গোধূলির শেষ আলো পর্ব ০৩+৪

0
694

গোধূলির শেষ আলো?
#পর্ব ০৩+৪
#writer Tanishq Sheikh Tani

খালিদ নিজের ভাগের ঘরটার সামনে এসে দারায়।প্রায় কমপ্লিট এখন শুধু প্লাস্টার আর জানালা দরজা করা বাকি।সব হতে দুচার দিন হয়তো লাগবে।বাড়ির নতুন ইটের গাথুনিতে পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়।কিছুক্ষণ ভেজা দেয়ালে হাত রাখে আনমনে। গোধূলির শেষ আলো মুছে যেতেই বাড়ির পথে পা দেয় খালিদ।যেতে ইচ্ছা হয়না ও বাড়িতে খালিদের।ভাইয়ের চোখে এখন আর সেই ভালোবাসা নেই আছে শুধু প্রতিহিংসা।আচ্ছা দুনিয়াতে সম্পদই কি সব? সম্পর্ক,ভালোবাসা এসবের কি কোনো মূল্যই নেই? হয়তো নেই।তাইতো ভেঙে পড়লো রক্তের বাঁধন। বর্তমানের ঘরটাও খালিদের কিন্তু ভাইয়ের মুখ কালো দেখতে আর ভালো লাগে না খালিদের।ভাবি রোজ কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু করে।তাই যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে যাবে।নতুন বাড়িটা এ বাড়ি থেকে ৫ ঘর পরের সুপারী বাগানের শেষে।ওমন নির্জনে বাড়িটা করেও মুশকিলে পড়েছে। রাত বিরাত কিছু হলেও কেউ ওমুখো হবে না।রাগের বশে তাড়াহুড়ো করেই বাড়িটা করেছে খালিদ।এখন মনে হচ্ছে ভিন্ন বসতিপূর্ণ জায়গায় জমি কিনে বাড়িটা করলেই ভালো হতো।মনে মনে হাজারটা চিন্তা নিয়ে বারান্দার গ্রিলের দরজায় টোকা পড়তেই দরজা খুলে দেয় একটা বাচ্চা ছেলে।খালিদ প্রচন্ড খুশি হয়। খুশির তোড়ে বাচ্চাটাকে বুকে টেনে নেয়।

“- চাচ্চু তুমি কই গেছিলে?

“- আমি? আমি তো বাইরে গেছিলাম আব্বু।ভাতিজার তুলতুলে গালে আলতো করে চুমু দেয় খালিদ।হঠাৎই মনে পড়ে দু ঘরের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা।সাথে বাচ্চাটাকে নামিয়ে দেয়।চাচার এমন আকস্মিক ভাব পরিবর্তনে যথেষ্ট অবাক হয় বাচ্চাটা।বাচ্চারাও বোঝে কোনটা দূরে ঠেলে দেওয়া।তাইতো ফুঁপিয়ে ওঠে বাচ্চাটা

খালিদের মা পেছনে দাড়িয়ে সব দেখে।নাতিকে কষ্ট পেতে দেখে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়।

“- আমার দাদুভাই কাঁদছে নাকি হুম? কি হয়ছে দাদু?চাচা বকছে?আচ্ছা যাও বড় নানুর কাছে যাও। খাজা খাও গিয়ে।

নাতিকে নিচে নামিয়ে দিতেই বাচ্চাটা কিছুক্ষণ চাচ্চুর রুক্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে ভেতরের ঘরে চলে যায়।

“- কি রে খালিদ! তুইও কি মাজিদের মতো হলি? ও তো বউয়ের পাল্লায় পড়ে মাথা নষ্ট করেছে। তুই এমন করছিস ক্যা?ওতোটুকু দুধের বাচ্চার সাথেও রেষারেষি তোদের?

মায়ের কঠিন কথাগুলো শুনে মুখটা মলিন করে বলে,,,
“- মা! তোমার আমাকে তেমন মনে হয়?

