গোধূলী শেষে তুমি আমি পর্ব-০৩

0
259

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৩

চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে একটি মেয়েকে মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে। মেয়েটা অনবরত কেঁদে চলেছে। হঠাৎ একটি অবয় সামনে আসতেই মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বললো।

_ কে,কে আপনি

অবয়টা হা হা করে হেঁসে উঠলো। সেই হাসির ঝংকারে আশেপাশে থাকা পাখিগুলো ভয়ে উড়ে গেলো। পাখিদের উড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো,শোনা গেলো তাঁদের ডানা ঝাঁপটানো। মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। তাঁর মুখ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। হঠাৎ অবয়টা এগিয়ে এসেই মেয়েটার ঘাড়ে কামড়ে দিলো। মেয়েটা ব্যথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো আল্লাহ বলে।

_আল্লাহ বলেই চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসলো রজনী। ঘাড়ে হাত দিয়ে অনুভব করলো! সে স্বপ্ন দেখেছে এতোক্ষণ। তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সে আবারও স্বপ্নে দেখেছে। আর কতদিন তাঁকে এই বাস্তবরূপী স্বপ্ন তাড়া করে বেরাবে। শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে মরুভূমির মতো শুষ্ক হয়ে আছে। ঘুম তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! সে ভালোই বুঝতে পারলো। কোন মতে সে নিজেকে স্থীর করলো। উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি তাঁকে পান করতেই হবে। না হলে এই খড়া মরুভূমি গলা থেকে নামবার নয়। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে নিলেই! মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা চক্কর দিতেই সে বুঝলো,তাঁর শরীরে ধুম জ্বর। ব্যথার জন্যই জ্বরটা এসেছে। এখন উপায়।নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ! এদের সামনে অসুস্থ হওয়া মানেই একটা উটকো ঝামেলা তাঁদের কাঁধে দেওয়া। ফোনটা হাতরে টাইম দেখে নিলো। রাত তিনটে বাজে। একে তো তার চোখে ঘুম আসতেই সময় নিয়েছে রাত একটা,এখন বাজে তিনটা। সেটাও রইলো না। কিছুটা স্থীর করে আবারও উঠে দাঁড়ালো। বোতলের মুখটা খুলে ঢকঢক করে পানি পান করলো রজনী৷ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। বোতলটা টেবিলের উপর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রজনী। ধীর পায়ে হাঁটতে রইলো ছাদের দিকে। ছাদের রেলিঙের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে রইলো রজনী। আকাশের চাঁদটা সচ্ছ। চাঁদের পাশের সাদা শুভ্র মেঘগুলো সব থেকে বেশি সুন্দর । সেদিন রাতেও তো এমন সচ্ছ আকাশ ছিলো। চারিদিকে চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিলো। কিন্তু সেই আলো কখন যে জীবনকে অন্ধকার নামিয়ে দিলো,তা রজনী জানে না। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ রজনী অনুভব করলো তাঁর পাশে কারো উপস্থিতি। শরীরটা যেন হিম হয়ে গেলো। সেদিনও তো এমন ভাবেই কেউ পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাহলে কি? রজনী ভয়ে দু-পা পিছিয়ে এলো।

রজনীকে পিছিয়ে যেতে দেখে পল্লব অবাক হলো। তাই সে বললো–

_ এতো রাতে ছাদে আসতে ভয় পেলেন না! আর আমার উপস্থিতি আপনাকে এতটা ভীত করে দিলো। বিষয়টা একটু কেমন জানি।

পল্লবের কথায় কোন হেলদোল নেই রজনীর। সে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো পল্লবের থেকে। আর পল্লব মনে মনে হাসলো। আসলেই মেয়েটা একটু আলাদা। হঠাৎ পল্লবের মনে পড়লো রজনীর কাটা হাতের কথা। তাই সে কিছুটা এগিয়ে গেলো রজনীর কাছে।

_ আপনার হাতের কি খবর? আর আপনার হাতটা কাটলো কী করে?

_ আঘাত দিয়ে,সেই আঘাতে মলম লাগানো মানুষ গুলোকে আমার একদম ভালো লাগে না ।

_ আমি কিন্তু ইচ্ছে করে আপনায় ব্যথা দেইনি।

_ ভাগ্যিস জানতেন না! জানলে তখন বাবা-মা তুলে কথা বলতেন না নিশ্চয়ই।

_ আপনি আমায় সত্যি ভুল বুঝছেন! পুরো বিষয়টা আমার অজান্তে হয়েছে। আপনার বিষয়ে মা আমায় জানিয়েছে। আগে থেকে জানলে হয়তো আমার দ্বারা কোন কষ্ট পেতে হতো না আপনায়। আপনার হাত কীভাবে কেটেছে ? আর কতোটা কেটেছে দেখি।

এই কথা বলেই পল্লব রজনীর হাত ধরতে যায়। কিন্তু রজনী দূর সরে দাঁড়ালো।

_ কথায় কথায় মেয়েদের হাত ধরা কেমন ভদ্রতা বলবেন আমায়। আমার ব্যথা আমাকে বুঝতে দিন। আর এই ভাবে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার বিরোক্ত লাগে।

চোখেমুখে বিরোক্ত ফুটিয়ে রজনী হেঁটে চলে গেলো। কিন্তু কিছুটা পথ যেতেই তাঁর মাথা আবারও ঘুরে উঠলো। কিন্তু এবার আর নিজেকে সামলে নিতে পারলো না,তাঁর আগেই ছাদের শক্ত ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। রজনীকে পড়ে যেতে দেখে পল্লব ভয় পেলো। দৌড়ে গিয়ে রজনীকে তুললো। রজনীকে ধরতেই বুঝলো রজনীর শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। খুব অবাক হলো পল্লব। এতটা জ্বর নিয়ে কতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিলো মেয়েটা। তারমানে তখন ক্ষতটা আড়াল করতেই তাঁদের বলেছে,সে ঠিক আছে। আল্লাহ এই মেয়ে এমন কেন?

_ এই যে শুনতে পাচ্ছেন। এই যে।

_ ধূর্ত কি নাম তা-ও তো ভুলে গেছি , কি করবো এখন?

পল্লব রজনীকে কোলে তুলে নিলো। নিচে এসে রজনীর ঘরে গিয়ে রজনীকে শুয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো তাঁর মা’কে ডাকতে। তাঁর মা আসতেই সে রজনীর মাথায় হাত রাখলো। হাত দিতেই সে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নিলো। ছেলের উদ্দেশ্যে বললো।

_ পল্লব অনেক জ্বর তো মেয়েটার শরীরে।

_ হ্যা মা,আমিও প্রথম দেখে ভয় পেয়েছি।

_ কিন্তু এতো রাতে কি করবো?

_ মা মাথায় পানি দিতে হবে। এখন এটা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। আগে তাঁর জ্ঞান ফিরাতে হবে। না হলে কোন ঔষধও তো তাঁকে দিতে পারবো না।

_ আচ্ছা দাঁড়া আমি পানি নিয়ে আসছি।

লিমা বেগম চলে গেলেন পানি আনতে। পল্লব রজনীর কাছে এগিয়ে গেলো। শ্যামলা চেহারার এই মেয়ের চোখের নিচে জমেছে কালি। গালের ডানপাশে ছোট্ট একটা তিল যেন এই শ্যামলা চেহারার মেয়ের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বারিয়ে দিয়েছে। আরো একটু কাছে যেতেই পল্লব আঁতকে উঠল। কারণ রজনীর ঘাড়ে খুব গভীর এক ক্ষত দেখা যাচ্ছে। পল্লব কিছুটা গভীর ভাবে লক্ষ করতেই বুঝতে পারলো এটা কামড়ের দাগ। কিন্তু এভাবে কে মেয়েটাকে কামড় দিয়েছে। ক্ষতটা কেমন কালো হয়ে আছে। প্রতিটা দাঁতের দাগ স্পষ্ট। পল্লব কি ভেবে হঠাৎ রজনীর জামার হাতাটা একটু সরিয়ে দিলো। হাতার কাপড়টা সরাতেই পল্লব এবার ভয়ে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালো। আল্লাহ এতোটা গভীর ক্ষত নিয়ে মেয়েটা বসে ছিলো। হাতের কাটা দাগটা কেমন ফাঁক হয়ে আছে। দু’টো সেলাই খুলেও গেছে। হয়তো দুপুরে পল্লবের শক্ত করে ধরায় এমন হয়েছে। আর এই মেয়েটা কোন মতেই সেটা কাউকে বুঝতে দিলো না। যে কেউ ক্ষতটা দেখলে বুঝবে,কেউ খুব গভীর ভাবে আঘাত দিয়েছে। কেউ নিজের সর্বচ্চ রাগ মিটাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে। আল্লাহ এই মেয়ের প্রতি কার এতো ক্ষোভ থাকতে পারে। পল্লব উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরে যেতে নিলে লিমা বেগমের সাথে দেখা হলো।

