গোধূলির শেষ আলো পর্ব – ১৫+ ১৬

0
647

গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ১৫ ১৬
Writer Tanishq Sheikh Tani

একদিন পর কাতারের ফ্লাইট থাকলেও আগেই বাড়িতে থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে খালিদ।ব্যাগ ট্যাগ সব গুছিয়ে রেডি হয়ে মাকে সালাম করে অনেকক্ষণ মায়ের হাতদুটো মুঠোবন্দি করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল।খাদিজা ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর আঁচলে চোখ মুছছে।

“- আমার উপর বেজার থাকিস নে বাজান।

“- এ কেমন কথা বলছো মা।বেজার কেন থাকবো।তুমি যা বলেছো নিশ্চয়ই তার মধ্যে আমার জন্য ভালো কিছু আছে বলেই বলেছ।

“- সত্যি কচ্চি রে বাজান।আমি চাই তুই ভালো আয় রোজগার করে তারপর বিদেশ থে ফিরে আয়।এই বাড়ি করতি যায়ে তোর পুঁজি তো সবই শেষ।সারাজীবন কি করে চলবি বিদেশ না গিলি? তোর বাপটারে ঐ জানোয়ার ডা অকালেই আমাগের তে কাড়ে নিল।দুই তহন মাত্র ৮ মাসের আর মাজিদ ৫ বছরের।উপরে আল্লাহ ছিল আর নিচে তোর বড় কাকা আর মামা না হলি কি যে হতো আমার।তোর বড় কাকাও পরে মুখ ফিরাই নিলো আমাগের তে।আমাগের জন্যি নাকি সে পঙ্গু।তোর বাপের পাওনা জমি সব আত্নসাৎ করে নিল।আল্লাহ আমাগের সহায় ছিল তাইতো ডাঙ্গায় ডাকাত জলে কুমির থাকতিও রাতের ঘুম হারাম করে বড় করছি তোগের।তোগের খারাপ কোনোকালেও চাইনে আমি বাজান।এইটুকু বলেই হুহু করে কেঁদে দিলো খাদিজা।মায়ের কান্নায় খালিদ উঠে বসলো।মায়ের মাথাটা বুকে নিয়ে সান্ত্বনা কি দেবে ভেবে পেলো না।মনটা খালিদের খুব খারাপ আজ।একটু পর চেনাজানা সব কিছু থেকে বহুদূরে চলে যেতে হবে তাকে।

“- মা! কেদো না প্লিজ।আমি কিছুই মনে করি নি তোমার কথায়।তুমি আমার মা।আমার বেহেশত তোমার আদেশই আমার জন্য শেষ কথা। আমাকে ক্ষমা করে দিও আমার কারনে পুরোনো ব্যথা মনে পড়লো তোমার।

“- না রে বাজান। তুই তো আমার নয়ন মনি।তোর কোনো দোষই আমি মনে রাখি না।সন্তান ভুল করতিই পারে তাই বলে তো মা তাগের পথ দেখানো ছাড়ে দিবে না।তুই এহনও দুনিয়াদারি বুঝিস নে।তাইতো বউয়ের মায়াকান্নায় ভুল করতি বসেছিলি।আমি মা হয়ে তো আর বসে বসে তোর সব্বনাশ দেকতি পারি নে।

“- মা তানিকে দোষ দিও না।ও বেচারি কিছুই বলে নি আমাকে।আমিই যেতে চাচ্ছিলাম না তোমাদের ছেড়ে।

“- হয়ছে খালিদ! চুপ কর।বাতাসে চুল পাকে নেই বাজান আমার।ওরে তোর যোগ্য ভাবার ভুলটা আমারই ছিল।

“- মা!তুমি না ওকে ভালোবাসতে।কি এমন অপরাধ করেছে ও যে এভাবে বললে। তুমি তো ওকে আমার চে বেশি চেনো মা।তবুও এভাবে বললে?