“- তাহলে ওমন কললি ক্যা আরশের সাথে? ও কষ্ট পেলো না? এতোক্ষন তোর জন্য দরজায় ঘুরাঘুরি করতেছে।কখন চাচা আসবে বার বার জিগ্যেস করতেছিল? তুই আইছিস শুনে দৌড়ে চলে আইছে।ও তোরে খুব ভালোবাসে রে বাজান।

“- আমি জানি মা।আমিও কি চাই আরশ কষ্ট পাক? আমিও সারাদিন বুকে নিয়ে ঘুরতে চাই।অনেক আদর করতে ইচ্ছা করে আরশকে।কিন্তু তুমি তো জানো ওর মা আমাদের কাছে ওকে আসা দেখলেই কি মারা টাই না মারে।আমি ওর কান্না সহ্য করতে পারি না মা। কেন এনেছে এ ঘরে? ভাবি দেখতে পেলেই খুব মারবে তো?

“- আরে মারবি না! ওর জম আইছে না তাই মেনি বিলেয় হয়ে গেছে।

মায়ের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে খালিদের।

“- মানে!

“- মানে তোর বড় মানা আইছে।তোর বড় মামাই যাইয়ে কোলে করে নিয়ে আইছে।ওর কি সাধ্য আছে মামা উপর কথা কবি।চুপ করে বসে আছে।না হলি এতোক্ষন তো বাড়ি মাথায় তুলে নাচতো।

“- বড় মামা এসেছে? কোথায়?

“- আমার ঘরে। যা গিয়ে সালাম করে আয়।

খালিদ পা চালিয়ে মায়ের রুমে ঢুকে মামাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জানতে চাই।

“- এই আছি কোনোরকমে রে বাবা।ডায়বেটিস, হাঁটু ব্যথা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তোর কি খবর? বিয়েশাদী করার ইচ্ছা কি এবারও নাই আব্বাজানের?

মামার মুখে বিয়ের কথা শুনে স্বভাবতই লজ্জায় মাথা অবনত করে মৃদু হেসে।তারপর বলে
“- মামা আপনি তো সবই জানেন।তাছাড়া যুগও বেশি ভালো না।এরপর একেবারে ৩ বছর পরই আসতে পারবো এতোদিন নতুন বউ সহ মা কি করে ঐ বাড়ি থাকবে বলেন? তাই চাচ্ছি আপাতত বিয়েটা করবো না।মাকে আপনার বাড়িতে একটা রুম ভাড়া করে রাখবো তিন বছর পর্যন্ত যদি আপনার সমস্যা না হয়।

“- খাদিজা এই তোর এই ছাওয়াল তো আমার অপমান করতেছে।এই আমি তোর বাড়ি থাকবো না।

জব্বার মিয়া রাগীমুখে দাড়িয়ে পড়ে।লালসাদা দাড়িতে শ্যামলা মুখটা রাগে কালো হয়ে গেছে জব্বার মিয়ার।ভাইয়ের রাগী স্বর শুনে রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসে খাদিজা।

“- মামা! প্লিজ রাগ করবেন না।আমি আপনাকে অপমান করতে চাই নি।আপনিও যদি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেন তো আমার আর মায়ের কি হবে?

মামার হাত ধরে মাথা নিচু করে ধরা গলায় কথাগুলো বলে চুপ হয়ে যায় খালিদ।মামার রেগে যাওয়াতে খুব ভয় পায়।সম্পর্ক ভাঙনের জ্বালা যে বড়ই পীড়াদায়ক।

“- আমি আছি আর থাকবো।আমার বোন তার নিজের বাবার বাড়িতে থাকবে।সেটা তো তারও।তাতে ওকে ভাড়া দিয়ে কেন থাকতে হবে খালিদ? নিজের বাড়ি কি কেউ ভাড়া দেয়।আমি তো বলি তুইও তোর মায়ের ভাগের জায়গায় বাড়ি কর।এই নির্জন জায়গায় ঘর করেছিস থাক ঘর।ভাড়া দিয়ে দে।

“-না ভাইজান।তা হয় না।এটা আমার স্বামীর ভিটা স্বামীর গিরাম। এ জাগা ছেড়ে মরার আগে আর কোথাও যাবো না আমি।তোমরা আমারে জোর করো না।

