ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা ৭ম পর্ব (শেষপর্ব)

0
3770

#ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা

৭ম পর্ব (শেষপর্ব)

ওহীর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো।

>>তী..তীহর ভাই।

তার নিজের অজান্তেই ওহীর মুখ দিয়ে এই নাম টি বের হলো। পাশ থেকে মোহর বললো,

>>হুম তীহর উসমান। আমার দেওর। আমাদের ছোটু। যাকে তোমার বাবা শ্যুট করে ছিলো।

ওহী বলে উঠলো,
>>না এটা মিথ্যা বাবা তীহর ভাইকে শ্যুট করেননি।

এটি বলে আবারো কাঁদতে লাগলো ওহী। মোহর তখন সেই পুরোনো পেপার টি এনে ওহীর হাতে ধরিয়ে দিলো। সেখানে একটি হেডলাইন
” পুলিশ ইন্সপেক্টর এর মেয়েকে অপহরণের চেষ্টায় যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ”

ওহী সেই খবর টি পড়লো। পাশে তীহর এর একটি ছবি। ওহী এক ঝটকায় সেই পেপার টি হাত থেকে ফেলে দিয়ে বললো,

>>না এসব মিথ্যা। সব কিছুই মিথ্যা লেখা যেদিন এমন টা হয়নি। সেদিন..

এইটুকু বলতে বলতে জ্ঞান হারালো। ওহী পড়ে যেতে নিলেই মোহর ধরে ফেললো।

>>ওহী প্লিজ বলো সেদিন কি হয়েছিলো। ওহী?

সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো ওহীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। মোহর সারা রুমময় পাইচারি করছে।আর তূর্য সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার আর মোহরের সত্যি টা জানা খুবই দরকার।
প্রায় তিনটার দিকে ওহীর জ্ঞান ফেরে। ওহী উঠে বসতেই মোহর দৌড়ে আসে।সেই সাথে তূর্য ও। তাকে দেখে ওহী ভয় পেয়ে যাই কিছুটা। মোহর তাকে আশ্বস্ত করে বলে।

>>ভয় পেওনা। সে আর তোমাকে আঘাত করবেনা। সে শুধু সত্যি টা জানার জন্যই এসেছে।

পাশ থেকে তূর্য বলে।
>>ওহী এখন ঠিক আছো?

>>হুম ঠিক আছি।

>>দাঁড়াও আমি খাওয়ার জন্য কিছু আনছি। (মোহর)

>>না আপু প্লিজ বসো। আমার কথা গুলো শুনে যাও। এই কথা গুলো তোমাদের জানা খুব দরকার। সত্য টা তোমাদের জানা খুবই দরকার। সত্যি সেটা নয় যেটা তোমরা জানো বা সেই পেপারে যা আছে। তিন বছর আগের সেই ঘটনা টি সম্পূর্ণই আলাদা। তুমি হয়তো ভাবছো তীহর ভাই আমার কারণে মরেছে আসলে তা নয়।

>>বলো ওহী আসল ঘটনা কি? (তূর্য)

>>আমি শুরু থেকে বলছি।

ওহী শুরু থেকে বলা শুরু করলো।

>>তীহর ভাই আমাকে নিজের ছোট বোন এর মতই জানতেন। এমনকি বাবার সাথেও অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো তার। তীহর ভাই আর আমার মধ্যে ভাই বোন এর মত সম্পর্কই ছিলো।

কিন্তু তীহর ভাই একজন কে খুব ভালোবাসতেন। সে ছিলো অগ্নির বোন অয়নী। অয়নী ছিলো আমার বেস্টফ্রেন্ড। অয়নীর মাধ্যমেই তীহর ভাই এর সাথে পরিচয় আমার। অয়নী ও তীহর ভাইকে খুব ভালোবাসতো। সেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই তারা একসাথে।
একদিন অগ্নি এই কথা টি জানতে পারে। সে ও প্রথমে নারাজ থাকলেও পরে বোনের কথা ভেবে সব মেনে নেয়।
সব কিছু ভালোই চলছিলো। কিন্তু অয়নীর বাবা ইমতি আংকেল এর জন্যে সব কিছু নষ্ট হয়ে যায়।