“- চিনি বৈকি আর।চোখে ধা ধা দেকছিলাম নয়লে কি ওমন অকাজের ঢেঁকি ঘরে আনি।লিজা রে দ্যাখ

“- ওহ! এই কথা তাহলে।লিজা তোমার মাথা আউলাচ্ছে।

“- কেউ আমার মাথা আউলাচ্ছে না।বরঞ্চ আমার চোখের পর্দা সরে গেছে এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে।এখনও সময় আছে ছাড়ে দে খালিদ ওরে।তুই রাজি হ বাকিটা আমি দেখে নিবানে।

“- মা! খালিদ মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে।এক মুহুর্তে থমকে যায় সব কিছু।সামনে বসা খাদিজা আর খালিদের মা আজ দুই মেরুর দুই বাসিন্দা মনে হচ্ছে খালিদের কাছে।খালিদ কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের হাত দুটো ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।কথা বলতে পারছে কান্নার তোরে।বুকের পাঁজরে ভীষণ রকম ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

“- দেক খালিদ বাজান আমার।লিজা অনেক ভালো মেয়ে ও তোরে খুব ভালোবাসে। আমি যদি তোর বিয়ের আগে ঘুনাক্ষরেও একবার লিজার মনে কথা জানতি পারতাম।কস্মিনকালেও ঐ তানির সাথে তোর বিয়ে দিতাম না।ছাড়ে দে বাজান ওরে।না হলি!

“- না হলি কি মা? বলো ? কি লুকাচ্ছো মা! মাগো আমি আজ চলে যাবো। কিছুতো সুখ নিয়ে যেতে দিতে।কিছু বিশ্বাস, ভরসা! এখন তো সংশয়,চিন্তা আর আতঙ্ক নিয়ে যেতে হচ্ছে দূর প্রবাসে আমাকে। আমার তানিকে আমি কার কাছে সুরক্ষিত রাখবো।ওর আপনই তো ওর বড় শত্রু হয়ে গেলো।মা তোমার পায়ে পড়ি ওর সামনে এসব আর বলো না।ও যে বড় ভালোবাসে, সম্মান করে তোমাকে।সহ্য করতে পারবে না তোমার দেওয়া আঘাত মাগো বলো না ওকে।ছোও আমার মাথা ছুঁয়ে কসম খাও।