“- মা তুমি চুপ থাকো।এখানে এতো কথা শুনে থাকা লাগবে না তোমার।আমি চাই তুমি মামা বাড়িই থাকো আমার বিদেশ যাওয়ার পর।মামা মা কে বোঝান।আমি বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

“- আমারে যাই কও কাজ হবি না।আমি এ গিরাম ছাড়ে কোনোখানে যাবো না।সে যা হয় হবি।দুইদিনের মেয়ের জন্যি কি আমি আমার স্বামীর কবর দেখতে পাবো না?আমি এইখানেই থাকবো এ আমার শেষ কতা।আর তুই ও এবার বিয়ে করেই যাবি।ভাইজান আইছে এইজন্যি কাল আমরা মাইয়ে দেকতি যাবো।

মেয়ে দেখার কথা শুনে খালিদ চমকে ওঠে।কলিজায় টান লাগে খুব জোরে।বিস্ময় আর অভিমানের সাথে মুখে ফুটে ওঠে একরাশ মলিনতা।

“- মা!
ছেলের মলিন মুখটা দেখেও না দেখার ভান করে রেগে বলে,
“- চুপ কর! তোর পেটে আমি হইছি না আমার পেটে তুই হইছিস? আমি যা বলবো তাই করবি না হলি দেখিস কি করবো?বুড়ি হয়ে গেছি। এখন কি আমার কোনো মূইল্লো আছে? যা ইচ্ছা কর।আমি মরি বাচি তোদের কি?

মায়ের চোখ মুছা দেখে খালিদ ধপ করে মায়ের পায়ের নিচে হাটু মুড়ে বসে।মায়ের হাত দুটো চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়,

“- মাগো তুমি কেদো না! তুমি আমার জান্নাত তোমার চোখের জল আমাকে ধ্বংস করে দেবে মা।কেদো না তুমি।আমি তোমাকে কষ্ট দিলে শাস্তি দাও মারো।তবুও কেদো না গো মা।তুমি যা বলবে তাই হবে।

কাঁদতে কাঁদতে মায়ের ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যায় খালিদ।কষ্টের পাহাড় শ্বাসরোধ করে ফেলছে মনে হয় খালিদের।

জব্বার মিয়া এসে বোনের পাশে বসে।

“- এমন করে না বললেও পারতি রে খাদিজা।ছাওয়াল ডা খুব কষ্ট পাইছে।তোরে তো ও খুব ভালোবাসে।আজকাল এমন ছাওয়াল খুজে পাওয়া যায় না রে।

“- আমিও জানি ভাইজান।তবুও কিছু পাওয়ার জন্য কিছু দুক্কু দিয়াই লাগে।আমি তো মা আমি জানি ওর কিসে ভালো আর কিসে খারাপ।এজন্যি যা করা লাগে সব করবো।তবুও আমার খালিদরে ওর প্রাপ্য দেবো। ছাওয়ালডা আমার বড়ই ভোলা গো ভাইজান।পরের জন্যি সব বিলায়ে দেয়।

“- হ! জব্বার মিয়াও বোনের ঘাড়ে হাত রাখে।
ভাই বোন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে তারপর খাদিজা ভাইকে কোথায় কোন মেয়ে দেখতে হবে সব বলে।

তানি পুষ্পাদের বাড়ি থেকে আসার পরই ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে।বার বার তাজের চেহারাটা ভাসছে। রাগে বিছানা খামচে ধরছে।ইচ্ছা তো করছে গিয়ে এক থাপ্পড়ে ওর দাঁত ফেলে দিতে কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মে সে সাহস অনুমতি কোনোটাই মিলছে না।মনের রাগ মনে পুষেই শুয়ে থাকে খিদা পেটে।কলিজায় এখনও ড্রাম বাজছে আতঙ্কে।
হঠাৎই বাবা মায়ের কথোপকথনে শিড়সোজা করে বসে তানি।কানটা খাড়া করে বসে শুনতে থাকে,

“- শোনো ফয়েজের আব্বা! তুমি রাজি হয়ে যাও।এমন ছাওয়াল লাখে একটা হয়।আল্লাহ মুখ তুলে চাইছে নাইলে তোমার ধিঙি মাইয়ের জন্যি এমন সমন্ধ কি কইরে আসে?

