#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৪]
❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌
ইনায়া বিছানায় বসে আছে। কিছুটা দূরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ধ্রুব শার্ট জড়াচ্ছে নিজের গায়ে। কালো রঙয়ের একটা শার্ট। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে তখন থেকে। ধ্রুব ড্রেসিংয়ের মিররে তার দিকে তাকালো। ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো—“কি হয়েছে?”
ইনায়া ফটফট করে বলে বসলো—“শার্ট খুলুন।”
ধ্রুব চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো—“কি বললে? শার্ট খুলতে বলছো?”
ইনায়া গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললো—“হ্যাঁ, খুলুন। এই কালো শার্টটা আপনাকে একেবারেই মানাচ্ছে না।”
ধ্রুব দ্বিধান্বিত চোখে চেয়ে বললো—“বাট, কালো তো আমার ফেভারিট কালার!”
ইনায়া ধ্রুবর দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ধ্রুবর কাছে। শার্টের বোতামগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সেগুলো খুলতে খুলতে বললো—“ফেভারিট হোক, যাই হোক। এই কালার আপনি আর পরবেন না।”
ধ্রুব মুহূর্তখানেক চুপ করে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে শার্ট খুলতে খুলতে বললো—“আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার আদেশ শিরোধার্য! আপনি যেটা দিবেন, আমি সেটাই পরবো। তবে, এখানে তো আমার আর শার্ট নেই।”
ইনায়া চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো তাকে। তারপর কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। চুপচাপ তা খুলে সেখান থেকে একটা প্যাকেট বের করলো। এগিয়ে এসে খানিকটা ইতস্তত করে ধ্রুবর হাতে তা দিলো। ধ্রুব ভ্রু গুটিয়ে তাকিয়ে প্যাকেটটা খুললো। ভেতরে একটা শার্ট। নেভি ব্লু রঙের। ধ্রুব সেদিকে তাকিয়ে ইনায়ার দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—“এটা?”
ইনায়া অপ্রস্তুত হলো। এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল—“কিনেছিলাম ক’দিন আগে।”
তারপর থামলো। থেমে থেমে আবারও বলল—“আপনার জন্য।”
ধ্রুব উচ্ছ্বসিত গলায় বলল—“আমার জন্য?”
ইনায়া মাথা দোলালো। কথা কাটিয়ে বলল—“আপনি শার্ট পরে নিচে আসুন, আম্মু ডেকেছিলো।”
বলে ইনায়া দাঁড়ালো না আর। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আশ্চর্য হলেও সত্য, যে সে লজ্জা পাচ্ছে। কেন? জানো না। তখনের চুমুর পর থেকে আচমকাই লজ্জা পাচ্ছে। ইনায়া ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে হেসে ফেললো। তার মতোন মেয়েও কি না লজ্জা পাচ্ছে!