“- একি অলক্ষুণে কাজ করছিস! ছাড় আমার হাত।ছাড়।

“- না মা! বলো আমার মাথা ছুঁয়ে। বলো এসব কিছুই বলবে না।আগের মতোই ভালোবাসবে ওকে।

খাদিজা পড়েছে মহাঝামেলায়।একদিকে ভাগ্যের দরজায় কড়া নাড়ছে ভয়ঙ্কর অতীত অপর দিকে প্রিয় পুত্রের জীবনাশংঙ্কা।কসম রক্ষা করতে না পারলে যে জীবনসংকট নেমে আসবে ছেলের ভাগ্যে।চোখের সামনে সমর্থ জোয়ান ছেলের অসহায় কান্না দেখে নিজের কথায় লজ্জা হচ্ছে খাদিজার।অগ্যতা উপায়ন্তর না দেখে মুখটা বেজার করে হ্যা বলে খাদিজা।তানিকে যে অপছন্দ করে এমন না।তবে তাকে আগের মতো আর পছন্দ কিংবা ভালোবাসে না খাদিজা। ফুপু থেকে শ্বাশুড়ি হওয়ার পদোন্নতিতে বদলে গেছে খাদিজা।এখন আর আগের মতো কোমল সুরে কাছে ডাকে না তানিকে। যেদিন আপন ভাতিজি লিজাকে ছাঁদে খালিদের শার্ট বুকে কাঁদতে দেখেছেন সারারাত ঘুমাতে পারেন নি।পরদিন লিজা জোর করেই দিয়ে আসতে বললো বাড়িতে। খাদিজা ভাতিজির কষ্ট সহ্য করতে পারে নি তাই দিয়ে এসেছিল। সারাটা পথ মুখটা কালো করে রেখেছিল লিজা।খাদিজা তবুও তানিকে বউমার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মতো পাপ মনেও আনে নি।শুধু ভাতিজির কষ্টে ব্যথা পেয়েছিল এই যা।ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পথে বাড়ির সামনের নির্জন সুপারি বাগানে ভর দুপুরে কেউ পথ আগলে দাঁড়াতেই সবার পৃথিবী আগের মতো থাকলেও খাদিজার পৃথিবী পাল্টে যায়।খাদিজা ঐ রাতও কেঁদে নির্ঘুম কাটিয়েছে। কি করে পাপ করবে সে চিন্তায় সেই রাতটা অতিবাহিত হয়।সকালে নামাজ পড়ে ছাঁদে উঠে আবার সেই ভয়ঙ্কর অতীতের মুখোমুখি হয়।সম্মান বাচাতে খাদিজাকে বাধ্য হয়ে বদলাতে হয়।না হলে যে সব উজার হয়ে যাবে এতোদিনের তিলতিল করে জমানো সম্মান, সম্পর্ক।
এরপর থেকেই ঘৃণা, রাগ দুটোই জন্মে তানির উপর।এই মেয়ের কারনেই আজ খাদিজার অন্ধকার অতীত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।ছেলেকে না চাইতেও দূরে ঠেলে দিতে হচ্ছে।খালিদ মাকে অনেক বুঝিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।
খালিদ ঢাকা যাওয়ার সময় সকাল থেকে রাতে পরিবর্তন করলো। মায়ের কথায় মনটা ভারি হয়ে উঠেছে। তানিকে এভাবে একা ফেলে যেতে সায় দিচ্ছে না মন।ঝড় উঠেছে খালিদের মনে কালবৈশাখী ঝড়।যার আভাস বাইরে থেকে কেউই পাচ্ছে না।

খালিদকে মনের কথাগুলো বলে খাদিজা নিজেই নিজেকে বোকা বলে।কি দরকার ছিল ছেলেকে সবকিছু জানানো।তার ছেলে যে বউ পাগল তাতো বিয়ের আগেই বুঝেছে সে।এখন কিছু একটা করলেও খালিদ সন্দেহ করবে।মুহুর্তেই ছেলের অসহায় মুখটা ঢেকে গেলো খাদিজার গোপন ষড়যন্ত্রের আড়ালে।খাদিজা কিছুক্ষণ ভাবলো কি করে ছেলের মনে আবার বিশ্বাস জন্মানো যায়।

“- তানি! তানি!

তানি রান্নাঘরে হাটুমুড়ে বসে কাঁদছিল। খালিদ গতকাল মাকে কাতার না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানালে মা রেগে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন। তা দেখে খালিদ যতোনা অবাক হয়েছিল তানি দরজার আড়ালে দাড়িয়ে একটু বেশিই হয়েছিল। কারন শ্বাশুড়িই একদিন তাকে বলেছিল খালিদ বিদেশ না গেলেই তিনি খুশি হন।তবে খুশি না হয়ে এমন চিৎকার করলেন কেন তিনি? আজকাল ভালো করে কথা বলে না শ্বাশুড়ি তানির সাথে।একে তো স্বামীর বিরহ তার উপর শ্বাশুড়ির পরিবর্তন কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তানির।একটু পর পর চোখ দুটো জলে ভরে আসছে।একা থাকলে জল পড়ার তীব্রতা বেড়ে যায়।রাগ লাগে তখন খুব তানির।রেগে চোখের জলকে বকে ইচ্ছামতো,” মরার জল তুই থামিস নে ক্যা।আর কতো বইবি।থাম কচ্ছি থাম।চোখের জল যেন তানির বকাতে দমতোই না বরং পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেতো।হঠাৎ খালিদের রূঢ় স্বরে চিৎকার শুনে কেঁপে ওঠে তানি। দাড়িয়ে চোখটা আঁচলে ভালো করে মুছে নেয়।মুখটা স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করে ঘরে দিকে দৌড়ে যায়।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে খালিদের রেগে যাওয়া মুখটার দিকে আধো আধো তাকিয়ে।ভয় লাগছে তানির খুব।খালিদ যখন ছোটবেলা পড়াতো তখন ঠিক এমন রেগে থাকতো।কিন্তু বিয়ের পর একদিনও জোরে কথা বলে নি তানির সাথে খালিদ।একটু দম নিয়ে জিজ্ঞেস করে

“- জ্বী!ডাকছিলেন

“- থাকিস কই তুই? ডাকতে ডাকতে গলার নলি ফেটে যায় আমার।

“- পাকের ঘরে ছিলাম।

“- এদিকে আয়!

তানি ভীরু পায়ে খালিদের খাটের কাছে যেতেই খালিদ একটানে বুকের সাথে মিশিয়ে শব্দ করে কেঁদে দেয়।প্রথমে শক লাগলে পরে তানিও এতোদিনের লুকানো চাপা কান্নার উন্মোচন করে খালিদকে আঁকড়ে। দুহাতে শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। যেন একটু ছাড়া পেলেই পালাবে খালিদ।নিজের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে তানির অশ্রুশিক্ত মুখটা হাতের মধ্যে নেয়।চোখ দুটো মুছে কপালে ভালোবাসা দিয়ে বলে,

“- সাবধানে থেকো তানি।তুমি আমার আমানত সেটাই তোমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেলাম।আমার দেহ কাতারে থাকলেও মন,প্রাণ তোমার কাছেই থাকবে।

“- আমি পারবো না। কিছুই পারবো না।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার।কেন বোঝেন না আপনি?

“- সব বুঝিরে পাগলী সব।কিন্তু কি করবো বলো? মায়ের কথা তো অমান্য করতে পারি না।তাছাড়া আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এতোটুকু ত্যাগ যে করতেই হবে আমাদের।তুমি পাশে না থাকলে আমি একা যে পারবো না সুন্দর ভবিষৎ গড়তে।আমাকে দূর্বল করে দিও না প্লিজ।তুমিই তো আমার শক্তির উৎস সেই তুমিই যদি কেঁদে দূর্বল হয়ে যাও তাহলে আমি কি করে থাকবো বলো? কাদে না লক্ষিটি।হাসি মুখে বিদায় দাও আমাকে।যেনো এ তিন বছর তোমার হাসি মুখটায় মনে তুলে রাখতে পারি।রোজ কাজ থেকে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যখন তোমার কথা মনে পড়বে তোমার হাসি মুখটা ভেবে যেন সে ক্লান্তি দূর করতে পারি।

“- আমি আপনার সব কথা মানলিও আমার মন তো মানছে না।সে তার স্বামীর আদেশ মাথায় তুলে নিলিও মন থেকে মানতে নারাজ।তার যে স্বামীর বিরহে খুব ভয়।আমি কি করে থাকবো আপনাকে ছাড়া বলেন না? আমি মরে যাবো বিশ্বাস করেন। আমাকে ছাড়ে যাবেন না দোহায় লাগে।তানি খালিদকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।

খালিদ আর বোঝানোর মতো ভাষা খুজে পায় না।নিজের মনকেই তো বোঝাতে পারছে না।এমন করে বউকে একা ছেড়ে যেতে খালিদেরও যে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু মা যে মানলো না।নয়তো রাস্তায় ফেরি করে খেলেও বউকে একা রেখে খালিদ বিদেশ যেতো না।মাকে আরেকবার বোঝানোর শেষ চেষ্টা করবে খালিদ।মা নিশ্চয়ই বুঝবে এই আশায় মনে বেঁধে তানিকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।স্বামী স্ত্রী কিছুসময় একান্তে সময় কাটালো হয়তো শেষবারের মতো, হয়তো নতুন সূর্যের ঝলমলে আলোর প্রত্যাশায়?

চলবে,,,
গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ১৬
Writer Tanishq Sheikh Tani

” ওলো বু! দ্যাখ কিডা আইছে?

