চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব-১০

0
180

#চন্দ্ররাতের_মায়া [১০]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

কয়েকটা টেস্ট করে রিপোর্ট হাতে ডাক্তার বসে আছে।সামনের চেয়ারে নন্দিতা তীব্র বসে আছে।দু’জনই চিন্তায় সংকুচিত হয়ে আছে।ডাক্তার হাতে রিপোর্ট নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো।ভারি ভারি স্বরে বললেন..

– মিঃতীব্র,আপনাদের বিয়ের কতদিন হলো?

– ছয় বছর

– ছয় বছরে আপনার স্ত্রী দুইবার প্রেগন্যান্ট হয়,আর কোনো কারনে বেবি দুইটা বেঁচে নেই

– জি

– কেন?কারনটা কি বলুন তো

– একবার ও মৃত বেবির জন্ম দেয়,আরেকবার জন্মের পর বেবিটাকে খুজে পাওয়া যায়নি।

– লাস্ট কবে আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হয়?

– দুবছর আগে,

– সেই বেবি কোথায়?

– সাত মাস পর জানতে পারি ওর পেটে কোনো বেবি ছিলো না।টিউমারের জন্য পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছিলো

– তাহলে প্রেগ্ন্যাসি টেস্টে হয়তো ভুল ছিলো।কোথায় করিয়েছিলেন টেস্ট?

– হসপিটালে।

– সম্ভাবনা আছে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট কারোর সাথে বদল হয়েছে।সে যাই হোক।টিউমার অপারেশন করিয়েছিলেন?

– জি

– কতদিন আগে?

– প্রায় দুই-বছর আগে

– মিঃতীব্র আপনি কাল একবার আসুন।আজ তেমন কিছু বলবো না।আপনি কাল দেখা করুন আমার সাথে।

বলেই ফাইলটা রেখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।বেলে চাপ দিতেই তার পি এ আসলো।তাকে বললো ” আজ আর রোগী দেখবো না।তাদের বলো কাল আসতে”।

তীব্র আর নন্দিতা কেবিন থেকে বেড় হলো।হসপিটালে আসলে নন্দিতার খুব কান্না পায়।কেননা এখানে আসলেই নবজাতকের দেখা মেলে।যা নন্দিতার মনকে কাচের ন্যায় ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।তীব্র বিষয়টি লক্ষ্য করে।কিন্তু তার কিছু করার উপায় থাকে না।

তারা বাড়িতে আসলে রাবেয়া চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নন্দিতাকে দেখে।তীব্রকে কর্কষ গলায় বললো” কি,ডাক্তার কি কোনো আশা দিলো?আমার দীর্ঘ বিশ্বাস, এই মেয়ের দ্বারা আমাদের বংশে নতুন কেউ আসবে না. “। রাবেয়া চৌধুরীর কথায় তীব্রর অনেক রাগ হয়।সে কিছু বলে না।মায়ের ওপর দিয়ে কথা বলার অধিকার তার নেই।মা বলতেই পারে।মা বলবে না তো কে বলবে?

রাতে খাওয়ার পর তীব্র ছাঁদে গিয়ে সিগারেট ধরালো।এক হাতে ছাদের কার্নিশ আরেক এক হাতে জলন্ত সিগারেট। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় কানায় কানায় ভয়ে গেছে ছাঁদ।কারোর পায়ের শব্দ কানে এলো।তীব্র মগ্ন হয়ে চাঁদ দেখতে থাকলো।যে এসেছে তাকে তীব্র চিনে ফেলেছে।তার শরীরের গন্ধ তার চেনা।যদিও অনেক বছর আগেই তাদের বিচ্ছেদ হয়, তবুও ভালোবাসার মানুষ কখনো পুরোনো হয় না।তীব্র করুন স্বরে বললো

– মিহিতা (তীব্রর ভাবী)

– হুম

– আমি ভালো নেই,জানিনা কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি

– একই তাপে পুরছি আমি নিজেও।

– আমি তোমায় ঠকাইনি মিহিতা।তোমার ভালো চেয়েছি আমি

– এই ভালো তো আমি চাইনি তীব্র,বলো চেয়েছিলাম?

