেই হু হু করে কেঁদে উঠে ধারা। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অঝরে কাঁদতে থাকে সে। যে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে এতোবড় ভূল করলো সেই ভালোবাসা আজ তাকে অস্বীকার করছে, তাকে ইমোশনাল ফুল বলছে। দিগন্তের কথাটা কি মেনে নিলে ঠিক হতো, এবোর্শন করালে কি এই সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে ধারা!! দ্বিধার একটা সাগরের মাঝে সাতার কাটছে ধারা কি করবে কিছুতেই যেনো বুঝে উঠতে পারছে না।
– এখন ন্যাকা কাঁদা কেঁদে কি হবে? যা কুকাম করার তাতো করেই ফেলেছিস। এখন কেঁদে ভাসালেও কিছুই হবে না। এই কান্নাটা আগে কাঁদলে কাজে দিতো।

অনলের ঠেস মারা কথায় ধারার আরোও কান্না পাচ্ছে। নাক টানতে টানতে কাঁন্নামিশ্রিত গলায় বলে,
– তুমি এমন খচ্চর কেনো অনল ভাই? মানুষ তো শান্তনাও দিতে পারে নাকি!!
– হাহ! এসব শান্তনার মতো ফাউ কাজ আমার দ্বারা কোনো জন্মে হয় নি, হবে ও না। এখন ফ্যাচফ্যাচানি থামা, নয়তো একটা থাপ্পড় মেরে সব কান্না বের করে দিবো।

অনলের ধমকে একেবারেই চুপ হয়ে গেলো ধারা। নিঃশব্দে চোখ থেকে পানি পড়ে যাচ্ছে ধারার। অনলের কেনো যেনো এই কান্না নামক জিনিসটা সহ্য হয় না। বিরক্তিপ্রকাশক শব্দ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ধারা তখন ও ভবিষ্যতের অপরিণতি ভেবে কেঁদেই যাচ্ছে।

রুম থেকে বের হতেই ধারার বাবা সেলিম সাহেব, মা সুরাইয়া বেগম এবং নিজের মা সুভাসিনী বেগমের সাথে সামনাসামনি হয় অনলের। তারা বেশ হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে পৌছেছেন। মেয়ের এমন এক্সিডেন্টের কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন সেলিম সাহেব এবং সুরাইয়া বেগম। তাই বড় বোন সুভাসিনী বেগমকেও ডেকে এনেছেন তারা। সুভাসিনী বেগম অনলের মা, অনল অবশ্য তাকে এই ব্যাপারটা একদম ই জানায় নি। শুধুশুধু মাকে চিন্তায় ফেলতে চায় নি সে। অনলকে দেখে সেলিম সাহেবের প্রথম প্রশ্ন থাকে,
– ধারার কি অবস্থা? হাড় গোড় ভাঙ্গে নি তো?
– না মামু, কিছু হয় নি তেমন তবে

অনল কিছু বলার আগেই একটি নার্স রিপোর্টের একটা ফাইল নিয়ে অনলের সামনে ধারায়। অনল তার দিকে তাকাতেই সে বলে,
– স্যার, মিস ধারার রিপোর্ট চলে এসেছে। তিনি চাইলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এবোর্শন করতে পারবেন কিন্তু স্যার কম্পলিকেশন আছে। আপনাকে ডা.মাহির সাথে কথা বলতে হবে।

হুট করে নার্সের এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যান সেলিম সাহেব। উত্তরের অপেক্ষায় অনলের মুখপানে তাকিয়ে থাকেন তিনি। অনল বেশ অপ্রস্তুতকর অবস্থায় পড়ে গেছে। সে এভাবে এই নিউজটা মোটেই জানাতে চায় নি মামু-মামিমাকে। আসলে এই রিপোর্টটা খানিকক্ষণ আগেই করতে পাঠিয়ে ছিলো সে, ভেবেছিলো এই রিপোর্টটা হাতে পেলে মামু-মামিমাকে ধীরে সুস্থে জানাবে। কিন্তু কোথায় কি! ধুমধাম করে সিনেমার মতো তারা ব্যাপারটা জেনে গেলো। সেলিম সাহেব বেশ ঠান্ডা গলায় অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– অনল, নার্স কি বললো? কিসের এবোর্শন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল বলে,
– মামু কিছু কথা বলবো, ঠান্ডা মাথায় শুনবেন

