ক্যামেলিয়া পর্ব-১২

0
21

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১২]

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

স্বভাবতই কোনো রেসে যাওয়ার আগে একবার হলেও তা নিয়ে নিজের ফেসবুকের আইডিতে পোস্ট করে ধ্রুব। এই বেলায়ও তাই। রেসের বের হওয়ার আগে তার আর ইনায়ার গাড়ির ছবি তুলে একসাথে পোস্ট করেছিলো। ক্যাপশনে লিখেছিলো—“Going to have a interesting race with her!”। একাউন্ট পাবলিক থাকায় আরাফের চোখে পড়ে তা। আগেই খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলো ইনায়ার বিয়ে হয়েছে। তাও কি না তাদেরই ভার্সিটির একজন লেকচারারের সাথে। খোঁজ নিলো আরো। জানলো লোকটা ধ্রুব। ইনায়ার ফোন ট্র্যাক করালো। লোকেশন বের করলো। সেই অনুযায়ী সেখানে পৌঁছালো। তারপর ইনায়াকে কিডন্যাপ করলো। পুরোটাই করলো খুব কৌশলে। লোকে যেন আঁচ করতে না পারে বিন্দু মাত্র।

আপাতত একটা বদ্ধ ঘরে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ইনায়া। হাত বাঁধা। সমানে চেঁচিয়ে গেলেও কেউ দরজা খোলেনি। আরাফ তাকে এভাবে কখন এসেছে সে জানে না। জ্ঞান ফিরে নিজেকে এখানেই দেখেছে সে। তারপর থেকেই চেঁচিয়ে যাচ্ছে ও। ইনায়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখে ভাসলো সবটা। আরাফের সাথে তার সম্পর্কের শুরু হয় সেকেন্ড ইয়ারের প্রথমের দিকে। আরাফ তখন থার্ড ইয়ারে পড়ে। হুট করে গায়ে প্রেমের হাওয়া গায়ে লেগেছিলো। বসন্তের ছোঁয়া পেতেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো। প্রথম ক’মাস ঠিক গেলেও আচমকা কিছু হলো। একদিন তাকে আরাফ ডাকলো একটা রেস্টুরেন্টে। ইনায়া গেলো দেখা করতে। কথাবার্তার মাঝেই আচমকা আরাফ ডেকে উঠলো তাকে—“ইনায়া?”

সামনে রাখা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতেই ইনায়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় জবাব দিলো—“হু?”

এতোদিনে ইনায়ার স্বভাব, আচার-আচরণের সাথে পরিচিত আরাফ। তাই সময় নিলো বলতে। ঢোক গিলে বলল—“মা-বাবা আজকে কিছু কাজে বাইরে গেছেন। কালকে ফিরবে।”

খাওয়ার হাত থামলো ইনায়া৷ হাতে ধরে রাখা কাঁটা চামচটা ঠাস করে টেবিলের উপর রাখলো। আরাফের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—“আমাকে কি মনে হয় তোমার? এসব কথা বলার সাহসই বা করো কি করে তুমি?”

আরাফ বোঝাতে চাইলো তাকে—“ইনায়া। সোনা এসব ব্যাপার কমন এখন। হতেই পারে।”
“না পারে না। তুমি সাহস করো কি করে এগুলো বলার?”

আরাফ মুখ থেকে বিরক্তিকর আওয়াজ তুললো৷ সেভাবেই বলল—“সবেতে সিনক্রিয়েট করা তোমার স্বভাব না? নরমাল একটা ইস্যুকে টেনে বড়ো করছো কেন?”

ইনায়া মূহুর্তেই চটে গেলো। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করলো—“আমি কোনো খোরাক মেটানোর জিনিস না। তোমার শিক্ষার অভাব আমি টের পাচ্ছি আরাফ। আই কান্ট বিলিভ যে, আমি তোমার মতো একজনের সাথে সম্পর্কেই বা গেলাম কি করে? মানে, হাউ?”
“ইনায়া!”
“ডোন্ট ডেয়ার টু রেইজ ইউর ভয়েজ অন মি। এতো শরীরের জ্বালা থাকলে পতিতালয়ে যাও। টাকা খসালে এমনিতেই ওরা তোমার গায়ের জ্বালা মিটিয়ে দেবে।”

আরাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার চোখেমুখে তখন ক্রোধ, অপমান আর জেদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ইনায়ার গলার স্বর কাঁপছে রাগে, ঘৃণায় আর নিজের ভুল পছন্দের আফসোসে। সেদিন আরাফের সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিলো। তারপর সে নিজে থেকেই কেটে দেয় সব যোগাযোগ। নম্বর ব্লক করে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রিমুভ করে দেয়।

চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় স্মৃতিগুলো একে একে মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। একদিকে ভয়, আরেকদিকে রাগে দপদপ করছে বুকটা। এখন ইনায়ার শুধু একটাই চিন্তা—কীভাবে এখান থেকে বের হবে? তখন দরজার বাইরে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। খুব হালকা কিন্তু স্পষ্ট। ইনায়া কান পেতে শুনলো। পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলো। ইনায়া রাগ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো—“আমায় বের করো আরাফ! খারাপ হচ্ছে কিন্তু।”

তরাক করে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো আরাফ। ইনায়া তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো আবারও—“হাত খোলো!”

আরাফ তার কাছে এসে বসলো। তার চোখ-মুখ ভালো করে দেখলো। তারপর ক্যাটক্যাট করে হেসে ফেললো। ইনায়া মুখ কুঁচকে ফেললো। মন চাইলো কষে চড় মারতে আরাফকে। বিধিবাম! তার হাত বাঁধা। ইনায়া ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করল—“আমায় এখানে এনেছো কেন?”

আরাফ হেসে বলল—“রিজন দু’টো। কোনটা আগে শুনবে বলো।”

ইনায়া ভ্রু কুঁচকে নিলো। আরাফাত তা দেখে বলল—“ছাড়ো। আমিই বলছি।
প্রথমত, আমায় যেভাবে ভরা রেস্টুরেন্ট আর ভার্সিটির সামনে অপমান করেছিলে তার একটা ছোটখাটো রিভেঞ্জ নেবো। আর দ্বিতীয়ত, তোমায় আদর করবো একটু। এর বেশি কিচ্ছু করবো না, গড প্রমিস!”

বলেই মুখবিবর নিষ্পাপ দেখিয়ে কন্ঠনালি ছুঁলো। পরপর বিদ্রুপ হাসলো। ইনায়া মুখে খিঁচে নিলো ঘৃণায়। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো—“তুই আসলেই একটা জা’নো’য়া’র। তোর থেকে ভালো কিছু এক্সপেক্ট করা যায় না।”

ইনায়ার মুখ থেকে ‘তুই’, ‘তোকারি’ শুনে মেজাজ খিঁচে এলো আরাফের। সে এগিয়ে এসে আঙুলে ইনায়ার মুখ চেপে ধরলো। ইনায়া কুঁকড়ে উঠলো ব্যথায়। ছটফটিয়ে মুখ ছাড়াতে চাইলেও পারলো না। আরাফ তার ঘাড় টেনে মুখের কাছে এনে দাঁত পিষে বলল—“এতক্ষণ ভালো ব্যবহার করছি। জা’নো’য়া’র কারে কয় এখন তোরে আমি দেখাবো মা**।”

বলেই চেঁচিয়ে কাউকে ডাকলো—“পলাশ! এই, এদিকে আয়!”

তখনই হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে একটা চ্যাংড়া-পাতলা গড়নের ছেলে ঢুকলো। পেছনে তার ক’জন সাঙ্গোপাঙ্গো আছে। ছেলেটা এসেই সালাম ঠুকে বলল—“জ্বি ভাই?”

আরাফ ইনায়ার মুখ থেকে ছিটকে ফেলার মতোন হাত সরালো। তারপর ইনায়ার দিকে তাকিয়েই পলাশের উদ্দেশ্যে ফিচেল হেসে বলল—“বাসর ঘর সাজা, গোলাপ দিয়ে।”

ইনায়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে বুঝতে সময় লাগছে তার। মাথা কাজ করছে না ওর। পলাশ হতভম্ব হয়ে একবার তাকালো ইনায়ার দিকে, আরেকবার আরাফের দিকে। আরাফ ধমকে উঠলো তাকে—“থোবড়া দিয়া মধু ঝড়তাছে না। কাজে যা! আধাঘণ্টার মধ্যে সব না হইলে তোদের সবকয়টারে আমি কি করুম দেখিস!”