– তখন আমি কেবল ভার্সিটি উঠি।আমার নিজের জীবনের নিশ্চয়তা নেই,তোমায় কিভাবে ভালো রাখতাম বলো ? আমি ভালোবাসার মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারিনা।ভাইয়া তখন মোটামুটি স্যাটেল হয়ে গেছে।তোমার অন্তত দেখতে পারবো এই আশায় ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ের ব্যাবস্থা করেছিলাম।তোমায় আমি ঠকাইনি মিহিতা,বিশ্বাস করো,আমি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম,তাই এমনটা করেছি।

– আমি জানি তীব্র।কি করবো বলো,আমি যে ভুলতে পারছি না।কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।তুমি কাউকে এতোটা কিভাবে ভালোবাসতে পারো,? পরিবারের এতো কথা,বাইরের মানুষের কথা, নন্দিতার বাচ্চা না হওয়া,এর পরেও তুমি ওকে এতোটা ভালোবাসো।কিভাবে?

(তীব্র সিগারেট মুখে দিলো)

– আমার খুব হিংসে হয় জানো,এই ভালোবাসা আমার প্রাপ্য ছিলো, কি ছিলো না?

– ভালোবাসা জিনিসটা কত অদ্ভুত!

– আমায় ক্ষমা করে দিও তীব্র, তোমার ওপর রাগে,ঘৃণায় আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।একটা মেয়ে সব সহ্য করে,ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর সাথে দেখলে তা সহ্য করতে পারে না।অনেক রাত হয়েছে।ঘরে যাও,নন্দিতা অপেক্ষা করছে।

মিহিতা চলে গেলো।তীব্র সিগারেটটা শেষ করে নিজের রুমে গেলো। নন্দিতা শুয়ে পড়েছে,চোখের কোনে জল বেঁধে আছে।কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে হয়তো।তীব্র অনেকক্ষণ ঘুমন্ত নন্দিতাকে দেখলো।মুচকি হেসে নন্দিতার কপালে একটা চুমু দিয়ে শরীরে কাঁথাটা জরিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

পরেরদিন সকালে তীব্র নাস্তা না করেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বেড়িয়ে গেলো।ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে।তিনি একটা পান মুখে দিলেন।তীব্রর দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। তীব্র না সূচক মাথা নাড়লো।ডাক্তার তার পি এ কে ডাকলো।ডেকে কি যেন বললো।কিছুক্ষণ পর একজন লোক আসলো চেম্বারে।তীব্র কিছুটা অবাক হলো।ডাক্তার তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

– মিঃতীব্র, দেখুনতো,ইনিই কি আপনার স্ত্রীর পেটের টিউমারের অপারেশন করিয়েছিলেন?

তীব্র অস্ফুট স্বরে বললো ” হ্যা “।ডাক্তার তখন বললো

– ডাঃ সিহাব,আপনি কি জানেন ডাক্তার প্যাশনটা কি?

সিহাব- জ্বি স্যার (ভয়ার্ত কন্ঠে)

– আপনি যে এরকম একটা কাজ করলেন,নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছেন তো ?

তীব্র কিছুটা হতভম্ব হচ্ছে। কি হচ্ছে তার বোধগম্য হলো না।সে যে ডাক্তারের কাছে এসেছে তার নাম ডাঃহাবিব।ডাঃহাবিব তীব্রর উদ্দেশ্য বললেন

– মিঃতীব্র, সরি টু সে,আপনার স্ত্রী কখনো মা হতে পারবে না।

তীব্র মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।মুহুর্তেই সারা শরীর ঘামতে শুরু করলো।তীব্র নিজের শার্টের ওপরের বোতাম খুলে ফেললো।ডাঃ হাবিব তার দিকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন।

– আপনি উত্তেজিত হবেন না।নিজেকে সামলাম।আপনি ভেঙে পড়লে আপনার স্ত্রীকে শক্তি জোগাবে কে?