“- কিন্তু মাইয়ে আমার এহনো ছোট ফয়েজের মা।ওরে কেমনে?তাছাড়া ও তো চাইতেছে না বিয়ে করতে।

“- ওর চাওয়া না চাওয়ায় কি হয়? যুবতি মাইয়ে ঘরে থাকলি মানষি একটা না একটা কলঙ্ক দিবো সুযোগ বুঝে।মান সম্মান থাকতে থাকতি পার করো নইলি কান্দা লাগবি।রহমত ভাইয়ের মাইয়ে ডা দেহো নাই বেরোই গেলো।

“- আমার তানি ওমন না।মাইয়ে আমার চঞ্চল হলিও লক্ষি আছে।

“- বেশি বুঝো না তো? যা কইছি শুনো।কাইল আসতি কও তাগের।

“- কিন্তু!

“- আর কিছু কইয়ো না তো?

“- তানিরে একটু কও?

“- কাল সকালে কবানে এখন আর কিছু কইয়ো না তো ওরে? তাইলে নাকের পানি চোখের পানি এক করবেনে।

তমিজ মোল্লা গম্ভীরমুখে বসে ভাবছে স্ত্রীর কথাও যুক্তি আছে।মেয়ে গ্রামের মানুষের চোখে পড়ার আগেই পার করে দেওয়া ভালো।তাতেই মঙ্গল। না হলে কেউ কিছু বললে চরিত্র দাগ পড়ে যাবে তখন বিয়ে দেওয়া কষ্ট হইয়ে যাবে।পরক্ষনেই মেয়েকে পর করে দেওয়ার কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে আসে।

তানি বাবা মায়ের কথা শুনে চমকে ওঠে। ভয় হয় যে প্রস্তাব এসেছে সেটা আবার তাজের বাড়ি থেকে আসে নি তো? যেখান থেকেই আসুক বিয়ে তানি করবে না এক্ষণ।দরকার হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।পুলিশে হওয়ার খুব শখ তানির।সে শখের জলাঞ্জলি কোনোমতেই দেবে না।

চলবে,,,গোধূলির শেষ আলো?
#পর্ব ০৪
writer Tanishq Sheikh Tani

সারারাত দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করেছে তানি।কি অপেক্ষা করছে আগামীকাল জানা নেই।শুধু জানা আছে যা হোক সাহস করে ঢাকা মামা বাড়ি পালাতে পারলেই হলো।সত্যি যদি বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায় তবে কি হবে? পালাতে কি পারবে ও এই সংকীর্ণ গণ্ডি ছেড়ে।যে মেয়ে একবেলা না খেলে চেচাঁমেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো আজ সেই মেয়েই খাওয়ার কথা ভুলে আছে।ফজিলা মেয়েকে ডাকতে এসেও ডাকে নি তানি ঘুমিয়ে গেছে দেখে।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁথাটা কাঁধ পর্যন্ত টেনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যান। মাকে রুমে আসতে দেখে অভিমানে ক্ষোভে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে থাকে।মা চলে যাওয়ার পরই ভেজা ভেজা চোখে মায়ের যাওয়ার পথে তাকায়।

পরদিন তানিকে কেউ কিছু জানায় না।তানিও না জানার ভান ধরে অল্প কিছু ভর্তা ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায়।রাতের পাবদা মাছের ঝোল সামনে দিলেও সেটা খায় না মনের কষ্টে যদিও মাছটা খাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল।