পলাশের মায়া লাগলো ইনায়ার জন্য। সে কিছু বলতে নিলে আরাফ আবার ধমক দিলো তাকে—“কাজে যা!”

সে গোমড়া মুখে একবার ইনায়াকে দেখে চলে গেলো নিজেদের কাজে। সময় গেলো। ইনায়া এবার দিক-বেদিক হারিয়ে বসলো। বুঝলো এমন সময় চেঁচামেচি করার চেয়ে বোকামো আর কিচ্ছু নেই৷ তাই আরাফের উদ্দেশ্যে হালকা গলায় বলল—“পাগলামি করো না আরাফ। ঠান্ডা মাথায় ভাবো। ভাই আমি ম্যারিড। বোঝো না প্লিজ!”

আরাফ হাসলো একটু—“বুঝছি তো সোনা৷ একটু দাঁড়াও। কাজ শেষের পথে।”

বলেই আরাফ আবার চিৎকার করে বললো—“পলাশ! কাজ হইছে?”
পলাশ দৌঁড়ে এসে জানালো—“হ, ভাই! রেডি সব। কইলে ঢুকায় দিমু।”

ইনায়া কেঁদে ফেললো। কাকুতি-মিনতি করতপ লাগলো। তা দেখে আরাফ এবার ইনায়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। বলল—“দেখো, ভালোভাবে বলতেছি। কান্নাকাটি কইরা কিছু হইবো না। আর চিৎকার করলেই সমস্যা বাড়বে। তাই বলি শোনো, মেনে নাও। আমার সাথে জেদ দেখায় কিচ্ছু হবে না সোনা।”

ইনায়া ভেজা গলায় বলল—“প্লিজ আরাফ, এমন করো না। প্লিজ!”

শেষেতে চেঁচিয়ে উঠলো। আরাফ ওর গলা চেপে ধরলো—“আওয়াজ নিচে, আওয়াজ নিচে! চুপ একদম!”

ইনায়া ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলে সে গাল ছেড়ে দিলো। ওর হাত খুলতে খুলতে পলাশের উদ্দেশ্যে বলল—“ওই মাইয়া গুলারে পাঠা। ওরে ঠিকঠাক গুছায়া যেন পাঠায় ওইখানে। যা!”

পলাশ মাথা দুলিয়ে বাইরে গেলে ঘরে দু’জন মেয়ে বসলো। ইনায়াকে তাদের কাছে পাঠিয়ে আরাফ বাইরে গেলো। ইনায়াকে ওরা শাড়ি পরাতে এলে ইনায়া রাগে ঘরের টেবিলে থাকা গ্লাস ছুঁড়ে মারলো তাদের দিকে। আঙুল তুলে শাসালো—“কাছেও আসবেন না। দূরে যান।”

মেয়েগুলো তবুও জোর করে ওকে সাজাতে গেলো। তা না পেরে শুধু শাড়ি পারলো। তখনই দরজায় নক করলো আরাফ৷ একটা মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল—“উনি কিছু করতেই দিচ্ছিলেন না। এতটুকু করেছি তাও।”

ইনায়া চেঁচিয়ে উঠলো আবারও—“আরাফ এসব ভালো হচ্ছে না।”

আরাফ ফিচেল হাসলো। মেয়েগুলোকে যেতে ইশারা করলো। তারা গেলে আরাফ এগোলো ইনায়ার দিকে। ইনায়া পিছিয়ে গিয়ে দৌড়ে পাশ কাটাতে চাইলে আরাফ ওকে ধরে ফেলে। ইনায়া ছটফটিয়ে ওঠে। ছাড়া পেতে চায়। নিজের সর্বস্ব বাঁচাতে চায়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ইনায়া ক্লান্ত হয়ে শান্ত হয়ে গেলো। আরাফ কুটিল হাসলো—“শক্তি শেষ?”

ইনায়া ছলছল চোখে তাকালো। আরাফের মোটেও মায়া হলো না। নিজের কার্য হাসিল করতে লাগলো। ইনায়ার চোখ থেকে জল গড়ালো। ধ্রবর মুখটা ভাসলো চোখে। তার ধোঁকার ফলই না আজ এসব? সে কি কোনোদিন তাকে ক্ষমা করতে পারবে? পারবে না! কক্ষনো না!

#চলবে