_____
—“আব্বু, আম্মু? ইনায়াকে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইছিলাম একটু। মা দেখা করতে চাইছে।”
রহমান সাহেব আর সুমিতা বেগম একযোগে মুখ তুলে তাকলেন ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব এতে অপ্রস্তুতই হলো বটে! ইনায়ার দিকে চাইলো আড়ে। মেয়েটা মুখ-ও তুললো না। চুপচাপ খাচ্ছে। টেবিল জুড়ে বয়ে চলা নীরবতা ভগ্ন করছে ইনায়ার চামচের টুংটাং শব্দ। ইশমাম পাশে বসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বোনের দিকে৷ এতো কিছুর পরেও এতো নির্বিকার কেন সে? একটু রিয়েক্ট করলে কি জাত যাবে? আজব মেয়ে মানুষ! তার মাঝে মধ্যে মনে হয় ইনায়া কোনো মানুষ না। বরং মহাকাশের কোনো গ্রহ থেকে টপকে পড়া এলিয়েন৷ মানুষরা কি এমন হয় কখনো? প্রথমত ইনায়াকে তার খুব রুড মনে হয়। অবশ্য এটা তার ভালোই লাগে। বড়ো আপু যেমন নরম-শান্ত, ছোট আপু তার উল্টো। তেজিয়ান-অশান্ত! আত্মীয়মহলে কেউ তাকে দু-চোখে সহ্য করতে পারে না। তার কথাবার্তার ধরন, চাল-চলন, ভাবভঙ্গি সব কিছু অন্যরকম লাগে ইশমামের। এজন্য সে তার ছোট আপুর ভক্তও বটে! সে কিছু বললে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দু-চারটে ধমক খেলেও গায়ে মাখে না। বরং গা পিছলে চলে যেতে দেয়। ইশমাম কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো ইনায়াকে। ইনায়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। ইশমাম বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে ইনায়ার দিকে হালকা ঝুঁকে বললো—“চুপ করে বসে থাকলে চলবে না, কিছু বলো। হ্যাঁ-না, যেটাই মনে হয়।”
ইনায়া চোখ ছোট করে তাকালো ভাইয়ের দিকে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবারও খাবারে মন দিলো। ধ্রুব তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো—“মা অনেক করে বলছিলো ওর সাথে দেখা করার জন্য। বলেছিলো, ইনায়াকে যেন একদিন নিয়ে যাই। তাই ভাবলাম আজই নিয়ে যাই। যদি আপনারা অনুমতি দেন।”
সুমিতা বেগম বললেন—“তবে কেবল যেই পরিস্থিতিতে ছিলে তোমরা, এখন এভাবে যাওয়া—”
“মা জানে সব। এজন্য আরো বেশি করে ওকে দেখতে চাইছে। চিন্তিত সে।”
রহমান সাহেব এবার চশমাটা একটু নামিয়ে আনলেন নাকে। মেয়ের দিকে চেয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন—“ইনায়া, মা? তুমি কি যেতে চাও, সোনা?”
ইনায়া এবার মুখ তুললো। ধ্রুবর চোখে চোখ পড়লো তার। কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নরম গলায় বললো—“যেতে পারি।”
রহমান সাহেব হেসে বললেন—“তাহলে আর কি? যাও সোনা৷ ভালো লাগবে আঙ্কেল-আন্টির সাথে দেখা করে আসলে।”
ইনায়া মাথা দোলাল। ইশমাম প্লেটের দিকে চেয়ে হাসলো। কনুই দিয়ে আবারো গুঁতো মারলো ইনায়াকে। ইনায়া তাকাতেই মিটমিট করে হাসতে লাগলো। ইনায়া চোখ রাঙালো তাকে৷ তবে সে চুলে তো!
______
—“আন্টিকে কখন বললেন সব?”
ধ্রুব গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জবাবে বলল—“যখন তোমায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।”
ইনায়া মাথা দোলালো—“ওহ! তা আন্টি হঠাৎ আমাকে দেখতে চাইছে কেন?”
“আন্টি তার বৌমাকে মিস করে, তাই।”
ইনায়া ভ্রু কুঁচকালো—“শুধু আন্টি মিস করে? আপনি করেন না?”
আচমকা মেয়েটার বাচ্চাসূলভ কথায় ধ্রুব ভড়কে তাকালো। পরক্ষণেই হেসে ফেললো। বলল—“না, তোমার শাশুড়ীর ছেলে তোমায় মিস করে। আমি কেন করবো? পরের বউয়ের দিকে আমি নজর দেই না।”
ইনায়া ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখলো। বাইরে তাকিয়ে থাকলেও তার মুখে লুকোনো খুশির রেখা স্পষ্ট ছিল। গাড়ির জানালার কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে জানালার বাইরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো—“ভীষণ বদ আপনি!”