কেবিনে হাটুতে মুখ গুজে কেঁদেই যাচ্ছে ধারা। নিচের বোকামির উপর নিজের রাগ উঠছে, আবার পরমূহুর্তে নিজেকে বড্ডবেশি অসহায় মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে অথৈ জলে সাতার না পারা অবস্থাতেই পড়ে গেছে। হাসফাস হচ্ছে কিন্তু কুল পাচ্ছে না। বাবা-মা আসলো বলে, অনল তো তাদের সব বলে দিবে তখন কি হবে! এসব চিন্তায় মগ্ন ছিলো ঠিক তখনই কেউ এসে অতর্কিতে তার চুলের মুঠি টেনে সজোরে গালে চড় বসিয়ে দেয়। অবাক নয়নে তাকাতেই দেখে সামনে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখের অশ্রু প্রমাণ দিচ্ছে আজ কতোটা ছোটো হয়ে গেছেন তারা। ধারা কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারো আরেক গালে চড় বসিয়ে দেন সুরাইয়া বেগম। গলা চেপে কান্নামিশ্রিত গলায় বলেন,
– হওয়ার সময় মেরে ফেললে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। তুই আজকে মরে যেতে পারলি না। আমাদের ভালোবাসার এমন ফল দিলি তুই? কুলাঙ্গার সন্তার জন্ম দিয়েছি আমি। কত গর্ব করতাম আমি তোকে নিয়ে, ছিঃ

বলেই এলোপাতাড়ি মারতে থাকে ধারাকে। অবস্থা খারাপ দেখে সুভাসিনী বেগম এগিয়ে যান, সুরাইয়া বেগমকে কোনো মতে আটকে রেখে বলে,
– সুরাইয়া এতো বড় মেয়ের গায়ে কি কেউ হাত তুলে নাকি! শান্ত হও তুমি

সুরাইয়া বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে থাকেন। একে অবিবাহিত মেয়ে, সমাজ না জানি কি বলবে মেয়েটাকে নিয়ে। এসব চিন্তা মাথায় আসতেই আরো হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি। সেলিম সাহেব যেনো পাথর হয়ে গেছেন। নিজের মেয়ে এমন একটা কাজ করবে এ যেনো কল্পনার বাহিরে। পা তার কাঁপছে। মাথায় ঘাম জমে আছে। ধুপ করে পাশে থাকা চেয়ারটিতে বসে পড়েন সে। ধারা বাবার চোখে চোখ অবধি রাখতে পারছে না। অনল অবস্থা বেগতিক দেখে ঠান্ডা গলায় বলে,
– মামু, আমরা ধারাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো। ওর সেলাইন শেষ হয়ে গেছে।

রাত ৮টা,
বসার রুমে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছেন সেলিম সাহেব। তার মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না। সুরাইয়া বেগম আচলে মুখ গুজে কাঁদছেন। সুভাসিনী বেগম তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। অনল অপজিটের সোফায় বসা। চোখ জোড়া মুছে, সুরাইয়া বেগম জোড়ালো গলায় বললেন,
– অনল, আমরা এই সপ্তাহের মধ্যেই এবোর্শন করবো।
– সুরাইয়া এবোর্শন করলে কি এই দাগ মুছে ফেলা সম্ভব?

সুভাসিনী বেগম চিন্তিত গলায় কথাটা বলে উঠে। তার কথা উপেক্ষা করেই সুরাইয়া বেগম বলেন,
– আচ্ছা আপা, আপনার মেয়ে হলে কি করতেন বলুন তো? আমার মেয়ের ভবিষ্যত পড়ে আছে। এই বাচ্চাটা রাখলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
– মামী, এবোর্শন করলে এমন ও হতে পারে ধারা আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। কিছু কম্পলিকেশন আছে। আমি আমার কলিগ গাইনোকোলোজিস্ট এর সাথে কথা বলেছি। ও এই কথাটা বললো। এখন আপনাদের ডিসিশন

অনলের এমন কথায় সেলিম সাহেব যেনো আরো ভেঙ্গে পড়েন। সুরাইয়া বেগম তবুও অটল গলায় বলেন,
– তুমি তবুও ব্যাবস্থা করো বাবা

নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বুকে কামড় লাগে ধারার। বাচ্চা নষ্টই যদি করতে হয় তবে তো দিগন্তের কথায় সে রাজী হয়ে যেতো। তার ভুলের শাস্তি এই মাসুম কেনো পাবে। দৌড়ে যেয়ে মায়ের কাছে আছে ধারা। আকুতি স্বরে বলে,
– মা, আমার বাচ্চাকে মেরো না। ওর কি দোষ বলো। এমন নিষ্ঠুর হয়ো না মা। প্লিজ

ধারার অঝরে আকুতি করে কাঁদছে, এই কান্না পাথরের মন গলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সুরাইয়া বেগম তার সিদ্ধান্তে অটল। এখন সেলিম সাহেব মুখ খুলেন,
– আমাদের মান সম্মান তো ধুলায় মিশিয়েছো ই এখন কি আত্নহত্যা করলে শান্তি পাবে তুমি?

সেলিম সাহেবের মুখে এরুপ কথা শুনে একেবারেই চুপ হয়ে যায় ধারা। সুভাসিনী বেগম এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। ধারার এমন আকুতি দেখে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন……..

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি