গোধূলির শেষ আলো পর্ব ১৭ +১৮

0
629

গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ১৭ +১৮
Writer Tanishq Sheikh Tani

“-মা ভালো! ওঠেক।নাওয়া খাওয়া সব তো ছাড়েই দিলি?এমন কললি কি করে হবি ক দিনি?
ফজিলা বিছানায় কান্নারত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকে।একদিন হলো জ্বামাইটা গেলো সেই শোকে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে অনবরত কাঁদছে তানি।খালিদ ঢাকা পৌঁছে দুএকবার কল দিলেও তানি কান্নার চোটে কথা বলতে পারেনি।খালিদের কন্ঠস্বর শুনে শুধু কেঁদেই গেছে।ওপাশ থেকে মনকে শত চেষ্টায় শক্ত করেও অবশেষে ব্যর্থ হয়ে কেদেছে খালিদ।খালিদ শ্বাশুড়িকে মোবাইল করে দিয়েছে তানিকে কিছুদিন বাবার বাড়ি নিয়ে রাখতে।কিন্তু তানি জেদ করে শুয়ে আছে বিছানায়।কোনোমতেই তাকে রাজি করানো যাচ্ছে না।খালিদের উপর প্রচন্ড অভিমান জন্মে গেছে হঠাৎই।

“- কিরে মা! ওঠ না।সন্ধ্যা নামে আসছে বাড়ি যাতি হবি তো আমার।চলেক

“- কলাম তো কোনোখানে যাবো না আমি।তুমি চলে যাও।

“- এম্বা করিস নে মা।খালিদ কানতি কানতি কয়ছে তোরে যেন নিয়ে যায়।

“- কোক।তার কথা শুনো ক্যা? আমার কি মূল্য তার কাছে? মা ই তো সব।এতো দরদ দেখানো লাগবি নে আমার জন্যি কারো।সে কাড়ি কাড়ি টাহা কামাক।আমারে নিয়ে না ভাবলিও চলবি।

“- ছি! কি কচ্ছিস এসব।চল

“- তোমরা কি সবাই পাগল হলে কও তো? ওর মা কে একা এই নির্জন বাড়িতে রাখে কি করে যাই তোমার সাথে?

“- আল্লাহ! তাই তো? আচ্ছা তুই ওঠ। আমি এক্কনি বু রে কচ্চি আমাগের বাড়ি যাইয়ে কয়দিন বেড়াইয়ে আসপেনে।তারও তো ছাওয়ালডা এতোদূর বৈদেশে গেছে।বুকটা তারও খা খা করতেছে।তুই ওঠে কাপড় পাল্টে নে।

“- তুমি কোথাও যাবা না।ওর মা রেও কিছুই কওয়া লাগবি নে।তুমি যাও বাড়ি।আমি যাবো না

“- পাগলামী করতিছিস কিসের জন্যিতি? কলাম তো তোর শ্বাশুড়িরেও কবানে সাথে যাতি।

“- তোমাগের কি লজ্জা নেই মা! আর কতো অপমান হতি চাও কও দিনি? তুমি কলি সে খুশিতি লাফাতি লাফাতি চলে যাবি?তোমার জ্বামাইরে বিদেশ যাওয়ার আগে দাওয়াত দিছিলে তো? গেলো সে? না তার মা গেলো কও? আব্বা তো পাতানে বোন পাতানে বোন কইয়ে আমারে সুখের দরিয়ায় ভাসাইয়া দিল।দেহো সুখ ঢলে ঢলে পড়তেছে আমার কপালে।তার পাতানে বোন তো এহন তারে কুটুম জ্ঞানও করে না।

“- চুপ কর! মাইয়ের বাপ মায়ের এতো মান সম্মান থাকতি নেই।মাথা সব সময় নুইয়ায়েই চলতি হয়।লাগবি নে কুটুম মানা আমাগের। তুই সুখে থাকলিই শান্তি।

