চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
526

#চন্দ্ররাতের_মায়া [অন্তিম পর্ব]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

তীব্রর কন্ঠটা গম্ভীর হলেও সেখানে যে ওর ভাইয়াকে ভষ্ম বানিয়ে দেওয়ার মতো এতো পরিমান তেজ আছে সেটা ওর ভাইয়া বুঝতে পারলো।নিচু স্বরে বললো

– প্রথম সন্তানটা মৃত জন্ম দিয়েছিলো।তারপরের সন্তানটা

– ২য় সন্তানের সাথে কি করেছো?

– যেদিন তোর ২য় সন্তানটা হলো সেদিন নার্সকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ি।তারপর একটা এতিমখানায় রেখে চলে এসেছিলাম।

– তার মানে আমার সন্তান এখনো বেঁচে আছে?

– হ্যা,তুই চিন্তা করিস না,আমি ওকে কোনো কষ্টে রাখিনি,সবরকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছি।

– তুই যদি আমার নিজের ভাই না হইতি তাহলে এতোক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকতি না।বাবা,মাকে সন্তানের থেকে আলাদা করে সুযোগ,সুবিধা করে দিয়েছিস তাই না।তোর সাথে কথা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে। কোন এতিমখানায় আমার ছেলে?বল কোথায়?

অফিসার জিপে তীব্র এবং তার ভাইয়াকে তুললো।তীব্রর সন্তানকে যে এতিমখানায় রাখা হয়েছিলো সেখানে।তীব্র শুধু ছটফট করছে।চোখ গড়িয়ে টপটপ করে অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছে।তখনি নন্দিতার ফোন আসলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নন্দিতা বললো

– তীব্র কোথায় তুমি? সকাল থেকে তুমি নেই,জানো বাড়িতে..

নন্দিতার কথা থামিয়ে দিয়ে তীব্র বললো,

– নন্দিতা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান এখনো বেঁচে আছে।হসপিটাল থেকে চুরি করেছিলো আমার নিজের মায়ের পেটের কালপ্রিট ভাই।

– কি বললে আবার বলো? প্লিজ আবার বলো না কি বললে?

– হ্যা নন্দিতা,আমাদের সন্তান বেঁচে আছে।

খট করে শব্দ হয়ে ফোনটা কেটে গেলো।তীব্রর বিষয়টা খটকা লাগলেও সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার প্রবল সুখ তাকে অন্য সকল চিন্তা থেকে বিরত রাখলো।প্রায় ৩ ঘন্টা রাস্তা অতিক্রম করার পর যেই এতিমখানা পাওয়া গেলো।তীব্র ঝাপ দিয়ে জিপ থেকে নামলো,জিপটা তখনো থামেনি।

– ভাইয়া কোথায় আমার ছেলে? কোথায়?

তীব্রর ভাইয়া “সমুদ্র” বলে ডাক দিতেই একটা ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলে গুটিগুটি পায়ে কাছে এলো।তীব্র নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না।নিজের ছেলেকে জরিয়ে ধরে মুখে চুমু দিতে দিতে কান্না করতে লাগলো।অফিসার ওর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন ” একটা বাবার কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন,এতো বড় পাষান কিভাবে হতে পারলেন।দেখুন ছেলেকে কাছে পেয়ে বাবার আর্তনাতটা একবার দেখুন।এ যে এক স্বার্থহীন ভালোবাসা ”

এই দৃশ্য দেখে ওর ভাইয়ার চোখেও জল এলো।বাচ্চা ছেলেটা হঠাৎ এরুপ কর্মকান্ঠে ভয় পেয়ে গেলো।কেউ এলজন এসে তাকে জরিয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, জরিয়ে ধরে কান্না করছে,এটার কারন সে জানেনা।তীব্রর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে তোতলানো স্বরে বললো

– তুপার মেন,ইনি কে?আমায় দলিয়ে ধরে আতে, আমাল ভয় লাগতে

তীব্র বললো

– আমায় চিনোনি? আমি যে তোমার বাবা,তোমার বাবা, একবার বাবা বলে ডাকো?