ইমতি আংকেল হচ্ছেন মন্ত্রী মানুষ। তিনি এসব জানতে পারার পর অয়নী কে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সবকিছুই এত আচমকা হয়েছিলো যে কেউই কিছু বুঝতে পারিনি আমরা।তিনি বিয়ের আয়োজন শুরু করেন। আমাদেরকে বলেছিলেন বিয়ে টা আমার আর অগ্নির হবে। বিয়ের দিনই আমরা শুনি বিয়েটা আমাদের হচ্ছে কিন্তু সেই সাথে অয়নীর ও।

হঠাৎ এসব শুনে অয়নী ভেঙ্গে পড়েছিলো।
আমি কোনোমতে ফোন জোগাড় করে তীহর ভাইকে কল করে জানিয়েছিলাম এই বিষয়টা। তিনি ছুটে এসেছিলেন। আমি আর অগ্নি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অয়নী কে যে করেই হোক পালিয়ে যেতে সাহায্য করবো। তীহর ভাই আসলে কৌশলে আমরা অয়নী কে বের করে দেয় কিন্তু তাদের কপাল খারাপ ছিলো। তারা বের হওয়ার আগেই ইমতি আংকেল এর লোকজন এর কাছে ধরা খেয়ে ফেলে।
এক পর্যায়ে তীহর ভাই কে তারা মারধর শুরু করেন। অগ্নি গিয়ে আটকায়। কিন্তু তখনি আংকেল আমাদের সবাইকে আটক করেন।
তীহর ভাই সুযোগ দেখে অয়নীকে নিয়ে আবারো পালিয়ে যেতে লাগলেই আংকেল তীহর ভাই কে শ্যুট করেন।
মন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে যেহেতু বাবা সেদিন ডিউটি তে ছিলেন। আংকেল বাবার গান টা ইউজ করেই তীহর ভাইকে শ্যুট করেছিলেন। আমাদের সবার চোখের সামনেই তীহর ভাই…

ওহী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মোহর ও নিঃশব্দে কাঁদছে। তীহর কে মোহর নিজের হাতে বড় করেছিলো অথচ সেই তীহর এর কত করুণ ভাবে মৃত্যু হয়েছিলো। আর তূর্য যেন পাথর হয়ে গিয়েছে এসব শুনে। তার চোখেও পানি। ওহী নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো বলতে শুরু করে,

>>তীহর ভাই আমার চোখের সামনেই ছটফট করতে করতে মারা যান। অয়নী তো যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলো। সে দৌড়ে গিয়ে রাস্তায় বের হয়ে একটি গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলো। অয়নীর মৃত্যু টাও আমার চোখের সামনেই হয়েছিলো। তীহর ভাই আর অয়নী যেন আমার দুই চোখের মণি ছিলো। খুব ভালোবাসতাম তাদেরকে। সেই দু’জনের করুণ মৃত্যু আমার চোখের সামনেই হলো। আমি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। প্রায় ২মাস পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

ইমতি আংকেল মন্ত্রী ছিলেন সেই কারণে তিনি মিডিয়া তে বলেন তীহর ভাই আমাকে অপহরণ করতে চেয়েছিলো তাই বাবা তার এনকাউন্টার করেন।
বাবা তীহর ভাইকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসতেন। তিনি অন্যায় এর বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমতি আংকেল আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাই বাবা চুপ হয়ে যান। আমার বাবা অনেক সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি দিনরাত অনুশোচনায় ভুগতেন। তীহর ভাই এর জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি সেই আক্ষেপ তাকে শেষ করে দিচ্ছিলো। সেবার প্রথম বাবার হার্ট এটাক হয়।