“- কি মাটি দিয়ে গড়া তুমরা হ্যাঁ? এসব কুসংস্কার নিয়ম আর কতোকাল কও তো মা? তুমরা মাথা নুয়াইলি কি আমার মাথা এ বাড়িতে উঁচু হবি? যেখানে আমার বাপ মারে সম্মান দেয় না সেখানে আমারে কি সম্মান সমাদর দিবি বুঝো না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান ধরো।

“- চুপ কর! অনেক বড় বড় কতা শিকে গিছিস?সমাজে যা চলে আইছে তাই মানতি হয়।তুই একাই কি নিয়ম বদলাতি পারবি?মায়ে মানুষ মায়ে মানুষির মতোই থাক।

“- যা চলে আইছে তাই যে চলতি হবি এমন কোনো কথা নাই মা।সমাজ পরিবর্তন হয়! মানুষের জীবনও তেমন। এসব কু প্রথা মানা ছাড়ে দাও।এতো করে কলাম আমারে বিয়ে দিও না দিও না।শুনলেই না।কি মজাডা পালে বিয়ে দিয়ে।এই যে সকালে আইছো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কই তোমার জন্যি তো পোলাও কুরমা রান্না করা দূরে থাক একবার এসে ভুলুক ও দিলো না খালিদের মা।তুমি হলি কি করতে? দুনিয়ার সব রান্না আপ্যায়ন করাতে ব্যস্ত হয়ে যাতে।ক্যা মা? আমি বোঝা হয়ে গিছিলাম? আমারে তোমার ছাওয়ালের মতো পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাড়াতে দিলে না ক্যা? ক্যা আমার জীবনডারে তুসির আগুন করে দিলে।মেয়েজাতের কি মান সম্মান, চাওয়া পাওয়া থাকতি নেয়?

“- দুই কলম বিদ্যা পড়ে জ্ঞান ঝাড়ছিস খুব দেকছি।বেশি পড়ালি যে কি সব্বনাশ হতো তা তো বুঝতিছিই।শোন! ছেলের বাড়ির মানুষ এমনই হয়।আমরা কন্যা দায়গ্রস্ত বাপ মা।আমাগের এতো উঁচু মাথা নিয়ে ঘোরা চলে না।এবার মুখি লাগাম দে।তোর শ্বাশুড়ি শুনলি কষ্ট পাবি।মা রে! গরিবের ঘরে একটা মেয়ে হওয়া মানে অনেক চিন্তার বিষয়। একটু সিয়ানা হলিই মাইনষের খারাপ চোখে পড়ে।নানা অপবাদ রটাই।তাই তো বাপ মা বিয়ে দিয়ে দেয় মান সম্মান বাঁচানো খাতিরে।সমাজে চলতি গিলি অনেক মান বিচার করতি হয়।তুই ছোটো মানুষ বুঝবি না এখন।

“-আমি বুঝবো না! হা! তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে।তুমি কোনোদিনই বুঝবে না আমারে মা! কোনোদিন না! খালি পেটেই ধরেছো। মেয়ের মন কোনোদিন বোঝো নাই তোমরা।আমার জ্বালা আমিই বুঝতিছি।এ জ্বালা তোমার এই স্বান্তনায় কোনোদিন নিভবি না।

“- কিসের এতো জ্বালা তোর হ্যাঁ! সেই তখন তে একই বকবক করে যাচ্ছিস? বলি আমরা কি সংসার করি নি।আমার বিয়ে তোর বয়সেরও আগে হয়ছেলো।ভালো করে শাড়ি পড়তি পারতাম না।কাম করতি পারতাম না।করি নাই সংসার? পালি নাই তোগের? তোর দাদি কি কম জ্বালাইছে? তাই বলে কি সংসার ছাড়ে চলে গেছি?

