কুয়াশার মাঝে তোমার দেখা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
289

#কুয়াশার_মাঝে_তোমার_দেখা
#তাওহিয়া_আক্তার
#পর্ব-৩(অন্তিম পর্ব)

“ফাবিয়া আমি তোকে দেখতে চাই।”

“ফারহান আমি না বলেছি আমাদের কোনো দেখা সাক্ষাৎ হবে না।আর তুই তো এই শর্তেও রাজি ছিলি তাহলে এখন নাকোচ কেনো করছিস?”

“প্লিজ দোস্ত একবার মিট করবো বেশি না।প্রায় ৭/৮ মাস আমরা খালি চ্যাটেই কথা বলি মিট তো করি না।”

“আমি মিট করতে রাজি নই।আর যদি মিট করার কথা বলেছিস তো আর কথাই বলবো না।”

ফাবিয়া ফারহানের সাথে কথা বন্ধ করে দিবাকে ফোন দেয়।

“হ্যালো দিবা।”

“হুম?”

“কি রে ৮ টা বাজে আর তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস?

” হুম?”

“আচ্ছা শুন না ফারহান যার কথা আমি তোকে বলছিলাম সে না আমার সাথে দেখা করতে চায়।”

দিবা কথাটা শোনা মাত্রই এক ধাক্কায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে।দিবার চোখ যেনো খুশিতে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।

“সত্যিই ফাবু। আমি সত্যিই অনেক খুশি হয়েছি।”

“হুম সত্যিই।কিন্তু এখন কি করবো?আমার যে রুপ ও তো আমায় দেখেই ভয়ে পালাবে।”

“আরে না পালাবে না।একবার দেখা করেই দেখ নাহ?”

“আমাকে যে ভুল বুঝবে?”

“বুঝলে বুঝবে কিন্তু দেখা কর।”

ফাবিয়াও দিবার কথা মেনে ফারহান আগামী পরশু বটতলায় দেখা করার কথা বলে।ফাবিয়ার মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথে ফারহান খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়।মূলত ফাবিয়ার সাথে শুধু দেখা করা না,ফাবিয়াকে নিজের মনের কথা জানাতেই সাক্ষাৎ করা।প্রথমদিনই ফারহান ফাবিয়ার উপর আর্কষিত হয়।

ফারহান নিজেকে সাজিয়ে পরিপাটি করে নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য রওনা হয়।

অন্যদিকে,ফাবিয়া মুখ ঢেকে বটতলায় বসে আছে।আজ না জানি ফারহান তাকে দেখে কিরকম আচরণ করবে?ফাবিয়া ভয়ে নিজের হাতে নিজেই আঁচড় কাটছে।এমতাবস্থায় ফাবিয়া বুলি করা সেই ৩ বান্ধুবী আসে।

“আরে ফাবিয়া দেখছি,তা এতো সকাল সকাল সেজে এসে কার সাথে দেখা করা হচ্ছে শুনি?বয়ফ্রেন্ড নাকি?”

পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে বলে উঠে,”আরে দেখছিস না,যে রুপ তাতে কোন ছেলে এই মেয়েকে পছন্দ করবে?”

“ওহ হে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।আর যদি পছন্দ করেও থাকে তাহলে নিশ্চিত ওই ছেলের এর মুখ দেখে নি নইলে এই মেয়েকে পছন্দ করতো না।”

ফাবিয়ার কাছে এসব কথা অসহ্যকর লাগছে।এই মেয়েদের থেকে বাঁচতে যখনই ফাবিয়া স্থান ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনই দূর থেকে ফাবিয়া কাউকে দেখতে পায়।নীল পাঞ্জাবীতে লোকটাকে প্রচুর স্নিগ্ধ লাগছে, হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ।ফাবিয়া লাল গোলাপ অনেক পছন্দ কিন্তু এটা সে আপন ছাড়া কাউকেই বলে নি।

ফারহানকে দেখা মাত্রই ফাবিয়া উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়।ফারহান কাছে এসে একসাথে ৪ টা মেয়েকে দেখে ফাবিয়াকে ঠিক চিনে উঠতে পারে না।তাই প্রশ্ন করে,

“এখানে ফাবিয়া কে?”