অগ্নি তার বাবার আসল রূপ জানার পর থেকে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। বাবা হার্ট এটাক করেছিলেন সেই সাথে আমিও পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অগ্নি একা হাতে আমাকে আর বাবাকে সামলিয়ে ছিলো। সে নিজের আদরের বোনকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েছিলো কিন্তু তাও আমাদেরকে বুঝতে দেয়নি।

আমার ঠিক হতে ২মাস লেগে গিয়েছিলো। সেই ২৪শে নভেম্বর এর তিন বছর হতে চললো কিন্তু আমি, বাবা,অগ্নি কেউই আজ অব্ধি তীহর ভাই আর অয়নীকে ভুলতে পারিনি।
আমাদের ঘরের একটি দেওয়ালে তীহর ভাই আর অয়নীর ছবি আজো পাশাপাশি ঝুলছে। তাদেরকে ভোলা সম্ভব ও না কখনো। সেদিন টাও ভুলবার মত নয়।

ওহী নিজের কথা শেষ করে আবারো হিচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগলো। মোহর একটা বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে। তূর্য এসব শুনে যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। যেই ভাইকে সে কখনো একটি চড় পর্যন্ত দেয়নি সেই ভাইয়ের এভাবে মরতে হয়েছিলো। তা ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। সে নিজে অনুশোচনায় ভুগছে। ওহীর সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে সে। সে ওহীকে বললো,

>>আমাকে মাফ করে দিও ওহী। তোমার সাথে আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। আসলে তার অবশ্য কারণ ও আছে অনেক। যা তুমি পেপার পড়ে অর্ধেকটাই বুঝে গিয়েছো।
তীহর একদিন আমাকে দু’টি ছবি পাঠিয়ে ছিলো। একটিতে ছিলে তুমি আর অন্য টিতে হয়তো অয়নী ছিলো। সে আমাকে নির্দিষ্ট করে বলেনি কোনটা তার প্রেমিকা। সে একটা মেসেজ দিয়ে বলেছিলো
“ভাই একটা আমার ভালোবাসা আর আরেকটা আমার বোন এর মত”

আমি তখন কনফিউজড ছিলাম যে তার প্রেমিকা কে? যখন নিউজটি জেনে ছিলাম সেদিন আমি ভেবেছিলাম তুমিই তীহরের প্রেমিকা আর তোমার কারণেই তীহর এর ডেথ হয়। তাই তোমার আর তোমার বাবার উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।
সেই ২৪শে নভেম্বর আমি শুধু আমার ভাই টাকে হারাইনি সেই সাথে আমার মা আর বাচ্চা কেও হারিয়েছি। তীহর কে অনেক আদর-যত্নে বড় করেছিলাম জানো। কখনো গায়ে হাত ও তুলিনি। আমার সেই ভাই টাকে এভাবে মেরে ফেললো ওরা।

সেদিন তীহর এর মৃত্যুর খবর শোনার পর মোহর তাড়াহুড়ো করে সিড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছো। সে তখন সাত মাসের অন্তঃসত্তা ছিলো।ফলে বাচ্চা গুলো পেটেই মারা যায়। মোহর ও মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। সেই সাথে মোহর নিজের মা হওয়ার ক্ষমতা ও হারিয়ে ফেলে সারাজীবন এর জন্য।আর আমার দুই দুই টা বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই হারিয়ে যায়।
এর কয়েকদিন পর মা ও আচমকাই মারা যান।
একদিকে তীহর এর মৃত্যু অন্যদিকে মায়ের মৃত্যু আরেকদিকে মোহর আর আমার বাচ্চা গুলো হারানোর যন্ত্রণা। আমাকে একদম পাথর করে দিয়েছিলো। আমার মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরতো আর সেটা ছিলো প্রতিশোধ। প্রতিশোধ এর আগুনে রোজ নিজেকে পুড়িয়েছি।।কিন্তু আমার জানা ছিলো না সত্যটা এমন।