আজ বাড়ি থেকে গোসল সেড়েই বেড়িয়েছে তানি।ভেজা ভেজা কোমড় পর্যন্ত চুলবেয়ে টুপটাপ করে এখনো পানি পড়ছে।দোপাট্টার কিছু অংশ ভিজে চুপচুপ হয়ে আছে তাতে।স্কুল শুরু ১১ টাই আর এখন বাজে সবে মাত্র ১০ টা।তাড়াতাড়িই চলে এসেছে বাড়ি থেকে আজ।এই এক ঘন্টা কি করবে তাই ভাবছে।হঠাৎই নদীর ধারের বাঁশের মাচানটা দেখে নিচে নেমে গেলো। যেহেতু পাশেই স্কুল এখানেই কিছুসময় বসে থাকার পরিকল্পনা করে তানি।কোথায় যেন শুনেছিল এই শান্ত নদীর ঢেউ, মিষ্টি রোদের আলো ছায়া খেলার প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকলে মনের দুশ্চিন্তা দূর হয়।আজ যখন সুযোগ সময় দুটোই আছে তানি সেটাকে কাজে লাগায়।বই গুলোকে একপাশে গাঁট করে রেখে দু হাতে মাচানে ভর দিয়ে বসে প্রকৃতির খেলা দেখায় মনোনিবেশ করে।নদীর পানির নিচের শেওলা পড়া ঘাসগুলোকে দেখে কিছুক্ষণ ভাবে, দূর মেহগনির বাগানের সবুজ পাতার বাহার দেখে ভাবে,নীল সাদা আকাশ দেখে ভাবে,বিভিন্ন ভাবনারা এসে ভীর করে ওর চোখে মুখে।দুটো ফড়িং কে অনুসরণ করে চোখ দিয়ে।ফড়িংদুটো উড়ে উড়ে এক গাছ ছেড়ে অন্য লতায় বসছে যেন পাল্লা পাল্লা খেলছে দুজন।কতো সুখ ওদের।সারাদিন মুক্ত স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারে।হঠাৎই একটা আজব প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেয় তানির।আচ্ছা ওরা কি বর বউ? নিশ্চয়ই হবে তাইতো এভাবে দ্বিধা শঙ্কাহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে।জিগ্যেস করি তো? তানি মাথাটা ঝুঁকে ফড়িং গুলোকে জিগ্যেস করে,

“- হ্যাঁ লো তোগের কি বিয়ে হয়ে গেছে রে? তোরা কি বর বউ? আ লো কথা ক? এতো ভাব ধরছিস ক্যা? আচ্ছা বর কিডা তোদের মধ্যে? উমম! হ্যাঁ এই লাল টাই হবে হয়তো?
এই বর বল না এতো ঘুর ঘুর কেন করিস বউয়ের পেছন।বউকে একা ছাড়ে দিতে পারিস নে?

“- না পারি না।তাহলে যে বউ পর হয়ে যাবে।বড়ই অবুঝ বউটা আমার।

পুরুষালি কন্ঠের জবাব পেয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে চোখ বড় বড় করে আড়চোখে লাল ফড়িংটার দিকে তাকায়।
তানি অতি আশ্চর্য হয় ফড়িং জবাব দিয়েছে ভেবে।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না?পরে ভাবে হয়তো মনের ভুলে শুনেছে জবাবটা।তা না হলে ফড়িং কি কথা বলতে পারে? নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

“-বউ কি পর হওয়ার জিনিস? বউ তো পাঁজরের হাড্ডি,শরীরের অংশ।ইশশ! বউ অবুজ! তুই খুব বুঝওয়ালা তাই না? শোনেক একদম বউকে অবুজ বলবি নে।তোর ঘর দোর সংসার বাচ্চা কে সামলায়? তুই তো সারাদিন খালি ঘুরঘুর করিস।ঘুরঘুরানি একটা।যা এখান থেকে।

ফড়িং কে পা দুলিয়ে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু লাল ফড়িং টা হলুদ ফড়িংএর পিছু ছাড়ছেই না দেখে তানি দাড়িয়ে পড়ে।কোমরে হাত রেখে বলে,

“- এই ছ্যাঁচড়া বর! তুই তো বড় বেশরম রে।দিনদাহারে বউয়ের পিছে ঘুরঘুর করতেছিস? লজ্জা কি হাটে বেঁচে খাইয়ে এইছিস তুই?

“- বউটা এতো সুন্দর হলে বর তো বেশরম হবেই তাই না বউ?