ফারহানের আওয়াজে মেয়েগুলো ঘুরে তাকাতেই ফারহানকে দেখে টাস্কি খায়। ফারহান দেখতে সাদা ধবধবে না হলেও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ফারহানকে সবথেকে আকর্ষনীয় লাগছে তার চশমাতে। চশমা যেনো ফারহানের সৌন্দর্যকে অন্য ধারাই নিয়ে গিয়েছে।৩ বান্ধবীর নেত্রী ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আপনার সাথে ফাবিয়ার কি দরকার?”

“সেটা ফাবিয়াই ভালো জানে?”

“তাই নাকি?আপনার সামনে যে উল্টো ফিরে ঘুরে আসে সেই ফাবিয়া।যান গিয়ে দেখুন ওকে।”

ফারহান সামনে তাকিয়ে দেখে এক রমনী ঠিক তার উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।কোনোক্রমেই তার মুখের কিঞ্চিৎও দেখা যাচ্ছে না।
ফারহান হালকা করে ফাবিয়াকে ডাক দেয়।ফাবিয়ার কানে ফারহানের আওয়াজ যেতেই ফাবিয়া ঘুরে তাকায়।

ফারহান খুব উচ্ছ্বাসিত ছিলো ফাবিয়াকে দেখার জন্য। ফাবিয়া ফারহানের দিকে তাকাতেই ফারহান স্তম্ভ হয়ে যায়।হাতে থাকা গোলাপ ফুল নিজ অজান্তেই মাটিতে পড়ে যায়।যা দেখে ফাবিয়া একটু অবাক হলেও নিজেকে সামলে নেই।এদিকে ফারহান যে কতটা অবাক হয়েছে তা তার চোখ মুখে স্পষ্ট প্রতীয়মান। ফাবিয়ার বান্ধুবী বলে উঠে,

“দেখেছিস আমি বলেছিলাম না,যদি ওকে কোনো ছেলে পছন্দও করে তবে ওর মুখ দেখে নি।মিললো তো আমার কথা।”

মেয়েটার কথায় ফাবিয়া মনে ভীষণ কষ্ট পায়।ফারহান ফাবিয়ার দিকে তাকিয়ে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“কে বলেছে আমি ফাবিয়াকে দেখি নি?আমি ফাবিয়াকে অনেক আগেই দেখেছি।”

ফাবিয়ার বান্ধুবী হেসে বলে,”তাই তাহলে হাত থেকে ফুল পড়ে গেলো কেনো?”

“ওকে দেখতে এতোটাই সুন্দর লাগছে যে সেই সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত হয়ে হাত থেকে ফুল পড়ে গেছে।”

“কি ওকে সুন্দর লাগছে?হা হা ফানি?ও আর সুন্দর দুটো’ই আকাশ পাতাল তফাৎ।ও তো এসিড ভিক্টিম। মুখটাই তো গলে পঁচে গেছে।”

বলেই ফাবিয়ার বান্ধুবীরে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ে।ফারহান মুচকি হেসে বলে,

“বাহ্যিক সৌন্দর্যই যদি সব হতো তাহলে কালো মেয়েরা হিরোর মতো স্বামী পেঁতো না।উনি তো এসিড ভিক্টিম যা উনি স্বইচ্ছায় হয় নি কিন্তু আপনারা?আপনারা তো স্বইচ্ছায় অন্ধ।যে কারণে উনার মনের সৌন্দর্য না দেখতে পারছেন না’ই বাহ উপলদ্ধি করতে পারছেন।আপনাদের মতো অন্ধ হওয়ার চেয়ে সত্যিকারের অন্ধ হওয়া অনেক ভালো।”

“আপনি একটা বাহিরের মানুষ হয়ে কি করে আমাদের কথা শুনাতে পারেন?”