– ডাঃ আপনি এটা কি বললেন?

– হ্যা মি তীব্র, আপনার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না। কারন বাচ্চা হওয়ার যে নাড়ি থাকে সেটা কেটে ফেলা হয়েছে।

তীব্রর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো।কাজটা কে করেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না।লাথি মেরে চেয়ার থেকে উঠে ডাঃসিহাবের শার্টের কলার ধরে গালে ঠাস ঠাস করে চড় দিতে দিতে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলো।এসব গালির সাথে সে পরিচিত নয়।নিজেকে যেনো হারিয়ে ফেলেছে।মাথার চুল মুঠ করে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো তীব্র। ডাঃসিহাবের সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।সাদা এফ্রোন লাল টকটকে হয়ে গেছে।ডাঃহাবিব বেল চাপতেই বাইরে থেকে ৪জন এসে তাদের সরিয়ে দেয়।প্রথমে ২ জন আসে।তারা তীব্রর হিংস্রতার কাছে টিকতে না পেরে ডাঃহাবিব আবার দুজনকে ডেকে পাঠায়।

থানায় অফিসারের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ডাঃহাবিব। ডানে বসে আছে তীব্র।ডাঃসিহাব কে রাখা হয়েছে ডাঃহাবিবের বাম দিকে।তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা।তীব্রর চোখ লাল রক্ত বর্ণ হয়ে আছে।হাতের মুঠ শক্ত।সে কোনো কথা বলছে না।ভেতরে ভেতরে এক পাহাড় কষ্ট নিয়ে বসে আছে।অফিসার গম্ভীর স্বরে বললো

– ডাঃসিহাব,নিজের করা অপরাধ কি শিকার করবেন? না ডলামলা দিতে হবে?

সিহাব- স্যার আমি আমার অপরাধ শিকার করবো।আমি নিজ ইচ্ছেয় করিনি স্যার

অফিসার- সেটা তো জানি,কার কথা বলেছেন বলুন

সিহাব- আমি যখন ওনার স্ত্রীর অপারেশন করছি তখন কেউ একজন আমার ফোনে ফোন করে

অফিসার- থিয়েটারে ফোন সাথে কেন আপনার?

সিহাব- স্যার আমার কাছে সবসময় একটা ফোন থাকে,সেখানে অতিপ্রয়োজনীয় ছাড়া ফোন করেনা কেউ।

– ফোন করে কি বললো?

– ফোন করে বললো নন্দিতা যেন কোনোদিনও মা হতে না পারে সে ব্যাবস্থা করতে।আমি রাজি না হলে একটা ভিডিও পাঠায়।সেই ভিডিওতে দেখলাম কেউ একজন আমার মেয়ের মাথায় পিস্তল তাক করে ধরে আছে।তারা বললো যদি না করি তাহকে আমার মেয়েকে তারা মেরে ফেলবে।বাবা হয়ে মেয়ের এরুপ অবস্থা দেখে তাদের কথা মতো আমি পাপ কাজটা করি।

তীব্র ক্ষিপ্ত হয়ে ডাঃসিহাববের ওপর তেড়ে যেতেই কয়েকজন কনস্টেবল মিলে তীব্রকে আটকালো।অফিসার তীব্রকে বললো ” মিঃতীব্র আপনি শান্ত হোন,আমরা বিষয়টা দেখছি।এর সাথে যুক্ত সবাই শাস্তি পাবে ”

তীব্র চেয়ারে বসতেই পোন আসলো।ফোন স্ক্রিনে ভাবী নামটা ভেসে এলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নামিশ্রিত আওয়াজ আসলো

– তীব্র,তোমার ভাইয়াকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে।তুমি কিছু একটা করো,প্লিজ ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, প্লিজ।

চলবে?