_____
ধ্রুব গাড়ি থামালো চারতলা একটা বাড়ির সামনে। হর্ণ বাজাতেই লম্বা-চওড়া বিশাল গেটটা খুলে দিলো দারোয়ান। সাই করে ভেতরে ঢুকে গেলো কালো মার্সিডিজ। গাড়ি পার্ক করে ধ্রুব ইনায়ার দিকে তাকালো—“চলো?”
ইনায়া মাথা দোলালো। গাড়ি থেকে নামলো। মাথা উঁচিয়ে দেখলো বাড়িটাকে। আগেও একবার সে এসেছিলো এখানে। ধ্রুবকে তখন দেখেনি। কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলো নাকি!
শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতেই আচমকা থামলো ইনায়া। এটা তার স্বামীর বাড়ি। তার বাড়ি! অদ্ভুত অনুভূতিতে শিহরণ খেলে গেলো শরীরে। ধ্রুব পাশে এসে দাঁড়ালো। ইনায়া তাকাতেই চমৎকার করে হাসলো। এগিয়ে এসে হাত ধরলে মেয়েটার৷ তারা ভেতরে ঢুকলে দেখলো ড্রইংরুমে নাসিমা বসা। টিভি দেখছিলেন। শব্দ পেয়ে মাথা ঘুড়িয়ে চাইলে ইনায়াকে দেখলেন। প্রথমে বিস্ময় নিয়ে তাকালেন, পরক্ষণেই খুশিতে আটখানা হয়ে হেসে ফেললেন। সেলাই করছিলেন তিনি। হাতের কাজ ওমনি ফেলে চলে এলেন ইনায়ার কাছে। ইনায়া হাসলো তাকে দেখে। সালাম দিয়েই জড়িয়ে ধরলো—“কেমন আছো?”
নাসিমা গদগদ হয়ে জবাব দিলেন—“ভালো মা। কতোদিন পর তোকে দেখলাম, সোনা! আয়, বোস।”
ইনায়াকে নিজের পাশে বসালে ধ্রুব গেলো নিজের ঘরে। ফ্রেশ হবে। বাইরে থেকে এসে বসে থাকা তার সয় না। সে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো ঘর ফাঁকা। এখনো ইনায়া আসেনি! সে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালো। রেলিং বেয়ে ঝুঁকে চাইলো নিচে। ইনায়া আর নাসিমা খোশগল্পে মত্ত। ইনায়াকে নাসিমা কি যেন ছবি দেখাচ্ছে। ইনায়া হাসছে! ধ্রুব তাকিয়ে দেখলো একদৃষ্টিতে তা। হাসলো ক্ষীণ। পরক্ষণেই তাদের কথাবার্তা কানে এলো। তারা কি দেখছে তা দেখতে ঝুঁকলো সে। ছবিতে একটা বাচ্চা ছেলে হাসছে। সামনে দইয়ের হাঁড়ি। ছেলেটার হাতে মুখে দইয়ে মাখামাখি। তবুও তার মুখ থেকে হাসি সরছে না। ধ্রুব চোখ বড়বড় করে তাকালো। তার ছোটবেলার ছবি! আয়হায়! কি একটা অবস্থা! মা ইনায়াকে এসব কেন দেখাচ্ছে। আর মেয়েটাকে দেখো, কেমন দাঁত কেলাচ্ছে! তার ছোটবেলার ছবি কাউকে দেখালে তার লজ্জা লাগে বহু আগে থেকেই। এখন তো ডিরেক্ট বউকে দেখাচ্ছে। সে কি করবে? লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়বে? কি বাজে একটা অবস্থা!
—“উপরে আসো তো একটু!”
ধ্রুবর ডাকে ইনায়া আর নাসিমা মাথা উঁচিয়ে তাকালো। সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল—“কি হয়েছে?”
ধ্রুব হকচকিয়ে গেলো। বলল—“একটু উপরে পাঠাও ইনায়াকে।”
নাসিমা বিরক্ত হলেন৷ ঝাঁঝিয়ে বললেন—“পারবো না। আমরা কথা বলছি।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো—“আমার বউকে নিয়ে আমারই মান- ইজ্জতের ফালুদা বানাচ্ছো। আবার বলছো, ‘কথা বলছি’!”