“- ইচ্ছা তো করতো। কি! করতো না? মন চাইতো না নিজের মতো করে একটা জীবন কাটাতি।যেখানে থাকবি না অপনান লাঞ্ছনা গঞ্জনা। থাকবি শুধু ভালোবাসা আর সম্মানের জীবন।একটু প্রশান্তি।

ফজিলার বেগম বিস্ফোরিত চোখে মেয়েকে দেখলো।সত্যি যখন ১২ বছর বয়সে স্বামী গৃহে এসে স্বামীর যৌন চাহিদা,সংসারের কাজ, শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবা করে দিনরাত ভুলে যেতো।পুতুল খেলার জন্য মন ছটফট করতো।কেদে কেদে দিনরাত পার করতো।কেউ জিজ্ঞেস করতো না কি ব্যথা? সবাই শুধু মুখ বাকিয়ে বলতো আধিখ্যেতা।কতোবার ছুটে পালাতে ইচ্ছা হয়েছে? কিন্তু পারেনি এই শিকল ছেড়ে যেতে।কই যাবে ফজিলা? কার কাছে যাবে? বিয়ের পর প্রথমবার যখন বাবা বাড়ি এসে মাকে স্বামীর ব্যথাতুর স্পর্শের কথা জানিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদলো একটু স্বান্তনার জন্য,একটু ভরসার জন্য।মেয়ে ও মেয়ে জ্বামাইয়ের বৈবাহিক গোপন কথা শুনে লজ্জায় মেয়ের মুখ চেপে আড়ালে নিয়ে দুটো চড় মেরে ইচ্ছামতো শাসিয়েছিল মেয়েকে ফজিলার মা।এসব কথা দ্বিতীয় কাওকে যেন কোনোদিন না বলে মেয়ে সে বিষয়ে পূর্বঅভিজ্ঞত সবরকমের নসিয়ত দিলো তানির নানী মেয়েকে।তানির মা ঐদিন হতবাক হয়ে ছিল মায়ের এই নিষ্ঠুর ও অপরিচিত রূপ দেখে।যে মাকে এতো আপন ভেবেছিল মুহুর্তে সে মা সহ সব আপন সম্পর্ক গুলো পর হয়ে গেলো।ছোট্ট ফজিলা সেদিন হঠাৎ করেই ২০/২২ বছরের মেয়ের মতো বুদ্ধিমতি হয়ে গেলো।সে বুঝে নিল তার জীবন এখানে আবদ্ধ, সীমাবদ্ধ।হাজার নির্যাতন হলেও তাকে মাটি কামড়ে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।একমাত্র মৃত্যুতেই তার মুক্তি।ক্রমেই ফজিলা আরো অনেক কিছু শিখে গেলো।যৌবনে স্বামীকে সয়ে গেলে বয়স হলে এই স্বামীই তাতে আসক্ত হয়ে যাবে।তার শাসনের সূচনা হবে সেদিন।সব কিছু সয়ে ঠিকে থাকতে পারলেই তার জীবন সফল।নয়তো দ্বারে ঠোকর খেয়ে বেড়াতে হবে।পরিশেষে একটা জিনিসই শিখেছে সংসার জীবনে যে সয় সে রয়।মেয়ে মানুষ স্বর্নলতা পরগাছার মতো।যতোদিন অন্যকে আঁকড়ে বাঁচবে ততদিন সে সত্যি বাঁচবে। কিন্তু আজ তার মেয়ের চোখে তাকিয়ে নিজের অতীতের প্রতিফলন দেখছে ফজিলা।দেখছে তার মেয়েও সেই ১২ বছরের ফজিলার মতো সংসার বিদ্বেষী,সংকীর্ণ নিয়মের প্রতি বিরাগী,সর্বপরি সকল সম্পর্কের প্রতি অনাস্থা জন্মে বসে আছে।কিন্তু না ফজিলা মেয়েকে এভাবে ভাবতে দেবে না।ফজিলা জানে এমন ভাবনা কতোটা পীড়াদায়ক। ফজিলা নিজেকে নিজের মায়ের জায়গায় উপলব্ধি করে।হ্যাঁ সেও চাই তানি সকল ঝড় ঝঞ্ঝা দুহাতে সমূলে উৎপাটন করে এগিয়ে চলুক তারই মতো মানহীন,একটা প্রাণ সর্বস্ব মেয়ে মানুষ হয়ে।যার থাকবে না কোনো চাওয়া পাওয়া,থাকবেনা দিনশেষে আমি বলে বলার মতো কোনো নিজস্ব সত্তা। যার সবকিছু হবে অন্যের জন্য।একসময় এভাবেই না পাওয়ার তৃপ্তি নিয়ে বিলীন হয়ে যাবে মহাকালের গর্ভে। ভাবনার ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরতেই দেখে তানি উঠে বাথরুমে চলে গেছে।ফজিলা বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বিয়াইনের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।পা বাড়ায় অপমান আর লাঞ্ছনার পথে। মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য মা হয়ে ফজিলা সব ধরনের অপমানের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।এদিক থেকে ফজিলা নিজের মায়ের থেকে কিছুটা উন্নত মানসিকতার।কারন ফজিলার মা কোনোদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসেন নাই।ফজিলার বাবা যতোবার এসেছিল বিয়াই বাড়ির মাছ ভাত কম মেয়ের সম্পর্কে নালিশ শুনেই পেট ভরিয়ে গেছেন তিনি।তানির কথায় মান অপমান বলে এসব মনে রাখলি তো ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়ে যাবে দু পরিবারে।অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বুদ্ধির ভাড় দেখে মনে মনে হাসেন ফজিলা।