হঠাৎ করে কেউ ছায়া দিয়ে দাঁড়াতেই ঢোক গেলে তানি।সাথে সেই পুরুষালি আওয়াজের জবাব।তাহলে কেউ এতোক্ষন ওর কথা শুনছিল ভেবে বড় করে ঢোক গিলে মুখটা উঁচু করে উপরে তাকাতেই বড় রকমের ধাক্কা খায়। বিস্ফোরিত চোখে মুখে হাত দিয়ে সরে দাঁড়ায়। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।হলোও তাই তানির মনে হচ্ছে সামনে বাঘের চেয়েও ভয়ংকর কেউ দাড়িয়ে আছে।যাকে দেখামাত্রই কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে।
একপলক খালিদের মুখটা দেখে চোখ সরিয়ে মাটিতে নিবদ্ধ করে তানি।হাত পা অনবরত কাঁপছে।

“- তুমি তো ভারী বেয়াদব হয়ে গেছো তানি?
বয়সে বড় কাওকে যে সালাম করতে হয় জানো না?
কন্ঠ স্বর রাগী রাগী করলেও মুখে হাসি খালিদের।আধভেজা চুলে এভাবে তানিকে দেখতে দারুন লাগছে।বড় ইচ্ছা করছে চুলগুলো ছুয়ে নাক ডোবাতে।কিছুতেই চোখ সরানো যাচ্ছে না ওর গোলাপি মুখশ্রী হরিনী দুনয়ন থেকে।আর কতেভাবে মারবে আমায় তুমি তানি?এতো ভালোবাসি তোমায় আমি।আমার সমস্ত তনুমন প্রতিক্ষন ওকে জড়িয়ে বাচতে চাই একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই। কিন্তু এই পাগলী কি এসব বুঝবে কোনোদিন? রাগ লাগে তানির চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা দেখে।

“- কি হলো কথা কানে যায় নি তোমার? (ধমকের সুরে)

ভয় আর জড়তা নিয়ে বললো তানি,
“- জ্বী,,জ্বী,, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

“-কি? ( রেগে)

তানির ইচ্ছা করছে বলতে কানে কম শোনেন? তালি বাজারের হারান ডাক্তারের কাছে যাইয়ে কান পরিষ্কার করে আসেন।বার বার বলতে হবে এখন।
হু।একবার বলতেই গলা শুকিয়ে গেছে।উনাকে এখন ১০০ বার শোনাতে হবে।আল্লাহ কাওরে পাঠাও আমারে উদ্ধার করো মনে মনেই বলে তানি বাহিরে আর প্রকাশ করার সাহস পায় না।

“- কি হলো চুপ করে আছো কেন? চুপ থাকলে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবো।

হায়! হায়! কই কি? খালিদের বাচ্চা তোর কি ক্ষতি করছি আমি।কেন এমন করিস আমার সাথে। কি দুশমনি আমার সাথে তোর? বাচ্চা মাইয়ে আমি।ভয় দেখাস খালি।তোর বউ তোরে খুব জ্বালাবি দেহে নিস।মাথা নিচু করেই বিরবির করে তানি।

খালিদের রাগ মাত্রা ছাড়া হয়ে গেছে ভাইয়া ডাক শুনে। ভাইয়া ডেকেছিল দেখে ক্লাস ফাইভে থাকতে পিটুনি দিয়েছিলাম তবুও ভাইয়া বললো। ভাইয়া বলা শিখাচ্ছি আজ তানি তোমার।খালিদ তানির হাত ধরে নদীর দিকে ধাক্কা মারে।খালিদের আচমকা এমন ব্যবহারে তানি ভয়ে কেঁদে দেয়।খালিদ এখনো হাত ধরে আছে তানির।এমনভাবে ঝুলে আছে তানি খালিদ হাত ছেড়ে দিলে সোজা নদীর পানিতে পড়বে।

“- আমি পড়ে যাবো ছাড়ে দেন আমারে।ভয় করছে আমার।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে খালিদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

“- তাহলে ভাইয়া বললে কেন? আর বলবে?