“যেভাবে আপনারা ফাবিয়াকে কথা শুনাচ্ছেন।কেনো এখন গায়ে লাগছে?আর এই মেয়েটা এসব কটুক্তি দিনের পর দিন শুনছে।কই ওর কথা তো একবারও ভাবছেন না।মনুষ্যত্ব বোধ আছে তো আপনাদের?”

ফারহানের কথায় মেয়েগুলো দমে যায়।ফাবিয়ার বান্ধুবী অন্য মেয়েদের বলে,

“চল তো,এসব লেকচার শুনার কোনো ইচ্ছা নেই।চল এখান থেকে।”

ফাবিয়ার বান্ধুবীরা চলে গেলে ফারহান মিষ্টি হেসে বলে,”কেমন আছিস তুই?”

“ভালো কিন্তু তুই ওদের মিথ্যা কেনো বললি?”

“মিথ্যা বললাম বুঝি?কই?”

“কেনো বললি আমাকে তুই আগেও দেখেছিস?”

“হুম দেখেছি তো। যখন ভরা রাস্তায় তোর মুখে কেউ এসিড ছুড়ে মারে সেদিনই তোকে প্রথম দেখেছি।তবে হ্যা এটা জানতাম না যে আমার নিত্যদিনের কথা বলা ব্যক্তিই সেই এসিড ভিক্টিম।”

ফাবিয়া সেদিনের কথা মনে পড়তেই চোখে পানি এসে পড়েছে। ফারহান ফাবিয়ার অবস্থানের কথা চিন্তা করে জিজ্ঞেস করে,”সেদিন এমন কি হয়েছিলো বলা যাবে?”

ফাবিয়া অতীতে চলে যায়।ফাবিয়ার অতীতে তারেক ফাবিয়াকে প্রপোজ করে।যেহেতু ফাবিয়া তারেকের প্রতি দূর্বল ছিলো তাই তারেকে প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে নেয়।

কিছুদিন তারেক আর ফাবিয়া ভালোই সম্পর্ক কাটে কিন্তু কথায় আসে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য নেই ঠিক সেরকম ভাবে তারেকও ফাবিয়ার মূল্য দিতে পারে না।ধীরে ধীরে ফাবিয়াকে অবহেলা করা শুরু করে।ফাবিয়া সবটা বুঝলেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য চুপ থাকতো। একদিন ফাবিয়া রেস্টুরেন্টে তারেকের সাথে অন্য মেয়েকে দেখতে পায়।

“তারেক এই মেয়েটি কে?”

“ফাবিয়া তু…তুমি এখানে?”

“এই প্রশ্নটা তো আমার তারেক।আজ আমি তোমাকে আমার সাথে ঘোরার কথা বললে তুমি বলো তুমি অসুস্থ কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি অন্য অসুখেই পড়েছো।”

“দেখো ফাবিয়া তুমি ভুল বুঝছো।”

“তাহলে সঠিকটাই তুমি বুঝাও।”

তারেকের পাশে থাকা মেয়েটি বলে উঠে,”তারেক হু ইজ সি?”

“আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে কিন্তু তুমি কে শুনি?”

“আমি তারেকের উডবি ওয়াইফ ইভেন আমাদের এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে।”

কথাটা শোনা মাত্রই ফাবিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে।নিজের অজান্তেই দু’চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলো।তারেক ফাবিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলে,

“ফাবিয়া শোন….”