তাজ পুকুরপাড়ে বসে একটা একটা করে ঢিল ছুড়ছে।মায়ের অভাব আজ খুব বুঝছে তাজ।মায়ের মরা মুখটাও দেখলো না অভিমানে,রাগে।কতো দুঃখ আর অপমান নিয়েই না গলায় দড়ি দিলো মা টা আমার! মনে মনে কথাটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বুকটা হা হা করে ওঠে মায়ের কোলে মাথা রাখতে।মা মা করে ছুটে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে জনমদুঃখিনী মাকে।কিন্তু সব শেষ।তাজের নিজের বলেই কিছুই নেই।কষ্টে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে তবুও কাঁদতে পারছে না তাজ।শেষবারের মতো হাতপাতালে দেখা অপমানিত অসহায় মায়ের মুখ বার বার চোখের সামনে ভাসছে।নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছে কুলাঙ্গার সন্তান বলে।তাজ আজ নিঃস্ব।বাপ থেকেও না থাকার সামিল।ভালোবাসা আজ অন্য কারো ঘরে।দূরে আজানের ধ্বনি কানে আসতেই চোখজোড়া জলে ভিজে আসে।আকাশের দিকে মুখ করে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে তাজ।চিৎকার করে বলে,

“- কেন!আমিই কেন? কি অপরাধ আমার?

“- প্রতিউত্তর না পেয়ে কান্নার জল প্রচন্ড অভিমানে হিংস্র হয়ে পড়ে।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তাজের।কোমল প্রান হঠাৎই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়।যা এই দুমাসেও চেষ্টা করে পারে নি তা আজ হুট করেই হয়ে গেলো।হিংস্রতা যেন চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলছে প্রতিশোধের নেশা।
পিতার পাপে পুত্র কাঁদে। জবাব চায় বিধাতার দ্বারে।কেহ না বোঝে প্রকৃতি যে তার আপন নিয়মে সঠিক বিচারেই চলে।

চলবে,,গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ১৮
Writer Tanishq Sheikh Tani

“- বু! আসপো!
“-আয়!
ফজিলা ভালোয় বুঝতে পারলো খাদিজার বলা “আয় “কথাটাতে কতটা অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য ছিল।তবুও দাত বের করে হেসে হেসে খাদিজার গা ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করে
“- ও বু কিরম আছো গো? শরীলডা ভালো আছে তোমার বু!
“- হুমম।তা কি মনে করে আলি?
“- বু বাড়ি আসপো তার আবার কি মনে করা লাগবি! তানির শ্বাশুড়ি পরে আগে তো তুমি আমাগের বু।
ফজিলার এই আবেগী কথাটাও খাদিজার মনকে নাড়া দিলো না।আগের মতোই মুখটা গম্ভীর করে বসে রইলো চুপচাপ।
“- বু! তোমার কাছে একটা আবদার নিয়ে আইছি।
“- হুম!
“- তানিরে দু/তিনদিনের জন্যি বাড়ি নিয়ে যাতাম যদি তুমি অনুমতি দিতে?মিয়াডার মনটা ভালো না।
“- মিয়া যদি বাড়িই রাখতি ইচ্ছা করে তালি বিয়ে দিতে গেলি ক্যা।বাক্সে ভরে রাখে দিতি মিয়ারে।আজ মন ভালো না,কাল শরীল ভালো এসব ছুতো দিয়ে নিয়ে গেলি কি আমার খালিদের সংসার করতি পারবি তোর মিয়া?
ফজিলা খাদিজার কাছ থেকে ভালো উত্তর আশা না করলেও এমন উত্তর আশা করে নি।মনে এবার সত্যি ব্যথা লাগে ফজিলার।
“- বু! মিয়া তো এহন তুমার।আমি তো পর ওর।তোমারে কতো মায়া করে,ভালোবাসে।তাইতো তোমার এক কথায় তানির বাপ রাজি হয়ে গিলো।
“- আপন আপনিই হয়!পর কি কোনোদিন আপন হয় ক? এই যে তুই আসার পর থে একবারও আমার খোঁজ নিছে? না নেয় নাই।মা পাইছে না? নিজের মা থুয়ে কি পরের মারে দরদ দেখাবি নাকি?আর কি কলি? আমার এক কথায় তানির বাপ রাজি হইছে? রাজি হবি না ক্যা! তোগের সাত কপালের ভাগ্য আমার ছাওয়ালের মতো জ্বামোই পাইছিস।জীবনে তো শুকরিয়া করবি না তোরা বুঝছি।
“-বু! তুমি এমন করে কতি পাললে? আমরা কি খুব অন্যায় করে ফেলছি তোমার সাথে?আমরা কি আপন না তোমার?
“- তালি কি খুব ন্যায় করিছিস? একটামাত্র মিয়া পার করলি।রাজপুত্তুরের মতোন জ্বামোই পালি। সেই জ্বামোই রে কি দিলি ক! আমার ছাওয়াল কি এতোই সস্তা রে ফজিলা? কিছুই কি পাওয়ার ছিল না ওর।
দ্যাখ ফজিলা! আমার কথায় কষ্ট পালি আমার কিছু কওয়ার নাই।যা সত্যি তাই কলাম।পাড়ার মানুষ যহন কয়! ও খাদিজা বু! ছাওয়াল বিয়ে দিয়ে কি আনলে? আমি বোবা হয়ে যায়।লজ্জায় মাথাডা হেট হয়ে যায় আমার।শ্বশুরবাড়ি তে ওর বন্ধু সজিব কতো কি পালো।নিতে চাই নেয় সজিব তাও শ্বশুর হুন্ডা,১ লাখ টাহা,ঘরের ফার্নিচার, সোনা গয়না সব দিছে। সেহানে আমার খালিদ কি পালো? গায়ে কি মান থাকলো আমার ছাওয়ালডার? কপালডাই খারাপ আমার ছাওয়ালের।আত্নীয়তা বজায় রাখতি নিজের ছাওয়ালডারে গাঙের জলে ফেলে দিলাম।কি আপন তা তো দেখিয়ে দিলি।একা একাই বকবক করে পান মুখে দিয়ে ঘুরে বসলো খাদিজা।খাদিজার যা মনেও ছিল না আব্বাসের ভয়ে সেসব তিতা কথা তানির মাকে শুনিয়ে নিজের মনের ভেতরের গুমড়ে থাকা পীড়াটা হালকা করলো।অন্যকে দুঃখ দিয়ে নিজের দুঃখ হালকা করে নিল খাদিজা।