আমি দেশে ফিরে আসি মোহরকে নিয়ে। তারপর তোমার ব্যাপারে খোঁজখবর চালাই। জানতে পারলাম তুমি স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছো। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো তখন। আমার মনে হয়েছিলো আমার ভাইকে শেষ করে নিজে সুখেই আছো। তাই তোমাকে তুলে নিয়ে এসে সেদিন…

তূর্য আর কিছুই বলতে পারেনি।
সেই ৩বছর আগের ঘটনাটি আজো তাদের জিবনে প্রভাব ফেলে যাচ্ছে।
তূর্য কান্না মুছে আবারো বলে,

>>অগ্নির বাবাকে আমি দেখে নিবো। উনাকে আমি মেরেই ফেলবো।

ওহী বললো,

>>আপনার কিছুই করতে হবেনা ভাইয়া। আল্লাহ উনাকে উনার পাপের শাস্তি দিয়ে দিয়েছেন। উনি ব্রেইন টিউমার এ আক্রান্ত। হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না। উনি তীহর আর অয়নীর সাথে যা করেছিলো তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় তাকে ছাড় দেননি।

কথাটি শুনে তূর্য কিছুটা শান্ত হলো। মোহর বললো,

>>তোমাকে আমি বলেছিলাম না তূর্য আমার মন বলছে তুমি ভূল মানুষদের শাস্তি দিচ্ছো। এখন অনেক হয়েছে তূর্য প্রতিশোধ এর নেশা ছেড়ে দাও প্লিজ। এবার একটু স্বাভাবিক হও। আল্লাহ আসল অন্যায়কারী কে তার শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। এবার তো নিজেকে প্রতিশোধ এর আগুনে পোড়ানো বন্ধ করো।
মনে রেখো তূর্য প্রতিশোধ এর আগুনে ততক্ষণই নিজেকে পোড়াও যতক্ষণ তুমি একা পুড়ছো। কিন্তু নিজেকে এতটাও পুড়িয়ো না যে সেই প্রতিশোধ এর আগুনে তোমার আপনজন গুলোই ঝলসে যায়।

মোহরের কথায় তূর্য সিদ্ধান্ত নিলো সে আর প্রতিশোধ নিয়ে ভাববে না। ওহীকে আজকেই ফিরিয়ে দিবে আর ওহীর বাবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। ততক্ষন ক্ষমা চাইবে যতক্ষণ না তিনি তাকে ক্ষমা করে এই #ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততার অবসান করেন। কিন্তু ওহী না করে। সে বলে,

>>আপনি আমার সাথে যা করেছেন তা জানার পর বাবা আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করবেন না। বরং উনাকে এসব না জানানোই ভালো হবে। বাবা এসব সহ্য করতে পারবেন না। প্লিজ ভাইয়া বাবাকে এসব কিছুই বলবেনা।

তূর্য আবারো অনুতপ্ত হলো। সে ওহীকে টর্চার করার ভিডিও টি আনাস সাহেব কে পাঠিয়ে ছিলো। যার দরুন আনাস সাহেব হার্ট এটাক করেন। তূর্য ওহীকে সব খুলে বললো। বাবার এমন অবস্থার কথা শুনে ওহীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে সে তূর্যকে বললো,

>>আপনি এমনটা না করলেও পারতেন। না জানি বাবা কত কষ্ট পেয়েছে। প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন বাবার কাছে।

>>আই এম সরি ওহী। প্রতিশোধ নেওয়ার নেশায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ভালো খারাপের পার্থক্য ভুলে গিয়েছিলাম। আমাকে মাফ করে দিও।

>>যাই হোক প্লিজ ভাইয়া বাবাকে আর এসব কিছুই বলবেন না। আমি আপনাকে মাফ করলাম।

তূর্য মোহর আর ওহীকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো ওহীর বাসার উদ্দেশ্যে।গাড়িতে মোহর তূর্য কে দেখছেন তার চেহেরার কঠিন্যর ভাব টা কমে গিয়েছে। পাগল পাগল দেখাচ্ছে তাকে। আনাস সাহেব তখন নিজের রুমে শুয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন হসপিটাল থাকার পর তিনি কালই বাসায় এসেছেন। বাসাই আসার পর ওহীর কথা আরো বেশি মনে পড়ছে তার।
অগ্নি নিজের রুমে বসে বসে ওহীর কথা ভাবছে।
তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। অগ্নি গিয়ে দরজা খুলে ওহীকে দেখলো। হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরে,

>> ওহ গড ওহী তুমি ঠিক আছো? এতদিন কোথায় ছিলে? জানো বাবা আর আমি তোমাকে কত খুঁজেছি। আমি খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া।

অগ্নি এসব বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ই দিলো। পাশ থেকে মোহর হালকা কেশে উঠলো অগ্নি ওহীকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

>>এরা কারা ওহী?

>>সব বলছি আগে ভেতরে তো ঢুকতে দাও।

>>ওহ সরি। আসুন আপনারা।

মোহর আর তূর্য ঘরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসলো। ড্রয়িং রুমের একটি দেওয়ালে দেখলো তীহরের একটি ছবি ঝুলানো। আর পাশে অয়নীর ও। তা দেখে মোহর আর অগ্নি দু’জনেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো।

ওহী দৌড়ে গিয়ে আনাস সাহেব কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

>>মা তুই কোথায় ছিলি এতদিন। এসেছিস তুই? জানিস তোকে না পেয়ে আমরা পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।

>>বাবা আমাকে কিছু লোক তুলে নিয়ে গিয়ে অনেক মেরেছিলো। তারপর আমাকে এক জায়গায় ফেলে দিয়েছিলো। আমার সাথে যারা এসেছেন তারা আমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাস্তায়। আমি তাদের কাছে তাদের সাথেই ছিলাম।

>>ওই জানোয়ার গুলো তোকে যেভাবে মেরেছিলো আমার আত্তা কেঁপে উঠেছিলো। তোকে আমি কখনোই মারিনি আর ওরা।

>>থাক না বাবা আমি এখন ঠিক আছি এসব বাদ দাও। চলো সামনের রুমে।

ওহী তার বাবাকে নিয়ে সামনের রুমে আসে। তূর্য আর মোহর এগিয়ে গিয়ে তাকে সালাম করলো। আনাস সাহেব তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

>>তোমাদেরকে ধন্যবাদ। আমার মেয়েটাকে তোমরা বাঁচিয়েছো।

তূর্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওহীর দিকে তাকাই। ওহী পলক ফেলে তাকে আশ্বস্ত করে। আনাস সাহেব কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে চলে গেলেন ভেতরে। অগ্নির একটা কল আসাতে সে উঠে পড়লো। সেই সময়ে তূর্য ওহীকে বললো,

>>ওহী তুমি তোমার বাবা কে এমন কি বলেছিলে যে উনি এমনটা বললেন?

ওহী শুভ্র হেসে বললো,

>>আমি বাবাকে বলেছি যে আমাকে কারা তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলো। আর আপনারা আমাকে কুড়িয়ে পান এবং নিজেদের সাথে রাখেন।

ওহীর কথা শুনে যেন তূর্য আরো বেশি গিলটি ফিল করছিলো। মোহর ওহীকে বললো,

>>অনেক অনেক থ্যাংকস ওহী।

>>থ্যাংকস দেওয়ার কিছুই নেই। আমি সব ভুলে যেতে চাই। আমি চাই না এই তিক্ততা রয়ে যাক আমাদের মাঝে। তীহর ভাই যেমন আমার ভাইয়ের মত ছিলো তূর্য ভাইয়া ও আমার ভাইয়ের মতই। আর হ্যহ আমি চাই যাতে আমাদের সবার মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আপনারা কিন্তু আসা যাওয়া করবেন। আর আমিও অগ্নি কে নিয়ে যাবো। মোহর আপুকে আমার খুবই ভাল্প লেগেছে। আমার যদি কোন বড় বোন থাকতো সে নিশ্চয় মোহর আপুর মতই হতো। মোহর আপু তুমি আমার অনেক খেয়াল। রেখেছো তার জন্যে অনেক অনেক থ্যাংকস তোমাকে।