মাত্র দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় গা দিয়েছিল চেয়ারম্যানের নতুন বউ নুরুন্নাহার।চোখ লেগেই এসেছিল শান্তির ঘুমে তার মধ্যে মেম্বারের বউয়ের হেরে গলায় ডাক শুনে মুখ চোখ খিচে সবচেয়ে খারাপ গালিটাই দিলো আস্তে করে নুরুন্নাহার।শাড়ির এলোমেলো আঁচল ঠিক করতে করতে বলতেই চাচ্ছিলো,

“- কি লো মাগি ওমন গলা ফাটাচ্ছিস ক্যা।ভর দুপুরি কি তোর সয়া আসলো নি লো।

কিন্তু বললো না নুরি।নতুন বিয়ে হয়েছে চেয়ারম্যানের সাথে দুদিন হলো। এখনই যদি সবার সাথে ঝগড়া করে তাহলে তো মানুষের চক্ষুশূল হয়ে যাবে।এমনিতেই গ্রামের মহিলারা কানাঘুষো করছে নুরি আর চেয়ারম্যানের বিবাহবহির্ভূত আগের সম্পর্ক নিয়ে।নুরির সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন চেয়ারম্যানের মরা বউয়ের সাথে ওরে তুলনা করে কেউ।নুরি ভেবে পায় না তাসলীর মতো বেটপ দেহের অধিকারিনী শ্যামলা বরণ বুড়ি মহিলাকে কেন ওর মতো রূপসীর সাথে তুলনা করে সবাই।দয়া মায়া কোল ভরে নিয়ে লাভ কি? সেই তো স্বামীর হাতে মরতে হলো।তারচেয়ে নুরিই সুখী ভাবে নিজেকে।গুন দিয়ে কি হবে? রূপটাই আসল। এই রূপের কারনেই চেয়ারম্যানের মতো ধূর্ত লোক নুরির পা চাটে।নুরি তিনবেলা লাক্স সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে স্নো পাওডার মাখে।ঠোঁটে সর্বদা কড়া লাল লিপিস্টিক থাকবেই।নুরিকে মাথায় ঘোমটা দেওয়া কেউ দেখেছে এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার।নিজেকে নিয়ে নুরির অহংকার করার তিনটি জিনিস আছে।রূপ,কোমড় ছাড়ানো কালোমেঘের মতো রেশমি চুল আর উচ্চতা।৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা নুরি।যার কারনে শরীরের মোটাত্ব বেমানান লাগে না বরংআকর্ষনীয় লাগে। ৪০ছুই ছুই নুরির বয়সের বাঁধন যেন এখনও ৩০ এর কোটায় আছে।আগের স্বামীর ঘর ছাড়ে খাটাখাটুনির আর খাবার কষ্টে।চেয়ারম্যান কে রূপের জালে ভুলিয়ে এই আয়েশের জীবনই চাই নুরি।নিজের রূপে বড় বড়াই নুরির। আয়নার সামনে আঁচল সরিয়ে নিজেকে দেখলে গর্বে মাটিতে পা ফেলতে ইচ্ছা করে না নুরির।আর তাকে কি না ওমন বেটে শ্যামলা মহিলার সাথে সবাই তুলনা করে? মুখটা বাকিয়ে চুলটা খোপা করতে করতে দরজার বাইরে এসে চোখ কুঁচকে যায় নুরির।সামনে দাঁড়ানো যে তাজ!তাজকে নুরির অনেক ভয়।এর আগে কয়েকবার ইচ্ছামতো চড় থাপ্পড় খেয়েছে তাজের কাছে চেয়ারম্যানের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার কারনে।আজ তো চেয়ারম্যানও বাড়িতে নাই তাজ কি আস্তো রাখবে নিজের মায়ের জায়গায় নুরিকে দেখে? ঢোক গিলে মুখটা কাচুমাচু করে হাসার চেষ্টা করে।

“- তাজ! বাজান ভালো আছিস?