ফজিলা খাদিজার কথার উচিত জবাব জানলেও দিলো না।মেয়ের মা বলে কথা।চোখে জল ভরে আসলেও তা গড়িয়ে পড়তে দিলো না।দাঁত কামড়ে দীর্ঘশ্বাস নিলো।অপমান গলধঃকরন করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“- আমি তালি আসি বু! সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
“-তাই ভালো! যাওয়ার সময় তোর মিয়ারে একটু বুঝাই যা আমার কথা যাতে শোনে।
“- আচ্ছা বু! ফজিলার চোখ ভেঙে কান্না আসছে।কিন্তু কাঁদছে না।তাড়াতাড়ি খাদিজার ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েকে না বলেই বাড়ির পথে হাটা ধরলো।মেয়ের সামনে এ মুখ নিয়ে কোনোমতেই দাড়াতে পারবে না ফজিলা।মেয়ের জন্য কলিজা পুড়ে যাচ্ছে ফজিলার।ইচ্ছা হচ্ছে মেয়েকে নিয়ে যেতে এই অপমানের পরিবেশ থেকে যেখানে তার পুতুলের মতো মেয়েটাকে পণ্য ভেবে ওজন করছে।নিজের শৈশবের দিনগুলো আজ আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কতো অসহায় মেয়েরা।ফজিলা নিজে না পেরেছে জরাজীর্ণ সমাজের নিয়ম থেকে বেরোতে। আজও না পারছে মেয়েকে বের করতে।সন্তানের ব্যথা মায়ের হৃদয় বিদীর্ণ করছে।যতো দ্রুত পারছে পা চালিয়ে এই গুমোট পরিবেশ থেকে বের হতে চাচ্ছে। কষ্ট শুধু নয়নের মনিটাকে এমন অনাদরে ফেলে যেতে হচ্ছে। তানি এতোক্ষন মা আর শ্বাশুড়ির কথা সব আড়ালে দাড়িয়ে শুনছিল।অপমানে পান্ডুর হওয়া মায়ের মুখটা দেখে তানি আড়ালে লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো।ছাদের আড়ালে দাড়িয়ে দূরে হেটে ফিরে যাওয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে অঝরে ঝরছে তানির চোখের জল।ছুটে মায়ের বুকে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে।বলতে ইচ্ছা করছে মা গো! ও মা! আমারে এই জাহান্নামে একা রেখে যেয়ো না মা।আমারে নিয়ে যাও গো মা।তোমার মমতার ছায়ায় লুকিয়ে রাখো মা।মা দৃষ্টির আড়াল হতেই একদৌড়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় হুমড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে তানি।বালিশে মুখ ঠেসে চিৎকার দিয়ে কাঁদে। সব আপন এখন পর হয়ে গেলো।মেয়ে মানুষের জীবন কেন এমন হয়?জীবনে এমন মুহুর্ত কেন আসে যখন নিজেকে সৃষ্টির সবচেয়ে অসহায় ও তুচ্ছ জীব মনে হয়।মেয়ের দুঃখ দেখেও বাবা মা কেন অসহায় হয়ে যায়? এতোদিন ধরে রাখা হাতটা এক নিমেষেই ছেড়ে দেয় অসহায়ত্ব নামক সামাজিক নিয়মের কাছে।