আর কিছু বলার আগেই তারেক নিজের গাল গরম অনুভূত করে।
ফাবিয়া কাঁদতে কাঁদতে তারেকের কলার ধরে বলে,

“ইউ চি*টার,রা*স্কেল।কি করে পারলি আমাকে ঠ*কাতে। আমি তো সিরিয়াসলি তোকে ভালোবাসতাম আর তুই আমাকে ঠ*কালি।আমি তোর নামে কেস করবো তোর সব রেপুটেশন শেষ করে দিবো।”

বলেই ফাবিয়া কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।ফাবিয়া চলে যাওয়ায় তারেক একটু চিন্তায়ই পড়ে যায়।এলাকার এমপির ছেলে তারেক এভাবে মেয়ে ঠকা*নোর কথা প্রচারিত হলে তারেক আর তারেকের বাবার সম্মান থাকবে না।তারেক ফোন দিয়ে কাউকে কিছু বলে।

পরেরদিন, ফাবিয়া কিছু জরুরি কেনাকাটায় বাহিরে যায়।কালকের ঘটনার পর থেকে ফাবিয়া তারেকের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে।হ্যা কেস না করলেও ফাবিয়া মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে।ফাবিয়া আনমনে রাস্তা দিয়ে হাটছিলো তখন একটা মাস্ক পড়া ছেলে ফাবিয়াকে পিছন থেকে ডাকে।ফাবিয়া পিছনে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা এসিড মেরে পালায়।মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত পরিবেশটা ফাবিয়ার আর্তনাদে প্রবল আকার ধারণ করে।

ফাবিয়া এত্তোক্ষণ শক্ত থাকলেও আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না।ফারহানের সামনেই কান্নাতে ভেঙে পড়ে।

“সেদিনের পর আমি চিকিৎসার পাশাপাশি আমার এসিড মারা নিয়েও কেস চলে।আর কেসটা চালিয়েছিলো আমার বাবা।আমার বাবা একজন উকিল ছিলো। তিনি চেয়েছিলো আমি যেনো ন্যায় বিচার পাই।আমিও তাই পেয়েছিলাম কিন্তু বিনিময়ে স্বনামধন্য ছেলের বিরুদ্ধে কেস লড়ায় তার জীবনটা দিতে হয়।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা ওই এলাকা ছেড়ে দেই।”

“হুম বুঝলাম।”

“তো তোর এখন কি ধারণা? আমাকে দেখার পর বন্ধুত্ব নষ্ট করা নাকি আমাকে অবহেলা করা।”

“আজব আমি কি একবারও তা বলেছি।তবে হে তোকে দেখার পর আমার একটা ধারণা জন্মেছে মনে।কি জানিস?”

ফাবিয়া অবাক চোখে তাকায়।ফারহান মুচকি হেসে বলে,”ধারণাটা হলো তোকে বিয়ে করা।আর হ্যা আমি তা করবোও।”

ফারহানের কথায় ফাবিয়া যেনো বেশ মজা পেলো।হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই ডেয়ারটা আবার কে দিলো শুনি?”

“উহু এটা কোনো ডেয়ার না।এটা আমার মনের কথা। আমি তোকে বিয়ে করতে চাই ফাবিয়া।”

“ফারহান সব কিছু নিয়ে মজা করা উচিত নয়।আর আমাকে বিয়ে করলে হাজারটা কটুক্তি উঠবে আমি তা চাই না। বেশ তো আছি বন্ধু হয়ে আমি সারাজীবন এই বন্ধুত্ব সম্পর্কটাই বজায় রাখতে চাই।তাই আমাকে জোড় করিস না।”

ফারহানের মন ব্যথিত হলেও ফাবিয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।ফাবিয়া আকাশের তাকিয়ে বলে,

“আমি চাই এক সফল নারী হতে।যাকে দেখে হাজারো ভিক্টিম অনুপ্রেরণা পাবে। আমি চাই এসব স্বনামধন্য বখাটে ছেলেদের শাস্তি দিতে।আর একদিন আমি তা পারবো।”

ফারহান শুধু মুগ্ধ হয়ে ফাবিয়ার কথাগুলো শুনে। ফাবিয়া ফারহানকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই চলে যায়।যেতে যেতে ফাবিয়ার চোখ পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।হয়তো মনের এক সূক্ষ্ম কোণায় নিজ অজান্তেই ফারহান জায়গা করে নিয়েছে।

সমাপ্ত