“- আমি আবার কবেত তে তোর বাজান হলাম রে নুরি খালা? আগে তো তোর চোখের শূল ছিলাম।আজ হঠাৎ মুখে মধূ নিয়ে বাজান ডাকলি ক্যা?

তাজের তীক্ষ্ণ চোখের চাহনীতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে নুরির।কি বলবে গলা দিয়ে বের হচ্ছে না?দুজনকে চুপ দেখে মেম্বারের বউ খিলখিল করে হেসে উঠলো।

“- ও মা! এ কি কচ্ছিস রে তাজ? মা রে কি কেউ খালা ডাকে নাকি রে? নুরি তো এহন তোর ছোট মা।

“- ছোট মা! বাহ! ভালোই তো তামশা শুরু হয়ছে।তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হাতের ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ঢোকে তাজ।

তাজকে চুপচাপ ঘরে যেতে দেখে বিস্মিত হলেও নুরি যেন হাফছেড়ে বাঁচে। প্রানটা ধপধপ করছিল তাজকে দেখে।তাজ ঘরে যেতেই মেনি বিড়াল থেকে বাঘিনী হয়ে ওঠে আগের মতোই।মুখটা কটমটিয়ে মেম্বারের বউয়ের উদ্দেশ্যে বলে,

“- আহা রে! কাউয়া কা কা করেও কাউরে ঠুহাতি পারে না।

“- তুই কি আমারে কিছু কলি নুরি?

“- কই না তো! তা তুমি কি আইজকে এনেই থাকবা নেহি বু! কও তো বিছানা সাজাইয়া দি

“- আরে কি কইস! আমি তো তোর ভালোর জন্যি আইলাম।তাজ তো কি বদরাগী জানিসই নাকি? ভাবলাম

“- ভাবলে আমারে চুলের মুঠি ধরে বাড়িততে বাইর করে দিবেনে আর তুমি তা দেহে হাতে তালি দিবা তাই নে?

“- ছি! তওবা তওবা! তুই মানুষ টা সুন্দর কিন্তুক তোর মনডা বড়ই অসুন্দর বুঝলি এক্কেবারে কয়লার কালি।

“- বেশি নাড়াইয়ো না তালি পরে সেই কালি তোমার শরীলিও মাখে যাবে কলাম।এহন যাও তো।

“- যাচ্ছি রে যাচ্ছি! আজকাল ভালোর নাম নাই।আইলাম ভালো কত্তি উল্টে কথা শুনাই দিলি।তাসলী থাকলি মোয়া মুড়ি না খাওয়ায়ে যাতি দিতো না।আমিই বা কি? স্বর্ণের সাথে তামার তুলনা করতেছি। হু

“- তালি পরে যাও না ঐ যে কবর দেহা যায়।যাও যাইয়ে কবর খুড়ে বাইর করে কও তোমারে মুড়ি মোয়া দিতে।আমি তো তামা।আমার কাছে কিসির জন্যি আসো তালি।
যাও! বারান্দার গ্রিলের দরজা খট করে লাগিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে নুরি।রাগে মেম্বারের বউয়ের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।চেয়ারম্যান এমপি হলে নুরি আগে এই বজ্জাত বেডিরেই খুন করবে বলে ভেবে রাখে।একদন্ড শান্তি দেয় না নুরিরে মেম্বারের বউ।এদিকে তাজ ফিরে আসায় আসন্ন ঘুম ফুর করে উড়ে গেছে নুরির চোখ থেকে।চিন্তা আর ভয় কাজ করছে মনে শুধু।