>>এইতো আমাকে পর করে দিলে। আমি না বড় বোন হই। আমাকে থ্যাংকস দেওয়ার কি আছে? পাগলী।

মোহর ওহীকে জড়িয়ে ধরলো। ওহী ও মোহরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

তূর্য আর মোহর চলে গেলো। অগ্নি আর ওহীর সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে অনেকটা। সেই #ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততার অবসান ঘটলো অবশেষে।

রাতে ওহী শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখলো অগ্নি জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। সে গিয়ে অগ্নিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। অগ্নি ওহীর স্পর্শ টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। ওহী দেখলো অগ্নির চোখে বিন্দু বিন্দু জলকণা। অগ্নি ওহীকে জড়িয়ে ধরে বললো,

>>জানো তোমাকে ছাড়া এই আটদিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি আমি নিজেও জানিনা ওহী। তোমায় ছাড়া সত্যিই আমি নিজের অস্তিত্ব ভাবতে পারিনা। আমার মনে হয়ে ছিলো আমি মরেই যাবো।

>>হুসশ এসব বলেনা। দেখো আমি ফিরে এসেছি ঠিকঠাক তোমার কাছে। কিন্তু সাথে আরো একজনকে নিয়ে এসেছি।

কথাটি বলে ওহী অগ্নির বুকে মুখ লুকালো লজ্জায়।

>>মানে?

>>আরে গাধা মানে তুমি বাবা হতে যাচ্ছো।

অগ্নি নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলো না। সে এক ঝটকায় ওহীকে কোলে তুলে নিলো। সারারাত ভর ওহীর সাথে গল্প করে কাটালো। একসময় ওহী অগ্নির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। অগ্নি ও ওহীর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলো।

রাতে মোহর নিজের রুমের ব্যাল্কুনি তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। মোহরের আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে। এমন সময় কিছু শব্দ শুনে মোহর রুমে ফিরে যায়। গিয়ে দেখে তূর্য লাগেজে করে ওর জামাকাপড় নিয়ে এসেছে। আর আলমারি তে সাজিয়ে রাখছে।

>>কি করছো তূর্য?

>>দেখছোনা কি করছি? আমি এই রুমে শিফট করছি।

>>তাহলে কি আমি ওই রুমে শিফট করবো?

>>কেন? আমার সাথে থাকতে কি তোমার সমস্যা আছে?

তূর্যের এই কথায় মোহর অবাক হয়ে বললো,

>>ন..না মানে তুমিই তো বলেছিলে আমরা আলাদা থাকবো।

>>হ্যা বলে ছিলাম। এখন আমিই আবার বলছি আমরা একসাথে থাকবো।

তূর্য মোহরের কাছে এসে মোহরকে জড়িয়ে ধরে বললো,

>>অনেক তো দূরে থেকেছি আর কত? আমাকে আবার আগের মত করে নাও না মোহর। আমাকে তোমার তূর্য তে পরিণত করো প্লিজ।

মোহরের চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। এটি আনন্দের কান্না। তূর্য বদলাতে চাইছে। সে তূর্য কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে দিলো। রাতটা তাদের ভালোই কাটলো।

ফজরের আজানের পর মোহর নামাজ পড়তে উঠে গেলো। সাথে তূর্য ও উঠেছে। তারা একসাথেই নামাজ আদায় করলো। তারা নতুন করে জীবনের সূচনা করলো।

ওহী আর অগ্নি সবসময়ই একসাথে নামাজ পড়ে আজকেও পড়লো।

তারা সবাই ই আল্লাহর কাছে তার রহমত প্রার্থনা করলো। তারা সকলেই আল্লাহর অশেষ রহমতে সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করা শুরু করলো।

❤সমাপ্ত❤