ইনায়া তাকালো ধ্রুবর দিকে। কি নির্লজ্জ ছেলেরে বাবা! মায়ের সামনে বউকে কেউ এভাবে ডাকে? গাঁধা নাকি? নাসিমা বেগম নিচ থেকে একইভাবে বললেন—“এতো বউকে দরকার হলে, এসে কোলে করে নিয়ে যা। আমাদের কথায় বাগড়া দিতে আসিস না।”
ইনায়া গোলগোল চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। ওর মাথা-মস্তিষ্ক এলোমেলো যেন। এতোদিন নিজের স্বামীকে নির্লজ্জ ভেবে এসেছে। এখন তো শ্বাশুড়ি তার-ও দু’কাঠি উপরে! অস্বস্তি, লজ্জায় তার অবস্থা করুণ। হায়হায়! কোথায় ফেঁসেছে সে? তখনই ধ্রুব ধুপধাপ নিচে এসে তাকে কোলে তুলে নিলো নাসিমার সামনে। ইনায়া চমকে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুব তাকে কোলে নিয়েই নাসিমের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—“তোমার মতো মা থাকলে আর কাউকে দরকার নেই। ঘষেটি বেগমের বোনের মতোন কাজকর্ম সব!”
নাসিমা মুহূর্তখানেক ধ্রুবর কথায় হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন—“কি বললি তুই? ঘষেটি বেগমের বোন? আমায় ঘষেটি বলছিস তুই?!”
“সত্যিই তো বললাম।”
ইনায়া ধ্রুবর কথা শুনে তার হাতে আড়ালে চিমটি কাটলো। রেগে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল—“ধ্রুব! কি হচ্ছেটা কি?”
ধ্রুব তাকালো ইনায়ার দিকে। বলল—“রাগছো কেন বউ? পেটে ব্যথা করছে?”
ইনায়া কটমট করে তাকালো তার দিকে—“চুপ করবেন আপনি! করছেন কি এসব?”
ধ্রুব তার তাকানো দেখে বলল—“তোমার এই শাশুড়ি আর আমার মা দুইজনই এক্সট্রা। আমি না বললে তুমি বুঝবে না!”
নাসিমা তখন হাত কোমরে দিয়ে বললেন—“এই ছেলে! তোকে ছোটবেলায় যত পিটাইছি, তার সব বৃথা গেছে! এখনো জিভে লাগাম নাই!”
ধ্রুব নির্লজ্জের মতোন হেসে বলল—“রেগো না আব্বুর বউ। সময় হলে সবকিছুর হিসেব চুকিয়ে নাতি-নাতনি গিফট্ করে যাবো।”
ইনায়া এবার সত্যি সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। নিজের মুখ গুঁজে রাখলো ধ্রুবর কাঁধে।
নাসিমা তখন আবার বসে পড়লেন—“বউমা, তোমার স্বামীর এই সব কথা কানে নিয়ো না। ছোটবেলা থেকে এমনই, মুখে কিচ্ছু আটকায় না!”
ইনায়া হেসে ফেললো এবার। তার বিয়ে যেভাবেই হোক, যতই না মানুক সে; শ্বশুরবাড়িটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং। বিশেষ করে শ্বাশুড়ি আর শ্বাশুড়ির ছেলে! দুজনেই কিন্তু চমচমের মতোন মিষ্টি। একদম খেয়ে ফেলার মতো! নিজের ভাবনায় নিজেই চমকালো ইনায়া। ইশ! এতো নির্লজ্জ সে কবে হলো? মুখ তুলে ধ্রুবর দিকে তাকালো৷ একেই বোধহয় বলে, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’।
#চলবে….
শব্দসংখ্যা—১৪০০+