তানি বেহুশ হয়ে পড়ে আছে বিছানায় পাশের ফ্লোরে।খালিদ সত্যি সত্যি চলে গেছে বিকাল গড়াতেই।মা কিছুতেই শুনলো না খালিদের কথা।কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে একসময় তানি।ইচ্ছা করে চিৎকার করে আকাশ বাতাস সবকিছু ভেদ করে কান্নার রোল তুলতে কিন্তু পারে না।কারন প্রথমত সে মেয়ে তারচেয়ে বড়কথা সে বউ।বউদের গলা সবসময় মৃদু হতে হয়।বড় গলা হলে তো গ্রামে ছি! ছি! পড়ে যাবে সে বউকে নিয়ে।তখন তো খাদিজার মানসম্মান থাকবে না।কান্নায় কান্নায় একসময় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে ফ্লোরে।
খাদিজা ঘরে বসে তসবি গুনছে।মনোযোগ মোটেও জিকিরে নেই খাদিজার।মন বার বার চেয়ারম্যানের কথাতেই চলে যাচ্ছে।”পুত্র বধূ তানিকে চেয়ারম্যান চাই!”নাহলে সব কথা জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে বার বার আব্বাস।আব্বাসের হুমকিতে অতীত আরেকবার জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে।বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে একটা শ্লোক আছে” আপণা মাংসে হরিণা বৈরি” অর্থ হরিণের শত্রু হরিণের নিজের মাংসই।খাদিজার ক্ষেত্রেও নিজের রূপই নিজের শত্রু হয়ে দাড়িয়েছিল।আব্বাস জোয়ার্দারের কুনজরে পড়ে অকালে স্বামী হারিয়ে বিধবা হতে হয়েছে।
খাদিজার স্বামী সৈয়দ হেকমত আলী খুন হওয়ার পর যখন আব্বাস কে বড় মিয়া পুলিশে দেয় তখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খাদিজা।কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পায় আব্বাস।আবার শুরু হয় দুঃশ্চিতার আর ভয়ের সময়।
এক একটা দিন যেন বছরের সমতুল্য মনে হতে লাগে খাদিজার।দুধের শিশুদুটোকে নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করতে লাগলো।খাদিজার জীবন সর্পদসংকুল হয়ে গেলো যখন বড় মিয়ারও পা কেটে ফেললো আব্বাস।শ্বশুর বাড়ির লোক মুখ ফিরিয়ে নিলো।খাদিজা দিনেও অন্ধকার দেখতে লাগলো।পরদিন সিদ্ধান্ত নিলো বাবার বাড়ি চলে যাবে।রাতে একচুল ঘুম আসলো না।মাঝরাতে হঠাৎ জানালায় টোকা পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে খাদিজা।ভয়ে শরীর ভিজে একাকার। তখনি শুনতে পেলো আব্বাসের ফিসফিসানি

“- শোন খাদিজা! স্বেচ্ছায় একবার ধরা দে।আমি কথা দিচ্ছি কাউরে কবান না।খালি একবার তোরে সাধ মিটায়ে,,,,

“- আল্লাহ রে ভয় কর শয়তান! এমন অবিচার করিস নে তোর দোহায় লাগে।বাঁচতে দে আমারে।

“- ঠিক আছে তালি তোর কথায় হবি।তোর বড় ছাওয়ালরে শেষবারের মতো দেহে নে।

“- আব্বাস!

“- দরজা খোল।কেউ জানবি নে কেউ না।খালি একবার।আমার মরা মায়ের কসম।আমার চাওয়া পূরণ করে দে আমি আর তোর ধারের কাছেও আসবান না।

“-কোনোদিন না।

“- মা*। থাক তোর যৌবন নিয়ে।তোর তে সব কাড়ে নেবো।স্বামী তো নিছি বাকি যা আছে সব।এহন একবার দিলি না খায়েশ মিটাতি তহন সারাজীবন ঘরে রাখে দিবো দেহি তোর কোন বাপ আমারে ঠেকায়।

“- আব্বাস তোর পায়ে পড়ি আমারে আর জ্বালাস নে।আমি আর পারতেছি নে।কি ক্ষতি করছি তোর আমি? কেন আমার সর্বনাশ করার জন্যি উঠে পড়ে লাগছিস?