_ কিরে তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস। আমাকে সাহায্য কর।

_ মা দুই মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।
তারপর পল্লব ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছু সময় পর হাতে করে একটা বাক্স নিয়ে এলো। লিমা বেগম বললো।

_ এটা দিয়ে কি হবে? রজনীর তো জ্বর এসেছে।

_ মা যাঁর জন্য শরীরে জ্বর এসেছে! সেটা ঠিক না করলে জ্বর কমবে না।

_ কিসের জন্য জ্বর এসেছে, আমি বুঝলাম না।

_ এদিকে আসো আমি দেখাচ্ছি।

তারপর পল্লব মায়ের হাত ধরে রজনীর সামনে এনে দাঁড় করালো। রজনীর হাত তুলে লিমা বেগমকে দেখাতেই তিনি ভয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।

_ মা’গো কি সাংঘাতিক। এতটা গভীর ভাবে কিভাবে কেটেছে।

_ মা আমার মনে হয়,আমাদের এখান থেকে উনার এই ক্ষত হয়নি! হয়েছে তাঁর বাড়িতেই। কিন্তু তিনি আমাদের দেখায়নি। আর দুপুরে আমার হাতের মোচড়ামুচড়িতে হাতের দু’টো সেলাই ছুটে গেছে। হয়তো এই জন্য এতো রক্ত ঝড়ছিলো। কিন্তু উনি তো তখন কিছু হয়নি বলে, আমাদের চলে যেতে বললেন। আমাদের ভুল, একটু জোর করলে হয়তো এখন এসব কিছু হতো না। ঘাড়ের ক্ষতটার কথা লুকিয়ে গেলো পল্লব।

_ সে যাইহোক, যা করার তাড়াতাড়ি কর। এই জন্যই হয়তো ভাইজান বলেছিলো। মেয়েটা তাঁর প্রচন্ড চাপা। নিজের কষ্ট কখনোই কাউকে বলে না। কিন্তু এতটা চাপা স্বভাবের আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

_ মা এসব পরেও বলা যাবে। আমি হাতের সেলাই দু’টো দিয়ে দেই। তুমি মাথায় পানি দিয়ে দাও।

_ কিন্তু তোর কাছে কাটা জায়গা অবস করার ইনজেকশন আছে, যে তুই সেলাই করবি।

_ মা, যে মেয়েটা এতো ব্যথা নিয়ে চুপ ছিলো! আমার মনে হয় না, সে এই জ্ঞান হারানো অবস্থায় সেলাই করলে কোন রিয়াক্ট করবে।

_ তবুও

_ মা তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার ছেলে একজন ডাক্তার। হ্যা আমি হয়তো চোখ বিশেষজ্ঞ, কিন্তু ডাক্তার তো?

আর কোন কথা বললো না পল্লব। সে তাঁর কাজ শুরু করে দিলো। ক্ষতটা ভালো করে পরিষ্কার করলো। ছুটে যাওয়া সেলাইটা নতুন করে দিলো। তারমধ্যে রজনীর মাথায় লিমা বেগমের পানি ঢালা শেষ হলো। তিনি নোংরা পানিটা বাহিরে রেখে আসতে গেলেন। সেই ফাঁকে পল্লব,ঘাড়ের ক্ষতটা পরিষ্কার করে দিলো। পরিষ্কার করতেই পল্লবের মনে হলো। যতটা নিজেকে এই মেয়ে দেখিয়েছে! তাঁর থেকেও গভীর এই মেয়ে। সুস্থ হলে তাঁকে জানতেই হবে এই ক্ষতের আসল কারণ কী?

চলবে,,