“- না কোনোদিন কোনোকালেই বলবো না।উঠান আমাকে।

“- উঠাতে পারি এক শর্তে।

“- আপনি উঠতে বললে উঠবো বসতে বললে বসবো তবুও উপরে উঠান আমাকে।আমার ভয় করছে।

“- না! তোমাকে আমি খুব চিনি।ধড়িবাজ মেয়ে তুমি।ফাঁক পেলেই দৌড়াবা।

“- জীবনেও দৌড়াবান না।সত্যি বলতেছি।বিশ্বাস করেন।

“- সত্যি তো?

“- কোটিবার সত্যি।

খালিদ একটানে নিজের উপর নিয়ে এসে ফেলে।তানি টান সামলাতে না পেরে খালিদের বুকের উপর পড়ে।ভয়ে খালিদের বুকের শার্ট খামচে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।হুশ ফিরতে তাড়াতাড়ি সরে দাড়ায়।

“- মোবাইল নাম্বার দাও তোমার?

খালিদের মুখে মোবাইল নাম্বার চাওয়ার কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।কারন কেউ জানে না ওর কাছে মোবাইল আছে।আব্বা গোপনে কিনে দিয়েছে গেমস খেলার জন্য। সেটা দিয়েই এখন একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে। কিন্তু এই খবর খালিদ কি করে জানলো ভেবে পায় না তানি।ঢোক গিলে বলে,

“- আমি তো মোবাইল ব্যবহার করি না।

কথাটা বলতে দেরি হয় না তানির হাত পেছন থেকে মুচরে ধরে খালিদ।

“- হাত ভেঙে ফেলবো মিথ্যা বললে।দে মোবাইল নাম্বার।

“- ০১৭….. তানি গড়গড় করে সব বলে দেয় খালিদের ধমকে।হাতের ব্যথায় কাতরাতে থাকে।তবুও জালিমটা হাত ছাড়ে না।

“- গুড গার্ল।সবসময় এমন হবে।শুধু শুধু আমাকে রাগাও কেন বউ।মুচকি হেসে হাত ছেড়ে মোবাইল নাম্বার সেভ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।

“- কে বউ?
বউ ডাক শুনে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে খালিদের ঠোঁটে বাকা হাসি দেখে চোখ নামিয়ে নেয়।

“-ঐ যে হলুদ ফড়িং বউ।তুমি কি ভাবছো তোমাকে বউ বলেছি? কেন ভাবছো? আমাকে কি তুমি? মুখের কাছে ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করে

“- ছি! ছি কি বলেন।আপনাকে আমি কোনোদিন ওসব ভাবি না।আপনি তো আমার ভাইআ!আআআ,,,,তানির মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে খালিদ।

“- কি বলতে গিয়েছিলে? আবার বলেছো ভাইয়া? ২য়বার এবং শেষবার ক্ষমা করে দিলাম।আর কোনোদিন যদি ভাইয়া ডাক ভুলেও শুনেছি তোমার মুখ থেকে এমন অঘটন ঘটাবো না? তখন মুখ লুকানোর জায়গাও পাবা না।

দূরে কাওকে আসতে দেখে তানির মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে, সরে দাড়ায় খালিদ।

“- যাও স্কুলে যাও।সোজা ক্লাসে গিয়ে বসবে।এদিক ওদিক যদি দেখেছি ধেই ধেই করে নাচতে তবে খবর আছে তোমার।আর হ্যাঁ! আমি কল করলে যদি না ধরছো?

“- ধরবো আমি। কল বাজার আগেই ধরবো।এবার আমি যাই( করুন চাহনীতে শান্ত গলায়)

“- যাও।সোজা ক্লাসে

“- জ্বী!

তানি অনুমতি পেয়ে চালু পায়ে চলে যায় খালিদের সামনে থেকে।কলিজায় পানি পায় খালিদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে।কিছুদূর গিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে খালিদ ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। তানি আর তাকায় না সোজা একদৌড়ে নাইনের ক্লাসে চলে যায়।

চলবে,,,