“- মায়াকান্দা বন্ধ কর শালি! চুপচাপ দরজা খুলে দে।তোর রূপে আমারে যে পাগলা কুকুর বানাইছে। এহন তোর রূপ যৌবনের স্বাদ না নিলি আমি শান্তি পাচ্ছি নে।আর কারো ক্ষতি না চাস তো খুলে দে। কলাম তো খালি একবার।

খাদিজা সেদিন নিজেকে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করে।এই আব্বাসের পশুত্ব থামানোর আর কোনো রাস্তা পায় না খাদিজা।নিজের বিবেকের কাছে হেরে যায় পারিপার্শ্বিক বিপর্যয়ের কারনে।সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল খাদিজার গলায় দড়ি দেওয়া নয়তো আব্বাসের লালসার স্বীকার হওয়া।অবুঝ পিতৃহারা দুটো সন্তানের মুখ চেয়ে সেদিন গলায় দড়ি দিয়েও ঝুলতে পারেনি খাদিজা।দুচোখের জলে নিজের সতীত্ব ভাসিয়েছে।লোকচক্ষুর আড়ালে সেদিন বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে আব্বাসের লালসার কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল।আব্বাস মরা মায়ের কসম কাটলেও পুরো একটা বছর খাদিজাকে ভোগ করে।একপর্যায়ে খাদিজা উপায়ন্তর না দেখে বাপের বাড়ি চলে যেতে চাই।যাওয়ার আগে আব্বাসের পায়ে পড়ে অনুরোধ করে আর যেন আব্বাস তার পথে না আসে।তবুও মানে না আব্বাস।জোর করে গায়ে থেকে যেতে।কিন্তু খাদিজা আর পারছিলো না পাপের জীবন বয়তে।শরীর ভেঙে পড়েছিল।নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে মরনাপন্ন হয়ে গেলো তখন আব্বাসের নজর ক্রমেই তার থেকে যেতে লাগলো কিছুদিন পর শুনলো আব্বাস বিয়ে করেছে।মৃতপ্রায় শরীরে যেন আবার প্রাণ ফিরে পেলো খাদিজা।আব্বাসের এদিকে আর না আসাতে খাদিজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।কলঙ্কের কালি মুছতে দিনরাত কেঁদেছে আল্লাহর দরবারে।দুটো সন্তানের মুখ চেয়ে বেচে ছিল পশুর লালসার শিকার হয়েও।কিন্তু এ বাঁচা যে মরার শামিল ছিল খাদিজার কাছে।নিজের যেই কলঙ্ককে লুকিয়ে রেখেছিল রাতের আঁধারে তা আজ আলোতে আসার জন্য ছটফট করছে।নিজের দুর্বিষহ অতীতের কলঙ্ককে ঢাকার একটা উপায়ই আছে খাদিজার কাছে তা হলো তানিকে যে করেই হোক তাজের হাতে তুলে দেওয়া।এরজন্য কলিজার টুকরা খালিদকে দূরদেশে পাঠাতে বাধ্য হলো খাদিজা।তানির অবস্থা বিন্দুমাত্র বুঝলো না নিজের স্বার্থের কারনে খাদিজা।একদিন নিজে যে অবস্থায় পড়েছিল আজ স্বেচ্ছায় স্বার্থের তাগিদে ছেলের বউকে সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছে খাদিজা।মমতা যেন হঠাৎই নিজের অসহায়ত্বের কাছে পরাজিত হলো।

খালিদ বাসের সিটে হেলান দিয়ে নিরবে অশ্রু ফেলছে।তানির কান্নাজড়িত মুখটা বার বার কাঁদিয়ে দিচ্ছে খালিদকে।ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বাহুডোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। হায়! কি অপারগতা আজ আমার।দৃষ্টিতে শুধুই বিরহব্যথার জল।বাইরে শো শো করে পার হওয়া গাছপালা গুলোর ফাঁক দিয়ে গোধূলির শেষ আলোটুকু এসে পড়ছে খালিদের চোখে।কেন যেন বুকের বা পাশটায় তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে লাগলো? চোখের সামনে মুহুর্তেই মুছে গেলো গোধূলির শেষ আলো।নেমে আসলো ঘোর অমানিশা।

চলবে,,