তাজ পুকুর পাড় থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাবার রুমের দরজায় টোকা দেয়।মাথায় নেশা চেপে গেছে।তানিকে নিজের জায়গায় এনে নিজের ব্যথা বোঝানোর নেশা।নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো শরীর কাঁপছে তাজের।ভেতরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।না! এখনও আব্বাস জোয়ার্দার দরজা খুলছে না।তাজ বুঝতে পারছে তার বাপ নতুন বউ পেয়ে মেতে আছে।এটা বুঝতেই রাগটা আরো বেড়ে গেলো তাজের।মরা মায়ের কবরের মাটি না শুকাতেই তার বাপ আরেক বউ এনে ফুর্তি করছে।বাপকে তাজ কখনোই কিছু বলবে না তবে নুরিকে সে ছেড়ে দেবে না মায়ের জায়গায় দখল করার জন্য।এখন আর মায়ের শেখানো ভদ্রতা জ্ঞান গায়ে মাখে না তাজ।সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় আঘাত করতে লাগলো তাজ।চড়া গলায় বলতে লাগলো,
“- ঐ আব্বা!দরজা খোল।আব্বা!
মাত্রই নতুন বউয়ের সাথে একটু অন্তরঙ্গ হয়েছিল কি তাজ এসে হেড়ে গলায় ডাক ছাড়ছে।লুঙ্গী গিট দিতে দিতে দরজা খুলে বের হলো আব্বাস।এসব বিষয়ের আব্বাসের লজ্জা শরম কমই আছে।তাই নির্লজ্জের মতো বের হয়ে তাজের সামনে দাঁড়ালো। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
“- ক! কি কবি?
“- কি কবো মানে? জানো না মনে হয়?
“- ওহ! আরে সবুর কর!
“- তুমি তো দুইদিন পর কবরে যাবানে তোমার সবুরের কতো শ্রীরি সব দেখছি। বুড়ো বয়সে তোমারই নাই সবুর।সেহানে আমি তো তোমার ছাওয়াল।
“- আরে আব্বা কি কইস!জিহ্বা কামড় দেয় আব্বাস মুখের উপর কথাটাবলায়।ছেলে যে বেপরোয়া হয়ে আছে সেটা বুঝে যায় আব্বাস।নিজের মতো ছেলেকেও যৌন খাদক ভেবে নিলো আব্বাস।এতে মনে মনে নিষিদ্ধ আনন্দ পেলো।
“- ভোল করে না আব্বা। কালকের মধ্যে তানিরে আমার চাই।
“- আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে।এহন যা বন্ধুগের সাথে ঘুরেক গে।কতোদিন পরে আইছিস।ওগের সাথে দেহা সাক্ষাৎ করে আয়।তোর শিকার কালই তোর কাছে ধরা দিবি নিশ্চিন্তে থাক।
“- হুমম।মনে তাজের নিশ্চিন্তা না আসলেও তাজ আর এক মিনিট দাড়ায় না।হনহন করে হেটে চলে যায়।আব্বাস জোয়ান ছেলের দিকে চেয়ে নিজের জোয়ানকালের কথা মনে করে।তাজের মতোই সুঠামদেহি আর বলশালী ছিল আব্বাস। মৃত বউ তাসলীর নীতি মানায় তাজের উপর রুষ্ট ছিল আব্বাস। কিন্তু আজ আর নাই।ছেলে তারই পথ ধরেছে ভেবে গর্বে বুক টান হয়।বিশ্বজয়ী হাসি হেসে আবার দরজা লাগিয়ে দেয় আব্বাস।
খালিদ অনেক্ষণ চেষ্টা করেও তানির মোবাইলে কথা বলতে পারলো না।খালিদ জানে না তানির মোবাইল খালিদের মা চুরি করে লুকিয়ে রেখেছে।বুকের পাশে ধুকপুকানি শুরু হচ্ছে তানির সাথে কথা বলতে না পারায়।অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে।অবশেষে মা য়ের সাথে কথা বলার এক ফাঁকে তানির কথা জিজ্ঞেস করতেই খাদিজা গলাটা ধরিয়ে বলে,
“- কি কবো আর বাজান! আমি তো নিজের ভুল বুঝতেই পারিছি।তানির আর তোর সম্পর্ক নিয়ে যা কইছি সব কথা মনে করে লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে আমার।
“- ওসব কথা থাক মা! তুমি যে আবার আগের মতো ওরে ভালোবাসো এটাই সব।আমি জানি আমার মা কোনোদিন ভুল করতে পারে না।পবিত্র মানুষ আমার মা।
ছেলের মনে নিজের সম্মানের কথা জেনে ভালো লাগে খাদিজার।মনে মনে অনুশোচনা হয় নিজের কাজের জন্য।একবার ইচ্ছা হয় ছেলেকে সব বলে দিতে কিন্তু না! পারে না খাদিজা।সব শুনে খালিদ যদি মাজিদের মতো পর করে দেয়।তবে এই লজ্জা নিয়ে এই বয়সে কই মাথা গুজবে।সব আশ্রয়, সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।মরা ছাড়া যে আর কোনো গতি থাকবে না।মনটা আবার ব্যথায় নীলাভ হয়ে যায়।না চাইতেও ছেলের বিশ্বাসের বুকে ছুরি মারার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে পড়ে।

চলবে,,,,