– তুমি আমাল বাবা না।তুপার মেন,আমি তোমাল কাতে যাবো

তীব্রর ভাইয়া দুহাত বাড়াতেই সমুদ্র ওর ভাইয়ার কোলে লাফিয়ে পড়লো।এবং গলা জরিয়ে ধরে থাকলো।তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললো

– এই হলো তোর সন্তান। আমি এতোটাও খারাপ না ভাই আমার,ওকে রোজ আমি দেখতে আসি।যখন যা লাগে সব কিনে দিই।ওর বাবা মায়ের অভাব পূরণের সকল চেষ্টা আমি করেছি।ও আমায় ভালোবেসে সুপার ম্যান বলে ডাকে।সুপার ম্যান তো বলতে পারে না, বলে তুপার মেন।সমুদ্র ইনি হলো তোমার বাবা,”

তীব্র এবং নন্দিতার সন্তান “সমুদ্র”।নন্দিতা এখন তাকে বুকের সাথে জরিয়ে ধরে বসে আছে।তীব্র বসে নন্দিতার সাথেই।এতিমখানা থেকে সোজা তীব্র বাসাতে চলে আসে।সাথে তার সন্তান, ভাইয়া এবং পুলিশ অফিসার ও ছিলো।জিপ বাড়ির সামনে দারাতেই তীব্র ওর সন্তান সমুদ্রকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই “নন্দিতা,নন্দিতা কোথায় তুমি,দেখো আমাদের ছেলে।দেখবে না নিজের ছেলেকে? বলে ডাকতে ডাকতে সোফায় বসলো।

এদিকে নিজের সন্তান বেঁচে আছে এই খবর যখন তীব্র ফোন করে নন্দিতাকে জানায় তৎক্ষনাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।এতোবড় ধাক্কা সামলাতে পারেনি।কাজের মেয়েটা দেখতে পেলো নন্দিতা ফ্লোরে পড়ে আছে।তারপর মাথায় জল ঢালার পর নন্দিতার শ্বশুর ডাক্তার ডাকলে নন্দিতাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিলো।জ্বান ফিরতেই তীব্রর সেই “নন্দিতা,নন্দিতা কোথায় তুমি,দেখো আমাদের ছেলে।দেখবে না নিজের ছেলেকে? ” কথাটা শুনে স্যালাইনের লাইনটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো নিচে ছুটতে থাকে।নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়ে বুকে জরিয়ে ধরে বসে আছে।কান্না করতে করতে তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে।

অফিসার তীব্রর ভাইয়াকে বললো

– চলুন,আপনার শাস্তির এখনো অনেক বাকি।

– আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি অফিসার। আমার মনে আর কোনো কষ্ট নেই।একটা অপরাধ ঢাকতে আরেকটা অপরাধ করেছিলাম।জরিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমি কিছুটা মুক্ত। শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।

হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতেই তীব্র বললো

– অফিসার দারান।

অফিসার দারালো।তীব্র উঠে চোখের জল মুছলো।কাছে গিয়ে বললো

– ভাইয়া, তুমি যে অপরাধ করেছো তার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো।আর তার থেকে বড় কথা আমি আমার সন্তানকে ফেরত পেয়েছি।আজ যে আমার বড়ই খুশির দিন।এই দিনে আমি চাইনা তোমার জন্য মিহিতা,বাবা,মা মনে মনে কষ্ট পাক।মানুষ ভুল করে তুমিও করেছো এবং ভুলটা বিঝতে পেরেছো।এটাই অনেক।যতোই হোক,তুমি তে আমার ভাইয়া।ছোট থেকে তোমার আদরে বড় হয়েছি।কিভাবে তোমার শাস্তি দেখবো বলো?

– ভাই আমার,একটু জরিয়ে ধরতে দিবি তোর এই পাপী ভাইটাকে?

তীব্রকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে।মিঃশেখর তার দুই ছেলেকেই জরিয়ে ধরে তিনিও কান্না করছেন।আজ যে মান অভিমানের পালা শেষ হতে চলেছে।নিজের রক্তের সম্পর্কের ভাইকে রেখে তার সুখের দিনে যে একটা অপূর্নতা রয়ে যাবেই।তাঁদের মান অভিমানের পালা দেখে অফিসার চোখের জল মুছে বললো

– এমন ভালোবাসার সম্পর্ক আমি আগে কখনো দেখিনি।সত্যিই তো,এতো অভিমান রেখে কি হবে।ভুলটা বুঝতে পেরে একসাথে থাকাই তো জীবন।আমরা বাঁচিই বা কয় দিন।এই কটা দিন যদি হিংসা,অভিমান করেই চলে যায় তাহলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না।আপনাদের পরিবারের ব্যাপার আপনারা বুঝে নিন।আমি আসও তাহলে।

তীব্র- কোথায় যাচ্ছেন অফিসার,মিষ্টি মুখ করে যান।আজ আমার সবথেকে খুশির দিন।

রাবেয়া বেগমকে বেজায় খুশি লাগছে আজ।তিনি অফিসারকে শুধু মিষ্টি খাইয়েই রেহায় দেননি।সাথে পাঁচটা প্যাকেটে মিষ্টি দিয়েছে।নন্দিতাকে জরিয়ে ধরে বললো, ” বৌমা,আমাকেও তুমি মাফ করে দিও,অনেক কথা শুনিয়েছি তোমায়”।নন্দিতা উত্তরে বললো ” মা কি বলছেন আপনি? আপনি তে মা,মা বলবে না তো কে বলবে? আমার নিজের মাকে তো ছেড়ে এসেছি,এখন আপনিই তে আমার আরেক মা”।শেখর চৌধুরী আহ্লাদে গদোগদো হয়ে বললেন ” কই আমার দাদুভাই,দাদুভাই চলো তো আমরা খেলি, তোমার জন্য কতো শত খেলনা কিনে রেখেছি দেখবে চলো”।সমুদ্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে শেখর চৌধুরীর সাথে বাগানে গেলো।

সমুদ্র ব্যাট হাতে দারিয়ে আছে।বল করছে শেখর চৌধুরী। নন্দিতা সমুদ্রের হাত ব্যাটের সাথে ধরে আছে।ছোট বাচ্চাদের যেভাবে হাত ধরে ক্রিকেট খেলায় সেভাবে।আর তীব্র আছে স্টাম্পের পেছনে। রাবেয়া বেগম আশেপাশের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে ব্যাস্ত।তার মুখে যেন হাসি সরছেই না।

শেখর চৌধুরী বল করলেন, নন্দিতা সমুদ্রের হাত দিয়ে ধরে থাকা ব্যাট দিয়ে বলে মারতেই বলটা উড়ে দুরে গিয়ে পড়ে।সমুদ্র খিলখিল করে হাসছে।তাকে জরিয়ে ধরে হাসছে নন্দিতা।পাশে দারিয়ে চোখে টলমলে জল নিয়ে তীব্র তাকিয়ে আছে।শেখর চৌধুরী তীব্রর কাধে হাত রাখলেন।মা ছেলের এই ভালোবাসা উপভোগ করছে।মায়ের ভালোবাসা কত সুন্দর।সমুদ্র নন্দিতার দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো ” তুমি দলিয়ে ধললে আমাল এতো ভালোলাগে কেনো? কেউ দলিয়ে ধললে আমার এতো ভালোলাগে না,কিন্তু তুমি দলিয়ে ধরলে আমাল খুব ভালোলাগে”।

সন্তানের মুখে এরুপ কথা শুনে একটি মায়ের মনের অবস্থা কিরুপ হতে পারে সেটা বর্নণা করা যায় না।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।সমুদ্র এখন বড় হয়েছে।ক্লাস টু’য়ে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখলো তীব্র দারিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। এটা দেখে কোনোরকমে ব্যাগটা রেখে রান্নাঘর থেকে নন্দিতার হাত ধরে টানতে টানতে ওপরে তীব্রর পাশে নিয়ে এসে বললো

” বাবাই,দেখো মা কে নিয়ে এসছি,লুকিয়ে লুকিয়ে এ্যা খাও তাই না,এবার মজা বুঝবে “।

সমুদ্রের কথা শুনে তীব্র নন্দিতা দু’জনই হাসছে।তীব্র সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বললো, “সরি বাবু,এই যে দেখো কান ধরছি,এই যে নাক মুলছি,আর কখনো এসব এ্যা জিনিস ছুয়েও দেখবো না,খুশি?”

” খুব খুতি ”

সমুদ্রের এরুপ তোতলানো কথা শুনে তীব্র আর নন্দিতা আবারো হাসলো।তীব্র সমুদ্রকে কোলে নিয়ে নন্দিতাকে জরিয়ে ধরলো।তাদের সুখের জীবন শুরু।একটা ছেলে ফিরে পেলো তার পরিবার।বাবা,মা পেলো তার সন্তান। আর কি চাই? এটাই কি যথেষ্ট নয়?

______________সমাপ্ত_______________

গল্পটা কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ।